অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৪ (২)
লিজা মনি
অগ্নি ইয়ানাকে পাজা কোলে তোলে নেয়। ইয়ানার শরীর থেকে প্রবাহিত রক্ত অগ্নির সাদা শার্ট লাল আকার ধারন করে। মুহূর্তের মধ্যেই সাদা কাপড় লাল রঙ্গে পরিনত হয়। ইয়ানা ছটফট করছে। অগ্নির শার্টের কলার খামচে ধরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠে।
জায়গাটা পাশঘেঁষা এক নির্জন। এখানে আধুনিক সভ্যতার কোলাহল থেকে বহু যোজন দুরে। সময় এখন গভীর রাত। আকাশে অমাবস্যার কৃষ্ণপট। আর এদিকে ইয়ানার তীব্র প্রসববেদনায় ক্ষতবিক্ষত চিৎকার যেন ছিঁড়ে ফেলছিল মাফিয়া বসের চিরঠান্ডা হৃদয়ের অজস্র গোপন স্তর।
একসময় যে আঙুল ট্রিগারে চাপ দিয়ে অবলীলায় জীবন কাড়ত। সে আঙুলেই আজ প্রকম্পিত কৌতূহল আর করুণ জিজ্ঞাসা। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অস্ত্রধারী সেই পুরুষকে করত এক অন্যরকম অস্ত্রোপচা। প্রকৃতির নির্দেশে ভালোবাসার তাগিদে এবং পরিস্থিতির অনিবার্যতায়। আতিক আর রানবীরের সংঘর্ষের জন্য আশে- পাশের সকল মানুষ ভয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গিয়েছিলো। চারপাশে যেন একটা পোকার অস্তিত্ব ও নেই।
অগ্নি ইয়ানার কপালে চুমু খেয়ে ভাঙ্গা আওয়াজে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কিছু হবে না তর জান। নিজের জীবন দিয়ে হলেও তর সুরক্ষা নিশ্চিত করব। একটা ভরসা আর ধৈর্য ধরো পাখি।
— ঘ.. ঘাবরাবেন না অগ্নি চৌধুরি। আমাকে কোনো এক নিরাপদ স্থানে নিয়ে চলুন।
ইয়ানা অনেক কষ্টে দুই লাইন কথা উচ্চারন করে। অগ্নি ইয়ানাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে পাশের জঙ্গলে ডুকে পড়ে। এই জায়গাটা তার পূর্ব পরিচিত। কাজের সূত্র ধরে অনেকবার আসতে হয়েছে। জঙ্গলের গভীরতা পেরিয়ে একটা পুরনো মন্দিরে ডুকে পড়ে। দেখে বুঝা যাচ্ছে এখানে কোনো সন্নাসীর বসবাস ছিলো। জায়গাটা ছিলো খুব পুরনো আর ভাঙ্গাচুরা নাগ মন্দির।
অগ্নি মন্দিরের মেইন দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এরপর ইয়ানাকে নিয়ে একটা উচু স্থানে শুইয়ে দেয়। ইয়ানার চিৎকার তার প্রতিটা রক্ত বিন্দুকে জমিয়ে দিচ্ছিলো। যার সামান্য আর্তনাদ সহ্য করতে পারে না সে আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। অগ্নি নিজে বসে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরে। এরপর মোবাইল বের করে কল চেক করে। ইয়ানার যখন পেইন শুরু হয়েছিলো তখন সে মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে দ্রুত ডাক্তার নিয়ে পৌঁছানোর জন্য। অনেকের রিপ্লাই ও এসেছে বাট এখন আর কোনো কানেকশন নেই। জঙ্গলের ভেতরে সামান্য নেটের ছিটে- ফুটে ও নেই। মাফিয়া বসের দাঁত খিঁচে উঠে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে মুহূর্তেই। রাগের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে নেটহীন মোবাইলটাকে সজোরে আছার মেরে চেঁচিয়ে উঠে,
” ডেম ইট! বালের সব বিপদ এমন অসময়ে দেখা দেয়।
মোবাইলে তিন জায়গায় ধাক্কা খেয়ে খন্ড- বিখন্ড হয়ে যায়।
ইয়ানা হাঁপিয়ে উঠছে। সহ্য করতে না পেরে কান্না করে উঠে,
” কিছু করুন অগ্নি চৌধুরি। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
অগ্নির চোখ লাল হয়ে উঠে। কার্নিশে পানি জমে যায়। কিছুক্ষন স্তব্দ হয়ে ইয়ানার ব্যাথাতুর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে শক্ত করে ইয়ানার দুই গালে হাত রেখে বলে,
” আমার উপর ভরসা আছে তো পাখি?
— নিজের থেকেও বেশি।
— তাহলে তোমার স্বামী তোমার ডেলিবারি করাবে। প্রস্তুত তো তুমি?
ইয়ানা অবাক হয়ে বলে,
” প… পারবেন আ.. আপনি?
— নিজেকে শক্ত করে রেখো সাথে আমাকে ও সাহস জুগান দিও। তুমি পাশে থাকলে আমি সবচেয়ে বড় যুদ্ধে ও জয় করে আসতে পারব। কিন্তু তোমার সাহস আমার খুব প্রয়োজন। তোমার হাজবেন্ড স্যুপারমেন হয়ে সব কষ্টের অবশান ঘটাবে। নিজের হাতে নিজের সন্তানকে নিয়ে আসব। কিন্তু খবরদার চোখ বন্ধ করবে না।
ইয়ানা কান্না করে অগ্নিকে জড়িয়ে ধরে। অগ্নি চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানে। ইয়ানা নিস্তেজ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। যে মাফিয়া বস জীবনে কারোর জন্য করুনা করত না, দয়া দেখাত না , কষ্ট পেত না সে আজ কারোর চিৎকারে ছটফট করছে। যার হাতে লেগে থাকত খুনের রক্ত আজ তার পুরো শরীরে লেগে আছে সন্তান আগমনের রক্ত। হয়ত খুশির আবার হয়ত সবচেয়ে যন্ত্রনাদায়ক। যার হাতে সবসময় অস্ত্র থাকত আজ সে হাতে নিজের স্ত্রীর প্রসব করাচ্ছে। যে হাতে বাচ্চাদের বলি দিত আজ সে হাতে আরেক বাচ্চাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসছে। জীবনে প্রথমবার অগ্নি চৌধুরি ভয় পাচ্ছে। তার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, বুক কাঁপছে এমন কি পুরো শরীর কাঁপছে অসম্ভব ভাবে। অধৈর্য হয়ে ইয়ানার নিস্তেজ শরীরটাকে পরখ করে।
সমুদ্রসান্নিধ্যে অবস্থিত কানাডীয় এক ক্ষুদ্র অথচ ঘনত্ববহুল অরণ্যানী। যপ্রকৃতির সুপরিকল্পিত নিসর্গনকুঞ্জ যার প্রতিটি বৃক্ষদেহ নিঃশব্দে ধারণ করে বহুকালের নিসর্গবেদনা ও প্রাকৃতিক স্মৃতিচিহ্ন। নিঃসীম নীলিমার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এই বনাঞ্চলের ঘনচিত্র বৃক্ষবিন্যাস সূর্যালোকের স্নিগ্ধ আবর্তনে হয়ে ওঠে রৌদ্রচ্ছায়ার এক সুরম্য নাট্যভূমি। যেখানে প্রতিটি পত্রপল্লব ধ্বনিত করে মৌন সঙ্গীত। গম্ভীর হেমলক ও রাজসিক সিডারের নিবিড় সমাহারে। স্থবিরতা ও স্পন্দনের এক আশ্চর্য সমবায় প্রতিভাত হয়। বনভূমির অন্তঃস্থলে বিচরণ করে হরিণের ক্ষিপ্র ছায়া, র্যাকুনের কৌতূহলভরা চাহনি, এবং বিরলবেশী কালো ভালুক।যাদের উপস্থিতি এই প্রাকৃতিক নিকুঞ্জকে করে তোলে জীবনের গোপন চলাচলে মুখর। পাথরবিছানো উপকূলে সমুদ্রের অবিরত জলোচ্ছ্বাস যেন গায় এক নিরব শব্দসঙ্গীত, যার প্রতিটি তরঙ্গ বহন করে প্রকৃতির অনন্ত চেতনার গূঢ় বার্তা। এই জঙ্গল শুধু একটি ভৌগোলিক পরিসর নয় বরং এক অস্তিত্বময় নিঃসঙ্গতা।যেখানে প্রকৃতির মৌনতা ও মনুষ্যহীনতার সম্মিলনে গঠিত হয় এক অলঙ্ঘ্য ধ্যানভূমি। আর সেই অরন্যের পাশেই একটা ছোট – খাটো ভাঙ্গা হিন্দু শাস্ত্রের নাগ মন্দীর।
সেই মন্দিরের ভিতরে আগমন ঘটতে চলেছে আগামী দিনের মাফিয়া লিডারের। ইয়ানার মুখে মুখে ঘাম ঝরতে থাকে। যন্ত্রণায় বিকৃত চোখ এবং জঠরের ভেতর ছিঁড়ে যাওয়া অস্থিরতার আর্তনাদে অগ্নির শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার হাতে একদম সময় নেই। কোনো ডাক্তার আসার অপেক্ষাও সে করতে পারবে না। অ্যাড্রেনালিনের অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে সে খুলে ফেলে নিজের কোট। গাড়ির ভিতরে থাকা ফার্স্টেড বক্সটা নিয়ে আসে। হাত মোড়ায় জীবাণুমুক্ত কাপড়।যতটুকু সম্ভব প্রস্তুতি নেয়।
অগ্নি ইয়ানার হাত চেপে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে,
” জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমি নেমেছি। তোমার প্রতিটা কষ্ট আমার হোক।
ইয়ানার যোনিপথে ইতোমধ্যেই শিশুর মাথার গঠন দেখা দিয়েছে। অগঞ্জ দ্রুততার সঙ্গে সাফ করে নেয় পরিসর, জীবাণুমুক্ত তোয়ালে, পানি এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে যা কিছু ছিল গাড়িতে। বুকের ভেতর হিমেল উত্তেজনা। আজ না আছে কোনো শত্রু, না কোনো বন্দুকযুদ্ধ। এমন এক মুহূর্ত তার জীবনে কখনো আসে নি। ধীরে ধীরে বাচ্চা আবির্ভাব হতে শুরু করলো। এক প্রবল চিৎকারের তীব্রতায় ইয়ানার সমস্ত শরীর যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিলো। রক্তে লাল হয়ে উঠছিল নিচের পুরো অংশ । সেই যন্ত্রণার মাঝে হঠাৎ এক তীক্ষ্ণ আর কোমল শব্দ—শিশুর কান্না! দুই হাতে আলতো করে শিশুকে ধারণ করে নেয় অগ্নি। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী রত্ন হাতে পেয়েছে। শিশুটির নাড়ি কেটে ফেলার জন্য সে নিজের পকেট থেকে বের করে এক স্টেরিল ছুরি। যেটি একসময় প্রাণনাশে ব্যবহৃত হতো আজ তা জীবনদানে।
শিশুটি ছিলো তার ছেলে। আগামী মাফিয়া সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। শিশুটি কাঁপছে, কাঁদছে, বেঁচে ও আছে। এ যেন তাঁর হাজার হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে এক জীবনের বিজয়। কিন্তু অগ্নির হৃদয় কি ঠান্ডা হয়েছে যেখানে তার জীবন অর্ধমৃত হয়ে পড়ে আছে। অগ্নি বাচ্চাকে তোয়াক্কা না করে ইয়ানার কপালে চুমু খেতে যাবে ইয়ানা আবার ও ছটফট করে উঠে। ঠিক আগের মত’ই সেই আর্তনাদ! সেই কান্নায় ছিল অন্যরকম এক বীভৎসতা যেন শরীর বিদীর্ণ করে কে যেন দ্বিতীয়বার উঠে আসছে। অগ্নির মস্তিষ্ক নড়ে উঠে। ডাক্তার বলেছিলো টুইন বেইবি হবে। অগ্নি ঘন ঘন শ্বাস টানে। প্রায় দশ মিনিট পর ইয়ানার থেমে যাওয়া চিৎকারে অগ্নির হৃদয়ের ক্ষত আবারও তাজা হয়ে উঠলো। এইবার সময় দীর্ঘ, ধীর আর বেদনাদায়ক ছিলো। ইয়ানা আধমরা হয়ে গিয়েছে প্রায়। চোখ প্রায় কোটরে বসে গেছে। অগ্নির শরীর থেকেও রক্ত ঝরছে। এত চাপ, এত চাপ, যে বুকে ব্যথা জমে আছে। অবশেষে দ্বিতীয় শিশু তাদ এক জান্নাত বেরিয়ে আসলো তার মেয়ে। অগ্নি নিজের শার্ট খুলে মেয়েটাকে জড়িয়ে নেয়। চোখ খোলা কিন্তু চিৎকার নেই। অগ্নি সেসব খেয়াল না করেই ছেলের পাশে রেখে দেয়। অগ্নি অধৈর্য হয়ে ইয়ানাকে নিজের সাথে চেপে ধরে। ইয়ানা পুরো- পুরি জ্ঞান হারিয়েছে।
অগ্নি ইয়ানার দুই গালে স্পর্শ করে চোখ খোলার জন্য। কিন্তু ইয়ানার কোনো হুশ নেই। সে বেহুশের মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। এতক্ষন পর্যন্ত মাফিয়া বস নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেও এখন সে সবচেয়ে বেশি অধৈর্য মানবে পরিনত হয়। অস্থির হয়ে উঠে সে। ইয়ানার চিবুক চেপে ধরে আকস্মিক। রাগে চোয়াল শক্ত করে ধরে অধৈর্য বস হুংকার দিয়ে উঠে,
” এই আল্লাহর বান্দি চোখ খুল বলছি। আমার ভেতরে ঘূর্নিঝর হচ্ছে বুঝতে পারছিস না। আমাকে কেনো এত কষ্ট দিচ্ছিস হ্যা? দুই মিনিটের মধ্যে চোখ খুল নাহলে সমুদ্রের উপর দিয়ে ভাসিয়ে দিব। তখন কেউ আটকাতে পারবে না আই রিপিট কেউ পারবে না আটকাতে। অগ্নি চৌধুরির ধৈর্যের পরিক্ষা নিস না খবরদার। ধৈর্য খুব আমার। অগনিত জনকে মেরেছি তকে মারতেও হাত কাঁপবে না আমার।
ইয়ানার মাথা এক পাশে হেলে যায়। পুরো মুখের ঘামের আস্তরন। পাশের সমুদ্রের উত্তালের গর্জন হয়ত সবাই শুনতে পাচ্ছে কিন্তু অগ্নি চৌধুরির বুকের ভেতরের নিরব উত্তাল কে শুনবে? যে সবসময় সামান্য হলেও শুনতে পেত সেই তো নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। ইয়ানার এমন অবস্থা কি মাফিয়া বস আদ’ও ঠিক আছে। রাগ উঠছে নিজের উপর। সেদিন যদি বেবি কনসিভে এগিয়ে যেতে না দিতাম তাহলে আজ তার বউটাকে এই অবস্থায় দেখত হত না। প্রয়োজন ছিলো না তার বাচ্চার। মৃত্যুর লড়াই করে কি প্রয়োজন ছিলো বাচ্চ দুনিয়ায় নিয়ে আসার। কিন্তু এই মেয়ে তো সবসময় আমার থেকে এক পা এগিয়ে যাবে। শুনে নি আমার কথা। যদি শুনত তাহলে আমাকে অন্তত তীব্র দহনে জ্বালিয়ে মারত না। এত ট্রিলিয়নার হয়ে লাভ কি যদি প্রয়োজনে একটাকে ও সামনে না পায়? অগ্নির চোখ দুটি জ্বলে উঠে। সেটা রাগ নাকি অতিরিক্ত দহনে বুঝা মুশকিল।
অগ্নি ইয়ানার রক্তাক্ত শরীরটাকে নিজের সাথে চেপে ধরে। তার নিজের শরীরেও রক্তে মাখা- মাখি।অগ্নির হাত দুটি ইয়ানার নারী সত্তায় লাল হয়ে গিয়েছে।
অগ্নি ইয়ানার গলায় সামাম্য চাপ প্রয়োগ করে বলে,
” চোখ মেলে তাকাও ইয়ানা। আর কত দহনে পুড়িয়ে মারবে আমাকে?
ইয়ানাকে একই ভঙ্গিমায় পড়ে থাকতে দেখে অগ্নি উন্মাদ হয়ে উঠে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ঠান্ডা মাথার খুনি এখন হয়ে উঠেছে এখন শোকাহত সাইকো। ইয়ানার দিকে দাঁত পিষে বলে,
” এই এত সহজে চলে যাবি আমাকে রেখে? আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে কে তাহলে? আমাকে ভালো মানুষ কে বানাবে? যখন চলেই যাবি তখন আমার কাছে কেনো এসেছিলি? শালী ধান্দা বাজ! ধান্দা করিস আমার অনুভুতির সাথে ? আমি আমার ভালোবাসাটা কার কাছে প্রকাশ করব? তুই জানিস না তকে বুকে আগলে না রেখে ঘুমাতে পারি না। এইভাবে চোখ বন্ধ করে রাখলে কি নিয়ে ঘুমাব আমি? তর কঙ্কালকে নিয়ে ঘুমাব রাবিশ!
অগ্নি নিজের হাতের চাপ আরও প্রখঢ় করে তুলে,
” আমাকে না মেরেই চলে যাচ্ছিস? সঠিক পথেও তো ফিরিয়ে আনলি না। শুনে রাখ এই জীবনে অগ্নি চৌধুরির জীবন থেকে তর মুক্তি নেই। আমার প্রতিটি হায়াৎ তর নামে উৎস্বর্গ করেছি বারংবার। আমার আগে তুই মরতে পারবি না। আরে বাল তর বন্ধ চোখ আমি সহ্য করতে পারি না তুই জানি না? *মরে যা সমস্যা নেই। প্রয়োজনে আইসে ডুবিয়ে নিজের সাথে রেখে দিব। তর নিশ্বাসের প্রয়োজন নেই তুই হলেই হবে আমার।*
রাগের আর উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে কখন যে তার হাতের চাপ শক্ত হয়ে উঠেছে সে খবর নেই। সে তো এখন আর নিজের মধ্যে নেই। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ যেন থমকে গিয়েছে। গলায় এত জোরে চাপ প্রয়োগে ইয়ানা কেঁশে উঠে। কিন্তু চোখ মেলে তাকায় না। ইয়ানার গলার আওয়াজ পেয়ে অগ্নির যেন প্রান ফিরে এসেছে।
ইয়ানা নিস্তেজ। অগ্নির প্রতিটা ধমক আর হুংকার কান অব্দি আজ পৌঁছাচ্ছে না।অগ্নির আত্না শুকিয়ে আসছে। এর চেয়ে অসহায় সে আর কোনোদিন হয় নি। একদিকে ইয়ানার নিস্তেজ শরীর ওর শ্বাস থমকে দিচ্ছে অন্যদিকে মেয়ের শরীর নড়তে না দেখে রুহ কেঁপে উঠে। অগ্নি ছটফট করে উঠে । কোনোমতে নিজের শরীরটাকে টেনে নিয়ে বাচ্চাদের সম্মুখে বসে। তার ছেলে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আর মেয়েটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। যেন শ্বাস নড়ছে না।
অগ্নি মেয়ে বাবুটাকে নিজের কোলে তোলে নেয়। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতেই আরও অস্থির হয়ে উঠে। তার মেয়ে ও চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অগ্নি নিজের হৃৎপিন্ডে একটা চাপ অনুভব করে। কাঁপা হাতে মেয়ের নাকের সামনে অনামিকা আঙ্গুল রাখে। থমকে যায় সে। আঙ্গুলটা সরিয়ে ফেলার শক্তিটুকুও যেন ফুরিয়ে গিয়েছে। নিজের চোখ বন্ধ করে দুই ফুটা চোখের পানি ছেড়ে দেয়।
মেয়েটাকে মাফিয়া বস নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে নিস্তেজ হয়ে বলে,
” ক.. কেনো এমনটা করলে আম্মু? পাপা কি খুব খারাপ ছিলাম? থাকা যেত না পাপার কাছে তার মা হয়ে। কেনো ছেড়ে গেলে আম্মু? পাপাকে আবার ও নিঃস্ব করে দিলে।
অগ্নি মেয়ের নিস্তেজ মুখে অজস্র চুমু খায়। পা দুটি দুই পাশে ছড়িয়ে বসে মেয়েটাকে নিজের দুই হাতে আগলে নেয়। সে তো বাচ্চা কোলে নিতে জানে না। তবুও কষ্ট করে নিচ্ছে। কারন এইটা তার মেয়ে, তার রক্ত, তার অস্তিত্ব সে। অগ্নি মেয়ের পুরো মুখে আদুরে স্পর্শ করে নিরবে কেঁদে উঠে। একজন সাধারন মানুষের মত মাফিয়া বসের চোখ দিয়ে ও গড়িয়ে পড়ছে জলকণা। মাফিয়া বস মেয়ের নিস্তেজ শরীরটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে বলে,
” আমি ভালো মানুষ হতে পারি নি,
ভালো স্বামী হতে পারি নি,
ভালো সন্তান হতে পারি নি,
ভালো ভাই হতে পারি নি কিন্তু
পৃথিবীর সবচেয়ে আদর্শবান বাবা হওয়ার অন্তত চেষ্টা করতাম। একটা সুযোগ কি তোমার পাপাকে দেওয়া যেত না আম্মু।
অগ্নি খোলা আকাশের দিকে এক পলক তাকাতে চায়। কিন্তু তার সাহস হচ্ছে না উপরওয়ালার কাছে তার মেয়ের জান ভিক্ষে চাওয়ার। কি করে চাইবে সে আজ? যে নিজেই হাজার হাজার বাবার সন্তানকে বলি দিয়েছে, হাজার হাজার মেয়েকে নরকে ঠেলে দিয়েছে। সে কি করে চাইবে নিজের মেয়ের প্রান ভিক্ষা।
অগ্নি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। শব্দ করে কিছুক্ষন মন খুলে হাসে কানাডার সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাফিয়া বস।
— তুমি তো বলেছিলে ইয়ানা আমার যাতে কোনোদিন মেয়ে না হয়। সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ, তুমি সবার অভিশাপ আজ কাজে লেগেছে। দেখো আমার মেয়ে হয়েছে কিন্তু বাবা ডাক শুনতে পারলাম না। তুমি ঠিক ছিলে। যে বাবা হাজারটা মেয়ের আর্তনাদের কারন হয় সে বাবা ডাক শুনার যোগ্য ওই নয়। কিন্তু আমার কেনো কষ্ট হচ্ছে বলতে পারবে? কার ও আমার মেয়ে। মাফিয়া সম্রাজ্যের রাজা অগ্নি চৌধুরির এক মাত্র রাজকন্যা।
অগ্নি মেয়ের ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো নিজের আঙ্গুলে স্পর্শ করে বলে,
” হেরে গিয়েছি আমি আম্মু। হেরে গিয়েছে তোমার পাপা। হেরে গিয়েছে একজন মাফিয়া বস। আমাকে কখনো ক্ষমা করো না আম্মু। পাপার শত্রুদের কারনে আজ তোমার এই অবস্থা। নাহলে তুমি ও সঠিকভাবে আমার কোলে আসতে। তোমার মাম্মাম বলেছিলো আমার যাতে কোনো মেয়ে না হয়। আল্লাহ দিয়েছিলো কিন্তু আবার কেরেও নিলো। পাপার পাপ আজ তোমার দৃষ্টি বন্ধ করে দিলো। এ…একবার তাকাও পাপার দিকে আম্মু। তোমার খোলা চোখ দুটি একটুর জন্য দেখতে চাই।
অগ্নি শব্দ করে কেঁদে উঠে। কেউ কি কোনোদিন অগ্নি চৌধুরির কান্না দেখেছে? উহুম কেউ দেখে নি। সবাই জেনেছে সে রাগী, নিষ্ঠুর, খারাপ কিন্তু সেও কারোর জন্য দেওয়ানা হয়ে কাঁদবে সেটা কি কেউ জানত? হয়ত মানবকুল তার কান্নার আওয়াজ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু জঙ্গলে দাড়িয়ে থাকা বিশাল গাছ- পালা গুলো হয়ত তার কান্নার সাক্ষী হচ্ছে। অগ্নি মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিতে থাকে। আজ রাগে তার চোখ লাল হচ্ছে না বরং নিজের মেয়ের বন্ধ হৃদস্পন্দের বিরহে লাল হয়ে আছে। আচমকা ইয়ানার কিছু অস্ফুর্ত বাক্য অগ্নির কানে এসে পৌঁছায়,
‘ আমার বাচ্চা, ব… বাচ্চা! আমার বাচ্চারা কোথায়?
অগ্নি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে গালে হাত রাখে। ইয়ানা পিটপিট দুর্বল চোখে তাকায় অগ্নির দিকে। নিজের অবস্থা পরখ না করে অগ্নির কোলে নিজের সন্তানকে দেখে হেসে উঠে। অগ্নির হাতে ধরে বলে,
” আমাদের তো টুইন বেবি হওয়ার কথা । আরেকজন কোথায়? ওদের ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়?
অগ্নি ইয়ানার হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এইটাই হলো মা জাতি। নিজে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে যখন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় তখন সব কষ্ট ম্যাজিকের মত বিনাস হয়ে যায়। ইয়ানা দুর্বল হাত দিয়ে অগ্নির কাছ থেকে মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কিন্ত মেয়ের নড়াচড়ার শব্দ না পেয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভয় নিয়ে বলে,
” অ.. অগ্নি চৌধুরি আমার মেয়ে কথা বলছে না কেনো? প্লিজ বলুন না আমার মেয়ে কথা বলছে না কেনো?
অগ্নি নিস্তব্দ হয়ে মাথা নিচু হয়ে বসে আছে। ইয়ানা পাগলের মত রিয়্যাক্ট করতে থাকে। রক্তাক্ত, দুর্বল শরীরটা নিয়ে কোনো রকম উঠে দাড়াতে চায়। কিন্ত সামান্য দাড়াতে পর্যন্ত পারছে না। অগ্নিকে নিশ্চুপ দেখে এক হাতে ঝাকিয়ে বলে,
” এই কথা বলছে না কেনো? আমার মেয়ের কি হয়েছে? ও কেনো আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আপনার মেয়ে ঠিক আপনার মত। কষ্টের মর্যাদা দিতে জানে না। দ.. দেখুন না নিজের জীবনকে বাজি রেখে পৃথিবীর আলো দেখালাম অথচ স্বার্থপরের মত আমার দিকে তাকাচ্ছে না। স্বর্থপর বাবার স্বর্থপর মেয়ে। প্লিজ বলুন না আমার দিকে তাকাতে। মেয়েরা বাবা ভক্ত হয়। আপনি বললে ঠিক তাকাবে আমার দিকে।
অগ্নি নিশ্বব্দভাবে বসে আছে। ইয়ানার মাথাটাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। দুজন রক্ত দিয়ে মাখা- মাখি। ইয়ানা এক হাতে ছেলেটাকে নিয়ে কপালে অজস্র চুমু খায়। এই বাচ্চা দুইটা তার জীবনের থেকেও বেশি দামী। ছেলেটা নিরবে আছে কিন্তু মেয়েটার তো হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে। ইয়ানা মেয়ে বাবুকে কোলে চেপে ধরে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে,
” আল্লাহ প্লিজ তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমার মমতাকে বিদায় জানাতে পারো না এমন নিষ্ঠুরতার সাথে। ওদের পৃথিবীতে আনার জন্য সব ত্যাগ করেছি। নয় মাস নিজেকে ঘর বন্ধী রেখেছি। আমার মাতৃত্বকে এইভাবে ঝরে যেতে দিও না। আমি আমার মেয়েটাকে চাই। ও তো নিষ্পাপ ছিলো।
ইয়ানা থামে। অস্থির হয়ে উঠেছে মেয়েটা। অগ্নি থামতে বলছে না। বরং সে চাচ্ছে আজ ইয়ানা কাঁদুক। আশ্চর্যের বিষয় যে ইয়ানাকে নিজের বাবা – মায়ের জন্য কাঁদতে দেখলেও হিংসে হত আজ তার সামান্য টুকু ও হিংসে হচ্ছে না। কেনো এমন আলাদা অনুভুতি?
— এই ছোট জীবনে আমাকে আর কত পরিক্ষার সম্মুখীন করবে? জীবন তো তখন ওই থমকে গিয়েছিলো যেদিন নিজের স্বামীকে খুন করতে দেখেছি, তখন ওই থমকে গিয়েছিলাম যখন জানতে পেরেছি সে একজন মাফিয়া, তখন স্তব্দ করে দিয়েছিলে যখন জেনেছি সে নারী – শিশু পাচারে যুক্ত। নিজের অস্তিত্ব তো সেদিন ওই বিলীন হয়ে গিয়েছিলো যেদিন আমার বাবা – মায়ের পুড়া লাশ দেখেছিলাম। এইটুকু জীবনে একবার নয় বারংবার ধৈর্যের পরিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আর কত ধৈর্যের পরিক্ষা নিবে তুমি আমার থেকে ? আমি পারছি না। আমাকে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।
ইয়ানা কেঁদে উঠছে। আর বার বার আল্লাহর কাছে জীবন ভিক্ষে চাইছে। অগ্নি নির্বাক ভঙ্গিতে সহ্য করতে না পেরে বলে,
” স্টপ ইয়ানা!
ইয়ানা অগ্নির কলারে ধরে বলে,
” আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিন না অগ্নি চৌধুরি। আমি ওর মুখ থেকে মা ডাক শুনতে চাই। আপনার তো অনেক টাকা। প্রচুর টাকার মালিক আপনি। অনেক ক্ষমতা ও আছে। এখন ক্ষমতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমার মেয়েটাকে আমার কোলে আবার ফিরিয়ে দিন।
— টাকা দিয়ে সব করা যায় না।
— যায় না? তাহলে এত পাপের টাকা কেনো জমিয়েছেন? কেনো এত ক্ষমতাবান হয়েছেন আপনি? যদি নিজের মেয়েটাকে আগলে রাখতে না পারেন তাহলে কেনো এত পাপ করেছেন?
ইয়ানা পাগলের মত ব্যবহার করছে অগ্নির সাথে। অগ্নি ইয়ানার হাত ধরে মলিন হেসে বলে,
” মেয়ে – বাচ্চা সংক্রান্ত সব পাপ আমি ছেড়ে দিব।
ইয়ানা থমকে যায়। চোখ তুলে তাকায় অগ্নির চোখের দিকে। অগ্নি উঠে দাঁড়িয়ে চোখে বন্ধ করে বড় করে শ্বাস টেনে বলে।,
” আমি মাফিয়া বস অগ্নি চৌধুরি আকাশ- জমিন, চন্দ্র- সূর্য সব কিছুকে স্বাক্ষী রেখে আমার মেয়ের নামে প্রতিজ্ঞা করছি কখনো আর নারী – বাচ্চা সংক্রান্ত পাপ করব না। সকল পাচার কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলছি।
অগ্নি গম্ভীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। মুলত সে লোকের আনাগোনা দেখতে পেয়েছে। ঠিক বুঝতে পেরেছে গার্ডরা কেউ এসেছে। ইয়ানা স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে আছে অগ্নির দিকে। ছেলেটা কাঁদছে কখন থেকে। ইয়ানার ঠোঁট কেঁপে উঠে। নিজের মেয়ের হৃদস্পন্দন বন্ধ দেখেই কি মাফিয়া বসের এই প্রতিজ্ঞা। ইতিহাস তাহলে ঠিক’ই বলে ব্যক্তি খারাপ হলেও বাবা কখনো খারাপ হয় না। একজন পিতার বুকে ও তাহলে পিতৃত্ব জেগে উঠেছে। আপনি নিজের ভুল বুঝেছেন কিন্তু তাতে কি আমার মেয়েটা আমার কোলে পুনরায় আসবে। ইয়ানা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে অন্য হাতে রাখতেই হুড়মুড়িয়ে কেউ মন্দিরে প্রবেশ করে। ইয়ানা চোখ তোলে তাকায়। মিরা, সুমু, অরিদ সবাইকে দেখে ইয়ানা শূন্যহীন দৃষ্টিতে তাকায়। রুয়ানা ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়ানার কাছে। সুমু কান্নারত ইয়াজকে কোলে তোলে নেয়। মিরা ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ইয়ানা হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠে,
” আমার মেয়েটা আর নেই মিরা। আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে ও। আমাকে মাম্মা বলে ডাক না দিয়েই স্বার্থপরের মত বিদায় জানিয়ে দিয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর। চিৎকার করে কাঁদলেও তৃষ্ণা মিটছে না। কি করব আমি? আমাকে ও কেউ মে….
ইয়ানা কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কারন বাহির থেকে অগ্নির হুমকি কানে আসে। । ইয়ানা শ্বাস টানে বড় বড়। সবার চোখে পানি। অগ্নি গার্ডদের দিকে তাকিয়ে গভীর আওয়াজে হুংকার দিয়ে বলে,
” সময় পাঠিয়েছি আরও এক ঘন্টা আগে। আসতে এত লেইট কেনো জানতে পারি?
অগ্নির শরীর রাগে কাঁপছে। প্রতিটি গার্ডকে দেখে রক্ত আরও টগবগিয়ে উঠছে। গার্ডরা মাথা নিচু করে বলে,
” স.. স্যার বিগত চল্লিশ মিনিট ধরে আমরা খুঁজে চলছি। ইউভি স্যার, রায়ান স্যার, অরিদ স্যার তারাও সাথে ছিলো আমাদের। অবশেষে আমরা জঙ্গলের ভেতরে ডুকে পরেই দেখি আপনি সামনে।
অগ্নি কপাল ঘেষে রাগ নিয়ন্ত্রন করে। যেখানে নিয়তি তাকে আজ অসহায় করে রেখেছে সেখানে সাধারন গার্ডরা কি করবে।
ইউভি একটা ডাক্তার নিয়ে মন্দিরের ভেতরে ডুকে। মিসেস শাইনা অগ্নির পূর্ব পার্সোনাল ডাক্তার। মিসেস শাইনার চোখে ও পানি। এমন অবস্থা সে নিজেও সহ্য করতে পারছে না। মেয়ে বাবুটাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে হাতে স্পর্শ করে অবাক হয়ে বলে,
” বাচ্চার শ্বাস তো চলছে! মেয়ে তো একদম ঠিক মিসেস চৌধুরি।
ইয়ানা কান্না করা অবস্থাতেই ডাক্তারের দিকে তাকায়। মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় সুখকর সংবাদ সে শুনতে পাচ্ছে। মিরা আর সুমুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দুর্বল রক্তাক্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একটা ছোট – খাটো খাম্বা ধরে মেয়েকে নিজের কোলে তুলতে তুলতে বলে,
” ওর কিছু হয় নি? আমার মেয়ের কিছু হয় নি আপু? তার মানে সে একদম ঠিক আছে? কিন্তু কিছুক্ষন আগে তো শ্বাস চলছিলো না।
ইয়ানার মুখে হাসির ঝিলিক ফুঁটে উঠে। অনেকগুলো চুমু খায় মেয়ের মুখে। ডাক্তার কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলে,
” বাচ্চার মাথায় চাপ খেয়েছে মিসেস চৌধুরি।হয়ত আপনি আঘাত পেয়েছেন কোথাও। তাই জন্মের পর কোনো রেসপন্স করে নি। কিন্তু ওকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে নাহলে অন্য কিছু ঘটে যেতে পারে।
— ক… কিছু হবে না তো আমার মেয়ের?
— আল্লাহ ভরসা।
সবার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
অরিদ — আমি ভাইয়াকে ডাক দিচ্ছি। ভাইয়া বউমনিকে এসে নিয়ে যাবে।
অরিদ বাহিরে বের হয়ে অগ্নির দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলে,
” তোমার মেয়ের শ্বাস চলছে ভাইয়া। ওকে দ্রুত হসপিটালে এডমিড করাতে হবে।
অরিদ কথাটা বলতে দেরী অগ্নির ভেতরে প্রবেশ করতে দেরী হয় নি। ভেতরে ডুকে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দেয়। এরপর কারোর দিকে না তাকিয়ে এক ঝটকায় ইয়ানাকে কোলে তোলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
” আমার ছেলে- মেয়েগুলোকে নিয়ে আয় । ভালোভাবে নিয়ে আসবে খবরদার তারা কান্না যাতে না করে।
মিরা — কান্না তো অলরেডি করছে ভাইয়া। আপনার ছেলে – মেয়ে দুইটার ক্ষিদে পেয়েছে।
অগ্নি — খাইয়ে দাও তোমরা।
অগ্নির কথা শুনে মিরা চোখ বড় বড় করে ফেলে। সুমু কেঁশে উঠে। রায়ান হেসে বলে,
” অনেক কষ্ট করেছিস জানি। তাই বলে বাবুরার খালামনিদের ইজ্জত নিলামে তুলিস না। ওরা কি খাওয়াবে ডাফার!
অগ্নির মস্তিষ্কে এতক্ষনে টনক নড়ে। নিজের বোকা কথায় নিজেই ঠোঁট নাড়ায়।
কানাডার প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যার তীর্থভূমি। সম্মানিত ও বহুস্তরবিশিষ্ট Montclair Institute of Trauma & Surgical Recovery যা কেবলমাত্র সংকটকালীন, অভিজাত ও রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তায় মোড়ানো রোগীদের জন্য উন্মুক্ত। সেই অনতিদর্শনীয় চিকিৎসালয়ের সপ্তমতলার প্রান্তবর্তী একটি সীমাবদ্ধ অথচ সুরক্ষাপূর্ণ কেবিনে। বর্তমানে নিঃসন্দেহে আধুনিকতম চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সংরক্ষণের মধ্যে আছে আরিফ। তার পাশের কেবিনে ইয়ানাকে ভর্তি করানো হয়েছে। অতিরিক্ত ব্লিডিং হওয়াতে রক্ত দিতে হয়েছে। মেয়েকে ভর্তি করানো হয়েছে এর পাশের কেবিনেই। কেবিনের সামনে সবাই বসে আছে। আরিফের অবস্থা খুবই খারাপ। অপারেশন লাইট অফ হয়ে গেলেই ইউভি তারা উঠে দাঁড়ায়। ডাক্তার বেরিয়ে আসলেই অগ্নি অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
” আ.. আমার ভাই আরিফ কেমন আছে?
ডাক্তার দুই ঠোঁট চেপে বিষাদ কন্ঠে বলে,
” অপারেশন সাকসেসফুল বাট চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছু বলতে পারছি না।
অগ্নি দাঁত চেপে ডাক্তারের কাছে তেঁরে যেতেই ইউভি আর অরিদ ধরে ফেলে।
— শান্ত হ ভাই। আরিফের কিছু হবে না। এখানে ডাক্তারের কি দোষ? তর ভালোবাসার জন্য হলেও আরিফ সুস্থ হয়ে ফিরে আসব।
অগ্নি ধপ করে বসে পরে চেয়ারের মধ্যে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। হাজারটা খুন করলেও হয়ত মাফিয়া বস কখনো নিস্তেজ হয় না। কিন্তু আজ তার কাছের মানুষগুলোর আঘাত সে সহ্য করতে পারছে না। সবাই অগ্নির গম্ভীর আর শান্ত রুপটাই দেখছে। কিন্তু ভেতরে যে প্রানঘাতি ঘূর্নিঝড় হচ্ছে সেটা দেখার ক্ষমতা কারোর নেই।
অগ্নি চুলগুলো টেনে বলে,
” ভাই হিসেবে আমি পরাজিত কারন আমি তাকে আকড়ে ধরে রাখতে পারি নি।
স্বামী হিসেবে স্বার্থপর কারন আমি তাকে কারোর সাথে সহ্য করতে পারি না।
বাবা হিসেবে আমি ব্যার্থ কারন আমি তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি নি।
সর্বশেষ মাফিয়া বস হিসেবে আজ আমি পরাজিত আর অসহায়, আমি কাউকেই ভালোভাবে রক্ষা করতে পারি নি।
অগ্নি পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে তার। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে ইউভির বাহুডরে।
কে বলে মাফিয়াদের বুকে হৃদয় থাকে না? কে বলে ভিলেনরা ভালোবাসতে জানে না?
আজ ইতিহাস সাক্ষী থাকুক —
অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৪
যে অগ্নি চৌধুরী হাজার গুলি-বারুদের ভয় না পেয়ে শত্রুদের ঘরে আগুন ধরিয়েছিল, লোকের দেহ ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন করে রক্ত নিয়ে উল্লাস করত।
সেই অগ্নি আজ নিঃশব্দ… নিস্তেজ… কারণ তার আপনজনেরা কাঁদছে।
সে রক্ত ঝরাতে জানে, কিন্তু আপনজনের এক ফোঁটা অশ্রু তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে ক্ষনে – ক্ষনে।
ভালোবাসা যখন পাথরের হৃদয়ে আঘাত করে, তখন সেই পাথরও গলে যায়।
ভিলেন বলেই কি মন থাকবে না?
মন থাকে তাদের। ভিলেনরাও ভালোবাসে — আর সেই ভালোবাসা যখন ব্যথিত হয়, তখন সর্বনাশ অনিবার্য।।