অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬২

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬২
লিজা মনি

ইয়ানা অগ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এরপর কোল থেকে উঠে আসে বিনা বাক্যে। অগ্নি কপাল কুচকে ইয়ানার যাওয়ার দিকে তাকায়। ইয়ানার নিরবতা রাগটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। লাথি দিয়ে মিনি টেবিলটা ফেলে দেয়। টেবিলটা পড়ে সাথে সাথে ভেঙ্গে যায় কাঁচ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ইয়ানা দরজার কাছে এসে ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে কেঁপে উঠে। সব ভয় আর অবাধ্যতা পিছনে ফেলে কাঁপা কাঁপা পায়ে অগ্নির কাছে এগিয়ে যায়। ভাঙ্গা কাচের টুকরো গুলোকে মেঝেতে ছড়ানো দেখে অন্য পাশ দিয়ে যায়। ইয়ানা অগ্নির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। অগ্নি মাথা তোলে ইয়ানার দিকে তাকায়। ইয়ানার হাতে একটা কাগজ দেখে কপাল কুচকে ফেলে। অগ্নির তাকানো দেখে ইয়ানার গলা শুকিয়ে আসছে। নির্ঘাত আরেকটা ঝড় যাবে তার উপর দিয়ে। অগ্নি ভারিক্কি গলায় কাগজের দিকে ইশারা করে বলে,

— কিসের পেপার এইটা?
ইয়ানা লাজুকতা আর ভয় নিয়ে সিটিয়ে যায়। হঠাৎ অগ্নির কণ্ঠে উচ্চারিত সেই তীব্র প্রশ্নবাণ ঘরের নিরবতা ছিন্ন করে চতুর্দিকে ধ্বনিত হয়। তার দৃষ্টিতে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়।
ইয়ানাকে এমন হাঁশ- ফাশ করতে দেখে অগ্নি ধমকে উঠে,
” আন্সার দ্যা কোয়েশচন ড্যাম ইট! প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এইভাবে বাদরামি শুরু করেছো কেনো?
ইয়ানা কেঁপে উঠে। লজ্জা আর ভয়ের সম্মিলিত ভারে যেন শরীর নিথর হয়ে আসে। নিস্তব্ধতাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে সে। কিন্তু তবুও তার ভীত নয়নে প্রতিফলিত হয় এক চূর্ণ বিচূর্ণ আত্মবিশ্বাস।
কঠিন ধমক আর কঠোর দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়িয়ে, ইয়ানার ভেতরের কোমলতা শূন্যে হেলে পড়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে শ্বাস ধরে রাখে। নিজের অস্তিত্বকেই প্রশমিত করতে চায় অগ্নির রাগের প্রাবল্যে। ধীর পায়ে এগোয় অগ্নির দিকে। পদে পদে তার লজ্জা, দ্বিধা আর ভালোবাসার সংকোচ প্রতিফলিত হয়।চোখ মাটিতে, কিন্তু অন্তর স্পষ্ট। অগ্নির সামনে এসে কোনো পূর্বাভাস না দিয়েই হুট করে বসে পড়ে তার কোলের ওপর। এক মুহূর্ত সমস্ত তোলপাড় থেমে যায়। তার বাহুতে ইয়ানার দেহের কাঁপুনি অনুভব করে।
অগ্নি নিজের রক্তপ্রবাহে এক অজানা কাঁপুনি অনুভব করে। ইয়ানা তার গলা জড়িয়ে ধরে আর
নয়নে নির্জন জিজ্ঞাসা কণ্ঠে স্তব্ধ কণ্ঠস্বর,
” আপনার কোল আলো করে যদি একটুখানি শিশু দুনিয়ায় আসে…আপনি কি তাতে খুশি হবেন মাফিয়া বস?
এক পলক স্তব্ধ হয়ে থাকে অগ্নি। তার রক্তলাল দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে বহু প্রাণ নিঃশেষিত হয়েছে। আজ সেখানে দ্বিধার রেখা। অগ্নি চোখ বুজে এবং ধীরে ভ্রুঁ কুঁচকে নেয়। জীবনের কঠিনতম প্রশ্নগুলোর একটিকে বোঝার নিরর্থক চেষ্টা করে সে।
তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। গলার খাদ নেমে আসে।কণ্ঠে এক অভেদ্য গম্ভীরতা,

— না আমি খুশি হব না।
সেই উচ্চারণ ছিলো শীতল, কঠিন, তবু তার অন্তর অজান্তেই কেঁপে উঠেছিল। একটি প্রশ্ন যা তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। একটি সত্য, যা তার ভেতরের অন্ধকারে একটি তীব্র আলো ফেলেছিল। ইয়ানা অবাক আর নিষ্পলকভাবে নিষ্ঠুর ব্যক্তিটার দিকে তাকায়। হৃদয়হীন ব্যক্তিটা এত সহজে আন্সার দিয়ে দিলো।
— আপনি নিজের অস্তিত্বকে দেখতে চান না?
— না।
অগ্নির কণ্ঠ নিঃসঙ্গ অথচ নির্ভুল। তার উত্তর ছিল একরৈখিক, যুক্তিহীন আত্মবিশ্বাসে আবদ্ধ।
– যদি কখনো ভুলে চলে আসে?
— আসবে না।
— এতটা আত্নবিশ্বাস?
— আসার কোনো চান্স রাখি নি। তাহলে আসবে কোথা থেকে?
— যদি চলে ও আসে তাহলে কি মুখ ফিরিয়ে নিবেন নিষ্ঠুর পিতার মত? নাকি আমাকে শাস্তির কাঠগড়ায় দাড়া করাবেন?

ইয়ানার প্রশ্নগুলো ছিল একেকটি সূক্ষ্ম বিষদংশনের মতো। যা অগ্নির কঠিন অবয়বের অন্তরস্তলে অদৃশ্য ফাটল সৃষ্টি করছিল। অগ্নি শীতল আর সন্দিহান দৃষ্টিতে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালে কুচকে থাকা সুক্ষ্ণ ভাঁজ। অগ্নির দৃষ্টি দেখে ইয়ানা চুপসে যায়। অগ্নি এক পলক কাগজটার দিকে তাকিয়ে ইয়ানার চুপসানো মুখটার দিকে তাকায়। দাঁতে দাঁত পিষে উঠে। তারপর বিনা সংকোচে কিন্তু চোয়ালের পেশিতে দমনযোগ্য রাগ টেনে দাঁত চেপে কাগজটি ইয়ানার হাত থেকে অবরুদ্ধ ক্ষোভে ছিনিয়ে নেয়।
কাগজের ভাঁজ খুলতে খুলতে বলেন,
” কি করেছো তুমি ইয়ানা? এমন কিছু হলে আমি তোমাকে….
আর বলতে পারি নি। কাগজে ইংলিশ শব্দগুলো ঝলঝল করছে। অগ্নির হাতের আঙুল কাঁপছিল।
রিপোর্টের মাঝে লাল হরফে লেখা,

“Positive for Pregnancy”
স্বামীর নাম লিখা অগ্নি চৌধুরি।
তার বুকের গভীরে এক অজানা কাঁপুনি দিয়ে উঠে।
এক মুহূর্তে তার হৃদয়ের গভীরে অজ্ঞাত বিস্ফোরণ হয়। একটা চাপা গর্জন উঠে আসে ভিতর থেকে। যা মুখ দিয়ে বেরোয় না। কিন্তু রক্তে, স্নায়ুতে, আর চোখের মণিতে প্রলয় ঘটায়। মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ টগবগ করে উঠে।পালিত যুক্তিবোধ ভেঙে পড়ে অপ্রতিরোধ্য এক পুরুষ ক্রোধে। ইয়ানা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। চোখ – মুখ খিঁচে অগ্নির শার্টের এক অংশ শক্ত করে চেপে ধরে। অগ্নি ইয়ানার আতঙ্কিত মুখটা দেখে আরও রেগে যায়। আকস্মিকভাবে তার দুই বাহুতে ইয়ানাকে আবদ্ধ করে। একদম কাঁপানো শক্তি নিয়ে চেপে ধরে তার সরল কোমল দেহকে।
ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে মেয়েটি।কিন্তু মুখে উচ্চারিত হয় না কোনো আর্তনাদ। শুধু নিঃশ্বাসের মাঝে ফুটে ওঠে নিঃশব্দ কষ্ট।অগ্নি তার মুখে চোখ রাখে তার আবেগ-জর্জরিত চাহনিতে বিশুদ্ধ আঘাতের রং।
অগ্নি ইয়ানার পুরো মুখে চোখ বুলিয়ে শক্ত কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে,

” কেনো করলে এইটা? সব ধরনের প্রোটেকশন দেওয়ার পরও আমার অবাধ্য কেনো হলে? কেনো করলে ইয়ানা? কেনো?
অগ্নির কণ্ঠে ছিলো না শুধু রাগ। ছিল এক ধরনের আহত পুরুষ অহং। যে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আর সে নিয়ন্ত্রণের উৎসে দাঁড়িয়ে ছিলো এক টুকরো ভালোবাসা নামক অনিশ্চয়তা।
অগ্নির কঠিন গম্ভীরতা নিয়ে প্রতিটি বাক্য ইয়ানাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে তুলে। তার হৃদয়ের পরিধিতে যে অস্পষ্ট কম্পন ছড়িয়ে পড়েছিল তা ছিল না নিছক ভয়ের প্রতিচ্ছবি। বরং ছিল এক অনুচ্চারিমর্ম বেদনার, পরিণতি-বিবর্জিত প্রেমের, আর মাতৃত্বের অলৌকিক বোধের অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ।
ইয়ানা আগে থেকেই জানত অগ্নি রেগে যাবে।
অগ্নির মনোজগত সুস্থ, স্নিগ্ধ বা মানবিক ধারায় প্রবাহিত হয় না। সে এমন এক সত্তা, যার অর্গলবদ্ধ আত্মা কেবল ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মমতার পরিমণ্ডলে দোল খায়।

তবু, সেই ভয়ংকর বাস্তবতার মাঝেও সে বিশ্বাস করেছিল একবার, অন্তত একবার, এই সন্তান সম্ভাবনার সংবাদ হয়তো সেই হৃদয়ের পাষাণ আবরণে সূক্ষ্ম চিড় ধরাতে পারবে।
তাঁর দুই ওষ্ঠের কাঁপন, দৃষ্টির নির্লিপ্ততা, কপালের তীব্র ভ্রুকুটি সবকিছু মিলিয়ে সৃষ্টি করছিল এমন এক পরিবেশ, যেখানে মাতৃত্বের কোমলতা দমিত হচ্ছিল পুরুষতান্ত্রিক অভিমান ও সংশয়ের কঠিন অভিঘাতে।
তার অন্তঃকরণে দোল খাচ্ছিল এক জটিল অনুকম্পা। সে শুধু নারী নয়।সে এখন জননী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
ইয়ানার হৃদয় স্পন্দিত হয়। কিন্তু বিন্দুমাত্র আনন্দে নয় বরং প্রতিটি ধ্বনি ছিল দোটানায়,
“এই সংবাদ আপনি গ্রহণ করবেন নাকি ঘৃণার বিষে ভরিয়ে দেবেন আমাকে? একটা ছোট অগ্নি চৌধুরি আসলে কি এমন ক্ষতি হবে? পারবেন না সব কিছু দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে আগলে রাখতে? মাফিয়া বস তো কখনো ভয় পায় না। তাহলে আজ কেনো ভয় পাচ্ছেন?

ইয়ানার কম্পনত কন্ঠ অগ্নির চোখের সেই ক্ষিপ্র বিদ্যুৎপাতে তার ভেতরের সাহস শুষে নেয়া হয়।
সে চুপসে যায়। ঠিক যেন আগুনের মুখোমুখি হওয়া এক ক্ষীণ প্রদীপ। অগ্নি নিশ্বাস টানে। ইয়ানাকে নিজের সাথে আবারও চেপে ধরে। ইয়ানার গলার কাছে কিছুক্ষন মুখ নিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
” প্রয়োজন ছিলো না আমার কাউকে? চাই নি কোনো বাচ্চা। যদি বলো নিজের অস্তিত্বকে আগলে রাখা, সেটা তো পরের ঘটনা । কিন্তু বর্তমানে তোমার প্রসব ব্যাথা কিভাবে সহ্য করব? সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই বউ । তোমার এক একটা চিৎকার হয়ত আমাকে শেষ করে দিবে। প্লিজ ইয়ানা মুছে ফেলো অস্তিত্বকে। ট্রাস্ট মি কিছু হবে না। তুমি তো চাইতে না আমার অস্তিত্ব তোমার গর্ভে আসুক। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি … আমি….

অগ্নির এমন কথায় আসস্মিক ইয়ানা স্তব্দ হয়ে যায়। অজানা রাগ চেপে বসে মাথায়। অগ্নির কলার চেপে ধরে । কেঁদে দেওয়ার মত ভাব তবুও মনকে শক্ত করে বলে,
” খবরদার যদি অপ্রত্যাশিত কোনো কথা বলেন? নিজের সাথে করা সব বর্বরতা সহ্য করেছি। এই নিয়ে কোনো বর্বরতা করলে খুন করব আপনাকে। ঠিক আছে চান না তো কোনো সন্তান? চাইতে হবে না। আমি চলে যাবে আপনার কাছ থেকে। ঠিক ততটুকু দুরে যাব যাতে আপনি আমার প্রসব চিৎকার শুনতে না পান। যাতে দেখতে না পারেন সন্তানের মুখ। আমি ওকে একাই দুনিয়ায় আনব। বাবা – মা দুটিই আমি’ই হব।ঠিক এমন এক দুনিয়ায় যাব যেখানে কোনো অন্ধকার ছায়া স্পর্শ করতে পারবে না। পাষন্ড মানুষ……

ইয়ানা আর নিজের বাক্যটা শেষ করতে পারল না। বাক্য শেষ করার আগেই বেপোরোয়া থাবার সম্মুখীন হতে হয় মাফিয়া বসের। ইয়ানারর কন্ঠনালী চেপে ধরে। অগ্নির কঠিন স্পর্শে থরথরিয়ে কম্পমান হয়ে উঠে ছোট- খাটো শরীরটা। অগ্নি চিবুক ধরে এক হাতে পিছন দিকে ইয়ানার চুল শক্ত করে চেপে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসে। অগ্নির এমন প্রগাঢ় ক্ষুব্দতায় মুখোমুখি হতেই আতঙ্কে ধরফরিয়ে উঠে মেয়েটা। গ্রীবাদেশ বাঁকালো অগ্নি, মুখের সন্নিকটে মুখ নিয়ে এসে রাগে কম্পমান হয়ে বলে,

” এই আল্লাহির বান্দি এত সাহস আসে কোথা থেকে তর? ভয় লাগে না আমাকে? এইসব কথা মুখে উচ্চারন করার আগে মনে হয় না যদি জিহ্বা কেটে ফেলে? বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবি তুই? আমার অস্তিত্বকে নিয়ে কোথায় যাওয়ার ধান্দা করছিস, ধান্দাবাজ নারী? ও আমা অংশ থেকে তৈরি হয়েছে। আমার অস্তিত্ব ও, অগ্নি চৌধুরির সন্তান। একজন আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়া বসের প্রথম সন্তান সে । তাকে দুরে সরানোর কথা চিন্তা করলে জান নিয়ে আসব। আই রিপিট জান নিয়ে আসব।
অগ্নির প্রতিটি শব্দ বিদ্যুৎ চমকের মত ইয়ানার শিরায় শিরায় প্রবেশ করে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেয় মানসিক বুনন। তার চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে আসে, অগ্নির রক্তমাখা কন্ঠে উচ্চারিত শব্দগুলো শুনে।
ইয়ানার পিঠে ঠেকানো অগ্নির বুকের উত্তাপ তাকে তাপ দিচ্ছে না—জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অগ্নি নিঃশ্বাস ফেলছে ধীরে, তবুও ফুসফুস যেন অক্সিজেন গ্রহণে অক্ষম কণ্ঠনালীতে আটকে আছে এক পাঁপড়ি ছেঁড়ার শব্দ।
ইয়ানা চোখে বন্ধ করে অগ্নির গলার স্পন্দন অনুভব করতে পারছে—তা হৃদয়ের স্পন্দনের চেয়ে ভীতিকর। ইয়ানার ঠোঁটের কোণে খেলে যায় বিশ্বজয়ের হাসি। চোখে পানি নিয়ে শব্দ করে হেসে বলে,

” আপনি হেরে গেছেন অগ্নি চৌধুরি। লোকাতে পারেন নি সন্তানের প্রতি আপনার মমতা, আপনার ভালোবাসা। আপনি তো আমার থেকেও বেশি উন্মাদ। নাম মাত্র বলেছিলাম স্যার আমি আপনার থেকে দুরে যাব কিন্তু আপনি তো উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। এরপর ও বলবেন আপনি বাচ্চা চান না? আপনি বাবা হতে চান না?
অগ্নি ইয়ানার চুল ছেড়ে দেয়। হাতের দৃঢ়তা নরম করে তোলে। সামান্য নিস্তব্দ হয়ে থাকে কিছুক্ষন। ধীরে ধীরে নিজের এক হাতে দিয়ে ইয়ানার জামা উপরে তুলে পেটে হাত রাখে। এইভাবে হঠাৎ হাত রাখাতে ইয়ানা শিউরে উঠে। অগ্নি নিরবভাবে শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে হালকা স্পর্শ করে যাচ্ছে। ইয়ানা লাজুকতা নিয়ে মৃদু কম্পিত হয়ে বলে,

” কি.. কি করছেন?
অগ্নি ইয়ানার দিকে এক পলক তাকায়। চোখে চোখে আলিঙ্গন হয় দুজনের। এরপর আচমকা কোলে তোলে নেয়। ইয়ানা অবাক হয়ে অগ্নির মুখের দিকে তাকায়। লাজুক মেয়েটি কাঁপা হাতে গলা জড়িয়ে ধরে। সে ইয়ানাকে নিয়ে একটা ডিভানের উপর হালকা ভাবে শুইয়ে দেয়। অন্য সময় হলে হয়ত মাফিয়া বস ছুঁড়ে ফেলত। ইয়ানা একই পলকহীনবে তাকিয়ে অগ্নির অনুভুতি পরখ করছে। অগ্নি ইয়ানার জামাটাকে উপরে তুলে উন্মুক্ত পেটে হালকা নিজের মুখ চেপে ধরে। কোনো এক অজানা জাদুতে তার পুরো শরীর কম্পমান হয়ে যায়। কারোর স্পর্শ, কারোর ভয়ে হয়ত তাকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে নি কিন্তু আজ মাফিয়া বস একজন বাচ্চার আগমন অনুভব করে কেঁপে উঠছে। তার শক্ত হৃদয়টাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে এক টুকরো মাংস- পিন্ড। অগ্নি পেটে কয়েকটা চুমু খায়।
সে খুব কষ্টে কয়েকটা শব্দ উচ্চারন করে,

” আমার অস্তিত্ব.. আমার সন্তান।
ইয়ানা তৃপ্তি নিয়ে হাসে। অগ্নি নিজের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে অজস্র চুমু খেতে থাকে। কিন্তু এখন আগেরকার মত শক্ত চুমু নয় একদম নরমভাবে। শক্তভাবে খেলে মাফিয়া বসের সন্তানের যদি ব্যাথা লেগে যায়। অগ্নি আবেগপ্লুত হয়ে নিজের অপ্রকাশিত ভালোবাসা,প্রকাশ করছে কিন্তু এইদিকে ইয়ানার নাজেহাল অবস্থা। লাজুকতায় ঘিরে থাকা মেয়েটা অগ্নির স্পর্শে সিটিয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলে,
” প..প্লিজ! বাচ্চা কোলে নিয়ে ইচ্ছেমত চুমু খেয়ে নিয়েন এখন আমাকে ছেড়ে দিন।
অগ্নি মুখ তোলে । এরপর ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি ফুটিয়ে ইয়ানার জামা ঠিক করে দেয়। ইয়ানাকে তুলে নিজের সাথে মিশিয়ে বলে,

” টেস্ট করার জন্য না জানিয়ে গিয়েছিলে?
— হুম।
— আমাকে বললে কি হত?
— সার্প্রাইজ ছিলো এইটা আপনার জন্য।
— ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
— হুম।
— ছেলে ডাক্তার নাকি মেয়ে ডাক্তার?
অগ্নির প্রশ্নে ইয়ানা ফুঁশ করে নিশ্বাস ছাড়ে। এই লোকের আগে যদি মরি তাহলে ভুলেও কোনো পুরুষকে খাটিয়া তুলতে দিবে না। নিজেও বহন করতে পারবে না। আল্লাহ যাতে একজন ছেলে দান করে। অন্তত খাটিয়া বহন করার জন্য হলেও।

— মেয়ে ছিলো।
— গুড জব। ডাক্তার কি বলেছে? মেয়ে বাবু হবে নাকি ছেলে বাবু হবে?
অগ্নির এহেন প্রশ্নে ইয়ানা তাজ্জব বনে যায়। অবাক হয়ে তাকায় অগ্নির দিকে। অগ্নি সরল ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইয়ানা ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,
“” উত্তেজনার জন্য কি আপনার মস্তিষ্ক বিলুপ্ত হয়েছে অগ্নি চৌধরি। মাত্র চার সপ্তাহ হয়েছে প্রেগনেন্সির। চার সপ্তাহের ভ্রুঁণ কে জিজ্ঞাসা করছেন এইটা ছেলে নাকি মেয়ে? লাইক সিরিয়াসলি! এইটার তো এখনও কিছুই সৃষ্টি হয় নি। ০.১ ক্ষুদ্র একটা বীজের মত। আর আপনি…. ইয়ানা হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে।
অগ্নি থতমত খেয়ে সামান্য কেঁশে উঠে। এরপর কথা পালটিয়ে বলে,

” বাচ্চা কনসিভ করেছো মেনে নিয়েছি। বাট এখন থেকে তোমার এই রুম থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ। যখন যা প্রয়োজন আমাকে বলবে। ভুলেও যাতে দরজার বাহিরে পা রাখতে না দেখি। তোমার সব অবাধ্যভাব তা রেগে গিয়েও হজম করে। কিন্তু ধৈর্য হারা হয়ে গেলে তার সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই ইয়ানা।
ইয়ানা নিশ্চুপে অগ্নির কথা শুনে। আগেই জানা ছিলো এমন কিছুই বলবে। তাই তেমন কোনো রিয়্যাক্ট করে নি। শুধু গম্ভীরতা নিয়ে সম্মতি জানায়।

— আপনাকে লোকে এত ভয় পায় কেনো? আপনার নাম দেখে ডাক্তার চিনে ফেলেছেন। অনেক ভয়ে ভয়ে রক্ত নিয়েছে। কতটুকু ভয় ডুকিয়ে রেখেছেন মানুষের মনে সেটা আজ নিজ চোখে দেখে আসলাম।
— সবাই ভয় পেলে কি হবে। তুমি তো তিল পরিমান ভয় ও পাও না।
— আমি গ্যাংস্টার বসের এক মাত্র ওয়াইফ। অগ্নি চৌধুরির বউ মিসেস ইয়ানা চৌধুরি। তার অনাগত সন্তানের মা। এত কিছুর সম্পর্ক আপনার সাথে আমার। ভয় পেতে যাব কোন দুঃখে।
অগ্নি স্বভাব সুলভ ঠোঁট কামড়ে হাস। ইয়ানার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
” আর সেই মাফিয়া বসের বাধ্য বউ হওয়ার চেষ্টা করো।

সন্ধ্যার ধূসর অনুভবের এক স্নিগ্ধ-দহন। পশ্চিম আকাশে সূর্যের ক্লান্ত আলোরা নৈঃশব্দ্যের অগ্নিপতাকা হয়ে পতপত করে জ্বলছিল। চারপাশের প্রকৃতি তখন রাত্রির ছায়া-চাদরে ঢেকে পড়ার পূর্বপ্রস্তুতিতে নিমগ্ন। বাতাসে মিশে থাকা কাকের কর্কশ কণ্ঠ যেন বিদায়ী দিনের আর্তনাদ করে তুলছিল।
আলো ও অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে, সূর্য-দীপ্ত দিগন্ত ধীরে ধীরে গাঢ় কমলা থেকে রক্তিম হয়ে শোকাবিষ্ট সন্ন্যাসীর আবরণে ঢলে পড়ে। সন্ধ্যাবেলার নিঃশব্দতা যেন হৃদয়কে ছুঁয়ে দেওয়া এক অদৃশ্য অঙ্গুলির মতো। পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে যে নীরব বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল তার মাঝে ছিল এক অব্যক্ত ভাষা।

নগরের পাথুরে পথ ধরে রিক্তভাষী বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে। দূরের গলি থেকে ভেসে আসা আজান, কাকের কলরব, আর দূরবর্তী গাড়ির হর্ণ মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর সৃষ্টি করেছিল। গৃহের জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছিল অন্তর্গত আলোর মায়া। সেই আলোয় কেউ দাঁড়িয়ে ছিল কি না বোঝা যাচ্ছিল না। হয়তো ছিল হয়তো কোনো এক অভিমানী আত্মা, যে সন্ধ্যার অন্ধকারে আলো খুঁজছিল। সবাই ডিভানে বসে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আর বার বার চোখ তুলে উপরে তাকাচ্ছে। রায়ান কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলে,

” কি ব্যাপার বলতো? অনেকক্ষন হয়েছে ইয়ানা গিয়েছে কিন্তু এখনও কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
অরিদ — টেনশন হচ্ছে। নির্ঘাত বউমনির উপর দিয়ে টর্নেডো যাচ্ছে।
রায়ান বুক সোজা করে বলে,
” এইসব টর্নেডো সহ্য করার অভ্যাস তর বউমনির আছে অরিদ। হার্টল্যাসের থাবায় পরে বেচারীকে ডাক্তার দেখাতে হয়। ভাই জানিস তর হার্ড রোমান্স মেয়েটা সহ্য করতে পারে না জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। একটু সদয় দেখিয়ে অন্তত একটু নরম হতে পারিস কিন্তু হিটলারটা নিজের কাজে একদম পরিপক্ক।
রায়ানের কথায় সবাই থতমত খেয়ে যায়। সুমু আর মিরা লজ্জায় পড়ে যায়। সুমু রাগান্বিত চোখে তাকায় রায়ানের দিকে। রায়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আরাম করে বসে। রুয়ানা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে। ইউভি রুয়ানার দিকে এক পলক তাকিয়ে ইউভির উদ্দেশ্যে বলে,

” আমার বউটা এখানে বসে আছে কথা সামলিয়ে বলিস।
— কেনো? তরা রোমান্স করিস নি?
ইউভি চোখ পাকিয়ে বলে,
” হাটুর বয়সী মেয়েকে ভালোবাসলে বুঝতে ঠেলা কাকে বলে? এখন আপাযত এইসব কথা বলিস না ওর সামনে। রুমে গিয়ে প্রশ্ন করতে করতে ও ক্লান্ত হয়ে যায় বাট আমি উত্তর খুঁজে পায় না।
রায়ান ঠোঁট চেপে হাসে। ঠিক তখন ওই রুয়ানার প্রশ্ন ভেসে আসে,
‘ রোমান্স করে ভাইয়া আপুকে অজ্ঞান বানিয়ে দিয়েছে। এইটা কিভাবে সম্ভব! অজ্ঞান হতে যাবে কেনো? সামান্য চুমু খেলে কেউ অজ্ঞান হয়ে যায় নাকি?

ইউভি পানিটা যাস্ট মুখে দিয়েছিলো। রুয়ানার প্রশ্ন শুনে মুখ থেকে পানি ছিটকে পড়ে। কেঁশে উঠে বেচারা । রায়ান ভোঁতা মুখে ইউভির দিকে তাকিয়ে পিঠ ঘেষে দেয়। ইউভি রায়ানের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বলে,
” আজ যদি ওর প্রশ্নে আমি পাগল হয় তাহলে তর মাথা ফাটাব রায়ান। কিসব প্রশ্ন করছে বলতো?
ইউভি রায়ানের কাছ থেকে উঠে গিয়ে রুয়ানার কাছে বসে। রুয়ানা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইউভির দিকে। সুমু আর মিরা থতমত হয়ে বসে আছে। না পারছে উঠতে আর না পারছে বসে থাকতে। সবগুলোর লাগামহীন কথায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ইউভি রুয়ানার কাছে স্বাভাবিক ভাবে বসে নিম্ন আওয়াজে প্রশ্ন করে,
” তুমি কিভবে জানো চুমু খাওয়াকে রোমান্স বলে?
রুয়ানা এক গাল হেসে বলে,

” ওইদিন আপনি আমাকে চুমু দিয়ে নিজেই তো বলেছেন এইটা স্বামী – স্ত্রীর রোমান্স। কিন্ত কথা হচ্ছে আপু সামান্য চুমুতে অজ্ঞান হয়ে যায় কেনো? আপু…
রুয়ানা কথাটা শেষ করতে পারে না। ইউভি দ্রুত রুয়ানার মুখ চেপে ধরে নাক- মুখ কুচকে ফেলে। রায়ান কেঁশে বলে,
” তর তাহলে চুমুগত ভার্জিনিটি নষ্ট হয়ে গেছে? বাহহ প্রচুর ফার্স্ট । সবচেয়ে বড় কপাল পোড়া তাহলে আমি ওই ছিলাম। বউ কাছেই ঘেষতে দেয় নি।
অরিদ — তোমার সাথে আমি ও আছি ভাইয়া।
সুমু – মিরা সহ্য করতে না পেরে কাজের কথা বলে কিচেনের দিকে চলে যায়। এখানে আর এক মুহূর্তে থাকা যাবে না। কখন জানি তাদের ইজ্জত নিয়ে টানা – টানি শুরু হয়। যেখানে নির্লজ্জ ভাল্লুকেরা থাকবে সেখানে লজ্জা টানা- টানি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ইউভি আড়ালে রুয়ানাকে সামান্য রাগ দেখিয়ে বলে,

” রুই আর একটা প্রশ্ন ও যাতে করতে না দেখি। আগে যেভাবে সবার কথা শুনেও চুপচাপ থাকতে এখন সেভাবেই থাকবে।
— আগে তো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত মানুষ ছিলো না কিন্তু এখন তো আছে। তাই প্রশ্ন করি।
— কে আছে?
— আপনি।
— না, আমি ও নেই। প্রশ্ন করবে ভালো তবে এইসব বিষয়ে যাতে আর সবার সামনে কথা বলতে না দেখি। বুঝেছো আমার কথা? এখন এখানে বসে থাকো চুপচাপ।
— হুম।
ইউভি আলতো হাসে। এই মেয়েটার বাচ্চামোগুলো তাকে চুম্বকের মত টানে। কতটা মায়া কাজ করে অবাধ্য মনটার ও হয়ত জানা নেই।

তাদের আড্ডার মধ্যে হুট করে চোখ যায় সিঁড়ির দিকে। সবার কথা অফ হয়ে যায়। অগ্নির শরীরে নরমাল ড্রেস তার মানে আজ কাজে যাবে না? ইউভি- রায়ান অবাক হয়ে একে – অপরের দিকে তাকায়। অগ্নি কাজে যাবে না অসম্ভব ব্যাপার। এই প্রথম এমন দেখছে তারা। অগ্নি ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সবার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্যান্টের পকেটে হাত ডুকিয়ে গম্ভীরতা নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকে ফেলেন। রায়ান কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বলে,

” কিছু করেছিস মেয়েটাকে? ইয়ানা কোথায়?
— রুমে । অগ্নির সোজা উত্তর।
— রুমে কি করছে? নিয়ে আয় এখানে?
— না আসবে না। রুম থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ।
— লাইক সিরিয়াসলি অগ্নি? বাহিরে গিয়েছে বলে তুই মেয়েটাকে রুম বন্ধী করে রাখবিব? এতটা সাইকো না হলেও পারতি।
— ভালো ছিলাম কবে আমি। তাছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামলে বেবির সমস্যা হবে। ওর ব্যালেন্স নেই যেকোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলব। নিরাপদে থাকা ভালো।
“বেবির সমস্যা হবে ” কথাটা সবার মাথায় বিদ্যুৎ – ঝটকার মত বারি খায়। তার মানে ইয়ানা….
ইউভি খুশিতে আত্নহারা হয়ে বলে,
” তার মানে ভাইয়া আমি চাচ্চু হব?
অগ্নির গম্ভীর উত্তর….
” হুম।
রুয়ানা বিষয়টা বুঝতে পেরেই চেঁচিয়ে উঠে,

” আমি খালামনি হচ্ছি। একটা পুঁচকো আসবে আমার কোলে। ভাবতেই কি খুশি লাগছে।
ইউভি তারা রুয়ানার দিকে তাকিয়ে খুশির হাসি দেয়। রুয়ানার চেঁচানো শব্দ মিরা – সুমু শুনতে পেয়ে কিচেন থেকে বের হয়ে আসে। খুশির খবরে একেক জন খুশিতে আত্নহারা। কিন্ত মাফিয়া বসের মুখের কোনো রিয়্যাকশন নেই। সবসময়কার মত গম্ভীর একজন ব্যাক্তি।
রায়ান অগ্নির কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,

” অজ্ঞান করে ফেলার বিষয়টা তাহলে এতদিন পর কাজে আসলো।
অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হালকা হাসে।
মিরা খুশিতে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে এসে সবাইকে দিয়ে বলে,
” আমি খালামনি হব ভাবতেই আলাদা ফিল আসছে।
অরিদ ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,
” খালামনি হতে যাবে কোন দুঃখে? চাচি হবে তুমি।

— জি না প্রথম সম্পর্ক সবসময় গুরুত্বপূর্ন থাকে। চাচি হওয়ার আগে আমি খালামনি হব।
— আমার ভাস্তি তোমাকে খালামনি ডাকবে না ওকে। কারন আমি ডাকতে দেব না। সে তোমাকে চাচি ডাকবে এন্ড এইটাই আমি শিখাব।
মিরা কটমট করে তাকায় অরিদের দিকে। অরিদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মিষ্টি খেতে থাকে। অগ্নি গম্ভীরতা নিয়ে অরিদ, রায়ান আর ইউভিকে মেসেজ দিয়ে বলে,
” এই সংবাদ যাতে বাহিরে প্রচার না হয়। আর কেনো বারন করছি আশা করি খুলে বলতে হবে না।
অগ্নির মেসেজটি পড়ে তারা গভীর নিশ্বাস ছাড়ে। রুয়ানা কিচেনে মিষ্টির পেকেট রেখে আসতে যাবে হুট করে কোনো ধারালো জিনিসের সাথে লেগে পা কেটে যায়। অতিরিক্ত খুশির কারনে হাটতে গিয়ে খেয়াল করে নি। রুয়ানা পায়ে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে সাথে সাথে বসে পড়ে। রুয়ানার চিৎকার শুনে সবাই দ্রুত সেখানে যায়। অগ্নি নির্বিকারভাবে ডিভানে বসে হালকা ঘার ঘুরিয়ে কিচেনের দিকে তাকায়।
ইউভি রুয়ানার পায়ের কাছে বসে প্লাজুটাকে সামান্য তুলে। রক্ত বের হচ্ছে দেখে সুমুকে আদেশ দিয়ে বলে,

” ফার্স্টেড বক্সটা নিয়ে আসো দ্রুত।
ইউভি রুয়ানাকে পাজা কোলে তুলে কিচেন থেকে নিয়ে এসে ডিভানে বসিয়ে দেয়। এরপর মৃদু ধমক দিয়ে বলে,
” চলাচল করার সময় মনযোগ কোথায় থাকে তোমার ইডিয়েট। দেখে হাটতে পারো নি? সব কিছুর মধ্যে উগ্র ভাব। কেনো, তোমার মত মেয়েরা সংসার করছে না? তোমার মধ্যে এখনও এত বাচ্চামো কেনো? কতটুকু রক্ত বের হচ্ছে এইটুকু শরীর থেকে
— আহহ ইউভি , মেয়েটাকে ধমকাচ্ছিস কেনো? ইচ্ছে করে ব্যাথা পেয়েছে নাকি? যাস্ট এক্সিডেন্ট।
ইউভির পর পর ধমকে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় মেয়েটা। ব্যাথা পেয়েও কাঁদে নি কিন্তু ইউভির এমন শক্ত কথায় ছোট মনে কষ্টের পাহাড় জমে উঠে। অভিমানে হৃদয় ভারী হয়ে উঠে। রুয়ানা কান্না আটকিয়ে রাখে। নিরবে চোখের পানি ফেলে তবুও শব্দ করে না। ইউভি সযত্নে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলে,

” ব্যাথা লাগছে এখনও?
রুয়ানা নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কোনো শব্দ বা কথা নেই। রুয়ানার উত্তর শুনতে না পেয়ে ইউভি পা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মুখের দিকে তাকায়। রুয়ানার মুখ স্বাভাবিক হয়ে আছে কিন্তু ঠোঁট কাঁপছে। রুয়ানার অবস্থা দেখে এতক্ষনে ইউভির মস্তিষ্ক টনক নড়ে। রাগের মাথায় কতগুলো ধমক দিয়েছে সে মেয়েটাকে।
রুয়ানাকে চিৎকার করতে দেখে মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তাই তো অজান্তেই সামান্য ধমক দিয়ে দিয়েছিলো। ইশ কতগুলো কথা বলেছে সে তার ছোট পাখিটাকে। ইউভি অপরাধীর মত তাকিয়ে মমতাময় কন্ঠে ডাক দেয়,,

‘ রুই।
রুয়ানা সে ডাককে উপেক্ষা করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
” তোমরা তাহলে থাকো আমি রুমে যায়। একটু পর আপুর সাথে দেখা করে আসব।
মিরা — তুই যেতে পারবি একা? চল আমি দিয়ে আসি।
— তেমন আঘাত লাগে নি আপু যে হাটত পারব না। সামান্য ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তাই বলে মরে যাব না।
রুয়ানার কথা শুনে ইউভি চট করে মাথা তুলে তাকায়। হৃদয়ে একটা তীব্র ধাক্কা দিয়ে যায় বাক্যটা। এতটা অভিমানী এই মেয়ে?
রুয়ানা সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে। ইউভি কিছুক্ষন নিষ্পলক তাকিয়ে ‘ আমি আসছি ” বলে সেও উপরে চলে যায়। রুমে ডুকে দেখে রুয়ানা হাটুর মধ্যে মুখ ডুকিয়ে রেখেছে ছোট শরীরটা কেঁপে উঠছে বার বার। কান্না যে করছে সেটা স্পষ্ট। ইউভি গভীর নিশ্বাস ছেডে রুয়ানার পাশে গিয়ে বসে। অনুমতি ছাড়া কাঁধে হাত রেখে নিম্ন আওয়াজে বলে,

” লিটল গার্ল। সরি! প্লিজ কান্না থামাও। সত্যি বলছি ইচ্ছে করে বলি নি এত কিছু।
রুয়ানা অভিমানে সরে আসে। নাক টেনে বলে,
” বিশ্বাস করুন ইচ্ছে করে আমি কিছু করি না যা আপনাদের কাছে বাচ্চামো লাগে। আপনি বলেছেন না যে আমার মত মেয়েরা সংসার করছে আমার এত উগ্র ভাব কেনো? আমাকে ওদের কাছে নিয়ে যাবেন?আমি ও শিখে সংসারী হতে চাই। তখন আপনাকে আমার এতকিছু সহ্য করতে হবে না। আমি ও সবার মত হয়ে যাব। বিশ্বাস করুন আমি এইসব বিষয় নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায় নি। তাই সে সম্পর্কে ধারনা নেই। আম্মু আপু কখনো শিখাই নি। বাহিরের জগত থেকে আব্বু আলাদা করে রাখত। আম্মু না শিখিয়েই আমাকে রেখে চলে গেছে। আজ যদি বেঁচে থাকত তাহলে আমি ও সব শিক্ষা গ্রহন করতে পারতাম। তখন কেউ নালিশ করার সুযোগ পেত না । আমি….
রুয়ানা কথা বলতে বলতে হেচকি তুলে ফেলে। কথা বলতে পারছে না গলায় আটকে আসছে। ইউভি আচমকা রুয়ানাকে নিজের বুকে চেপে ধরে,
” সরি পাখি, খুব করে সরি।, কিছু শিখতে হবে না তোমাকে। বর্তমান তুমিটাকেই আমি জীবনের চেয়েও বেশি ভালো বাসি। কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। আর কখনো বকব না। প্লিজ আর কান্না, অভিমান করে থেকো না। আমার হৃদয়ে ব্যাথা হচ্ছে।
রুয়ানা ইউভির বুকে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে। রুয়ানাকে চুপ থাকতে দেখে ইউভি মাথা চুমু খেয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখে। রুয়ানাও বিড়াল ছানার মত শক্ত- পোক্ত দেহের সাথে মিশে থাকে।

রজনীর অপার স্তব্ধতা যখন ধীরে ধীরে নগরের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে অন্তর্জগতের গহনতম গহ্বরে সঞ্চারিত হয় তখন চতুর্দিকের দৃশ্যপট এক রহস্যময় বিষাদে মোড়ানো মঞ্চে পরিণত হয়। রাতের কালোত্ব নিছক রঙ। পৃথিবীর সমস্ত শব্দ যেন কিয়ৎক্ষণের জন্য আত্মগোপনে গেছে।বাতাস থমকে আছে, চাঁদ মেঘে মুখ লুকিয়ে আছে। গৃহস্থের উঠোনে স্নায়বিক সন্ত্রস্ততায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষটিও কাঁপতে কাঁপতে স্তব্ধ হয়ে আছে। জোনাকির ক্ষীণ জ্যোতিষ্মানতায় পথপ্রান্তর অলক্ষ্য হাহাকারে বিলীন হয়ে যায়। আর দূরবর্তী অরণ্যে কুকুরের কণ্ঠনিনাদ যেন এক মৃতপ্রায় আবেগের চিৎকার।

এই নিঃশব্দতা কোনো দৈহিক অভাব নয়, বরং এক গভীর মানসিক শব্দ। যার প্রতিধ্বনি হৃদয়ের প্রতিটি কুঠুরিতে ধাক্কা মারে। মানবমনের যত অপ্রকাশিত অভিপ্রায়, অবদমন, অপ্রাপ্তি সব যেন এই রজনীর আঁধারে কণ্ঠস্বর পায়।
এমন রাত্রিতে, হঠাৎ করে খুলে পড়ে আরেক কাহিনী। অগ্নি ল্যাপটপের কাজ শেষে রুমে ডুকে ইয়ানাকে দেখতে না পেয়ে ওয়াশরুমের দিকে তাকায়। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ দেখে ল্যাপটপ রেখে বিছানায় এক পাশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষন পর ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ পেয়ে সেদিকে তাকায়। সেদিকে তাকাতেই স্তব্দ হয়ে যায়। নিজের চোখের সাথে যুদ্ধ করে চোখ সরিয়ে নেয়। ইয়ানা একটা টাওয়েল পেচিয়ে রেখেছে বুক থেকে হাটু অব্দি। অগ্নির অবস্থা দেখে ইয়ানা ঠোঁট চেপে হাসে। মনে মনে আওড়ায়,

” আজ আপনাকে জ্বালিয়ে মারব মাফিয়া বস। আপনি দেখবেন, জ্বলবেন কিন্তু কিছু করতে পারবেন না। এত দিন পর আপনাকে ঘায়েল করার একটা সুযোগ পেয়েছি হাত ছাড়া কিভাবে করি বলুন?
ইয়ানা কথাগুলো মনে আওড়াচ্ছে আর পুরো রুমে এদিক থেকে সেদিক হাটা- হাটি করছে। লজ্জায় সে নিজেই মরে যাওয়ার অবস্থা এরপরও নিজের কাজে অটুট। অগ্নি গভীর গলায় বলে,
” ড্রেস পড়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
— ঘুম আসছে না।
— না আসুক এরপর ও শুয়ে থাকো।

ইয়ানা বাঁকা হেসে অগ্নির কাছে যায়। এরপর বিছানায় উঠে হুট করে অগ্নির পেটের উপর বসে পড়ে। অগ্নি চোখ থেকে হাত সরিয়ে ইয়ানাকে দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে যায়। নিশ্বাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। চোখ সরিয়ে নেয় সাথে সাথে। ইয়ানা ডান হাত দিয়ে অগ্নির আ্যঁডমস আ্যপলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে। ইয়ানার হাতের স্পর্শ পেতেই অগ্নি নিয়ন্ত্রন হারা হয়ে পড়ে। কিন্তু এরপরও মাফিয়া বস নিজেকে সামলে বলে,
” লিভ মি দ্যা ফা*ক এলোন ইয়ানা! আমাকে উন্মাদ করো না পড়ে কিন্ত পস্তাবে তুমি।
ইয়ানা সামান্য হেসে বলে,
” কি করবেন আপনি শুনি? আমি কিন্ত প্রেগন্যান্ট!
অগ্নি বড় বড় শ্বাস টানে। ইয়ানার হাতের বিচরন অগ্নির পুরো বুকে করতে থাকে। ঠোঁটের কোণায় লেগে আছে দুষ্টু হাসি। পেট ফেটে হাসি আসছে তার।
অগ্নি দাঁতে দাঁত পিষে ঘন নিশ্বাসের সাথে বলে,

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬১

” স্টপ. ফা* ক ইউ ইয়ানা। মরে যাচ্ছি আমি। তোমার অসুস্থততাকে হাতিয়ার করে আমার ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা নিও না।
ইয়ানা অগ্নির কন্ঠনালিতে চুমু খেয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অগ্নি হেচকা টানে বিছানায় ফেলে দেয়। অগ্নিকে নিজের উপরে দেখতে পেয়ে ভড়কে যায়। অগ্নি ইয়ানার উন্মুক্ত গলায় মুখ ডুবিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
” ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা নিয়ে বাঁদরামি করতে এসেছো? ভাগ্য ভালো আমার সন্তান তোমার পেটে। নাহলে হসপিটালে পাঠাতাম।
অগ্নি কথাটা বলেই ইয়ানার উপর থেকে উঠে এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে। ইয়ানা সামান্য ভয় পেলেও অগ্নির অবস্থা দেখে ওয়াশরুমে গিয়ে শব্দ করে হেসে উঠে। উফফ মাফিয়া বস আপনাকে যাস্ট দেখার মত ছিলো!

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৩