অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫৫

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫৫
লিজা মনি

অগ্নি এগিয়ে যাবে তার আগেই ফাট করে আওয়াজে একটা বুলেট তার বাহুর ভিতরে ভেদ করে যায়। বুলেট ছিন্ন করে যায় মাংশ পেশি। রক্ত ছিটকে পড়ে নির্জন রাস্তায়। বাচ্চারা ভয়ে কাঁপতে থাকে। অগ্নি হাত চেপে ধরে সেখানে দাড়িয়ে যায়। ইয়ানা চেঁচিয়ে উঠে। সবাই কেমন স্তব্দ হয়ে যায়। অগ্নি ক্ষতস্তানে হাত চেপে ধরে। চোখে অনল দাউ দাউ করে জ্বলছে।
আততায়ী আবার বন্দুক তুলে তাক করে অগ্নির দিকে।।এইবার সে হাসে এমনভাবে যা এক বিকৃত হাসির রুপ নেয়।
অগ্নি তখনও দাঁড়িয়ে কিন্তু মাথা নিচু নয় গর্জন অবধারিত।
ইয়ানা কান্না মিশ্রিত ভাঙ্গা আওয়াজে বলে,,

” না প্লিজ! বন্ধুক নামিয়ে রাখুন।
অতাতীয়র ভয়ংকর আর বিকৃত হাসি। অগ্নির বাহুতে বুলেটের ক্ষতস্থান থেকে টকটকে লাল তরল গড়িয়ে পড়ছে অথচ চোখে এক ফোঁটা ভীতির ছায়া নেই। শুধু গাঢ় এক গম্ভীরতা।
ঠিক তখনই আচমকা সেই লোকটা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উচ্চস্বরে একটি যন্ত্রণাবিদ্ধ চিৎকার ছুটে আসে তার মুখ থেকে। কারণ তার গোপন স্থানে ইয়ানার ছোঁড়া লাথি গিয়ে লাগে সজোরে। সামান্য সময়ের জন্য হলেও সে ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। শরীরটা খানিকটা হেলে পড়ে।
এই সুযোগেই ইয়ানা বিদ্যুৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোকটার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেওয়ার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। তার চোখে তখন ভয় নয়, ছিল এক রকম উন্মাদ সাহস। ইয়ানার ঠোঁট থেকে ঝঁরে পড়ে জ্বলে উঠা শব্দগুলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” তদের দুর্বল জায়গা ওই হচ্ছে এইটা। সামান্য আঘাত করব আর তদের সব শক্তি শেষ।
ধস্তাধস্তি শুরু হয়। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা যেন সেদিন নির্দয়। ইয়ানার হাত ছুঁয়েও বন্দুকটা ধরা দিল না। অতাতীয় আবার ঘুরে দাঁড়ায়।এবার আরেক স্তরের হিংস্রতায়। এক হাতে ইয়ানার চুল মুঠি করে ধরে তাকে পেছনে টেনে নেয়।আর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অশ্রাব্য, ঘৃণ্য গালিগালাজ। তার চোখে তখন নরকের আগুন আর হাতে বন্দুক।
অগ্নি দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দ কিন্তু চোখে সেই নিঃশব্দ তাণ্ডবের রক্তিম রূপ। তাঁর দৃষ্টি ক্ষণে ক্ষণে ছুটে যাচ্ছে ইয়ানার কাতর মুখের দিকে।আবার ছুটে যাচ্ছে সেই বিকৃত মুখো লোকটার বন্দুকধারী হাতে।
লোকটার আরেক হাত তখন ইয়ানার বাহু চেপে রেখেছে। কোনো ভাঙা পুতুলকে ধরে আছে। আর বন্দুক তার চোখেমুখে শাসনের হুমকি হয়ে তর্জন করছে।

পাশে রুয়ানা কাঁপতে কাঁপতে ভেঙে পড়ে কান্নায়। তার শিশু কণ্ঠে আতঙ্কের ধ্বনি আকাশের নীরবতাও বিদীর্ণ করে। সুমু শিশুদের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছে। তাদের শরীর দিয়েই রক্ষা করতে চায় সেই ভয়াবহতার হাত থেকে। তার গলা শুকিয়ে আসছে। ঠোঁট কাঁপছে অসম্ভব। মুখের রেখাগুলোতে জমে আছে মৃত্যুভয়ের ছায়া।
শিখা চৌধুরি এক হাতে মাটির পাথর তুলে নিয়ে দৃপ্ত হাতে ছুঁড়ে মারতে যাবে এমন সময় অগ্নি নিঃশব্দ কিন্তু দৃঢ় এক না সূচক ইশারা দেয়। সে থেমে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অগ্নির দিকে সেই দৃষ্টিতে কেবল প্রশ্ন,
“কেন থামালে?”

এই বিভীষিকাময় মুহূর্তে কেন্দ্রস্থলে এসে পৌঁছায় অরিদ ও মিরা। গাড়ি থামিয়েই এক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা জাহান্নমের এক খণ্ড দৃশ্য দেখে শিউরে ওঠে। ইয়ানা তখনো ধস্তাধস্তি করছে সেই লোকটার সঙ্গে। এক অসম যুদ্ধ।
মিরা ছুটে যেতে চায় ইয়ানার দিকে। অরিদ এগিয়ে যায় অগ্নির রক্তাক্ত শরীর দেখে শিউরে উঠে। কিন্তু আগুনের মতো ঝলকে ওঠা অগ্নির চোখ দু’জনকেই থামিয়ে দেয়। ইশারা বুঝতেই অরিদ আর মিরা দু পা পিছিয়ে যযায়।
সবাই থমকে থাকে। কেউ এগোতে পারছে না।কেউ পিছোতে পারছে না। সময় থেমে গেছে। কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ায় আতঙ্কের গন্ধ। বন্দুকের হুমকি এক নিশ্বব্দ হুমকি।
অরিদ অগ্নিকে রক্তাক্ত অবস্থা দেখে আৎকে উঠে।

