অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬০

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬০
লিজা মনি

প্রায় অনেক্ষন ধরে মিরে কেঁদে যাচ্ছে। পুরো ফ্লোরে টিস্যু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। মা ও আজ ডাক দিলো না। মিরা নাক টানছে আর ফুঁপাচ্ছে। সব শেষ হয়ে গেলো আমার। ক্ষ্যাপা বাঘ আমার সব ইজ্জত লুটে নিয়েছে। এখন এই মুখ আমি কাকে দেখাব? আমি লোকের সামনে কথা বলব কিভাবে? মিরা একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে। মিরার কান্নার শব্দে অরিদের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। অরিদ ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তি নিয়ে বলে,

” উফফ মিরা কানের কাছে কি শুরু করেছো? সারারাত ঘুমায় নি। তোমার কারনে আমাকে সকালে ঘুমাতে হয়েছে। প্লিজ ঘুমাতে দাও আর তোমার ট্যাপ রেকর্ড অফ করো।
অরিদের বিরক্তিকর প্রতিটা শব্দ মিরার মস্তিষ্কে আগুন ধরিয়ে দেয়। শালা বাদর, সারাজীবন সতীনের মত চুল ছিড়ে এসেছিস। আর আজ এসেছিস স্বামী হতে? আমি ঘুমাতে দেই নি তাই না? নিজে লুচ্চামি করে এখন আমার নাম দেওয়া হচ্ছে। মিরা রাগে রি- রি করে উঠে। বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে অরিদের মাথায় সজোরে আঘাত বসিয়ে দিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” নামুন আমার বিছানা থেকে। অসভ্য পুরুষ! আমার সব শেষ করে দিয়েছে। বাহিরে পরকীয়া করে বাড়িতে ভালো সাজতে আসে। আমার বিছানা থেকে উঠুন।
মিরার দেওয়া পর পর বালিশের স্পর্শে অরিদ ভালোভাবে চোখ খুলে। মিরাকে পাগলামি করতে দেখে বালিশ সহ টান দিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। আকস্মিক টাল সামলাতে না পেরে মিরা অরিদের বুকের উপর গিয়ে পড়ে। অরিদ সামান্য রাগ দেখিয়ে বলে,
” মাথায় কি তেঁতুল গাছের পেত্নীটা ভর করেছে বিয়াদব। সকাল সকাল কি শুরু করেছো? বলছি না ঘুমাতে দাও, বিরক্তি কেনো করছো?
মিরা অরিদের বুকে শক্ত করে কামড় দিয়ে ধরে রাখে। মিরার দাঁতের ধারালো আঘাতে অরিদ দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। মিরা নিজের রাগ মিটিয়ে লাল লাল চোখ করে অরিদের দিকে তাকায়। অরিদ নাক – মুখ কুচকে বলে,
” সারারাত নখের খামচি দিয়ে তোমার কি মন ভরে নি? এখন তোমার কামড় দেওয়া বাকি ছিলো? এইটা দাঁত নাকি ছুঁরি।
মিরা নিশ্বাস টেনে বলে,

” এমন কেনো করলেন আমার সাথে? যখন অন্য কাউকে ভালোবাসেন তখন আমাকে কেনো স্পর্শ করলেন? আমাকে তো দু- চোখে সহ্য করতে পারেন না। যখন সহ্য করতে পারেন না তখন স্পর্শ করতে লজ্জা করলো না।
অরিদ শুয়া থেকে উঠে বসে। এরপর একদম মিরার কাছাকাছি এসে বলে,
” বউ থাকতে পরকীয়া কেনো করতে যাব? যাকে অরিদ চৌধুরি সহ্য করতে পারে না তার ছায়াও সে সহ্য করে না। বউকে অসহ্য করার মত পাপ আমি করব নাকি আজব! একটা মাত্র বউ আমার।
মিরা ভ্রুঁ নাচিয়ে অরিদের দিকে তাকায়। অবাকতার চরম পর্যায়ে গিয়ে হাস্কি সুরে বলে,
” বাব্বাহহহ! যতটা নাদান নিজেকে এখন প্রকাশ করছেন ততটা নাদান কিন্তু আপনি নন। লজ্জা করলো না আমার ইজ্জত নষ্ট করতে?
অরিদ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

” এই ইজ্জতটা তো আমার জন্য ওই তুলে রেখেছিলে। আমি আমার সম্পদ নিয়ে নিলাম।
মিরা দাঁত কটমট করে বলে,
” জিন্দেগীতেও না।
অরিদ সামান্য কপাল কুচকে বলে,
” রাতে তো একদম ঠিক ছিলে। একসাথে ইনোসেন্ট বাচ্চার মত শাওয়ার ও নিলে আমার সাথে। সকালের সূর্য চোখে পড়তেই এমন পাগলামি কেনো শুরু করে দিয়েছো শুনি? তোমাকে তো কোন পেত্নী ধরবে না। কারন পেত্নীরা তো পেত্নীদের ও ধরে না।
মিরা রাগে চেঁচিয়ে উঠে,
” কিহহ! আমি পেত্নী? অসভ্য লোক, নির্লজ্জ ব্যাটা আমার রুম থেকে বের হন।
অরিদ হামি দিয়ে বলে,

” সরি পারব না বের হতে। প্রথমবার শশুর বাড়িতে এসেছি। জামাই আপ্পায়ান খেয়ে এর পর যাব। আমার আপ্পায়নে বাঁধা দিলে রাতের কার্যক্রম আবার শুরু করব।
অরিদ বাক্যটা শেষ করে মিরার দিকে এক চোখ টিপ দিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায় । মিরা হা করে করে তাকিয়ে আছে অরিদের দিকে। কত বড় লুচ্চা এই ব্যাটা ভাবা যায়। এইটাকে এতদিন ভালোভাবে সবচেয়ে বড় অন্যায় করেছি। এর সব ভদ্রতা লোক দেখানো ছিলো। আসলে এই তো একটা নির্লজ্জ! গুঁইসাপের সহচরী। বাংলাদেশের নির্লজ্জ পুরষ্কার বিতরন হলে নির্দিধায় উনি পাবেন। মিরা পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নামে। পেইন কিলার খাওয়ার জন্য শরীরে তেমন ব্যাথা নেই। তবে শরীর প্রচুর মেজ মেজ করছে।আচ্ছা উনি পেইন কিলার কোথায় পেলেন? আমার বাসায় তো এইসব ছিলো না। হুট করে কোথা থেকে নিয়ে এসে আমাকে খাওয়ালেন? বাহিরেও যায় নি। মিরা চোখ ছোট ছোট করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজের অবয়ব দেখতে পেয়ে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠে। গলায় জ্বলজ্বল করছে কিছু স্পর্শ। মিরা দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। এই মুখ সে কাকে দেখাবে? এত লজ্জা সে কোথায় রাখবে? মিরা তুই আফ্রিকার জঙ্গলে চলে যা। এখানে লজ্জার চেয়ে সেখানে সিংহের সাথে বসবাস করবি। তবুও এই লোকের সামনে যাস না। মিরা গলায় হাত দিয়ে বিরবির করে বলে,

” কি করেছে ভন্ড লোক।
— একবার যখন শুরু করেছি তখন এইটা প্রতিনিয়ত ওই হবে।
মিরা চোখ বড় বড় করে ফেলে। হুট করে পিছনে ফিরে। দেখে অরিদ একদম রেডি হয়ে দাঁত কেলিয়ে দাড়িয়ে আছে। মিরা নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে অন্যদিকে ফিরে যায়। কেনো জানি ঝগড়া করতেও লজ্জা করছে। মিরাকে লজ্জা পেতে দেখে অরিদ ঠোঁট কামড়ে হাসে। অরিদকে বেরিয়ে যেতে দেখে মিরা আমতা আমতা করে বলে,।
” চলে যাচ্ছেন?
অরিদ থেমে গিয়ে মিরার উদ্দেশ্যে বলে,
” আমাকে থাকতে বলছো?
— এই প্রথম এসেছেন আমাদের বাড়িতে। না খেয়ে গেলে মা আমাকে বকবে।
— এই মাত্র না রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললে?
— রুম থেকে বের হতে বলছি বাড়ি থেকে নয়।
— আচ্ছা। তোমার মনে হয় আমি তোমাকে না নিয়ে একা একা চলে যাব?
মিরা কপাল কুচকে বলে,

” মানে?
— মানে তুমি আমার সাথে চলে যাচ্ছো সেটা বলতেই তোমার মায়ের কাছে যাচ্ছিলাম।
— জীবনেও আমি যাব না।
— তুমি যাবে।
— যাব না।
— ঠাটিয়ে দিব এক থাপ্পর বিয়াদব। যাবে মানে যাবে।
— দুইটা থাপ্পর দিয়ে চলে যান তবুও যাব না।
— তুমি যাবে তোমার চৌদ্দগোষ্টি ও যাবে।
— আমার চৌদ্দগোষ্টি নিয়ে চলে যান কিন্তু আমি যাব না।
— রাগাচ্ছো কেনো মিরা? আমি থাকতে পারব না।
— ছোট বাচ্চা নাকি আপনি? যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না।
— ছোট বাচ্চা হলে মায়ের কোলে থাকতাম। বড় হয়েছি তাই এখন বউয়ের কোলে থাকব। রেডি হয়ে নাও। তুমি যাচ্ছো আমার সাথে।

— যাব না বলছি তো।
অরিদ দাঁতে দাঁত চেপে উঠে। মিরার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বলে,
” যাবে না?
মিরার এক আওয়াজ — যাব না।
অরিদ শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে বলে,
” ওকে তাহলে আমিও যাচ্ছি না। দরজাটা ভালোভাবে লাগিয়ে দাও তো মিরা। রাতের কাজ এখন দিনে করব।
অরিদকে এগিয়ে আসতে দেখে মিরা লাফিয়ে উঠে। দু পা পিছিয়ে বলে,
” খবরদার ভন্ডামি করবেন না। আপনাকে মেরে ফেলব।
অরিদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
” বউয়ের হতে মরতে ও রাজি।
মিরা টেবিল থেকে একটা ফল কাটার চাকু দেখিয়ে বলে,

” সত্যি সত্যি কেটে ফেলব। কাছে আসবেন না একদম।
— কি কাটবে?
মিরা নিচের দিকে ইশারা দিয়ে বলে,
” ওইটা।
অরিদ কিছুক্ষনের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। কথাটা বুঝতে পেরে অবাক হয়ে বলে,
” এত ডেঞ্জারাস তুমি?
— অনেক।
— ওকে নিজের ভবিষ্যত নিজে যা ইচ্ছে করো।
অরিদের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে মিরা প্রায় কেঁদে দেওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়। অরিদ একদম কাছে এসে দাঁড়ায়। মিরা নিজেকে শান্ত করে বলে,
” যাব! যাব আমি আপনার সাথে। প্লিজ দুরে যান।
অরিদ বাঁকা হেসে বলে,
” এই তো গুড গার্ল। এইভাবে আমার কথা শুনে চলবে।
মিরা কটমট করে বলে,

” অসভ্য!
অরিদ দরজার দিকে এগিয়ে যায়। মিরা দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে নামে। দেখে অরিদ আর বাবা পাশা – পাশি হেসে কথা বলছে। মিরা সেদিকে তাকিয়ে নাক ছিটকিয়ে বলে,
” দেখো রাক্ষসটা কিভাবে হাসছে? ইচ্ছে করছে ইট দিয়ে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করতে। অভিশাপ দিলাম জীবনেও সুখী হবে না। বউয়ের টর্চার সারাজীবন ভোগ করতে হবে।
মিরা বিরবির করতে করতে নিচে নেমে আসে। হাতে অনেক বড় একটা ব্যাগ। মিরা নিচে নামতেই অরিদ আড়চোখে একবার তাকায়। মিরা বাবার দিকে তাকাতেই তিনি বললে,
” আর কিছু দিন থাকতে পারতি মিরা। বইগুলো সাথে করে নিয়ে আসতি। তাহলে আর পড়ার চাপ থাকত না। কি আর করার! তবে ভালোভাবে এক্সাম দিস।
মিরা অবাক হয়ে মনে মনে আওড়ায়,,
” এক্সাম! আমার এক্সাম কবে? আমি তো ভার্সিটিতেই যাব না আর। বাবা কিসের এক্সাম তাহলে?
হুট করে অরিদের দিকে চোখ যেতেই আসল কাহিনী বুঝতে পারে। অরিদ এক ভ্রুঁ নাচিয়ে বাঁকা হাসে। মিরা কটমট করে তাকিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে মিহি সুরে বলে,

” হুম বাবা সব তো জানো ওই। সোমবারে চলে যাচ্ছি। রবিবার এসে তোমাদের সাথে দেখা করে যাব
নিজের খেয়াল রেখো।
এরপর মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
” মা নিজের খেয়াল রাখবে।
মিরার মা মিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” সুখী হ মা। আমাদের জন্য চিন্তা করিস না। প্রথম বার জামাই এসেছে অথচ কত ব্যস্ততা। সকালে এসেছে আবার না খেয়ে সকালেই চলে যাচ্ছে।
মিরা ভ্রুঁ কিঞ্চিত ভাঁজ করে বলে,
” উনি সকালে এসেছে?
মিরার প্রশ্নের সাথে সাথে অরিদ সামান্য কেঁশে বলে,
” মিরা চলো আমার অফিসের লেইট হয়ে যাচ্ছে।
মিরা সামান্য মাথা নাড়িয়ে বাবা – মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে এক প্রকার কান্না মিশ্রিত চোখে নিজের গন্তব্যে এগিয়ে যায়।

অগ্নি গম্ভীর হয়ে চোখ বুজে বসে আছে উচ্চপৃষ্ঠের একটি গাঢ় কাঠের চেয়ারে। শরীর স্থির, অথচ ভ্রুর নিচে জমে থাকা ছায়া বোঝায় তার মস্তিষ্কে এক শৃঙ্খলিত ষড়যন্ত্রের লহর বইছে। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি খেলে যায়।যেন বহু আগেই সে এ দৃশ্য কল্পনায় দেখে রেখেছিল।
হঠাৎ একটানা নিস্তব্ধতা চিরে বাজে ফোনের রিংটোন। চোখ না খুলেই কানে ফোনটি তুলে নেয় সে। গলা ভারী, স্থির—তবু শীতল,,
— হয়েছে?
ফোনের ও পাশ থেকে সম্মানমিশ্রিত উত্তরে ভেসে আসে,
— হ্যাঁ স্যার। সবকিছু নিখুঁত। আতিকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট একেবারে শূন্য করে দিয়েছি। এখন তার কাছে কিছুই অবশিষ্ট নেই। আপনি চাইলে চেক করে নিতে পারেন।
অগ্নি চোখ মেলে দেয়। ঠোঁটে আরও দৃঢ় এক বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রাখে। শান্ত কণ্ঠে বলে,
“গুড জব। এবার শুরু হবে আসল খেলা।
ঘরের কোণ থেকে ইউভির হাস্যরসাত্মক টোনে সংলাপ ভেসে আসে,,

— তাহলে অবশেষে আতিক আর রানবীর দুজনেই হয়ে গেল ভিখারী!
অগ্নি তাকায় ইউভির দিকে, তাকানোয় যেন লুকানো তৃপ্তির ছায়া। ধীরে বলে ওঠে,
“এটা একদিন হবেই, ইউভি। আমি তো আগেই জানতাম।
রায়ান সোফায় হেলান দিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
— আজ মনে হয় ঘুমটা শান্ত হবে। বহু বছরের প্রতীক্ষার অবসান তো হলো অবশেষে।
— তবে কি এবার শেষ চালটা দিয়ে দেই? ইউভির উৎসুক প্রশ্ন।
অগ্নির কণ্ঠে থেমে থাকে এক কঠোর অনড়তা,
” না, এখনই নয়। আগে ওদের দেউলিয়াপনা দেখি নিজ চোখে। এতকাল রাজত্ব করেছে এবার ভিক্ষা করুক কিছুদিন।
ইউভি হেসে ফেলে,

“কিছুক্ষণের মধ্যে ফোন আসবে তোর কাছেই দেখে নিস।
রায়ান মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“কি হাস্যকর ব্যাপার, বল তো? যে মানুষটা ওদের পাট করে দিচ্ছে তার কাছেই এসে কান্নাকাটি করছে! মেরে ফেলছিস না কেন?”
অগ্নির চোখে আসে এক পলকের অস্থিরতা
আবার তা মিলিয়ে যায়। শান্ত ভঙ্গিতে সে বলে,
‘ব্যাঙ্ক খালি করেছি ঠিকই, কিন্তু ওদের ঘাড়ে এখনো অনেক হাত। চাইলে এখনই শেষ করে দিতে পারি। কিন্তু…
ইউভি তার বাক্য ধরে ফেলে,
“কিন্তু তুই ইয়ানাকে নিয়ে চিন্তায় আছিস। যদি তোকে কিছু হয় তাহলে ইয়ানাকে রক্ষা করবে কে? আমি ঠিক বললাম, তাই তো?”
অগ্নির মুখে গাঢ় এক গম্ভীর হাসি। ধীর স্বরে বলে,
“আমার যদি কিছু হয়, ওরা ইয়ানাকে শেষ করে দেবে। আমি মরে শান্তি পাব, কিন্তু তার আগে ইয়ানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
রায়ান চোখ নামিয়ে আধা-মজার সুরে বলে,

— এসব কথা আমার সামনে বলছিস শুভ চিন্তা। কিন্তু ইয়ানার সামনে যেন ভুলেও এসব বলিস না!
অগ্নির ঠোঁটে বিদ্রূপে মিশ্রিত এক ক্ষণিক হাসি খেলে যায়। চোখের কোণে জমে ওঠে এক অনুচ্চারিত ক্লান্তি চেপে রাখা অনুভব বিস্ফোরণের দ্বারপ্রান্তে। নীরব কণ্ঠস্বরে, তবু স্পষ্ট বিদ্রূপ নিয়ে সে বলে ওঠে,
” পাগল হয়ে গিয়েছিস? এইসব বললে ওই মেয়ের কান্নার জ্বালায় রাতে ঘুমাতে পারব ভেবেছিস? সব কিছু থেকে ছেড়ে আসার জন্য যেভাবে পাগলামি করে । আর এইসব বললে তো আমাকে রুমে লক ডাউন করে রাখবে।
ইউভি ও রায়ানের ঠোঁটের কোণে এক চাপা আর ম্লান হাসি খেলে যায়। এই সম্পর্কের অনিবার্য অন্তিম চিত্র প্রত্যক্ষ করার জন্য যেন তারা মৌন দর্শকের ভূমিকায় বসে রয়েছে। তবে সেই হাসির নিচে এক প্রশ্ন জমাট বেঁধে ওঠে,
” অগ্নি কি সত্যিই ভালোবাসার অগ্নিকুণ্ডে নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত? নাকি সে কেবল সময়ের এক নিষ্ঠুর অভিনয়ে নিপুণ পারদর্শী?
ঘরের নিঃশব্দতা, বাতাসের নিথরতা আর চোখে চোখ রাখা সেই মুহূর্ত সব কিছু মনে হয় ঘোষণা করছে,
” বিচ্ছেদের চেয়ে ভালোবাসা আরও ভয়ংকর।”

রাতের নীলাভ অন্ধকারে ঘিরে থাকা বিশাল আকাশ যেন নিঃশব্দে ঝুঁকে আছে দোলনার দিকে। নিস্তব্ধ বাতাসেও এক অদৃশ্য সান্ত্বনার সুর বাজে। দোলনায় বসে থাকা ইয়ানার কোল জুড়ে শুয়ে আছে রুয়ানা। শিশুর মতো ঘুমন্ত নয় বরং এক অদৃশ্য বিষাদের ভারে অবনত। ইয়ানার আঙুলগুলো তার কেশে ছুঁয়ে যায় অবিরত। যেন মাতৃত্বের কোমলতার পরশে সমস্ত ভাঙন ঢেকে দিতে চায়।
নিম্নস্বরে হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত কথায় ইয়ানা বলে ওঠে,
“রুই বাবা-মা হয়তো আর নেই কিন্তু আমি আছি। তোর ছায়ার মতো তোর সব দুঃসময়ের ঢাল হয়ে। রুই আজ আব্বু বেঁচে থাকলে তোর এই বিয়েটা কি মেনে নিত?
রুয়ানার মৌনতা উত্তর দেয় চোখের ভাষায়।নিরব কান্না আর অস্ফুট ব্যথা। ইয়ানা তার অশ্রুসজল চোখ মুছে নিয়ে ক্ষীণ হাসিতে মুখ আলোকিত করে।

‘না, কখনোই না। বলত আমার মেয়েটা এখনও ছোট। যতই ভাল হোক সেই ছেলেটা আমার বাচ্চা মেয়েটার কপালে এত তাড়াতাড়ি সংসারের ভার চাপাতে পারব না। কিন্তু দেখ আমি তো এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। তুই আমাকে স্বার্থপর ভাবছিস না তো ?
রুয়ানা প্রথমবারের মতো চোখ তুলে তাকায়।গলা জড়িয়ে আসে
” না আপু তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ ছিলে, আছো, আর থাকবে।
ইয়ানার কণ্ঠ এবার আরও মমতাময় আশীর্বাদমিশ্রিত,
“ইউভি ভাইয়া খুব ভালো। সে তোকে আগলে রাখবে। প্রতিটি দুঃখে নিজেকে ঢাল বানাবে। কখনো ওর হৃদয়ে কষ্ট দিস না। উনি যা বলবে বোঝার চেষ্টা করিস। সিরিয়ালে যেমন দেখিস তেমনভাবে।
রুয়ানা ভাবুক হয়ে বলে,

” সিরিয়ালে স্বামীর যত্ন করে কোথায় আপি? পুরো নাটক চলে যায় ভিলেনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে।
ইয়ানা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। কিভাবে বুঝাবে এই মেয়েকে?
— তাহলে হিন্দি মুভির মত করবি।
— এইসব ভাষা বুঝি না আমি।
— কোরিয়ান ড্রামতে যেভাবে করে সেভাবে করবি।
— ড্রামা তো আমি আরও আগে দেখি না।ভাজুং- ভুজুং বুঝি না এইসব। হ্যা তবে গোপাল ভাড় দেখি। সেখানে তো গোপাল গিন্নিকে প্রচুর ভয় পায়। সেইম মন্ত্রীমশাই ও। তাহলে ইউভি ভাইয়ার উচিত আমাকে ভয় পাওয়া তাই না আপু? রাজা মশাই পুরো রাজ্যের রাজা হয়েও রানী মাকে সাঙ্ঘাতিক ভয় পায়। যাক অবশেষে তবে আমাকে ও কেউ ভয় পাবে।

রুইকে খুশিতে গদগদ করতে দেখে ইয়ানা গভীর নিশ্বাস ছাড়ে। বুঝাতে চেয়েছিলো কি আর এই মেয়ে কথার টান কোথায় নিয়ে গিয়েছে! ইয়ানা কিছু বলতে যাবে তার আগেই কারোর পায়ের শব্দে থেমে যায়। পিছনে ফিরে ইউভিকে দেখে হাসি দিয়ে দোলনা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে যায়। রুয়ানা ইয়ানার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ইউভি রুয়ানার দিকে তাকায়। ইয়ানা চিন্তিত হয়ে বলে,
” উনি ফিরেছেন ভাইয়া?
— হ্যা আমার সাথেই আসলো। দ্রুত রুমে যাও ইয়ানা নাহলে তান্ডব লাগিয়ে দিবে। নিজের স্বামীকে তো ভালোভাবে’ই চিনো। সুইমিংপুলে রেখে যে ব্যক্তি মাফিয়া জগৎ উলোট- পালট করে দিয়েছিলো সে আর কি করতে না পারে। পাগল!
ইয়ানা সামান্য হেসে বলে,

” ভাইয়া উনাকে চিকিৎসা করানো দরকার। মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে।
ইউভি থতমত মুখে ইয়ানার দিকে তাকায়। ইয়ানা উৎসুক নয়নে বলে,
” ঠিক বলি নি আমি?
ইউভি ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
” তুমি এই কথাটা যে আমার কাছে বলেছো সেটা যাতে অগ্নি জানতে না পারে। জানতে পারলে আমাকে জমিন থেকে আসমানে পাঠিয়ে দিবে।
ইয়ানা — কেনো ভাইয়া?
ইউভি — আগে প্রায় ওকে বলতাম চিকিৎসার কথা। এখন যদি জানতে পারে তুমি ও বলছো তাও আমার সাথে। তাহলে শালা নির্ঘাত ভাববে আমি তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। এমন অনর্থ না করে কথাটা নিজের পেটেই রেখে দাও। মুখ থেকে বাহির করা দরকার নাই।
ইয়ানা ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা নাড়ায়। এরপর দোলনায় দোল খেতে থাকা রুয়ানার দিকে এক পলক তাকিয়ে চলে যায়। ইয়ানা চলে যেতেই ইউভি দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুয়ানার দিকে তাকায়। এরপর ধীর পায়ে দোলনায় পাশা- পাশি হয়ে বসে। হঠাৎ কারোর উপস্থিতি পেয়ে সেদিকে তাকায়। ইউভিকে দেখে রুয়ানা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। তার মনে অজানা এক অনুভব হচ্ছে। সবাই বলত বিয়ের দিন রাত হচ্ছে বাসর রাত। নতুন কেউ তার পাশে থাকবে ভাবতেই গা শিউরে উঠে। সে ও কোনো এক পুরুষের সাথে এক বিছানায় থাকবে। যেভাবে আম্মু – আব্বু থাকত!
রুয়ানার ভাবনার মাঝেই ইউভির শান্ত কন্ঠে,

” রুই!
রুয়ানা কেঁপে উঠে এত মিষ্ট ডাকে। তাকায় সে ইউভির দিকে। ইউভি মুচকি হেসে বলে,
” চলো আজ পুরো রাত দুজনে চন্দ্রবিলাশ করি।
রুয়ানার চোখ দুটি খুশিতে চিকচিক করে উঠে।
— চলুন।
ইউভি রুয়ানার সাথে আরও চেপে বসে। রুয়ানা লাজুকতার সাথে মিলিয়ে যায়।
নির্জন রাতের নিঃস্তব্ধতায় দোলনাটি চাঁদের কণামাখা সুরে দুলছে।আর তার বুকে আশ্রয় নিয়েছে দুইটি হৃদয়। ভিন্ন শরীর কিন্তু এক আত্মা। চন্দ্রালোক তাদের মুখাবয়ব ছুঁয়ে দিয়ে ভালোবাসার শপথে মৃদু কিরণ এঁকে চলেছে। বাতাসে জড়ানো চাঁদের মায়া তাদের হৃদয়ের ভাষা বুঝে নীরবে ঝরে পড়ে পাতার ওপর। কোনো শব্দ নেই তবু ভাষাহীন কথোপকথনে মুখর তারা।চোখের চাওয়ায়, নিঃশ্বাসের গতিতে, হৃদস্পন্দনের অনুরণনে। এ যেন প্রেমের এক চিরন্তন আরাধনা। যেখানে দোলনাটিও হয়ে উঠেছে সময়ের বাইরে এক অলৌকিক সাক্ষী।

রাতের গভীর অন্ধকার যখন চারিদিকে প্রসারিত হয় তখন সবকিছু নিস্তব্ধতার এক নিঃশেষ সাগরে ডুবে যায় । নক্ষত্রমণ্ডল তার জ্বলজ্বলে আলোকরাশিকে অন্তরালে লুকিয়ে রেখে, কালো আকাশে থিতিয়ে থাকে নির্জন শূন্যতায়। বাতাস তখন অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা গভীর শ্বাস। সেটা ধীরে ধীরে গায়ের রেশ ধরে গড়িয়ে পড়ে। নিঃশব্দতায় ভরিয়ে দিচ্ছে প্রতিটি কোণা। তখন দূরের একটি কাঁকড়া তার ঝিঁঝিঁ শব্দটি থেমে যায়। আর কোনও পাখির ডাকে প্রতিধ্বনি থাকে না । প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণীও আজকের রাতের গম্ভীরতা অনুভব করে নিঃসঙ্গতা মেনে নিয়েছে। পাতা ঝরানো বৃক্ষের ডালগুলো অবশ হয়ে আছে।বাতাসের নড়াচড়ায় হালকা কম্পমান এক শূন্যতা ও ভয়ংকর সুনিপুণ নৈরাশ্যের প্রতীক। সমস্ত শব্দের অবসান ঘটিয়ে রাত স্বয়ং একগুঁয়ে, অনভিপ্রেত একটি সমাধিস্থল হয়ে দাড়িয়ে থাকে। যেখানে কেবল অস্তিত্বের নিস্প্রাণতা আর অন্তহীন শূন্যতার মিশ্রণ বিদ্যমান। রাতের নিস্তব্দ রজনীতে ইয়ানা পা টিপে রুমে প্রবেশ করে। রুমটা ডিম লাইটের আলোতে লাল হয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে ডিভানে কারোর উপস্থিতি লক্ষ্য করে লাইট অন করে দেয়। ইয়ানা কপাল কুচকে ব্যাক্তিটার দিকে তাকায়। আজ এত শান্ত! নম্র, ভদ্র। সূর্য হঠাৎ কোন দিক দিয়ে উদয় হলো? সিংহ আজ বিড়ালের মত বসে আছে। ইয়ানা গলা কেঁশে মৃদু আওয়াজে বলে,

” ফ্রেশ না হয়ে এখানে বসে আছেন কেনো? শরীর দুর্বল লাগছে?
কথাটা শেষ করে ইয়ানা নিজের কথায় নিজেই নাক ছিটকায়। উনার আবার অনুভুতি আছে নাকি? অনুভুতি থাকলে তো ভালো’ই হত। অগ্নি কপালে হাত দিয়ে সেই আগের ভঙ্গিমায় গম্ভীর হয়ে বসে আছে। ইয়ানা কিছুটা বিরক্ত হয়। আরে আজব শান্ত থাকবে সেটা ভালো লক্ষন তাই বলে দেবদাসের মত স্তব্দ হয়ে বসে থাকবে? ইয়ানা সামনে এগিয়ে গিয়ে অগ্নির শরীরে হালকা স্পর্শ করে বলে,
” এখানে বসে আছেন কেনো এইভাবে? খারাপ লাগাছে শরীর?
অগ্নি মুখ থেকে হাত সরায়। চোখ দুটি দেখে ইয়ানা অবাক হয়ে। অগ্নি যখন প্রচন্ড রেগে অথবা টেনশনে থাকে তখন চোখ এইভাবে লাল হয়ে যায়। তাহলে বর্তমানে উনি কোনটা করেছেন? রাগ নাকি টেনশন! ইয়ানা আর ভাবতে পারে নি কারোর শক্ত হাতের স্পর্শে মুখ কুচকে ফেলে। অগ্নি ইয়ানার বাহু চেপে ধরে নিজের উড়ুর উপর বসায়। এরপর কন্ঠের খাদ নামিয়ে শক্ত গলায় বলে,

” কোথায় ছিলে এতক্ষন? তুমি জানতে না এখন আমি বাড়ি ফিরব? আসার সময় তোমার সাথে কথা হয় নি? যখন যানো আমি এখন বাড়ি ফিরব তখন রুমে ছিলে না কেনো?
— দেরী কোথায় হলো? আমি রুয়ানার কাছে ছিলাম।
— আমি রুমে আসার পর মোট ছয় মিনিট বাইশ সেকেন্ড ধরে তোমাকে খুঁজে পাই নি ইডিয়েট।
— সত্যি ওইত ছয় মিনিট অনেক সময়! এই ছয় মিনিটে বিদেশ থেকে আসা যাবে।
— ফাইজলামো করছে আমার সাথে?
—- মাফিয়া বসের সাথে ফাইজলামি করার মত স্পর্ধা আমার নেই। ছাড়ুন আমাকে আর নিজেও ফ্রেশ হয়ে আসুন।
অগ্নি ইয়ানাকে নিজের সাথে আরও ভালোভাবে চেপে ধরে বলে,

” উহুম, উঠবে না। যেভাবে বসে আছো সেভাবে থাকো।
— কিন্ত আপনি আগে শাওয়ার নিয়ে আসুন।
অগ্নি ভ্রুঁ কুচকে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,
” কিছু করেছি আমি তোমার সাথে সে বাধ্যতামুলক আমাকে শাওয়ার নিতে হবে। যেভাবে বসিয়ে রেখেছি সেভাবে থাকো। নড়াচড়া করলে হার্টবিট বেড়ে যায়।
ইয়ানা চুপসে যায়। শান্ত হয়ে বসে থাকে একই ভঙ্গিমায়। অগ্নি ইয়ানার চুলগুলো গলার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়। এরপর দাগ গুলোতে হালকা স্পর্শ করে সেদিকে তাকিয়েই বলে,
” ঔষধ খেয়েছিলে দুপুরে?
— হুম।
— চিন্তা করো না ক্ষতস্থানে আর ব্যাথা পাবে না।
ইয়ানা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। লজ্জায় গাল হয়ে উঠে। প্রাইভেট টাইমে এই লোকটার আদুরে কন্ঠে, ফিসিফিসানি সুর ইয়ানাকে বড্ড ভাবায়। এইটাই কি তাহলে জেগে থাকা অগ্নি চৌধুরি? যার মুখ সবসময় গম্ভীরতায় ঢেকে থাকে। হাসে খুব কম। যাকে সে কখনো মন খুলে হাসতে দেখে নি। যার গম্ভীর মুচকি হাসি এত সুন্দর তার প্রানবন্ত হাসি নিশ্চয় অনেক সুন্দর। ইয়ানা নিজের কৌতুহল না রেখে অগ্নিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,

” আপনি কখনো মন খুলে হাসেন না কেনো?
অগ্নির হাত থেমে যায়। সে এতক্ষন ইয়ানার শরীরের ক্ষতগুলোকে পরখ করছিলো। ইয়ানার উৎসুক নয়নে এক পলক তাকিয়ে নিশ্বাস টেনে বলে,
” কোনো কারন ছাড়া তোমার মত হাহহা হিহিহি করার ইন্টারেস্ট নেই আমার ।
— কিহহহ! আমি সারাদিন হাহা – হিহি করি?
— আমার সাথে তো ত্যারামি করো। অন্যকারোর সাথে করো কি না জানি না।
— এই মাত্র ওই না বললেন আমি সারাদিন হাহা হিহি করি।
— যা বলেছি ভুলে যাও।
— অসভ্য!
— শুনে অভ্যস্ত অন্য কিছু বলো।
ইয়ানা রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠে। অভিমানে অগ্নির কোল থেকে উঠে যেতে চাইলে অগ্নির তিরিক্ষি আওয়াজ,
” খবরদার উঠবে না। অবাধ্য হলে সারারাত ছাড় পাবে না। তোমার অসুস্থতার কথাও ভুলে যাব। আমার এখনও পুষায় নি।
ইয়ানা দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে আওড়াও ” লুচ্চা”

সুমু আজ নিজ প্রথম এখানে এসে রান্না করেছে। রায়ানের সব পছন্দের খাবার নিজের হাত বানিয়েছে। সে জানে রায়ান জানলে তাকে বকাঝঁকা করবে।। তাতে কি? দুই একটা বকা খেলে কিছু হবে না। রান্না শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এতক্ষন আগুনের কাছে থাকাতে শরীর কেমন ছনছন করছে। শাওয়ার নেওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ডুকে পড়ে।

রায়ান বাড়িতে এসে সোজা রুমে ডুকে পড়ে। সুমুকে রুমে খুঁজে না পেয়ে কপাল কুচকে ফেলে। বেলকনিতে গিয়ে দুই একবার নাম ধরে ডাক দেয় বাট কোনো রেসপন্স নেই। চিন্তায় মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন সজাগ হয়ে উঠে। বারান্দা থেকে রুমে এসে পুনরায় ডাক দিতে যাবে তার আগেই চুপ হয়ে যায়।। ভেতরে শাওয়ার থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। রায়ান শান্তির নিশ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসে। আরেকটু হলে জান বেরিয়ে যেত। কিছুক্ষনের ব্যবধানে দরজা খুলার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকাতেই থমকে যায়। মুখ হা করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। সুমু বিছানায় হঠাৎ রায়ানকে দেখতে পেয়ে স্তব্দ হয়ে তাকায়। রায়ানকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুমু নিজের দিকে এক পলক তাকায়। বর্তমানে তার শরীরে টাওয়েল ছাড়া কিছুই নেই।

সুমু নিজের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে। রায়ানের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠে। রায়ান ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখ অন্য কথা বলছে। কেমন ঘোলাটে আর উন্মাদ শকুনের মত তাকে নজর দিচ্ছে। সুমু শুকনো ঢোক গিলে পুনরায় ওয়াশরুমে ডুকতে যাবে তার আগেই রায়ান এক হাতে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।সুমু লজ্জা আর ভয়ে অসম্ভব ভাবে কাঁপছে। মনের ভুলে কাপড় নিয়ে ডুকতে ভুলে গিয়েছিলো। ভেবেছে এক মিনিটে কাবার্ট থেকে কাপড় নিয়ে আবার ডুকে যাবে। কিন্তু কে জানত এখন উনার আগমন ঘটবে। ইসস কি বিশ্রি পরিস্থিতি! রায়ান একদম সুমুর কাছে এসে দাঁড়ায়। সুমু পিছিয়ে যেতে যেতে ওয়াশরুমের দরজার সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়। সে অসম্ভবরকম কাঁপছে। ভয়ে হাত – পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। রায়ান সুমুর পুরো শরীরে একবার স্ক্যান করে বাঁকা হেসে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। সাথে সাথে সুমু শিউরে উঠে। দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। সুমুর অবস্থা দেখে রায়ান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

” কে যেন বলেছিলো রোমান্টিকের “র ” ও জানি না। অন্যের প্রেমে শুধু বাঁধা দেয়। সেই মানুষটা বুঝবে আজ রোমান্টিকতা কাকে বলে?
সুমুর শরীর আর ও কেঁপে উঠে,
— ক.. কি করছেন রায়ান? সামনে থেকে সরুন ড্রেস চেইঞ্জ করব।
— একদম সকালে করবে।
— ম.. মানে?
— বেডে চলো।
আকস্মিক সুমু হাওয়াতে ভেসে উঠে। টাওয়েলের গিটে ভালোভাবে চেপে ধরে। রায়ান সুমুকে কোলে নিয়ে একদম বিছানায় শুয়ে দেয়। সুমুর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে কম্পনরত কন্ঠে বলে,
‘ রায়ান না।
— প্লিজ না করো না। মরে যাব আমি জান।
— অসভ্য হয়ে গিয়েছেন।
— আজ রাতটা অসভ্যতার চরম পর্যায়ে যেতে দাও প্রমিস সকালে সভ্য হয়ে যাব। একদম তোমার মত।
— আপনার জন্য রান্না….
আর বলতে পারে নি রায়ানের করুন সুর,,

” প্লিজ সুমু, আজ চাইছি আমি। ফিরিয়ে দিও না।
রায়ানের করুন চাহনি সুমুর ভেতরটা নাড়িয়ে তুলে। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস টানে। ঠিক ওইত আর কত অপেক্ষা করাবে সে? তাকে তার অধিকার দেওয়া উচিত। সুমু নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে মাথা নাড়িয়ে বলে,
” হুম।
— সিউর?
— হুম।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫৯

রায়ান মুচকি হেসে সুমুর ঠোঁট জোড়া নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে। এই প্রথম সে সুমুকে এত গভীর ভাবে স্পর্শ করছে। সুমু নড়ে- চড়ে উঠে। রায়ানের উন্মাদনার সাথে সে হাঁপিয়ে উঠে। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠে মেয়েটা। সময় যাচ্ছে, মুহূর্ত যাচ্ছে। তাদের ভালোবাসা গভীর থেকে আরও গভীর হতে থাকে। রুমে জুড়ে অন্ধমাকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চাঁদের আলোতে দুইটা উন্মাদ প্রেমিককে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ভালোবাসার পূর্নতা লাভ করেছে আরও দুইজন পাগল প্রেমিক।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬১