অন্তঃদহন পর্ব ১৩
DRM Shohag
আসমানী নওয়ান জহুরী চোখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশ দু’আঙুলের সাহায্যে কপাল ঘষে। এরপর গলা ঝেড়ে বলে,
– প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। টেনশনে ভুলভাল বলে ফেলেছি। আমাকে একটু সাদা পান্তা খেতে দাও।
কথাটা বলে আকাশ অসহায় মুখ করে তাকালো। সে এখন-ও টেনশনে ভুলভাল বলছে।
আকাশের কথা শেষ হতেই শিমু শব্দ করে হেসে ফেলল, সাথে সন্ধ্যা-ও ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। সাদা পান্তা নাম বোধয় আজ প্রথম শুনলো দু’জন। শিমু হাসতে হাসতে বলে,
– আকাশ ভাইয়া পান্তা যে সাদা হয়, এটা তুমি না বললে জানতেই পারতাম না।
আকাশ শিমুকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। দৃষ্টি তার ডানদিকের সোফায় বসা হাস্যজ্জ্বল সন্ধ্যার দিকে আটকে যায়। সন্ধ্যার গালে সৃষ্ট সেই টোল আকাশের চোখেমুখে একরাশ মুগ্ধতা এনে দেয়।
আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে আকাশের কপালে হাত ছোঁয়ালে আকাশ সম্বিৎ ফিরে পায়। দ্রুত সন্ধ্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান চিন্তিত কণ্ঠে বলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তোমার কি জ্বর আইছে? জ্বর আইলে তুমি উল্টাপাল্টা বকো।
আকাশ তার মায়ের হাত কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
– উফ মা! আমি ঠিক আছি। প্রচন্ড ক্ষুধায় এমন হচ্ছে। তুমি প্লিজ কিছু খাবার ব্যবস্থা কর।
আসমানী নওয়ান আর কিছু বললেন না। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। ছেলের কথা মেনে নিলেন। হয়তো ক্ষুধার জন্য-ই এসব বলছে। তবে অবাক হলেন একটুখানি। আকাশ সাধারণত এভাবে তার কাছে কিছু খাওয়ার আবদার করেনা। মা হিসেবে তিনি আজ অবাক হলে-ও খুশি হয়েছেন বেশি। অতঃপর জিজ্ঞেস করেন,
– কি খাইবা?
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– ভাত।
আসমানী নওয়ান আর কিছু বললেন না। আকাশের পছন্দের ডাল, ভাত রাঁধতে চলে গেলেন। আকাশ মাছ, মাংস যতটা রুচি করে খায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করে খায় ডাল, ভাত। আসমানী নওয়ান এর ভালো লাগে, তার ছেলে খাওয়াদাওয়ার দিক থেকে তার মতো-ই হয়েছে। বাঙালিদের সেই গ্রাম্য খাবারগুলো খুব পছন্দ করে আকাশ। তবে আকাশের বাবা উল্টো।
আসমানী নওয়ানের সাথে আকাশের খালা ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে গেলে সন্ধ্যা নিজে-ও উঠে দাঁড়ায় যাওয়ার জন্য, সাথে শিমু সঙ্গ দেয়।
আকাশ আড়চোখে একবার তাকালো সন্ধ্যার দিকে। বিড়বিড় করল,
– কী ডেঞ্জারাস মেয়ে!
ড্রয়িং রুম একদম ফাঁকা হয়ে গেলে আকাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। টিভি অফ করে রিমোট টেবিলের উপর রেখে দেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা নেমে এসেছে। আকাশ ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা কনুই এর উপর পর্যন্ত গুটিয়ে নেয়। চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি। এমন ব’ল’দ দের মতো দৌড়ে এখন নিজেকে দু’টো থা’প্প’ড় দিতে ইচ্ছে করছে। ভাবলো, এই বাড়িতে আর টিভি রাখা যাবে না। ডান হাত উঠিয়ে চাঁপ দাঁড়ির তুলনায় সামান্য বড় দাঁড়ির ভাঁজে হাত বুলায়।
সন্ধ্যার ঘর পাস করতে গিয়ে হঠাৎ-ই চোখ পড়ে, দরজা খোলা। সন্ধ্যা বেডের উপর বসে কিছু করছে। আকাশের কিছু মনে পড়লো। অতঃপর নিঃশব্দে সন্ধ্যার ঘরে প্রবেশ করে।
সন্ধ্যা খুব সুন্দর করে মেহেদী দিয়ে দিতে পারে। শিমু এটা জানতে পেরে মেহেদীর কোণ আনতে গিয়েছে।
সে সন্ধ্যার থেকে মেহেদী দিয়ে নিবে। সন্ধ্যা দু’পা ভাঁজ কর বেডের উপর বসে আছে। বা হাতে পায়ের নখ খুঁটছে।
আকাশ সন্ধ্যার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে। দু’হাত আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে রেখেছে। প্রায় মিনিট দুই সন্ধ্যার করা অকাজ দেখল সে। এরপর গলা ঝাড়লে সন্ধ্যা দ্রুত মাথা উঁচু করে। আকাশকে দেখে অবাক হয়।
আকাশ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– পায়ের নখ খেতে চাও? যেভাবে হাত লাগিয়েছ, মনে তো হচ্ছে, মুখ লাগাতে আর দু’সেকেন্ড-ও সময় নিবে না।
সন্ধ্যা দ্রুত তার পায়ের নখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। আকাশ দেখল। দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে গম্ভীর স্বরে বলে,
– তোমাকে সালাম দিতে বলেছিলাম। মনে নেই? বে’য়া’দ’ব মেয়ে!
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে,
– যারা কালো জাদু করে তাদের সাথে তোমার কি কোনো কানেকশন আছে?
আকাশের লাস্ট কথা শুনে সন্ধ্যার চোখমুখে অঢেল বিস্ময় ভর করে। আকাশ উত্তরের অপেক্ষায় যেন। সন্ধ্যা শুকনো ঢোক গিলল। এতো উদ্ভট কথা সে এই জন্মে শোনেনি, যত উদ্ভট কথা এই কয়দিনে আকাশের মুখে শুনেছে। আকাশ ডান পকেট থেকে একটি ছোট্ট বক্স বের করে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– নাও।
সন্ধ্যা একবার আকাশের হাতে থাকা বক্সটির দিকে তাকায়, আরেকবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ বিরক্ত হয়ে বক্সটি বেড এর উপর রেখে বলে,
– আকাশ নওয়ান কারো কাছে ঋণী হয়ে থাকেনা। তোমার নুপুর ফিরিয়ে দিলাম।
কথাটা বলে আকাশ আর এক সেকেন্ড-ও এখানে দাঁড়ালো না। দরজার কাছে গিয়ে আরেকবার পিছু ফিরে তাকায়, সন্ধ্যা চুপচাপ বক্সটির দিকে চেয়ে আছে। আকাশ বিরক্ত হলো, সন্ধ্যা বক্সটি খুলে দেখছে না বলে! কিছু বলতে গিয়ে-ও জিভ গুটিয়ে নিল।
আকাশ ভাবে, মেয়েটা কি আসলেই কালো জাদু জানে? মেয়েটার আশেপাশে আসলে তার এতো হাসফাস লাগে, এটা সে নিজেকে-ও বোঝাতে পারে না। চরম বিরক্ত সাথে মে’জা’জ খারাপ হয়। সিদ্ধান্ত নিল, এই মেয়ের সাথে আর কোনো কথা-ই বলবে না। বলতে হবে-ও না। আপাতত সে প্রচুর ব্যস্ত থাকবে। আর এসব ফা’ল’তু হাসফাস থেকে-ও মুক্তি পাবে।
আকাশ এখানে আর দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে তার ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় বিরক্তি আর রা’গে সন্ধ্যার ঘরের দরজা ডান হাতে উল্টোদিকে ধাক্কা দেয়, ফলস্বরূপ বেশ জোরেসোরে শব্দ হয়। সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে দরজার পানে তাকালে কাউকে দেখেনা। কিসের শব্দ হলো বুঝল না।
আকাশের দিয়ে যাওয়া নুপুরের বক্স খোলে সন্ধ্যা। ভেতরে একজোড়া নুপুর। নুপুরটি রূপার। সন্ধ্যা দেখেই চিনতে পেরেছে। সে বুঝল, সেদিন তার পায়ের নুপুর পরে যাওয়ায় আকাশ তাকে এই নুপুর দিয়েছে। ডান হাতে নুপুরজোড়া উঁচু করে ধরল।
এরকম হাজারটা দিলেও তার ভাইয়ের দেয়া ভালোবাসায় ঘেরা নুপুর কি আর পাবে সে? কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
তবুও এই নুপুরজোড়া পেয়ে সন্ধ্যার মুখে একটুখানি হাসি ফুটল, কারণ জানেনা সে।
শিমু সন্ধ্যার পাশে বসে বলে,
– হাসছ কেন ভাবি?
শিমুকে দেখে সন্ধ্যা নিজেকে স্বাভাবিক করে।
শিমু সন্ধ্যার হাতে খেয়াল করতেই সন্ধ্যার হাত থেকে নুপুরজোড়া নিয়ে অবাক হয়ে বলে,
– ওয়াও! নুপুর টা কি সুন্দর! কোথায় পেলে? খালামণি দিয়েছে?
সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। শিমু ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আসার আগে আকাশকে এদিক থেকে যেতে দেখল। তাহলে কি? অতঃপর আগের চেয়েও বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– আকাশ ভাইয়া দিয়েছে?
সন্ধ্যা বেড থেকে শিমুর ফোন নিয়ে তার নুপুর পড়ে যাওয়ার কাহিনী লেখে, আকাশ কেন দিয়েছে সব-ই লিখে শিমুকে দেখায়। শিমু লেখাগুলো পড়ে বলে,
– ওওওও এবার বুঝলাম! সে যাক, নুপুরজোড়া মারাত্মক সুন্দর। তুমি আমার কাজিন বা ফ্রেন্ড হলে আমি এটা ডা’কা’তি করতাম!
কথাটা বলে শিমু হেসে ফেলল। সন্ধ্যা হেসে ইশারায় বলে,
– তুমি চাইলে এটা নিতে পারো।
শিমু হাসতে হাসতে বলে,
– পা’গ’ল না-কি! কেউ কিছু দিলে সেটা অন্যকে দিতে নেই। আমি তো ডা’কা’তি তখন করতাম, যদি তারা নিজের টাকায় কিনত, বুঝেছ?
সন্ধ্যা মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। এরপর মেহেদীর কোণ নিয়ে শিমুকে মেহেদী পরিয়ে দিতে শুরু করে। হাতের যত কাজ আছে, সন্ধ্যার মোটামুটি সব হাতের কাজ খুব নিখুঁত হয়।
পরদিন,
ঘড়ির কাটায় জানান দেয়, বিকাল ৫ টা। আকাশ তার অফিসে বসে মনোযোগ সহকারে কাজ করছে। আকাশের পিএ বায়ান আকাশকে সালাম দিলে আকাশ সালাম এর উত্তর নেয়। বায়ান মৃদুস্বরে বলে,
– স্যার একটা কথা ছিল।
আকাশ চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– বলে ফেল।
বায়ান আমতা আমতা করে। আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– ওয়াশরুম ওদিকে। আগে পেট পরিষ্কার করে এসো যাও।
বায়ান থতমত খেয়ে তাকায়। মাথায় নাড়িয়ে বলে,
– স্যার আমার বাথরুম চাপেনি।
আকাশ সাথে সাথে প্রশ্ন করে,
– তাহলে কি চেপেছে? কো’ষ্ঠ’কাঠিন্য রোগীদের মতো আ আ করছ কেন?
বায়ান অসহায় চোখে তাকালো। অতঃপর ঢোক গিলে বলে,
– স্যার আমার একজন হেল্পার হলে ভালো হয়।
আকাশ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। পিএ-র হেল্পার লাগে জানতো না তো। বায়ান মৃদুস্বরে বলে,
– সে থাকলে আমার অনেক উপকার হতো। বাসায় অসুস্থ মা থাকে। মেয়েটি আমার পরিচিত।
আকাশ বেশ কিছুক্ষণ বায়ানের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ওকে।
এরপর তার কাজে ব্যস্ত হয়। বায়ান খুশি হয়। অফিসরুম থেকে বেরিয়ে সকালের ফোনে একটি মেসেজ দেয়,
– কনফার্ম হয়ে গিয়েছ। এবার তুমি দ্রুত শহরে চলে এসো।
বিকালের রোদ পড়ে যাওয়ার পর, সকাল আর নীরা দুই বান্ধবী গ্রামের মাঠে বসে আছে।
– তুই জানতি না আকাশ নওয়ান সন্ধ্যার স্বামী?
নীরার কথায় সকাল রে’গে বলে,
– আমি কিভাবে জানবো? আমি ভেবেছিলাম ওর এক বুড়োর সাথে বিয়ে হয়েছে। এতো সুন্দর ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে জানলে ওই সন্ধ্যাকে গর্তে ঢুকিয়ে রাখতাম।
সকালের কথা নীরার ভালো লাগলো না। সৎ বোন হোক, বোন তো! সন্ধ্যাকে দেখতেই পারেনা মেয়েটা। নীরা বলে,
– মেয়েটা তোদের বাড়িতে অনেক ক’ষ্ট করেছে। ওখানে গিয়ে ভালো থাকলেই ভালো। তোর বাপ মা ওকে দেখতে না পারলেও বিয়েটা ভালো জায়গায় দিয়েছে। মেয়েটা অনেক ভালো।
কথাটটুকু বলতেই সকাল নীরার গালে থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। নীরা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকায়। সকাল চোখ পাকিয়ে বলে,
– আমার বান্ধবী হয়ে ওর সাফাই গাস কেন? ঘুরতে নিয়ে গেলাম আমি, আর ভালো হয়ে গেল ও। ছোট থেকে সবসময় ওর প্রশংসা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেল। ওর অ’ত্যা’চা’রে বাইরেই বেরোতে পারিনা।
নীরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। রে’গে বলে,
– সন্ধ্যার অনেক গুণ, সেটা আমরা এই গ্রামের সবাই জানি। তুই তো পারিস চারটে গিলতে। আর ঘুরতে।ঘুরতে গিয়ে সমান সমান টাকা দিয়েছি। তোর টাকায় যায়নি আমি। আমার বাবার টাকা আছে। খবরদার খোটা দিবিনা।
সকাল রে’গে তাকায়। হঠাৎ-ই হেসে বলে,
– তোদের সন্ধ্যার জীবন জা’হা’ন্না’ম বানিয়ে ছাড়বো আমি, শুধু দেখ।
নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই স্বার্থপর মেয়েটা আবার কি করবে? অতঃপর বলে,
– কি করবি তুই?
সকাল বসা থেকে উঠে বলে,
– আকাশ নওয়ান এর অফিসে চাকরি পেয়েছি। এখন ভাব!
কথাটা বলে গুণগুণ করতে করতে জায়গাটি প্রস্থান করে। নীরার সন্ধ্যার জন্য খারাপ লাগলো। এই সকাল সন্ধ্যাটাকে শান্তি দিল না। এখানে থাকতে-ও কত জ্বালাতো! নেহাৎ-ই সন্ধ্যা ভালো মেয়ে বলে কিছু বলত না।
চোখের পলকে আরও দু’দিন পেরিয়ে গেল। বিকেলের আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমছে। সন্ধ্যা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে মেঘলা আকাশপানে চেয়ে আছে। মেঘ জমতে জমতে বিকালের আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসলো। ঝিরঝির বৃষ্টি পরতে শুরু করে। সন্ধ্যা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দু’হাত মেলে দেয়। মুখে হাসি ফুটল। বৃষ্টি তার খুব পছন্দ।
শিমু আর শিমুর মা আরও দু’দিন এখানে থেকে সন্ধ্যাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবে বলেছে।
সন্ধ্যার পরনে হলুদ রঙের একটি কুচি করে পরা শুতি শাড়ি। মাথায় আঁচল টানা। পায়ে আলতা দিয়েছে। শিমু তাকে যে আলতা দিয়েছিল, সেই আলতা দু’পায়ে দিয়েছে। কোনো কারণ নেই। দিতে ইচ্ছে করছিল, তাই দিয়েছে।
সন্ধ্যার আলতা পছন্দ বলে সৌম্য মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার জন্য আলতার কৌটা এনে সন্ধ্যার হাতে ধরিয়ে দিত। সন্ধ্যা খুশি হয়ে সৌম্য’র দু’গাল টেনে দেখাতো – তুমি অনেক ভালো ভাইয়া।
সৌম্য হেসে সন্ধ্যার কান টেনে বলত, – এতো পাম কই পাস?
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বোঝাতো, সে সত্যি বলছে।
কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যা মৃদু হাসলো, সাথে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
বৃষ্টির গতি বাড়তে দেখে সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে জাগলো। ইচ্ছেকে দমালো না। আসমানী নওয়ান, শিমু, শিমুর মা ঘুমিয়েছে, এরকম পরিবেশে সবার ঘুম আসলে-ও সন্ধ্যার আসেনি।
সন্ধ্যা বেলকনি থেকে ঘরে এসে দু’হাতে শাড়ি উঁচু করে তার আলতা রাঙা পায়ের দিকে দৃষ্টি দেয়। এক পায়ে নুপুর না থাকায় কেমন খালি খালি লাগলো।
নুপুর পরার অভ্যেস সন্ধ্যার অনেক আগে থেকে, সেখানে মাঝে মাঝে পায়ে আলতা দেয়। এখন আলতার সঙ্গে পায়ে নুপুর না থাকায় সন্ধ্যার একটু-ও ভালো লাগলো না। অনেক ভেবেচিন্তে জড়তা নিয়ে আকাশের দেয়া নুপুরজোড়া বের করে বক্স থেকে।
মেঝেতে বসে সৌম্য’র দেয়া একটি নুপুর খুলে বক্সটিতে রেখে দেয়। এরপর আকাশের দেয়া নুপুর দু’টি দু’পায়ে পরে নেয়। সন্ধ্যা খুব মনোযোগ দিয়ে নুপুর দু’টি দেখল।
উজ্জ্বল রূপালি চেইন নুপুর এটি। সূক্ষ্ম জালির মতো নকশা। একাধিক ছোট ছোট চেইন একসাথে বোনা হয়েছে। যা সন্ধ্যার কাছে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগলো। এরপর মেঝে থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।
ছাদে পা রেখে সন্ধ্যা আশেপাশে তাকায়। বৃষ্টির বেগ প্রচুর। হালকা ঠান্ডা বাতাসে সন্ধ্যার মাথা থেকে আঁচল পড়ে যায়। সন্ধ্যা আশেপাশে তাকালো। বৃষ্টির দাপটে অস্পষ্ট লাগলেও সন্ধ্যা দেখল আশেপাশের সব ছাঁদ ফাঁকা। সন্ধ্যা ছাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। কতদিন পর বৃষ্টির পানি গায়ে পড়লো। সন্ধ্যা ছাদের চতুর্পাশে ফাঁকা জায়গা গুলো হাতের কাছে যা পেল, সেসব দিয়ে বন্ধ করে দিল। এর কারণ ছাদে বৃষ্টির পানি জমা হবে।
সন্ধ্যা ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। সন্ধ্যার হাসি দীর্ঘ হয়। ডান হাতে শক্ত খোপা খুলে দেয়। এরপর তার স্বভাবসুলভ একটুখানি নাচতে শুরু করল। অনেক ভালো নাচতে পারে, এমন নয়,, শুধু নিজের ভালো লাগার জন্য মাঝে মাঝে এমন করে।
আকাশ ঘুমিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি দেখে ছাদে এসেছে। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে সামনে পা বাড়াতে গিয়ে-ও থেমে যায়। স্তম্ভিত চোখে সামনে তাকায়।
হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত সন্ধ্যা, বাম কাঁধে শাড়ির আঁচল,, আলতা রাঙা দু’পায়ে নুপুর, আকাশ তার কিনে আনা নুপুর এক দেখাতেই চিনতে পারলো। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঘনকালো কিচকিচে চুলগুলো সন্ধ্যার নাচের সাথে দুলছে।
ছাদে জমা পানি জমে সন্ধ্যার গিরা পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। সন্ধ্যা দু’হাত মেলে মাথা উঁচু করে কয়েকবার লাফ দেয়, ফলস্বরূপ চারদিকে পানি ছিটিয়ে যায়। সন্ধ্যার মুখের হাসি আরও দীর্ঘ হয়।
সন্ধ্যা হঠাৎ-ই উল্টো ঘুরে নিচু হয়ে ছাদে জমানো পানি ছিটিয়ে দেয়, পানির কণাগুলোর স্থান হয় আকাশের মুখে। আকাশ বা দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বুজে নেয়।
দরজার কাছে সন্ধ্যা আকাশকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়। ঠোঁট লেপ্টানো হাসি মিলিয়ে যায়। দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অর্ধেকের বেশি চুল কাঁধ পেরিয়ে ডান পাশে এসে জায়গা করে নিয়েছে। যা হাঁটুর অনেকটা নিচ পর্যন্ত।
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। তার হাত পা কাঁপছে ল’জ্জায়। ঢোক গিলে শাড়ির আঁচল টেনে নেয় মাথায়। যদি-ও ভিজে গিয়েছে, তবু-ও বেশ কসরত করে মাথায় একটুখানি টেনে নিল। মাথার অর্ধেকের বেশি বাইরে বেরিয়ে থাকলো।
বৃষ্টির গতি প্রচুর। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কি করবে বুঝতে পারছে না। ডান হাতে সামনে আসা লম্বা চুলগুলো একটু একটু করে পিছনদিকে দেয়।
আকাশ নিরব দৃষ্টিতে সন্ধ্যার পানে চেয়ে। সে কি রিয়েকশন দিতে ভুলে গিয়েছে। তার মনে হলো এতো বড় চুল সে এই প্রথম সন্ধ্যার মাথায় দেখল।
দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে ঘুরছে। শ্যামলা গড়নের মেয়েটির মুখে অগণিত বৃষ্টির পানির কণা। যা অনবরত বেয়ে পড়ছে। ভেজা শাড়ি গায়ে লেপ্টে আছে, তবে শুতি হওয়ায় ততটা খারাপ লাগছে না। দু’পায়ের আলতা সাথে নুপুর আকাশের চোখে লাগলো ভীষণ।
সন্ধ্যা দু’হাত কচলায়, অস্বস্তি ঘেরা মুখে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়৷ আকাশের পরনে একটি নেভিব্লু কালার ট্রাউজার, পেশিবহুল ফর্সা উদাম শরীর। চওড়া দু’কাঁধ। দু’হাত ট্রাউজারের পকেটে রাখা। হঠাৎ আকাশকে এভাবে দেখে সন্ধ্যা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়।
সন্ধ্যা আকাশের দৃষ্টি অনুসরণ করলে, মনে হলো আকাশের দৃষ্টি তার পায়ের দিকে। এটা বুঝতে পেরে সন্ধ্যা তার দু’পা গুটিয়ে নিতে চাইলো।
এতোক্ষণ পানি জমা থাকলে-ও এখন কোনোদিক দিয়ে হয়তো ফাঁকা হয়ে গিয়ে পানিগুলো যেতে শুরু করেছে। এজন্য তার পা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। কতক্ষণ এভাবে থাকবে। নিজের সকল সংকোচ চেপে সন্ধ্যা ধীরপায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে, উদ্দেশ্য ছাদ থেকে কোনোভাবে নেমে যাওয়া।
আকাশ যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধ্যা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, মাথা নিচু তার। শরীর মৃদু কাঁপছে। আকাশের বাম পাশে একটুখানি জায়গা যেখান দিয়ে সন্ধ্যা দ্রুত পাস করে পা রাখে সিঁড়িতে। আকাশ সাথে সাথে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়।
সন্ধ্যা ভেজা গায়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে লুটিয়ে পড়ছে।
আকাশের সন্ধ্যার চুলগুলোর পানে চেয়ে হঠাৎ-ই বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– এগুলো তোমার চুল?
অর্ধেক সিঁড়ি নেমে যাওয়ার পর আকাশের কথায় সন্ধ্যার পা থেমে যায়। আকাশের বলা অযৌক্তিক কথায় সন্ধ্যা অবাক হয়। এগুলো তার চুল নয়তো, সে ধার করে এনেছে? কি অদ্ভুদ! তবে সন্ধ্যা পিছু ফিরল না। বরং আবার-ও পায়ের গতি বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। ল’জ্জা, ভ’য়, সংকোচ সবমিলিয়ে মেয়েটি পালাতে পারলে যেন বাঁচে।
আকাশ দুরন্ত সন্ধ্যার মিলিয়ে যাওয়া চুপচাপ দেখল। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। টানা বৃষ্টি ঝরছে, থামার নাম নেই। আকাশ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। চুল দাঁড়ি বেয়ে বৃষ্টির পানি টুপটুপ করে বক্ষে ঢলে পড়ে।
আকাশ শান্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসা করাতে হবে। মারাত্মক প্রবলেম হয়েছে। আকাশ বিরক্তিতে বারবার এদিক-ওদিক হাঁটতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ভেজা গায়ে বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে, এই বৃষ্টির মধ্যেই সে বেরিয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত নিল আজ আর বাড়ি ফিরবেই না। হসপিটালে কেবিন ভাড়া করে ওখানে থাকবে। নাহ হসপিটালে কেন থাকবে,, আনিকার বাড়ি গিয়ে ওর মাথা আগে টাক করবে। ডা’য়’নি টা তার ডিভোর্স পেপার পুরো ছাই করে ফেলেছে। ওর জন্য-ই এখন-ও এই মেয়ে তার বউ। আর এই মেয়ে বউ বলেই মেয়েটা তাকে রীতিমতো অসুস্থ বানিয়ে দিচ্ছে। এই মেয়ের জন্য মনে হচ্ছে তাকেই বাড়ি ছাড়তে হবে। বিড়বিড় করল,
– বে’য়া’দ’ব মেয়ে। সালাম কালাম নেই। উল্টে আমাকে অসুস্থ বানাচ্ছে! কি বে’য়া’দ’ব ভাবা যায়!
সৌম্য সকাল সকাল সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে বাসে উঠেছিল, ঢাকায় আসতে আসতে বিকাল ৪ টা বেজে গিয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, এজন্য সৌম্য’র সিএনজি পেতে দেরি হয়েছিল, ফলস্বরূপ বেশ অনেকটা ভিজে গিয়েছে আর ফিরতে-ও লেট হলো। সৌম্য তার মেসের সামনে একটি রিক্সা থেকে মাত্র নামলো। তার রুমের পাশের রুমে নক করে। রিহান দরজা খুলে সৌম্য’কে দেখে অবাক হয়ে বলে,
– আজ আসবি, কল করলি না যে!
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– ফোন অন করিনি। রুমের চাবি দে।
রিহানের মন পড়ে, চাবি ইরা নিয়ে গিয়েছে। অতঃপর বলে,
– তোর ঘরের চাবি তোর ইরাবতী নিয়ে গেছে।
সৌম্য অবাক হয়ে বলে,
– মানে?
– যা বললাম তাই।
সৌম্য রে’গে বলে,
– তুই চাবি দিলি কেন?
রিহান ঘরের ভেতরে গিয়ে বলে,
– জোর করে নিয়েছে, কি করব?
সৌম্য রিহানের ঘরে গিয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– চাবি রেখে যাওয়াই ভুল হয়েছে আমার।
রিহান কিছু বলল না। সৌম্য রুমের বিদ্যমান সিঙ্গেল বেডের উপর বসে দু’হাত জমা করে দু’হাঁটুর উপর রাখে। মিটিন তিনেক পর-ই সৌম্য উঠে দাঁড়ায়। তার ব্যাগ থেকে একটি শার্ট, প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নেয়।
এরপর দ্রুত বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালে রিহান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কই যাস? তুই আসবি জানতাম না, তাই তোর জন্য মিল নিইনি। আগে বললে নিয়ে রাখতাম।
সৌম্য কিছু বলল না। রিহান এগিয়ে এসে সৌম্য’র হাত টেনে বলে,
– আরে কই যাস? আমি খাবার এনে দিচ্ছি বাইরে থেকে। তুই রেস্ট নে।
সৌম্য বিরক্ত হয়ে বলে,
– কাজ বাড়িয়ে রেখেছিস, এখন রেস্ট করব কিভাবে?
একটু থেমে বলে,
– আগামীকাল বোনুকে এখানে আনবো। রুমের তো বারোটা বেজে আছে। চাবিটা নিয়ে আসতে হবে।
রিহান অবাক হয়ে বলে,
– খোঁজ পেয়েছিস?
সৌম্য রিহানের দিকে তাকায়। মুখে মলিনতার ছোঁয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– পাইনি। তবে কালকে পাবো। দোয়া করিস যেন বোনুর খোঁজ পাই। কতদিন হয়ে গেল ওকে দেখিনা!
রিহান সৌম্য’র কাঁধে হাত রেখে নিরব সান্ত্বনা দেয়।
ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে। সৌম্য একটি ফাঁকা জায়গায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইরার ফোনে মেসেজ দিয়েছে। সাথে লোকেশন পাঠিয়েছে, সে যেখানে আছে।
সৌম্য এইকয়দিনে তার ফোন কয়েকবার অন করেছিল মাত্র। তাছাড়া সবসময় বন্ধ করে রাখতো। যখন ফোন খুলত, ইরার কতশত মেসেজ, কল নোটিফিকেশন ভেসে উঠত। সৌম্য মলিন মুখে ফোন হাতে বসে থাকতো। ইরার কল আসলে দ্রুত ফোন অফ করে রাখতো। কথাগুলো ভেবে সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
হঠাৎ-ই ইরা একপ্রকার দৌড়ে এসে সৌম্য’র গলা জড়িয়ে ধরে। সৌম্য’র শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। দু’সেকেন্ডে-ই সৌম্য ইরাকে চিনলো। ঢোক গিলে নেয় সৌম্য। ইরা দু’পা উঁচু করে দু’হাতে শক্ত করে সৌম্য’র গলা জড়িয়ে ধরেছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটি। সৌম্য তার ডান হাত ইরার মাথায় রাখতে গিয়ে-ও গুটিয়ে নেয়। চোখ বুজে বহুক’ষ্টে কয়েকবার ঢোক গিলল। মৃদুস্বরে বলে,
– ইরা ছাড়।
ইরা ছাড়লো না। বরং আর-ও শক্ত করল হাতের বাঁধন। সৌম্য স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ইরা সৌম্য’কে ছেড়ে দু’হাতে সৌম্য’র গাল আগলে নিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– কোথায় হারিয়েছিলি তুই সৌম্য? আমি এই কয়েকটাদিন পা’গ’লের মতো খুঁজেছি তোকে, কোথাও পায়নি৷ বল না, তুই কই হারিয়েছিলি? আর এমন করিস না সৌম্য। আম.আমার দম আটকে আসে।
সৌম্য ইরার বিধ্বস্ত মুখপানে চেয়ে রইল৷ ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে, চোখদু’টো অসম্ভব লাল। সৌম্য’র চোখেমুখে অসহায়ত্ব। চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শক্ত করল৷ এরপর তার দু’গাল থেকে ইরার হাত সরিয়ে দিয়ে সৌম্য নিজেই দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলে,
– তুই আমার থেকে দূরে থাকবি ইরা৷ আর কতবার বলব তোকে?
ইরার ঝাপসা চোখে তাকালো সৌম্য’র দিকে। আবার-ও সৌম্য’র দিকে এগিয়ে গিয়ে করুণ কণ্ঠে বলে,
– আমি তোকে খুব ভালোবাসি সৌম্য। কেন বুঝে-ও বুঝিস না তুই?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– কারণ আমি তোকে ভালোবাসিনা।
কথাটা শুনতেই ইরা দু’হাতে সৌম্য’র শার্টের কলার ধরে চেঁচিয়ে বলে,
– তুই মিথ্যা বলছিস৷ মিথ্যুক তুই। আমাকে ভালোবেসে স্বীকার করিস না তুই।
সৌম্য ঢোক গিলে ইরার দু’হাত তার কলার থেকে ঝাড়া মে’রে সরিয়ে দিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
– ভালো বাসি না আমি তোকে৷ বাসি না ভালো৷ বাসি না। বুঝলি তুই?
ইরা কান্নামাখা চোখে সৌম্যকে দেখল। মাথা নিচু করে আশেপাশে কিছু খুঁজল। মেস থেকে আনা সৌম্য’র সেই ডায়রি, যেটা সে সাথে এনেছিল৷ হাতে-ই ছিল। পড়ে গিয়েছে হয়তো৷ রাস্তা থেকে ডায়রিটি কুড়িয়ে নিয়ে সৌম্য’র দিকে ধরে বলে,
– এবারে-ও মিথ্যা বলবি?
সৌম্য ইরার হাতে তার কেনা ছোট্ট ডায়রিটির দেখে ঢোক গিলল। তেমন কিছু-ই লেখা নেই৷ আবার আছে-ও। প্রথম পাতায় লেখা আছে, – ইরাবতী? আমার লাইফের সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা শুনবি?,,, তোকে একটু-ও ভালোবাসি না ইরাবতী।
ডায়রির একদম শেষ পাতায় লেখা – ইরাবতী তুই আমার নয়, তাই তোকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস দেখাতে পারলাম না৷ ডায়রির পাতাগুলো তবে ফাঁকা-ই থাকলো, ঠিক যেভাবে সৌম্য’র হৃদয় ইরাবতী বিহীন শূণ্য থাকবে।
ইরা কান্নামাখা গলায় বলে,
– কেন অস্বীকার করিস সৌম্য? আমার কিচ্ছু চাই না, শুধু তুই আমাকে তোর সাথে রেখে দে না সৌম্য!
সৌম্য ঝাপসা চোখে ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ-ই উল্টো ঘুরে দ্রুতপায়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। ইরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। প্রায় পাঁচ মিনিট পর সৌম্য একটি লাইটার কিনে আনে। ইরা কিছু বোঝার আগেই সৌম্য ইরার হাত থেকে ডায়রিটা কেড়ে নিয়ে লাইটারের সাহায্যে ডায়রিতে আগুণ জ্বালিয়ে দেয়। ইরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দৌড়ে গিয়ে ডায়েরিটা নিতে চায়, তার আগেই সৌম্য সেটি দূরে ছুঁড়ে ফেলে। ইরা সেদিকে দৌড় দিতে গেলে সৌম্য বা হাতে ইরার ডান হাত টেনে ধরে। এরপর বা হাতে ইরার মুখ তার দিকে ফিরিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
– ওই ডায়রিটা যেভাবে পুড়ছে, ঠিক সেভাবেই তোর প্রতি আমার ভালোবাসা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। এবার আমাকে ভুলে যা ইরাব….
বলতে গিয়ে-ও আর বলতে পারলো না সৌম্য। গলা ধরে আসে তার৷ ইরার টইটুম্বুর আঁখিতে দৃষ্টি মিললে সৌম্য ডানদিকে ঘাড় ফিরিয়ে চোখ বুজে নেয়। ইরা দু’হাত সৌম্য’র গাল তার দিকে ফিরিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– তুই মিথ্যে বলছিস সৌম্য। আমার কিচ্ছু চাই না। আমি তোর সাথে টিনের ঘরে থাকবো, তুই আমাকে তিনবেলা খেতে দিতে না পারলে-ও আমি একটু-ও অভিযোগ করব না। তুই যেভাবে রাখবি, আমি সেভাবে-ই থাকবো, আমি মধ্যবিত্ত সৌম্য’র বউ হয়ে পুরনো, ছেড়া শাড়ি পরব। বিশ্বাস কর, আমার একটু-ও ক’ষ্ট হবে না। তুই আমাকে শুধু একটু ভালোবাসবি সৌম্য?
সৌম্য শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ খুলল না। ইরা আবার-ও সৌম্য’র গলা জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা গলায় বলে,
– বল না সৌম্য, আমায় ভালোবাসবি তুই?
সৌম্য চোখ বুজে রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– পারবো না।
ইরা সৌম্য’র কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে সৌম্য’র পায়ের কাছে বসে পড়ে৷ দু’হাতে সৌম্য’র বাম পা আঁকড়ে ধরে সৌম্য’র উরুতে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমায় ফিরিয়ে দিস না সৌম্য। আমি তোকে ছাড়া ম’রে যাবো রে! তোর ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। চল না সৌম্য আমরা বিয়ে করে নিই।
অন্তঃদহন পর্ব ১২
কথাগুলো বলে আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সৌম্য নড়লো না একটু-ও। একটি টুঁ-শব্দটিও করল না। বুকের হাড়গুলো সব যেন একসাথে চেপে আসছে। সৌম্য’র নিঃশ্বাস নিতে ক’ষ্ট হয়। দমবন্ধ লাগছে তার। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ার আগে-ই সৌম্য ডান হাতের শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নেয়। চোখ খুলে অন্ধকার আকাশপানে তাকায়। দৃষ্টিজোড়া আবার-ও ঝাপসা ঠেকল। ভেতর থেকে একটি করুণ সুরে বাক্য বেরিয়ে আসে,
– এই সমাজে সৌম্য’দের ভালো থাকা যে মানা ইরাবতী!