— ভাইয়া তোমার শরীর থেকে অসম্ভব রক্তক্ষরন হচ্ছে। বউ মনিকে না বাঁচিয়ে দাড়িয়ে আছো কেনো এখানে?
ফোঁটায় অন্তর্জ্বালার প্রলয় নৃত্য করছে। তার মুষ্টি এতটাই কঠোর যে শিরা-উপশিরাগুলো বেদনার চিৎকার করছে। চোখে ছিল আগ্নেয় প্রতিজ্ঞার নিষ্ঠুর দীপ্তি। বারবার দৃষ্টি ছুটে যাচ্ছে ইয়ানার বাহুতে গেঁথে থাকা সেই অপবিত্র স্পর্শের দিকে।অপরাধ যার মীমাংসা কেবল মৃত্যু হতে পারে। সেই স্পর্শ যা অগ্নির কাছে এক অনুচ্চারিত যুদ্ধঘোষণা।
তীব্র রক্তক্ষরণ মাথা ঝিমঝিম করা ক্লান্তি। কোনো কিছুই তাকে স্তব্ধ করতে পারল না। সে এগিয়ে যায় নীরবতার ভেতর দিয়ে এক নিষ্ঠুর ঝড়ের মতো। কোনো ঘোষিত প্রতিশোধ নয় বরং এক বোধহীন আর নির্মম শীতলতা যা নিঃশব্দে গ্রাস করে।

লোকটা তখনো ইয়ানার সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তিতে ব্যস্ত। অগ্নি এক নিঃশ্বাসে তার সামনে পৌঁছে যায়। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই আচমকাই তার লৌহকঠিন হাত ছায়ার মতো উঠে এসে গেঁথে যায় লোকটার কণ্ঠনালিতে।
সে মুহূর্তে অগ্নির চোখে কোনো ক্ষোভ নেই। কোনো রকম চিৎকার নেই। হুঙ্কার তো দূরের কথা।কেবল এক অন্ধকার নির্বিকারতা। মৃত্যু তার ছায়াসঙ্গী হয়ে অগ্নির আঙুলের ডগায় নেমে এসেছে।
লোকটা ছটফট করে উঠে।কণ্ঠনালী চেপে ধরা অবস্থায় বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করে কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হয় না।
অগ্নি তখন ভারী, নিঃসীম এক শীতল কণ্ঠে,
কন্ঠনালী চেপে একদম শান্ত আওয়াজে বলে,

” বলেছিলাম স্পর্শ করিস না। হাতের স্পর্শ যাতে না লাগে আমার স্ত্রীর গায়ে। তর হাতটা শকুন কে দান করে দেওয়া উচিত। নোংরা জিনিস শকুনের বড্ড প্রিয়।
তাঁর কণ্ঠে কোনো চিৎকার নেই।ছিল কেবল এক অমোঘ সত্যের ঘোষণা যা উচ্চারিত হয় নীরবতার মধ্যেও বজ্রের মতো প্রতিধ্বনিত হয়।
এই ছিল অগ্নি। যন্ত্রণার মাঝেও স্থির তবু ধ্বংসের পূর্বাভাসে দগ্ধ এক পুরুষ।
ইয়ানা অগ্নিকে দেখে পিছিয়ে যায় কিছুটা। মিরা ইয়ানাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। রুয়ানা এগিয়ে এসে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,

” তুমি ঠিক আছো তো আপু? কিছু হয় নি তো তোমার?
— আমি একদম ঠিক আছি। চিন্তা করিস না তরা।
অগ্নির হাত তখন সেই বিকৃত লোকটার কণ্ঠনালিতে এমনভাবে গেঁথে আছে। লোকটার চোখ ধীরে ধীরে উল্টে যাচ্ছে। সাদা অংশে জেগে উঠছে মৃত্যুভয়ের ছায়া। মুখ হা করে আছে। ভিতরের জিহ্বা কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু কোনো শব্দ, না আর্তনাদ, না সাহায্য কিছুই বের হয় না।
সে প্রাণপণে চেষ্টা করে দম নিতে। ব্যর্থ দেহটা ছটফট করে ওঠে। এক চূড়ান্ত প্রয়াসে লোকটা তার হাত উঁচিয়ে আঘাত হানে ঠিক অগ্নির সেই রক্তাক্ত স্থানে। যেখানে আগেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে। মুহূর্তেই অগ্নির মুখ বেঁকে যায় ব্যথায়।এক রকম চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ঠোঁট ফাঁকে। ঠিক যেমন গ্রিলের নিচে ঢাকা গ্যাসের শিখা হঠাৎ জ্বলে উঠেছে।

তার কপালের রগগুলো লাল থেকে গাঢ় নীল হয়ে উঠতে থাকে। শিরায় শিরায় চাপ তৈরি হয় অসহ্য রকমের। তবুও অগ্নি সেই লোকটাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়ে না । রক্ত, ব্যথা, ক্ষয় এসব তার কাছে তুচ্ছ। কারণ সেই অপরাধটা স্পর্শ করেছে তার হৃদয়ের গভীরতম ক্ষতস্থানকে। তার বউকে স্পর্শ করেছে!
অগ্নি পিছন থেকে লোকটার একটা হাত চেপে ধরে। তারপর এক তীব্র মোচড় দিয়ে হাড় ভেঙে দেয় এক ঝটকায়।
কড়-কড়-কড়াআয়াহহ!
হাতের হাড় চূর্ণ হয়ে যাওয়ার সেই ভয়ানক শব্দ কানে গিয়ে বিদ্যুৎ খেলে দেয় আশেপাশের সবাইকে। লোকটা এক গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ে। সেই চিৎকারে চারপাশের নির্জনতা ভেঙে যায়। অদূরেই থাকা কিছু কুকুর আর পাখিরাও আচমকা চঞ্চল হয়ে ওঠে।

যারা এতক্ষণ লুকিয়ে কিংবা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তারাও এখন স্পষ্ট দেখতে পায়।
অগ্নি তখনও শান্ত মুখে, দৃষ্টি কঠোর, নিঃশ্বাস ভারী করে লোকটার মুখ চেপে ধরে।মুখে কোনো শব্দ না করে তাকে টেনে নিয়ে যায় পাশে থাকা একটা বন্ধ ও পরিত্যক্ত কক্ষে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে জমাট বাঁধা প্রতিশোধ। ঠোঁটদুটো চেপে ধরে রাখা।চোখের মণিতে বিকেল পড়া সূর্যের মতো রক্তরঙের দীপ্তি।
তখনই পিছন থেকে এগিয়ে যায় ইয়ানা। চোখে পানি গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভয় আর অস্থিরতা নিয়ে ছুটে যেতে চায় অগ্নির দিকে।
কিন্তু হঠাৎ করেই সেই ঘরে গর্জে ওঠে এক বিস্ফোরণতুল্য হুংকার,

” একটা পিঁপড়া ও যাতে প্রবেশ না করে।
অগ্নির কণ্ঠে সেই মুহূর্তে কোনো মানবিকতা ছিল না।
ছিল কেবল গর্জন। আগুনের ধ্বনি আর পুরুষত্বের নিরংকুশ রুদ্রতা। সেই স্বর দেওয়াল কাঁপিয়ে দেয়
বাতাস জমে যায়। পাখিরা উড়ে যায় আশপাশ থেকে।
তার সেই হুংকারে ইয়ানার পা থমকে যায়। চোখ ভিজে ওঠে। ঠোঁট কামড়ে ধরে শক্তভাবে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না।

ইয়ানা দাঁড়িয়ে থাকে। স্তব্দ হয়ে যায় অগ্নির সেই রহস্যময় কন্ঠে। অগ্নি বদ্ধ রুমটাতে প্রবেশ করতেই চার – পাঁচজন গার্ড আসে আরিফের সাথে। আরিফ কোনো দিকে না তাকিয়ে অগ্নির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী চলে যায় সেই বিশাল বদ্ধ রুমে। বাড়িটা অনেক পুরনো। কেউ না থাকায় আশে- পাশে প্রচুর নোংরা পরিবেশ। আর বাড়ির নিচের খোলা স্থানটাই পথশিশুদের রাত কাটানোর স্থান। ইয়ানার ভয়ে রক্ত জমে যাচ্ছে। কি হবে ভিতরে এখন? লোকটাকে কি করবে? লোকটা অপরাধ করেছে কিন্তু তাই বলে কি এতটা কঠিন মৃত্যু!

অগ্নি লোকটাকে কোনো কিছু দিয়ে বাঁধে না। এতক্ষন লোকটার সাথে অগ্নির অনেক ফাইট হয়েছে। অগ্নির ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু তার দুইটা ঘুষিতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লোকটা। অতাতীয়র মুখ থেকে অনর্গল রক্ত বমি হচ্ছে। গার্ডরা ভিতরে প্রবেশ করলে তাদেরকে ইশারা করে কাঙ্খিত জিনিসটা দেওয়ার জন্য। কালো হুডি পরিহিতা একজন গার্ড বক্স থেকে একটা দাঁড়ালো ছুঁরি বের করে অগ্নির হাতে দেয়। অগ্নি ধাঁরালো দৃষ্টি দিয়ে লোকটার দিকে তাকায়। কোনো শব্দ ছাড়া লোকটা কিছু বুঝে উঠার আগেই দেহ থেকে হাত আলাদা করে দেয়। লোকটা ব্যাথায় শব্দ করে চিৎকার করতে ও পারছে না। ততক্ষনে মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। শুধু মেঝেতে শরীর ছেড়ে দিয়ে পাগলের মত ছটফট করছে। রক্ত রাঙ্গা হয়ে গিয়েছে নোংরা মেঝেটা। শুধু একটা হাত কাটা হয়েছে। যে হাত দিয়ে ইয়ানার বাহু চেপে ধরেছিলো সেটা। অগ্নি হাটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে। লোকটার সুস্থ আঙ্গুলগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,

” বলেছিলাম আমার স্ত্রীকে স্পর্শ না করিস। কিন্তু এই হাত দিয়ে তাকে মারার জন্য গান তো চেপে ধরেছিলি! তাহলে অক্ষত কিভাবে থাকবে বলতো?
লোকটা মেঝেতে লুটোপুটি খেয়ে গোঙ্গাচ্ছে। তরল তাজা রক্ত ভেসে যাচ্ছে পুরো মেঝে। রক্তের গন্ধ মোঁ মোঁ করছে চারপাশ। অগ্নি ছুঁরিটা লোকটার হাতের আঙ্গুলের উপর আলতো ভাবে রাখে। এরপর একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে সজোরে চাপ দেয়। আঙ্গুলগুলো ছুঁরি আঘাতে গভীর ক্ষতে থেঁতলে যায়। অগ্নি ছুঁরিটা দিয়ে হাত থেকে একটা একটা একটা করে আঙ্গুল আলাদা করতে থাকে। যেন এই কাজটা কোনো আর্ট। কাউকে নির্মম অবস্থা করাটাও কোনো এক শক্তি কোনো এক ধৈর্য। যেটা করার ক্ষমতা সবার থাকে না। বর্তমানে লোকটার এক হাত নেই কব্জি থেকে। আরেক হাতের প্রতিটি আঙ্গুল আলাদা হয়ে ছিটকে পড়ে আছে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে লোকটা লোকটা জ্ঞান হারায়। গার্ডের সাহায্য নিয়ে লোকটার জ্ঞান ফেরানো হয়। অগ্নি গম্ভীর হয়ে বসে রক্তাক্ত বডির সামনে। মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে চোখে চোখ রেখে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,,

” কার সহকারী তুই? তর কোন বসকে মেরেছি আমি?
লোকটার ভাঙ্গা গলার শব্দ বিরবির করে উঠে,
” আলবার্ট! ”
অগ্নির চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। কপালের রগগুলো পুনরায় ফুলে উঠে। লালাভ চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠে,

” শালা মাদারবোর্ডের বাচ্চা !
গার্ডের কাছে গচ্ছিত প্রতিটি গান দিয়ে লোকটার দেহে একই জায়গায় বিশটা গুলি করে। গুলির আঘাতে পুরো বুক ঝাঁঝরা হয়ে উঠে। মাংস খুলে পড়ে শরীর থেকে মেঝেতে। রক্তের স্রোত বইতে থাকে। এতেই থেমে থাকে নি। পুরো দেহে পর পর অসংখ্য গুলি বিদ্ধ করে। গুলি বিদ্ধ হওয়া বডিটা কি কোনো মানুষের নাকি কোনো মাংসের স্তূপ বুঝা মুশকিল। পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। গুলির শব্দে চার – পাশ ঝংকার তুলে।

বাহির থেকে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়ানা তারা কেঁপে উঠে। ইয়ানা জানত এমন কিছুর সম্মুখীন হবে তাই বাচ্চাগুলোকে এখান থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা বাচ্চা, তারা ভয় পেলে আগলে রাখবে কে? রাতে যখন এইসব বিকট শব্দের ভয়ংকর বাজে সপ্ন দেখে চিৎকার দিয়ে উঠবে তখন এদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে কে? কেউ নেই তাদের। তাই ইয়ানা আগে থেকেই আলাদা পাঠিয়ে দিয়েছে। ইয়ানা ভিতরে ভিতরে ভয়ে কাঁপছে কিন্তু উপর থেকে একদম শক্ত। মিরা, ইয়ানা , শিখা চৌধুরি, অরিদ অগ্নির ভয়ংকর রুপ সম্পর্কে অবগত। কিন্তু সুমু, আরু আর রুয়ানা! তারা তো আজ প্রথম দেখেছে। গুলির প্রতিটি ভয়ংকর আওয়াজে তারা কেঁপে উঠছে। ইয়ানা চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে শান্ত থাকার জন্য। রুয়ানাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। কি আশ্চর্য ব্যাপার তাই না? যে ইয়ানা এক সময় এই গুলির শব্দ পেলে ভয়ে আতঙ্কে বরফের মত জমে যেত সে আজ অন্যকে আশ্বস্ত করছে। এক ভয়ংকর অনুভুতির সাথে থাকতে থাকতে নরম অনুভুতি ও ভয়ংকর হয়ে উঠে।
লোকটার শরীরে ইচ্ছে করছিলো আরও গুলি বসাতে। কিন্তু প্রতিটি বন্ধুকের বুলেট শেষ হয়ে গিয়েছে। অগ্নি আরিফের উদ্দেশ্যে দাঁত পিষে বলে,,

” কু*ত্তার বাচ্চাটাকে নিয়ে চলন্ত গভীর পানি অথবা নর্দমার স্রোতে ভাসিয়ে দে।
আরিফ — জি ভাই সব হবে। তার আগে আপনাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া প্রয়োজন।
অগ্নি ভ্রুঁ কুচকে তাকিয়ে বলে,,
” ডাক্তারের কাছে যাব কোন দুঃখে?
আরিফ– ভাই আপনার শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। রক্ত এখনও বের হচ্ছে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। জ্ঞান হারিয়ে পরবেন যে কোনো সময়।
অগ্নি আরিফের কথাকে এড়িয়ে চলে বিরক্তি নিয়ে বলে,,
‘ লাগবে না এইসব। হসপিটাল গেলেই বালের ডাক্তার সব বেডে চেপে ধরে রাখে। লম্বা পাইপ একটা লাগিয়ে বলবে কয়েকদিন বেড রেস্ট নিন। যত্তসব ফাউল মার্কা ন্যাকামি কথা বার্তা।
অগ্নি লোকটার শরীরে থুথু ফেলে বাহির হতে যাবে এমন সময় মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হুট করে স্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে থাকে। আরিফ জেদ ধরে অগ্নির কাছে গিয়ে বলে,

” ভাই জীবনে কোনোদিন আপনার অবাধ্য হয় নি। যেদিন থেকে আমাকে পালন – পোষন করে আপনার সহকারী বানিয়েছেন ঠিক সেদিন থেকে আপনার একটা কথাও অমান্য করি নি। আজ আপনাকে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। বাংলাদেশে আপনার পার্সোনাল ডাক্তার নেই যে রুমে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে দিয়ে আসবে। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খুব দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
অগ্নি নাক – মুখ কুচকে ফেলে। সামান্য গুলি খেয়ে ও এখন হসপিটালে যেতে হবে। এতটা খারাপ দিন চলে এসেছে ওর!

” বালের ন্যাকামো ছাড় । রক্তপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছে শরীর এমনি ঠিক হয়েছে। কত গুলির আর মার খেয়ে পড়ে ছিলাম। সেখানে ঘাঁ হয়ে যেত কিছু হত না। এখন সামান্য গুলিতে কি হবে?
অগ্নির তিরিক্ষি মেজাজের ভিতরে অতীতের ভয়ংকর সত্য অনুমান করতে পেরে আরিফ গভীর নিশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু সে আজ অগ্নিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেই। আর যদি না নিতে পারে তাহলে সেও অগ্নি চৌধুরির এসিস্টেন্ট নয়। অগ্নি আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার পুনরায় দাঁড়িয়ে যায়। আরিফের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,,
” আমার মাথা এমন করছে কেনো আরিফ? হাটতে পারছি না ঢলে পড়ে যাচ্ছি। বালের জিন্দেগী ! কি হয়েছে আমার সাথে?
আরিফ কাঁদোকাঁদো ফেইস নিয়ে বলে,,

” কারন আপনার গুলি লেগেছে ভাই । এখন তো দাঁড়িয়ে আছেন একটু পর তাও পারবেন না।
অগ্নি নিশ্বাস ছেড়ে বলে,,
” ডাক্তারের কাছে চল। তবে মাত্র দশ মিনিট। লম্বা দড়ি যাতে হাতে পায়ে না লাগানো হয়?
আরিফের চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠে। অগ্নিকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করা। কতবার গুলি, ছুঁড়ির আঘাত খেয়ে এসে থম মেরে শুয়ে থাকত। যেন কোনো ব্যাথা, অনুভুতি নেই। ইউভি আর রায়ান পার্সোনাল ডাক্তার দিয়ে আসে তবুও জোর করে চিকিৎসা করানো হয়।
আরিফ খুশিতে আত্নহারা হয়ে অগ্নির পাশে গিয়ে বলে,,
” চলুন ভাই।

__যদি ভুলেও কোনো মহিলা নার্স আমার কাছে আসে তাহলে তকে মেরে টুকরো টুকরো করব।
সাথে সাথে আরিফের মুখ চুপসে যায়। মহিলা নার্স আসলে তাকে কেনো মারবে? সে কি করেছে এখানে?
— আসবে না ভাই। প্রয়োজন হলে সারা রাত বসে পাহারা দিব তবুও একটা মেয়ে ডুকতে দিব না। আর ভাবি তো আছেই।
অগ্নির মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,,,

” ওই মেয়ে যাতে না যায়।
আরিফ পিছু পিছু গিয়ে অবাক হয়ে বলে,
” কোন মেয়ে ভাই?
অগ্নি — ওই বিয়াদবটা।
— বিয়াদব কে?
অগ্নি কিছু বলে না। বাড়িটা থেকে বের হয়ে আসে। শিখা চৌধুরি তারা ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অগ্নিকে দেখতে পেয়ে শিখা চৌধুরি এগিয়ে যায়। শক্ত গলায় বলে,,
” মেরে দিয়েছো লোকটাকে?

অগ্নি রহস্যময় হেসে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অগ্নির হাসিতে সবার উত্তর পেয়ে যায়। ইয়ানার চোখ দুটি ফুলে উঠে। অগ্নির ক্ষত জায়গাটা তার চোখ এড়ায় না। বুকটা ধুক করে উঠে। ডাক্তারের কাছে না গিয়ে যাচ্ছে কোথায় উনি? ইয়ানা চোখের পানি মুছে অগ্নির পাশে দাড়াতেই অগ্নি গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসে পড়ে। ইয়ানা থম মেরে দাড়িয়ে যায়। আরিফ ইয়ানার দিকে তাকায়। অগ্নি সিটে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলে,,
” ওইদিকে কি দেখছিস? গাড়ি স্ট্রাট দে।
ইয়ানা কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই অগ্নির ধমকে আরিফ গাড়ি স্ট্রাট দেয়। ইয়ানার চোখের সামনে দিয়ে গাড়িটা দ্রুত বেগে চলে যায়। ইয়ানা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকিয়ে রাখে। শিখা চৌধুরি ইয়ানার কাঁধে হাত রেখে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে।

ঝর্না সেই সকাল থেকে পাগলামো করছে। রুমের যত জিনিস পত্র আছে সব ভেঙ্গে মেঝেতে ছড়িয়ে – ছিটিয়ে রেখেছে। রেশব অফিস থেকে এসে ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে বাড়ির চারপাশে তাকায়। শব্দটা ঝর্নার রুম থেকে আসছে। মেয়েটা কয়েকদিন ধরেই অনেক অস্বাভাবিক আচরন করছে। নিজেকে প্রায় ঘরবন্ধী করে ফেলে। কারনটা রেশবের অজানা নয়। ভালোবাসায় পাগল হয়ে আছে। তাও এমন একজনের জন্য যার সাথে মিল হওয়া অসম্ভব! রেশব নিশ্বাস ছেড়ে ঝর্নার রুমের কাছে যায়। দরজা খুলে ভিতরে ডুকতেই তার পাশ দিয়ে একটা ফুলদানি ঘেষে যায়। রেশব সেটা দেখা মাত্র সরে গিয়েছিলো। তাই তার শরীরে আঘাত লাগে নি। রেশব জিনিস পত্রের দিকে এক পলক তাকিয়ে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,,

” কি করেছিস পুরো রুমটাকে?
ঝর্না বিছানার এক পাশে বসে বলে,,
” কেনো এসেছিস এখানে ভাইয়া তুই? আমি মরে গিয়েছি নাকি বেঁচে আছিস সেটা দেখতে?
রেশব ধীর পায়ে ঝর্নার কাছে যায়। এরপর তার সামনে বসে মাথায় হাত রেখে বলে,,
” কেনো পাগলামো করছিস এমন?
ঝর্না রেশবের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে।
— আমি সত্যি অগ্নিকে খুব ভালোবাসি ভাইয়া। ও আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিলো। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না ভাইয়া। ইয়ানার সাথে যখন অগ্নিকে এক সাথে দেখি তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। খুব কষ্ট হয় ভাইয়া। আমি অগ্নিকে চাই। শুধু একটা বার ওর মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চাই। সত্যি বলছি থেমে যাব ভাইয়া। আর পাগলামি করব না।

রেশব — অগ্নি বিবাহিত! তর ভালোবাসা ঠিক ততদিন ছিলো যতদিন সে অবিবাহিত ছিলো। কিন্তু আজ তার বউ আছে। একজন বিবাহিত ছেলেকে কেনো ভালোবাসছিস?
ঝর্না — ও বিবাহিতা ভাইয়া সেটা ওর ব্যাপার। তাই বলে কি আমার ভালোবাসা কমে গিয়েছে। আমার অনুভুতি কি বিলুপ্তি হয়ে যাবে ভাইয়া। এতটাই সহজ সবকিছু। ভালোবাসা যদি ভুলেই যাওয়া যেত তাহলে ইতাহাসে ভালোবাসার এত ব্যাখ্যা থাকত না।এত এত ইতিহসের পাতা রচিত হত না। ভালোবাসার জন্য ওইত সব পাগলামো। আমার ভালোবাসা কেনো বুঝলো না। পূর্নতা কেনো পাব না আমি। এক পক্ষিক ভালোবাসা আর সহ্য করতে পারছি না। সত্যি বলছি মরে যাব আমি।
রেশব বোনের মাথায় হাত রেখে বলে,,,

” একটা ছেলের জন্য মরে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। ভুলে যা তাকে। আমি এর থেকে ও ভালো পাত্র তর জন্য খুঁজে এনে দিব।
ঝর্না কৃত্রিম হেসে বলে,,
” যে মলম দিয়ে ক্ষত নিবারন হবে সেই মলম ছাড়া হাজারটা মলম ব্যবহার করলেও কিছুই হবে না। ক্ষতস্থান সেই আগের মত ওই ঝলঝল করবে। এখন আমাকে একা থাকতে দাও ভাইয়া। প্লিজ!
রেশব আর কিছু বলে না । বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ঝর্না দরজা পুনরায় লাগিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে। হাটুতে মুখ গুজেঁ নিশ্বব্দে কেঁদে উঠে।

অগ্নিকে একটা এক্সট্রা কেবিনে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে ডাক্তার উনি এসে রক্ত পরিষ্কার করে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর হাতে স্যালাইন লাগাতে গেলেই অগ্নি হুট করে শুয়া থেকে উঠে বসে। স্যালাইন দেখে বিরক্তি নিয়ে বলে,,
” এইসব দড়ি কেনো লাগাচ্ছেন আমার হাতে? এইসব ছাতার মাথা দুরে সরান।
ডাক্তার ভরকে যায় অগ্নির রাগ দেখে। অরিফ দরজায় দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিলো কোনো মেয়ে নার্স যাতে ডুকতে না পারে। অগ্নির ধমকের শব্দে সে ভয়ে ঢোক গিকে কেবিনে প্রবেশ করে।
— মি. চৌধুরি প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। এখন স্যালাইন না দেওয়া হলে শরীর সম্পূর্ন রুপে দুর্বল হয়ে পড়বে।
আপনি কি কোনোভাবে ইনজেকশন ভয় পাচ্ছেন?

অগ্নি কপাল কুচকে ফেলে। ডাক্তারের কথা শেষ হতেই আরিফ বড় বড় চোখ করে তাকায় ডাক্তারের দিকে। বলে কি এই পাগল লোক? যে মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করে, নিজের হাতের ক্ষতস্থান নিজের হাত দিয়ে সেলাই করে ফেলে সে নাকি সামান্য ইনজেকশনকে ভয় পাবে! জীবনে এর চেয়ে বড় আশ্চর্যকর কথা শুনার আগে আমাকে অজ্ঞান কেনো করে ফেলো নি আল্লাহ। পানি পিপাসায় যদি মরে যায় তাহলে এই ডাক্তারের দোষ। এই ডাক্তারকে একবার টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। তাহলে হয়ত অগ্নি চৌধুরিকে দেখতে পারত।
আরিফ শুকনো ঢোক গিলে বলে,,
” ভাই ডাক্তারের কথা মেনে নিন। স্যালাইনটা লাগিয়ে নিন। নাহলে শরীর দুর্বল থাকলে একটু কানাডায় ফিরবেন কিভাবে?

অগ্নি ভ্রুঁ কুচকে বলে,,,
” তর কথা অনুযায়ী এইটা নিয়ে এক ঘন্টা শুয়ে থাকতে হবে! সর বাল সামনে থেকে। রাতে ঘুমানোর সময় ভালোভাবে এক ঘন্টা শুয়ে থাকি কি না সন্দেহ!
আরিফ — ভাই তাহলে রাতে কি করেন?
অগ্নি — বউ আছে, এইবার ভাব কি করি।
আরিফের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এমন নির্লজ্জ তো তার বস ছিলো না। এমন উত্তর কিভাবে দিতে পারলো। এখন আমি এর পাল্টা উত্তর কি দিব?
ডাক্তার অগ্নিকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে স্যালাইন লাগিয়ে দেয়। এর মধ্যে ইউভি আর রায়ান কেবিনে ডুকে। রায়ান অগ্নির হাতে স্যালাইন দেখে খুশি হয়ে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলে,,
” আপনার জন্য একটা যুদ্ধের বাংলো বানানো দরকার। অনেক কষ্টে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তবে সেই বাংলোতে আপনার নাম থাকবে বড় বড় অক্ষরে।
ডাক্তারের বোকা চাহনির উত্তর,,

” কিসের যুদ্ধ?
রায়ান — স্যালাইন যুদ্ধ।
ডাক্তার মুচকি হাসে। এরপর বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
ইউভি অগ্নির কাছে গিয়ে চেয়ারে বসে বলে,,
” হসপিটার কেমন লাগছে ভাই?
অগ্নি কিছু বলতে পারে না। তার আগেই দরজার কাছের দিকে দৃষ্টি পড়ে। ইয়ানা আর শিখা চৌধুরি দাঁড়িয়ে আছে। অগ্নি সেদিকে তাকিয়ে রাগে অন্যদিকে তাকায়। অগ্নির আচরন ইয়ানার মনটা বিষিয়ে তুলে। কোনো বাঁধ ছাড়ায় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইয়ানা কেবিনে ডুকার জন্য প্রবেশ করতেই অগ্নির কর্কশ আওয়াজ,,
” খবরদার আম্মু! এই ঘাড় ত্যারা যাতে আমার কাছে না আসে। বলো রাস্তায় গিয়ে আরও মানব সেবা করতে। আর রাস্তায় যতজন বৃদ্ধ বসা আছে সবাইকে গিয়ে সাহায্য করতে। আমার আশে- পাশে যাতে না আসে।
পুরো কেবিনে অগ্নির প্রতিটা বাক্য ধ্বাক্কা খায়। ইয়ানা চোখ তুলে তাকায় বেডে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটার দিকে। শিখা চৌধুরি অগ্নির উদ্দেশ্যে বলে,,

” সে কি জানত ওই ব্যক্তি ছদ্মবেশী ছিলো?
অগ্নি দাঁতে দাঁত পিষে,,
” অনুমতি নিয়ে বের হয়েছে আমার? একবার ও বলেছে এখানে আসবে? আমাকে বললে আমি বাড়িতে ডেকে সবাইকে নিয়ে আসতাম। রাস্তায় কেনো যেতে হবে বলো?
শিখা চৌধুরি — কয়জনকে নিয়ে আসতি? তুই ঘুমে ছিলি তাই ডাক দেয় নি। নাহলে তর অনুমতি ছাড়া কোথাও বের হয়েছে মেয়েটা।
অগ্নি — যদি একবার বলতো তাহলে পুরো বাংলাদেশের পথশিশু ধরে নিয়ে আসতাম। আজ যদি সঠিক সময় আমি না পৌঁছাতে পারতাম তাহলে কি হত তোমাদের ধারনার ও বাহিরে। সব ত্যারামির ফল এইসব।
ইয়ানা নিজেকে শক্ত করে অগ্নির প্রতিটা কথা উপেক্ষা করে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। অগ্নি ইয়ানাকে আসতে দেখে বলে,,

” ভিতরে কেনো এসেছো? পর – পুরুষের স্পর্শ লেগেছে তোমার শরীরে । শাওয়ার নিয়ে পবিত্র হয়ে আসো। আর স্পর্শকর জায়গায় এমনভাবে ঘষবে যাতে চামড়া পর্যন্ত উঠে যায়।
ইয়ানা কোনো কথার উত্তর না দিয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,,
” শরীর কেমন আছে এখন? এখনও ব্যাথা পাচ্ছেন?
ইয়ানার এমন প্রশ্নে রায়ান, আরিফ আর ইউভি তব্দা লেগে যায়। অগ্নি এইভাবে ধমকিয়েছে আর মেয়ে একদম নরমাল হয়ে আছে। শিখা চৌধুরি মুচকে হাসি দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। ছেলে – বউয়ের মাঝ – খানে থাকাটা উনার ঠিক না।
ইয়ানার এমন খাপছাড়া ভঙ্গিতে অগ্নি রক্তচোখে তাকায়। ইয়ানা সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলে,

” তাকিয়ে লাভ নেই , এখন আর ভয় পায় না।
অগ্নি ইউভি তাদের উদ্দেশ্যে বলে,,
” বের হ তরা কেবিন থেকে।
রায়ান — কেনো?
অগ্নি — বউ এসেছে তাই।
রায়ান হেসে বলে,,
” ভাই এইটা হসপিটালের কেবিন। মেয়েটাকে একটু শান্তি দে।
অগ্নি কটমট চোখে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,,
” আমার হাতে মাইর খাওয়ার আগে সবগুলো বিদায় হ। আর সব কিছুর ব্যবস্থা খুব দ্রুত কর।আরিফ কেবিনের দরজাটা ভালোভাবে লাগিয়ে দে। এক ঘন্টার ভিতরে আমার অনুমতি ব্যাতীত যাতে কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে।
সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রায়ান দরজার এখানে দাঁড়িয়ে বলে,
,
” কন্ট্রোলে থাকিস ভাই। নাহলে শাওয়ার নেওয়ার কাজে ভুগতে হবে। তর শরীরের ক্ষত কিন্তু এখনও গভীর।
অগ্নি দরজার দিকে তাকাতেই রায়ান দরজা বন্ধ করে দেয়। বাহিরে ইউভি, রায়ান আর আরিফ হেসে ফেলে।
ইউভি — তাহলে তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের রোমান্সের পাহাড়া দে। আমি আর রায়ান গিয়ে গরম কফি খেয়ে আসি। যদি একটু দেখার সৌভাগ্য হয় তাহলে ভুলবশত দেখে নিস।
আরিফ ভোঁতা মুখে বলে,,,
” অকালে প্রান হারাতে ইচ্ছুক নয় ভাই।
ইউভি আর রায়ান চলে যায়। আরিফ একটা চেয়ারে বসে বিরবির করে বলে,,
” বসের রোমান্স দেখতে দেখতেই বয়স্ক হয়ে যাব। আমার কপালে আর জুটবে না। কিন্তু এক ঘন্টা কেনো বললো? একটু পর ওইত চলে যাচ্ছি।

ইয়ানা অগ্নির থেকে দুরত্ব বজায় রেখে বসে। অগ্নি বিষয়টা খেয়াল করে ইয়ানার দিকে তাকায়। ইয়ানা অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। অগ্নি ইয়ানার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর হেসে বলে,,
” কাছে আসো।
ইয়ানা নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়ে বলে,,
” যেখানে আছেন সেখানেই শুয়ে থাকুন। আমার শরীরে অন্য পুরুষের ছোঁয়া লেগেছে। আমাকে স্পর্শ করলে আপনার এলার্জি হবে। আপনি তো অন্যের স্পর্শ করা জিনিস ব্যবহার করেন না।
ইয়ানার চোখ পানি টলমল করছে।
— বউরে…

সামান্য একটা শব্দে ইয়ানা থমকে যায়। পেটের ভিতর এক মুচর দিয়ে উঠে। শরীরটা কেঁপে উঠে ভিতরে ভিতরে। অগ্নির দিকে তাকাতে গিয়ে ও অভিমানে আবার থমকে যায়। তাকাবে সে এই লোকের দিকে। অগ্নির এইবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে। সব নষ্টের মুল হচ্ছে এই লম্বা দড়ি। এইটার কারনে বউটাকে কাছে নিয়ে আসতে পারছে না। বিরিক্তি আর রাগ নিয়ে এক টানে সূচটা খুলে ফেলে। সামান্য তরল রক্ত গড়িয়ে পড়ে কিছুটা। ইয়ানা হতভম্ভ হয়ে কাছে গিয়ে অধৈর্য হয়ে বলে,,

” কি করেছেন এইসব। হায় আল্লাহ কি করব আপনাকে নিয়ে আমি।
অগ্নি কোনো কথা শুনে না। ইয়ানাকে টান মেরে বেডে ফেলে দেয়। ইয়ানা টাল সামলাতে না পেরে অগ্নির নিচে পড়ে যায়। অগ্নি ইয়ানার গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে,,
” বলছিলাম না কাছে আসতে। এত ত্যারামি কেনো করো বলোতো?
ইয়ানা ছটফট করে উঠে,,
” ঠিক এই কারনেই আসতে চাইছিলাম না। জানতাম এমন একটা টর্নেডো ঘটে যাবে আমার উপর দিয়ে। ইঞ্জুরি আপনি মি, চৌধুরি।
অগ্নি ইয়ানার জামার এক পাশ নামিয়ে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দেয়। প্রায় অনেক্ষন পাগলামো করে ইয়ানার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,,
” যেখানে লোকটা স্পর্শ করেছিলো সেখানে আমার ঠোঁটের স্পর্শ জ্বলজ্বল করছে।
ইয়ানা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,,

” আত্না শান্তি হয়েছে? এইবার লম্বা করে একটা নিশ্বাস নেন।
অগ্নি — উহুম! বাকি কাজটা আগে সেরে নেয়।
ইয়ানা — একদম না। এইটা হসপিটাল। প্লিজ লিভ!
অগ্নি — আমি আছি, তুমি আছো সাথে রয়েছে সুন্দর একটা বিছানা। এখন এইটা হসপিটাল বা অফ্রিকার জঙ্গল হোক তাতে আমার কি?
ইয়ানা কিছু বলার আগেই হুট করে ফোন বেজে উঠে। অগ্নি মোবাইলটার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। ইয়ানার উপর থেকে উঠে মোবাইল কানে চেপে ধরে। ওইপাশের আওয়াজ শুনে গম্ভীর হয়ে বলে,
” হুম আসছি। নিজেদের জায়গায় চলে যা।
ফোন কেটে দিয়ে অগ্নি শরীরে শার্ট জড়িয়ে নেয়। ইয়ানার উদ্দেশ্যে বলে,,
” চলো?
ইয়ানা অবাক হয়ে বলেন,,

” কোথায়?
অগ্নি — কানাডায়।
ইয়ানা চোখ বড় বড় করে ফেলে। আশ্চর্য হয়ে বলেন,,
” কিহহ! পাগল হয়ে গিয়েছেন? আমি রুইকে একা রেখে কানাডা যাব!
অগ্নি ইয়ানার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” রুই ইউভির সাথে আছে। গন্তব্যে গেলে তুমি সবাইকে পেয়ে যাবে।
ইয়ানা — সত্যি বলছেন? আমার বোনটাকে রেখে চলে যাবেন না তো?
অগ্নি গম্ভীর আর রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,,
” এতটাও খারাপ আমি নয়। রুয়ানা ইউভির জীবন। তাই রুয়ানাকে প্রটেক্ট করার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আছে।
ইয়ানা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,,
” আগে কেনো বলেন নি?
অগ্নি — কি হত?
ইয়ানা চিন্তিত হয়ে বলে,

” কিন্তু আপনি তো অসুস্থ। প্লিজ আগে সুস্থ হয়ে নিন।
অগ্নি ইয়ানার হাত ধরে বেড থেকে নামায়। এরপর কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
” এমন হাজার ও ক্ষত নিয়ে যুদ্ধ করেছি। সেখানে এই সামান্য ক্ষতে কি করবে?
ইয়ানা কিছু বলে না চুপ হয়ে যায়। নীরবতায় ডুবে থাকা ইয়ানা তখন আর কিছুই বলে না। তার ঠোঁটদুটি পাপড়ির মতো জড়সড় নিষ্প্রাণ, অব্যক্ত ক্রন্দনে ভারী হয়ে ওঠে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দুগুলো প্রতিরোধহীনভাবে গড়িয়ে পড়ে। একেকটি হৃদয়ের চূড়ান্ত হাহাকার। বাইরের জগত নিশ্চুপ অথচ তার ভিতরে এক অনন্তকালব্যাপী কোলাহল চলছে।দগ্ধ স্মৃতির চিৎকার আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের আকুতি।
— আমার বাবা – মায়ের কবরটাও নেই!
বুকের মাঝে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে দহন।
যেখানে আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুঁজে ফেরে মৃত মানুষের ছায়া। কোনো সমাধি নেই। নেই কোনো ঠাঁই আর নেই মাটি ছোঁয়ার অধিকার।

তাঁরা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জীবনের সমস্ত ইতিহাস এক মুহূর্তেই নিঃশেষ! সীমাহীন প্রশ্ন এসে কাতর করে তোলে ইয়ানার অন্তর্গত সত্তাকে।
কিন্তু কোথাও কোনো জবাব নেই। আকাশ স্তব্ধ আর বাতাস বোবা।
“সেই দিন কেউ ছিল না? কেউ কি পারত না তাঁদের বাঁচাতে? কোথাও কি ছিল না কোনো হৃদয়বান প্রাণ? কোনো সাহসী হাতে কি পৌঁছায়নি তাঁদের দিকে?”
চোখ মেলে দেখলেও কিছুই দেখা যায় না।
শুধু জ্বলন্ত দৃষ্টি ভেদ করে উঠে আসে জ্বলন্ত স্মৃতি।
সেই জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে ছটফট করা দুটি শরীর।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫৪

যাদের জন্মদাত্রী হয়ে ওঠার ঋণ এখনও রয়ে গেছে ইয়ানার শরীরে। ইয়ানা চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেই। ততক্ষনে তারা হসপিটাল পেরিয়ে গাড়ির কাছে চলে আসে। অগ্নি দরজা খুলে দিলে নিশ্বঃব্দে গিয়ে ব্যাক সিটে বসে পড়ে। অগ্নি ও ইয়ানার সাথে ব্যাক সিটে বসে। ইয়ানা অবাক হয় অগ্নিকে ব্যাক সিটে দেখে কিন্তু কিছু বলে না। ড্রাইভিং সিটে আরিফ বসে গাড়ি স্ট্রাট দেয়। ইয়ানা বিকেলের সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করছে। আর কি কখনো আসা হবে বাংলাদেশে? প্রশ্নটা রয়ে যায় তার মনের গহীনে।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫৬