অন্তঃদহন পর্ব ১৬
DRM Shohag
কথাটা বলে আবার-ও চোখ বুজে নেয় আকাশ। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। কি রিয়েকশন দিবে বুঝল না। কিন্তু সময় ন’ষ্ট না করে ওয়াশরুমে যায়। একটি মগে পানি ভরে আনে। অন্ধকারে কিছু খুঁজে না পেয়ে সন্ধ্যা তার শাড়ির আঁচল মাথা থেকে নামিয়ে
একটু অংশ ভিজিয়ে ভিজিয়ে আকাশের কপালে জলপট্টি দিয়ে দেয়। এরপর বা হাতে আকাশের চুল টেনে দিতে থাকে। একটু পর পর আঁচল উঠিয়ে মগের পানিতে ভিজিয়ে আবার-ও কপালে দিয়ে দেয়। সাথে মাথার চুল টেনে দিতে থাকে। এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো জলপট্টি সাথে চুল টেনে দিয়ে সন্ধ্যার দু’হাত ব্য’থা হয়ে যায়। একপর্যায়ে সন্ধ্যা কাঁপা হাত আকাশের গলায় দিলে বুঝতে পারে, আকাশের গায়ে আর জ্বর নেই। সন্ধ্যা আকাশের শরীরে জড়ানো কাঁথা সরিয়ে দেয়। আকাশ একটু নড়েচড়ে ঘুমে বিভোর হয়।
সন্ধ্যা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল আকাশের মাথার কাছে। একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে আছে মেয়েটি। আকাশ সটান হয়ে শুয়েছে। দু’হাত আড়াআড়িভাবে বুকে গুঁজে রাখা। ফ্যানের বাতাসে মাথার চুলগুলো একটু একটু উড়ছে। সন্ধ্যার
চোখের কোণ কখন যে ভিজে গাল গড়িয়ে পানি পড়ে,, মেয়েটি বুঝতেই পারেনা। আচ্ছা তার এতো ক’ষ্ট কেন হচ্ছে? কয়েকদিনের বিয়ে করা স্বামী-ই তো! তবুও সন্ধ্যার মন মানে না। মেয়েটি এখানে আর দাঁড়ালো না। ডান হাতে ভেজা গাল মুছে ধীর পায়ে ঘরটি থেকে প্রস্থান করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সন্ধ্যা আকাশের ঘর থেকে এসে বিছানায় শুয়েছিল ঠিক-ই। কিন্তু তার চোখে ঘুম ধরা দেয়নি। সারারাত ছটফট করে কাটিয়েছে। ভোরের দিকে একটুখানি চোখ লেগেছিল, এক ঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছে। তারপর আবার-ও ঘুম ভেঙে যায়।
সন্ধ্যা ফজর নামাজ পড়ে বেলকনিতে যায়। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস মেয়েটির গা ছুঁয়ে দেয়। সন্ধ্যা মলিন মুখে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে সন্ধ্যার চোখে পড়ে তার বেলকনি সোজা কিছুটা দূরে খাড়াভাবে দাঁড়ানো বকুল গাছ। সন্ধ্যা এর আগে-ও ওখানে গিয়ে বকুল ফুল কুড়িয়ে এনেছে। আজ আবার-ও ইচ্ছে করল। ইচ্ছেকে না দমিয়ে বাগানের উদ্দেশ্যে ছুটে গেল।
সকাল সকাল আকাশের ঘুম ভেঙে যায়। মাথাটা ভার হয়ে আছে। খেয়াল করল তার পরনে পাঞ্জাবি। গতকাল রাতে শরীর, মন দু’টোই খারাপ লাগছিল, কখন ঘুমিয়েছে নিজে-ও বুঝতে পারেনি। ফ্রেশ না হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। স্মৃতিতে আবছা মনে হলো, সন্ধ্যা তার কাছে এসেছিল। কথাটা ভেবে আকাশ তার ব্রইনে চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তেমন কিছু মনে করতে পারলো না। আকাশ নিজের উপর বিরক্ত হলো। ভাবলো, আজ সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে গেলে সে এসব অবান্তর চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি পাবে। এই ভেবে একটু স্বস্তি পায়।
এরপর আকাশ বেড থেকে নেমে দাঁড়ালে পায়ের সাথে কিছু বেঁধে পরে যায়। আকাশ নিচু হলে দেখল পানিভর্তি মগ ছিল, যা তার পা বেঁধে সব পানি ঢেলে পরে গিয়েছে। আকাশ অবাক হলো। এই মগ-ভর্তি পানি এখানে কিভাবে আসলো? সে কি এনেছিল? কিন্তু কেন আনবে? আকাশ বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কি যে হচ্ছে তার সাথে। নিজেকে পা’গ’ল পা’গ’ল লাগে।
আকাশ সকাল সকাল শাওয়ার নিল। অস্বস্তি লাগছিল। তাছাড়া আজ সারাদিন বাইরে কাজ আছে। বাড়িতে আসার সময় পাবে না। আকাশ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাথা মুছে বেলকনিতে যায়। এককাপ কফি হলে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন সবাই ঘুমে। ভাবলো সে নিজেই গিয়ে বানিয়ে আনবে। কিন্তু বেলকনিতে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকে যায়, প্রকৃতির মাঝে এক অন্যরকম সন্ধ্যাকে দেখে।
সন্ধ্যা মাটিতে বসে বকুল ফুল কুড়াতে ব্যস্ত। খোপা করা দীঘল চুলগুলো মাটিতে গড়িয়ে লুটোপুটি খায়। সন্ধ্যা বসে একটা একটা করে ফুল কুড়িয়ে শাড়ির আঁচলে ভরিয়ে রাখছে।
আকাশ একধ্যানে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যার গতিবিধি লক্ষ্য করায় বিভোর হলো। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলে আকাশ বা হাত বেলকনির রেলিঙে রেখে চোখ বুজে নেয়। হৃৎস্পন্দনের চাপ বেড়েছে। আকাশ মাথা দু’দিকে নাড়ায়। নাহ, সে আর সন্ধ্যাকে দেখবে না।
সন্ধ্যা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। হঠাৎ তার সম্মুখ বরাবর দোতলায় দৃষ্টি গেলে আকাশকে দেখে অবাক হয়। মেয়েটির চোখেমুখে সামান্য ল’জ্জার ছিটেফোঁটা। তবে আকাশের থেকে দৃষ্টি সরালো না। আকাশ একবারের জন্য-ও চোখ খুলল না। সন্ধ্যার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। সে আর দাঁড়ালো না। বকুল ফুলে ভরা আঁচল হাতে ধরে দৌড় দিল এখান থেকে।
আকাশ আরও কয়েক সেকেন্ড পর চোখ মেলে তাকায়। জায়গাটি ফাঁকা দেখে আকাশের দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে। চঞ্চল হয় খানিক। কিন্তু সন্ধ্যাকে আর চোখে পড়ল না। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে তো দেখবে না সন্ধ্যাকে। তবুও কেন খুঁজছে তার দৃষ্টি। সে তার নতুন অনুভূতির চক্করে মনে হচ্ছে ডিপ্রেশনে পড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে যায়।
সন্ধ্যা তার ঘরে এসে ফুলগুলো বিছানার উপর রাখে। এরপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে সুই-সুতো বের করে বিছানায় গিয়ে বসে। সুঁইয়ে সুতো লাগিয়ে ছোট্ট ছোট্ট বকুল ফুলগুলো একটি একটি করে শুইয়ের মাঝে গেঁথে দেয়।
তার সব আনা ফুলগুলো দিয়ে দু’টো ছোট্ট মালা বানায়। এরপর একটি ফুলের মালা সন্ধ্যা তার হাতে দু’প্যাঁচ দিয়ে পরে। হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে সন্ধ্যা।
সুঁই-সুতো ড্রয়ারে রেখে ফুলের মালা দু’টো টেবিলের উপর রাখে। এরপর চেয়ারে টেনে বসে একটি প্যাড খুলে সাদা পাতা বের করে। ডান হাতে একটি পেন্সিল নেয়,, এরপর খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু আঁকতে থাকে।
সন্ধ্যার হাতের কাজ সুন্দর। ক্লাস সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত ক্লাসে আঁকতে হতো। হাতের কাজ ভালো হওয়ায় আঁকার হাত খুব একটা খারাপ না। আবার অনেক ভালো-ও না। তবে যা পারে, তা চলনসই।
প্রায় ১ ঘণ্টা সময় নিয়ে বেশ কসরত করে কিছু আঁকলো। ছবির নিচের দিকে এক কোণায় টুপ করে একফোঁটা পানি পড়ে। সন্ধ্যা শাড়ির আঁচল দ্বারা অতি যত্নে পানিটুকু মুছে দেয়।
এরপর তার আঁকা ছবির নিচে কয়েক লাইন লিখে রেখে দেয় প্যাডটি। গাঁথা মালার একটি তার হাতের কব্জিতে পরা, আরেকটি মালা আঁকানো ছবিটির উপর রেখে দেয়। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি লেপ্টে। তবে দৃষ্টি ঝাপসা।
ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ৯ বেজে ৩০ মিনিট।
আকাশ সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। বা হাতে চেইন ঘড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত খুব সুন্দর করে গোটায়।
টানা কয়েকদিন এই সাদা পাঞ্জাবি পরার কারণ সে তার অফিসে যায় না, বরং খুব সভ্য, ভদ্র এক সভাপতি হওয়ার সকল কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকে সে। আজ-ও তার ব্যতিক্রম নয়। বেশ কয়েকটা এলাকায় অভাবীদের কিছু কাপড় বিতরণ করবে সে। তাছাড়া বড় বড় নেতাদের সাথে সাক্ষাৎের ব্যাপার আছে।
আকাশ এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসল নাস্তা করার উদ্দেশ্যে। পাশে অরুণ বসা। ছেলেটা আগের মতো কথা বলে না। অনামিকার সাথে সেই ঘটনার পর থেকে একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– মেয়েজনিত চক্করে পড়া কতবড় ভুল এইবার বুঝেছিস? যা হবার হয়েছে, এখন এসব ভুলে যা। পৃথিবীতে মেয়ে মানুষ বলে কেউ আছে এটাই ভুলে যা। আর শান্তিতে থাক।
অরুণ খাবার গিলে একটু হেসে বলে,
– তোর কপালে যে কি আছে। মেয়ে মানুষের থেকে দূরে থাকার জন্য আমাকে যত টিপস্ দিলি জীবনে। হাহ! খা ভাই। আমি আমার মতো ভালোই আছি।
আকাশ আর কিছু বলল না। আসমানী নওয়ান চুপচাপ আকাশের প্লেটে খাবার দেয়। আকাশ মায়ের নিশ্চুপতা দেখল। কিছু বলল না, কিছু বলার নেই-ও। একবার খাবার মুখে নিতেই চোখে পড়ল সন্ধ্যা রান্নাঘর থেকে এদিকে এগিয়ে এসে একটি চেয়ার টেনে বসল। সন্ধ্যার অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু আসমানী নওয়ান তাকে বসতে বলেছে। ভদ্রমহিলার এমনি-ই মন খারাপ, সেখানে সন্ধ্যা তার কথা না মেনে তার মন আরও খারাপ করে দিতে চায়নি। তাই চুপচাপ এসে বসল। অপরপাশে একটু বামদিকে সরে আকাশ বসা। সন্ধ্যা ঢোক গিলে চোখ তুলে তাকালে আকাশের সাথে চোখাচোখি হয়। দু’জনেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। আকাশ খাওয়ায় মনোযোগী হয়। সন্ধ্যা-ও একটু একটু করে খাচ্ছে।
অরুণ খাবার শেষ করে বেরিয়ে গিয়েছে। আকাশ পানি খেয়ে একবার সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সে যতবার সন্ধ্যাকে দেখছে, শুধু মনে হচ্ছে মেয়েটি আজ চলে যাবে। গলা ঝেড়ে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– তোমার ভাইয়া কখন আসবে?
সন্ধ্যা চোখ তুলে তাকায়। দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে জানায়, সে জানেনা। আকাশ আর কিছু বলল না। চুপচাপ উল্টো ঘুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যার আবার-ও চোখজোড়া ঝাপসা হয়।
মন বলে ওঠে,
– আমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়ানোর এতো তাড়া কেন আপনার!
সন্ধ্যার পর পর,, সন্ধ্যা রেডি হয়ে বেলকনিতে বসে আসে। কমদামি এক বোরখা পরনে, সাথে মাথায় হিজাব বাঁধা। এই দু’টো কাপড় সৌম্য’র কিনে দেয়া।
রেডি হয়ে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে সন্ধ্যা। সে জানে সৌম্য যখন বলেছে, সৌম্য তাকে নিতে আসবে, তখন সৌম্য তাকে নিতে আসবেই। আসমানী নওয়ান তার সাথে আজ সারাদিন সেভাবে কথা বলেনি। আকাশকে সকালে একবার দেখেছিল। এরপর আর একবারের জন্য-ও দেখেনি আজ।
সন্ধ্যা তাকে দেয়া গহনা, শাড়ি সবকিছু আসমানী নওয়ানকে ফিরিয়ে দিতে নিলে তিনি বলেন,
– এসব তোর-ই জান্নাত।
সন্ধ্যা ইশারায় বোঝায়, তার আর আকাশের তো ডিভোর্স হয়ে যাবে, তখন তিনি উত্তরে বলেছেন,
– এসব নেয়ার জন্য তোকে আকাশের বউ হতে হবে
না। সব তোর কাছে রাখ।
সন্ধ্যা আসমানী নওয়ান এর কথা ঠিক বোঝেনি। তবে সে এসব কিচ্ছু নেয়নি তার সাথে, সব এই ঘরের এক কোণায় রেখে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে সে তার ভাইয়ের দেয়া শিক্ষায় বড় হয়েছে। যে শিক্ষায় আত্মসম্মান এর পরিমাণ ছিল অনেক। সন্ধ্যা কিছুতেই এসব নিতে পারবে না।
সৌম্যকে আসতে দেখে সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে আর দাঁড়ালো না। একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সৌম্য বেল বাজানোর আগেই সন্ধ্যা দরজা খুলে দেয়। সৌম্য সামনে তাকিয়ে তার বোনকে দেখে মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি বোনু! দেরি হয়ে গিয়েছে।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বোঝালো, কোনো সমস্যা নেই। পিছন থেকে আসমানী নওয়ান ভেজা গলায় বলে,
– না বলেই চলে যাচ্ছিস জান্নাত?
সন্ধ্যা সাথে সাথে পিছু ফিরে তাকায়। আসমানী নওয়ান এর কাছে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে সন্ধ্যা। সে কি কখনো এনার প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারে? যেখানে সন্ধ্যাকে সবাই দূরে ঠেলে দিয়েছে, তার ভাই ছাড়া। সেখানে আকাশের মা-ও একজন মায়ের মতো তাকে কত ভালোবাসা দিয়েছে। সন্ধ্যা ইশারায় বোঝায়,
– আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
আসমানী নওয়ান ভেজা চোখে চেয়ে সন্ধ্যার মুখে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে।
শিমুর মা এগিয়ে এসে সন্ধ্যার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
– আমাদের সাথে দেখা করতে আসার কথা ভুলিস না যেন মা।
সন্ধ্যা মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, দমকা হাওয়ায় যেমন কেউ কিছু হারিয়ে ফেলে, নয়তো পেয়ে যায়, ঠিক তেমনি সে এক দমকা হাওয়ায় পেয়ে যাওয়ার মধ্যে এই ভদ্রমহিলা দু’টিকে মা হিসেবে পেয়েছে।
আকাশ সেই সকাল সকাল বাইরে চলে গিয়েছিল।সভাপতি হওয়ার জন্য মোটামুটি অনেক শ্রম দিয়ে বেচারা ক্লান্ত। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো সফল-ও হবে। এটা নিয়ে আকাশের মন ভালো আজ।
মাত্র ফিরে গেইটের সামনে সৌম্য’কে দেখে মনে পড়ল, আজ সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে যাবে।
সৌম্য তার পাশে আকাশকে দেখে সালাম দেয়। আকাশ সালাম এর উত্তর নেয়। গতকালকের ব্যবহারের জন্য সৌম্য ভীষণ বিব্রতবোধ করছে। গলা ঝেড়ে বলে,
– ভাইয়া গতকালকের জন্য স্যরি!
আকাশ সৌম্য’র কাঁধে হাত রেখে বলে,
– চাপ নিও না। রা’গ তো গতকালকেই পড়ে গিয়েছে। আমি-ও ভুলে গিয়েছি৷
সৌম্য একটু হাসলো। তার হাতের চেক আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিলে আকাশ ভ্রু কুঁচকে চেকটি নেয়। অবাক হলো না, আবার ফিরিয়ে-ও দিল না। সে সৌম্য’কে চেনে। এই টাকা সে দিবেই। ভীষণ আত্মসম্মান ছেলেটির। শিমুকে পড়তে দিয়ে মোটামুটি ভালো-ই চিনেছে সৌম্যকে। অযথা কথা খরচ করল না তাই এটা নিয়ে। অতঃপর বলে,
– ডিভোর্স পেপার আসতে কিছুদিন সময় লাগছে। পেপার আসলে আমি তোমাকে কল করলে আমার সাথে যোগাযোগ কর, কেমন?
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি ভাইয়া।
সৌম্য আকাশের উপর রা’গ’লো না। আকাশ সুষ্ঠুভাবে ডিভোর্স দিতে চাইছে, এখানে তার কিছু বলার নেই। তার বোনের গায়ে ডিভোর্সি ট্যাগ লাগবে। সৌম্য’র ক’ষ্ট হলো তার বোনুর জন্য। কিন্তু কিছু করার নেই। এ তো নতুন নয়, তাদের দুই ভাইবোনের কপাল এমন-ই। সৌম্য মেনে নিয়েছে। সে তার বোনকে আগলে রাখবে তার কাছে।
সৌম্য আকাশের থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যাকে বলে বাইরে যায়, সে চেকটি দিতে এসেছিল। এখন রিক্সা ডেকে এনে এখান থেকে বোনুকে নিয়ে যাবে। আকাশ এগিয়ে দিতে চেয়েছিল, সৌম্য না করে দিয়েছে।
আকাশ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে সামনে সন্ধ্যাকে দেখে থেমে যায়।
আকাশের বলা ডিভোর্স পেপার এর কথা শুনে সন্ধ্যার চোখ জলে চিকচিক করে। আকাশ শান্ত দৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে।
আসমানী নওয়ান, শিমুর মা ভেতরে চলে গিয়েছে। তবে শিমু এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ফোনে রিলস দেখছিল, এর মধ্যেই সন্ধ্যাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মলিন মুখে চেয়ে আছে। হঠাৎ-ই আঙুলের চাপ লেগে একটি রিলস্ চালু হয়, যেখানে একটি মেয়ে কণ্ঠে গান বেজে ওঠে,
– বুঝবি তুই, কাঁদবি তুই
যখন আমি থাকবো না,
হাত বাড়িয়ে, ডাকবি তুই
আর তো ফিরে আসবো না।
এটুকু হতেই শিমু দ্রুত তার ফোন অফ করে দেয়। আকাশ, সন্ধ্যা দু’জনেই শিমুর দিকে তাকায়। শিমু ছোট করে বলে,
– স্যরি!
আকাশ কিছু বলল না। সন্ধ্যা আকাশের দিকে চেয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। আকাশ অবাক হয় সন্ধ্যার হাসিতে। সন্ধ্যা নিজেকে সামলে হাত দিয়ে ইশারায় বোঝায়,
– ভালো থাকবেন।
আকাশের নজর সন্ধ্যার হাতে পড়লো। বকুল ফুলের মালা সন্ধ্যার ডান হাতে পেঁচানো। আকাশের মনে পড়লো ভোরে সন্ধ্যার ফুল কুড়ানোর দৃশ্য।
সন্ধ্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে নেয়। ক’ষ্ট হচ্ছে তার। সন্ধ্যা আর সময় ন’ষ্ট করল না। শিমুকে হাত নেড়ে বাই বলে আকাশকে পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। চোখের কোনে লেগে থাকা নোনতা জলকণা ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল দ্বারা মুছে নেয়।
আকাশ দ্রুত পিছু ফিরে তাকায়। দেখল সন্ধ্যা ব্যস্ত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আকাশ ঢোক গিলল। বুকটা কেমন যেন চিনচিন করে উঠল। তবে সন্ধ্যা চলে গিয়েছে মনে হতেই আকাশের মন বলে ওঠে, এবার সে এই অনুভূতি থেকে মুক্তি পাবে। আর পা’গ’ল পা’গ’ল লাগবে না তার।
আকাশের বাবা কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরে এদের সকলের কাহিনী দেখেছে চুপচাপ। তার চোখেমুখে ছিল বিরক্তি সাথে সন্ধ্যা চলে যাওয়ার কারণে ছিল খুশির ঝিলিক।
মেসের সামনে এসে রিক্সাওয়ালাকে দাঁড়াতে বলে সৌম্য। এরপর সে রিক্সা থেকে নেমে সন্ধ্যার হাত থেকে একটি মাঝারি সাইজের ব্যাগ নিয়ে একপাশে রাখে। এরপর সন্ধ্যার হাত ধরে বলে,
– বোনু নেমে আয়।
সন্ধ্যা বা হাতে বোরখা সামান্য উঁচু করে রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায়। সৌম্য রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এক হাতে সন্ধ্যার হাত ধরে, আরেক হাতে ব্যাগটি নিয়ে এগিয়ে যায় তার মেসের দিকে। এরপর পকেট থেকে চাবি বের করে ঘরের তালা খোলে। দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে আগে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– ভেতরে আয় বোনু।
সন্ধ্যা ঘরের ভেতরে পা রাখে। আশেপাশে তাকায়। সন্ধ্যার কাছে ঘরটি জেলখানার মতো লাগলো। এর চেয়ে তো তাদের গ্রামের টিনের বাড়ি-ও ভালো আছে। ঘরের এক কোণায় ছোট্ট একটি চৌকি পাতা। এক সাইডে একটি টেবিল, বইয়ের ভাড়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আর কিছু হাঁড়িপাতিল, যা রাখার জায়গা নেই। ঘরের কোণায় একটি ছোট্ট ব্যাগ দেখল, ওখানেই হয়তো কয়েকটা কাপড় আছে। তার ভাই এখানে থাকে ভাবতেই সন্ধ্যার চোখজোড়া ভিজে ওঠে। সৌম্য সন্ধ্যার মনোভাব বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বলে,
– আমার এখানে থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে গেছে বোনু। তুই এইখানে একটা রাত ক’ষ্ট করে থাকতে পারবি না?
সন্ধ্যা টলমলে চোখে তার ভাইয়ের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, সে পারবে।
সৌম্য মলিন মুখে তার বোনের পানে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বোনু তুই ফ্রেশ হয়ে নে কেমন? আমি বাইরে থেকে খাবার কিনে আনছি।
সন্ধ্যা সৌম্য’র হাত টেনে ধরে দু’দিকে মাথা নাড়ায়। ইশারায় বোঝায়,
– আমি খিচুড়ি রান্না করি ভাইয়া?
সৌম্য সন্ধ্যার কথা বুঝতে পেরে হাসলো। সৌম্য’র খিচুড়ি পছন্দ বলে, বাড়িতে গেলে সন্ধ্যা লুকিয়ে, চুরিয়ে তার জন্য খিচুরি রান্না করে রাখতো। এরপর সে গেলে যত্ন করে তার সামনে খাবার এনে দিত। সৌম্য সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– ছোট মায়ের হাতের খিচুড়ি অনেক মিস করেছি। অবশ্যই আজ সুযোগ পেয়েছি যখন, তখন খাবো।
সন্ধ্যা হাসলো। সৌম্য ঘরের কোণায় কারেন্ট এর চুলা সেট করে সন্ধ্যাকে দেখিয়ে দেয়,, এটা সে আর রিহান শেয়ারে কিনেছিল। এরপর সৌম্য খিচুড়ি রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বের করে দেয়। এগিয়ে এসে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে খুব সাবধানে কাজ করবি বোনু কেমন? আমি তোর জন্য ফুসকা আনতে যাচ্ছি। তুই যে শুধু শহরের ফুসকা খেতে চাইতি। আগে তো সুযোগ পাইনি। আজ আগে তোর ইচ্ছে পূরণ করি।
সন্ধ্যা খুশি হয়ে দু’হাতে সৌম্য’কে জড়িয়ে ধরে, ভাইয়ের বুকে মাথা রাখলো। সৌম্য সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে মৃদু হাসলো। তার বোনু-ই তার সব। এই যে তার বোনু তার কাছে এসেছে, কি যে শান্তি লাগছে। এইকয়টাদিন কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিল।
সৌম্য সন্ধ্যা ছেড়ে বেরিয়ে যায়, যাওয়ার আগে সন্ধ্যাকে ঘরের দরজা আটকে দিতে বলে। আর বলে,
– যাবো আর আসবো। ভ’য় পাস না যেন বোনু।
সন্ধ্যা চলে গেলে আকাশ বাইরে এসেছে। কি জানি কেন, সে সন্ধ্যা যাওয়ার পর থেকে সেই পথে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে তাকে। কিন্তু কেন? আকাশ কয়েক পা হাঁটলো রাস্তায়। এদিক-ওদিক হেঁটে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইছে। ব্যর্থ হয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। পুরো বাড়ি কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ঘরে চলে আসে। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। এরপর এগিয়ে গিয়ে হাতঘড়ি খুলে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল একটি বক্স। বক্সটি আকাশের পরিচিত ঠেকল। হাতঘড়ি টেবিলের উপর রেখে বক্সটি তুলে নেয় আকাশ। অতঃপর বক্সের মুখ খুললে চোখে পড়ে দু’টো নুপুর সযত্নে বক্সের ভিতর পড়ে আছে। আকাশের চোখেমুখে বিস্ময়। ডান হাতে নুপুর দু’টি তুলে উঁচু করে মুখের সামনে ধরে। এটা তো সন্ধ্যাকে দেয়া তার নুপুর। সে খুব পছন্দ করে কিনে এনেছিল নুপুরজোড়া।
জীবনের প্রথম নুপুর কিনছিল কোনো মেয়ের জন্য। সে জানেনা কেন, প্রথম তার পছন্দ হয়েছিল, আর দ্বিতীয়ত সন্ধ্যার কান্নায় তার খারাপ লেগেছিল। মেয়েটি তাকে ফেরত দিয়ে গেল কেন? আকাশের একটুখানি রা’গ হলো সন্ধ্যার উপর, খারাপ লাগলো ভীষণ। তার দেয়া পছন্দের জিনিসটুকু কাছে রাখলে খুব কি ক্ষ’তি হতো?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুপুর দু’টি বক্সে রেখে দেয়। একটি ভাঁজ করা কাগজ উড়ে মেঝেতে পড়ে গেলে আকাশ নিচু হয়ে কাগজটি কুড়িয়ে নেয়। এরপর সোজা হয়ে ধীরে ধীরে কাগজের ভাঁজ খুলে লেখাগুলো মনে মনে আওড়ায়,
এই যে শুনুন,
একটা আবদার রাখবেন?
আমাকে ভুলে গিয়েও হঠাৎ কোনো এক ভোরে, নয়তো কোনো এক বিকেলে, নয়তো কোনো এক সন্ধ্যায় এই সন্ধ্যাকে মনে করবেন?
জানি করবেন না। চাঁদ সবসময় বামুনের থেকে পিছিয়ে যায়। আমার উদ্ভট আবদারে বিরক্ত হলে, ক্ষমা করবেন।
আপনার হয়তো রাজনীতিবিদরা পছন্দের তালিকায়, তবে আমার মনে হয়, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া ভালো নয়, এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। জানি, আমি মূল্যহীন সন্ধ্যার কথা আপনার কাছে আমার মতোই মূল্যহীন। তবু-ও নিজের একটি ইচ্ছে লিখে ফেললাম। ক্ষমা করবেন।
আপনাকে সাদা পাঞ্জাবিতে ভীষণ স্নিগ্ধ, সুন্দর লাগে। ভালো থাকবেন শুভ্র-পাঞ্জাবিওয়ালা।
ইতি
সন্ধ্যা শেখ
ছোট্ট একটি চিঠি। যার শব্দসংখ্যা ৯৪। ১০০ টি শব্দ-ও নেই যে চিঠিতে। সেই চিঠি পড়ে আকাশের বুকে চিনচিন ব্য’থার উৎপত্তি হলো। সন্ধ্যার শুভ্র- পাঞ্জাবিওয়ালা সম্মোধনে সামান্য সুখকর ব্য’থার অনুভূতি হলে-ও বাকিটুকুর ভারে আকাশ বোধয় ক’ষ্টের ছাপে নুইয়ে পড়ে।
মেয়েটি তার কাছে আবদার করেছে, তাকে যেন কোন একদিন মনে করে আকাশ। অথচ আকাশ তো মেয়েটিকে ভুলতেই পারছে না।
আজ সারাদিন বেখেয়ালে কাজ করেছে। অরুণের কতগুলো ধাক্কা-ও খেয়েছে। বেখেয়ালের কারণ টা তো সন্ধ্যা। আকাশকে সন্ধ্যা চাঁদের সাথে তুলনা করল কেন? আর নিজেকে বামুন কেন বলল? চিঠির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,
– মেয়ে তুমি কি জানো? তোমার কত গুণ আছে? তোমার মাঝে সৌন্দর্যের সীমা নেই।
মেয়ে জানো কি? তুমি যে আস্ত এক মায়া।
এতো এতো গুণ, এতো সৌন্দর্য, এতোখানি মায়া থেকে বেরোনো যায়? আমি তো এখনো পারিনি। ভেবেছিলাম, তুমি চলে গেলে এই অনুভূতির শিকড় ছিঁড়ে বেরোতে পারবো। কিন্তু আমার অনুভূতির প্রখরতা যে বেড়েই চলেছে। আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি সন্ধ্যা!
আকাশের কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঝরে পড়ছে। চিঠিটি খুব যত্নে ভাঁজ করে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলো। এরপর বেলকনিতে চলে গেল।
ইরা তার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে আছে। গতকাল সৌম্য’র সাথে দেখা করে আসার পর থেকে ইরার মনে হচ্ছে সে কাঁদতে ভুলে গিয়েছে। সেই যে ঝর্ণার নিচে বসে কাঁদলো। তারপর আর কান্না আসেনি। তার মনে হচ্ছে তার মাঝে প্রাণ নেই, সে শুধু তার দেহ টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে। দু’হাত জানালার গ্রিলে রেখেছে। ইরা দেখতে পায়, – সৌম্য তার দিকে হেসে তাকিয়ে আছে।
ইরা ডান হাত উঠিয়ে ডাকতে চায়, তার আগেই সৌম্য হাস্যজ্জ্বল মুখে ডাকে, – ইরাবতী?
কত মায়া এই ডাকে! ইরা মলিন মুখে বলে,
– সৌম্য আমাকে একটু ভালোবাসবি?
কথাটা বলে ইরা চারপাশে তাকালো। কেউ নেই। সৌম্য আর আসবে না তার কাছে। তাকে খুব নিঁখুতভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিয়ে করে নিবে কি? বিড়বিড় করল,
– বিয়ে করিস না সৌম্য। আমি আর তোর কাছে যেতে চাইবো না। তবুও তোর পাশে অন্যকাউকে ঠাই দিস না।
বাবার ডাকে ইরা ঝাপসা চোখজোড়া মুছে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ইশতিয়াক আহমেদ টেবিলের উপর একটি প্যাকেট রেখে সোফায় বসে। ইরার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,
– তোমার পছন্দর রসমালাই এনেছি।
এরপর তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে,
– ইরাকে রসমালাই দাও তো।
ইরা টেবিলের উপর রাখা প্যাকেটটির দিকে তাকালো। স্মৃতির পাতায় এক সোনালি দিন ভেসে ওঠে। রসমালাই ইরার ভীষণ পছন্দের। তাই শখ করে রসমালাই নিজ হাতে বানানো শিখেছিল। যখন তারা বন্ধু ছিল। একদিন সৌম্য’র জন্য নিজ হাতে বানানো রসমালাই বাটি ভরে নিয়ে গিয়েছিল ভার্সিটি। ভার্সিটির মাঠে বসে সৌম্য খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছিল। ইরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। সৌম্য’র সবকিছুই তার ভালো লাগে। সৌম্য খেতে খেতে সব রসমালাই খেয়ে ইরার দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলেছিল,
– স্যরি ইরাবতী! ভুলে সব খেয়ে ফেলেছি।
ইরা অবাক হয়। সৌম্য হঠাৎ হঠাৎ এই নাম টা নেয়, আর ইরার প্রতিবার মনে হতো এই প্রথম ডাকছে সৌম্য এই নামে। প্রতিবার নতুনত্বরে স্বাদ
পায় সৌম্য’র ইরাবতী ডাকে। তবে সেদিন সৌম্য’র কথায় হেসেছিল। বুঝেছিল, মিষ্টি সৌম্য’র পছন্দের খাবার। ডান হাতে সৌম্য’র চুল এলোমেলো করে দিয়ে হেসে বলেছিল,
– সব তোর জন্য-ই নিয়ে এসেছিলাম সৌম্য।
কথাগুলো ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখের কোণ ভিজে উঠল, ইরা টের পায় না। এই রসমালাই তার সৌম্য’কে ছাড়া সে সেদিন-ই খেতে পারবে, যেদিন সে পা’গ’ল হয়ে তার সৌম্যকে ভুলে যাবে। তার বাবাকে মৃদুস্বরে জানায়,
– খাবো না।
কথাটি বলে ইরা তার ঘরে যেতে পা বাড়ায়। ইশতিয়াক আহমেদ বলে,
– তোমার সাথে আমার কথা আছে। এসো।
ইরা তার বাবার দিকে তাকায়। ইশতিয়াক আহমেদ বলে,
– তোমার জন্য পাত্র ঠিক করেছি। আগামীকাল তোমাকে দেখতে আসবে। রেডি হয়ে থাকবে।
ইরা খুব স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল,
– আমি বিয়ে করব না।
ইশতিয়াক আহমেদ সোফা থেকে উঠে মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। পকেট থেকে ফোন বের করে একটি পিক বের করে ইরার সামনে ধরে। ইরা তার বাবার থেকে ফোনটি তার হাতে নেয়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় ফোনটির দিকে।
পিকটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একটি বিয়ে বাড়ি যেখানে সৌম্য বর সেজে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই সৌম্য’কে ঘেঁষে এক নতুন বউ।
পিকটি দেখে ইরার দুনিয়া কেঁপে ওঠে। গতকাল বিয়ের কথা বলে, আজকেই বিয়ে করে নিল সৌম্য? বি’ষবাণ এর চেয়ে-ও বি’ষা’ক্ত কিছু যেন তার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলোর বেগে ছুটতে শুরু করল। স্তব্ধ হয়ে এই যন্ত্রণা নিবারণ করতে চাইলো ইরাবতী।
সে কাঁপছে। হাত থেকে ফোন পড়ে যাওয়ার আগেই ইশতিয়াক আহমেদ ফোনটি নিয়ে নেয় ইরার থেকে। এরপর ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলে,
– আশা করি, এবার বিয়ে করতে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।
ইরা তার বাবার কথা শুনেছে কি-না! সে কাঁদতে পারছে না। বহু’ক’ষ্টে উল্টো ঘুরে ধীরে ধীরে কয়েক পা এগিয়ে যায়, উদ্দেশ্য তার রুম। হাঁটতে পারছে না সে। শরীর টলছে। তবু-ও নিজেকে টেনে নিয়ে গেল। তার ঘর থেকে তিন হাত দূরত্বে এসে ইরার পা থেমে যায়। আর এগোতে পারলো না সে। শরীর ছেড়ে দিতেই আস্তে করে বামদিকে হেলে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যায়।
ইরার মা মেয়ের অবস্থা দেখে দৌড়ে গিয়ে ইরার পাশে বসে ভাঙা গলায় ডাকে,
– ইরা?
ইশতিয়াক আহমেদ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ইরার দিকে। ইরার হাত, পা বাঁকা হয়ে আসছে। মুখ বেঁকে যাচ্ছে। এ পর্যায়ে ইশতিয়াক আহমেদ ভ’য় পেলেন। সময় যত বাড়লো ইরা তত অস্বাভাবিক হতে লাগলো। ইশতিয়াক আহমেদ মেয়ের অবস্থায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইরার পাশে বসে ইরাকে ডাকে,
– ইরা?
ইরার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তার বাবা গলা ধরা গলায় ডাকে,
– ইরা মা?
ইরার রেসপন্স নেই। ইশতিয়াক আহমেদের চোখেমুখে ভীতি জড়ো হয়। তার মেয়ে এরকম করছে কেন? সময় নষ্ট না করে মেয়েকে দ্রুত কোলে তুলে নেয়। বাইরে বেরোতে বেরোতে চিৎকার করে বলে,
– তাড়াতাড়ি গাড়ি বের কর। আমার মেয়ের কি যেন হয়েছে! হসপিটাল যেতে হবে।
ততক্ষণে কেউ গাড়ি বের করেছে। ইশতিয়াক আহমেদ মেয়েকে নিয়ে পিছনের সিটে বসে। ইরার মা কাঁদতে কাঁদতে ইশতিয়াক আহমেদ এর পাশে বসলে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
ইরার বাবা ইরার গালে হাত রেখে ডাকে,
– মা? ইরা? কোথায় ক’ষ্ট হচ্ছে তোমার?
ইরা শরীর ছেড়ে দিল। অস্ফুটস্বরে ভাঙা কণ্ঠে বেরিয়ে আসে,
– আমার সৌম্য চিরতরে হারিয়ে গেল!
দু’চোখের কোণ ঘেঁষে দু’ফোঁটা য’ন্ত্র’ণা’ময় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ইরা শান্ত হয়ে গেল। আর একটু-ও নড়লো না সৌম্য’র ইরাবতী।
ইরার কথা কেউ শুনতে পায় না। ইশতিয়াক আহমেদ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। পা’থ’র মনের অধিকারী এক মানব মেয়ের করুণ অবস্থায় যেন নিমিষেই ভেঙে গেল! এতো নি’ষ্ঠু’র মানবের চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করলো তার মেয়ের কঠিন অবস্থা দেখে।
সৌম্য কালকের জন্য খুব অল্প করে একটু একটু করে বাজার করেছে। হাফ কেজি গরুর মাংস নিয়েছে,, তার বোনুর পছন্দের রুই মাছ নিয়েছে কয়েকটা কাটা পিস। আর কাঁচা বাজার টুকটাক যা লাগে, খুব সামান্য পরিমাণে নিয়েছে৷ সাথে নিয়েছে তার বোনুর ফুসকা। গ্রামে-ও ফুসকা পাওয়া যেত, তবে এখানে রেস্টুরেন্টে যে ফুসকাগুলো পাওয়া যায়, সেসব গুণগতমান অনেক ভালো হয়,, তাছাড়া সৌম্য নরমাল ফুসকার সাথে দই ফুসকা-ও নিয়েছে।
এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ সৌম্য’র পা থেমে যায়। এই সেই জায়গা, যেখানে গতকাল তার ইরাবতী তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। কেঁদে কেঁদে ভালোবাসা ভি’ক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু সৌম্য নিঃশব্দে, হাজারো য’ন্ত্র’ণা বুকে চেপে তার শখের নারীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আচ্ছা তার ইরাবতী কি সত্যি-ই অন্যকে বিয়ে করে নিবে? এমন হলে সৌম্য’র খুব ক’ষ্ট হবে, কিন্তু সে ক’ষ্ট দোখার কেউ নেই। বাবা মায়েরা কতকিছু সেক্রিফাইস করে৷ সে-ই তার বোনুর মা, সে-ই তার বোনু বাবা। তাকে তো তার বোনুর জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে। তাছাড়া ইরাবতী রাজরানি না হয়ে চাকরানী হতে কেন আসবে তার কাছে? ইরাবতী ভালো থাকুক।
চোখের সামনে ভাসলো গতকালকের বিধ্বস্ত ইরাবতীর মুখটা। যখন সে বলেছিল, সে ইরাবতীকে ভালোবাসবে,, ইরাবতীর মুখ চকচক করে উঠেছিল। সেই দৃশ্য ভাসলো। সৌম্য’র চোখ ঝাপসা হয়৷ দু’হাত প্যাকেটে ভর্তি৷ সৌম্য ডান হাতের বাহু দ্বারা চোখ মুছল।
এসব ভাবনার ইতি ঘটালো৷ তার বোনু তার জন্য অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যা এতসব দেখে ভীষণ খুশি হবে৷ দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ইশারায় বলবে, – ভাইয়া তুমি খুব ভালো।
কথাটা ভেবে সৌম্য একটু হাসলো। কতদিন পর বোনুর হাতের রান্না খাবে। সন্ধ্যার হাতের রান্না তার খুব পছন্দের। মনে হয় একদম মায়ের হাতের রান্না৷ বোনু তো তার মা-ই৷
হঠাৎ পিছন থেকে সৌম্য’র মাথার পিছনে রড দিয়ে কেউ গায়ের জোরে বারি দেয়৷ সৌম্য’র শরীর দুলে ওঠে। কয়েক পা সামনে চলে যায়। দু’হাত থেকে খাবারের জিনিসগুলো পড়ে যায়৷ সৌম্য ডান হাত তুলে মাথার পিছনে দেয়৷ ঝাপসা চোখে সামনে তাকালে দু’জন লোককে দেখল, তবে ভীষণ ঝাপসা। সৌম্য এলোমেলো পায়ে তাদের আ’ঘা’ত করার জন্য এগোলে, একজন সৌম্য’র কপাল বরাবর আগের চেয়ে-ও জোরে আরেকটা বারি দেয়। সৌম্য’র মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে। কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। পড়ে যেতে নিলে আরেকজন এসে বা হাতে সৌম্য’র শার্টের কলার ধরে ডান হাতে সৌম্য’র পেটে চা’কু ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সৌম্যকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দু’জন এখান থেকে চলে যায়।
সৌম্য মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকে। মাথাটা সামান্য উঁচু করে উঠতে চাইলো, একটুখানি শক্তি-ও যে নেই শরীরে। পারলো না উঠতে। শক্ত মাটিতে শরীর ছেড়ে দিল। ফাঁকা রাস্তা, কেউ নেই আশেপাশে, যে একটু সৌম্য’কে সাহায্য করবে। সৌম্য বিড়বিড়িয়ে অস্ফুটস্বরে কয়েকটি শব্দ করল,
– ই.রাববতী, বোনু অপেক.ক্ষা..
আর কিছু বলতে পারলো না। শরীর স্থির হয়ে গেল। বন্ধ চোখের পাতা ভেদ করে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো জমিনের বুকে।
পাশেই অবহেলে পড়ে রইলো তার বোনুর জন্য পছন্দের সব খাবার। যা নিয়ে তার বোনুর কাছে আর পৌঁছানো হলো না সৌম্য’র।
সন্ধ্যা রান্না শেষে পুরো ঘর পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে।
আকাশের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আকাশ কি তার দেয়া চিঠি পাবে? না-কি তার মতো-ই তার চিঠি-ও অবহেলায় পড়ে থাকবে ঘরের এক কোণে? না-কি চিঠির জায়গা হবে কোনো এক ময়লার স্তূপে? আকাশ তাকে ভুলে গিয়ে আবার-ও বিয়ে করবে?
তার বোন সকালের বলা কথাগুলো ভেবে চোখ ভিজল। হয়তো সত্যি-ই আকাশ তার অপূর্ণতার জন্য তাকে ডিভোর্স দিয়ে, পরীর মতো একটি মেয়েকে বিয়ে করবে, তাইনা? করবে না-ই বা কেন? সে তো ভীষণ সুন্দর। তার সাথে আকাশকে যায়? একটু-ও যায় না।
সন্ধ্যা দু’হাতে চোখের কোণ মুছে নিজেকে সামলে নিল। এসব আর ভাবতে চায় না।
বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ ভাইয়ের জন্য বসে বসে অপেক্ষা করছে সন্ধ্যা।
সেই কখন বেরিয়েছে সৌম্য ভাইয়া। এখনো আসেনা কেন? যাওয়ার আগে যে বলল যাবে আর আসবে। কোথায় সে? আসে না তো! সন্ধ্যা অপেক্ষা করতে করতে এগিয়ে গিয়ে একটি প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে নেয়। দু’জনের জন্য এক প্লেটেই নিয়েছে৷ আগে কত একসাথে খেয়েছে৷ হয় সে সৌম্যকে খাইয়ে দিত, আর নিজে খেত। নয়তো সৌম্য ভাইয়া নিজে খেত আর তাকে খাইয়ে দিত৷ সন্ধ্যা আজ ঠিক করেছে সে সৌম্য’র হাতে খাবে৷ খিচুড়ির প্লেট টি নিয়ে চৌকির উপর রাখলো সন্ধ্যা, এরপর একটি জগভর্তি পানি এনে বিছানার কাছে মেঝেতে রাখলো।
তখন-ই দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ভাবতে ভাবতেই তার ভাই এসে পড়েছে৷ সন্ধ্যা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
সৌম্য’র জায়গায় দু’জন অপরিচিত লোককে দেখে সন্ধ্যা অবাক হয়। সাথে একটু ভ’য় পায়। জায়গাটি অপরিচিত। সে তো কিছু চেনেনা। সন্ধ্যা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। হাত দিয়ে ইশারা করে বলতে চায়, – তারা কি চায়?
তার আগেই একজন লোক সন্ধ্যার গালে ক’ষি’য়ে এক থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। সন্ধ্যা হুমড়ি খেয়ে পড়ে দরজার কোণার সাথে কপাল ধাক্কা খায়। কপাল বোধয় কেটে গিয়েছে। সন্ধ্যা দাঁতে দাঁত চেপে ব্য’থা গিলে দু’হাতে দরজা আঁকড়ে ধরে। সে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। এটা কি হলো তার সাথে? তাকে কেন মা’র’লো এভাবে?
একজন লোক বলে ওঠে,
– মা’ল ডা সেই তো!
লোকটির বি’দ’ঘু’টে চাহনীতে বলা তি’ক্ত বাক্যটি শুনে সন্ধ্যা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকায় লোক দু’টোর দিকে। এরা বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে, সন্ধ্যা বুঝেছে। ভ’য়ে মেয়েটির হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। তবু-ও সাহস করে সন্ধ্যা উঠে দাঁড়াতে চায়, তার আগেই আরেকজন সন্ধ্যার অপর গালে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। সন্ধ্যা আবার-ও হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেঝেতে। পুরুষালি শক্ত হাতে দু’টো থা’প্প’ড় খেয়ে সন্ধ্যার মাথা ঘুরছে। গাল দু’টো টনটন করে উঠলো। সন্ধ্যা ভেজা চোখে লোকগুলোর দিকে তাকায়। এরা কারা? তার সৌম্য ভাইয়া কোথায়? কখন আসবে তার ভাই? সে তো কথা-ও বলতে পারেনা। একটু আওয়াজ করবে সেটা-ও পারছে না।
হঠাৎ-ই একজন এগিয়ে এসে সন্ধ্যার চুলের মুঠি ধরে বলে,
– মাইয়া বো’বা হইলে কি হইছে! মা’ল তো কাঁচা। ম’জা হইবো।
কথাটা বলে সন্ধ্যাকে ছুঁড়ে ফেলে। সন্ধ্যা আবার-ও ঠাস করে পড়ে যায়। এবার তার মাথা চৌকির সাথে গিয়ে ধাক্কা লাগে। এতোগুলো থা’প্প’ড়, ধাক্কা, মাথায় ব্য’থা পেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। না চাইতে-ও ব্য’থায় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। কি করেছে সে? লোকগুলো তাকে এভাবে মা’রছে কেন? সন্ধ্যার নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। এ কোথায় এসে পড়লো সে? মাথা ব্য’থায় মনে হচ্ছে মাথা খুলে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যা নিজের অসুস্থতাবোধকে প্রশ্রয় দিল না। নয়তো এরা তার স’র্ব’না’শ করে দিবে যে।
সন্ধ্যার মুখ বরাবর গরম খিচুড়ির প্লেট চোখে পড়ে। যেটা কিছুক্ষণ আগে সে-ই রেখেছে। সুযোগ বুঝে সন্ধ্যা চৌকির উপর রাখা গরম খিচুরি হাতে নিয়ে একজনের মুখের দিকে ছুঁড়ে মা’রে। লোকটি চেঁচিয়ে ওঠে। অপরজন সেই লোকটির দিকে এগিয়ে গেলে সন্ধ্যা জান হাতে নিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তা একদম ফাঁকা। যেন কেউ কোথাও নেই। অনেক রাত হয়েছে যে, ফাঁকা তো হবেই। সন্ধ্যার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। একবার তার সৌম্য ভাইয়া আসুক। কেন আসছে না তার সৌম্য ভাইয়া? আরও কখন আসবে? তার যে ভীষণ অসহায় লাগছে।
পিছনে দৌড়ের শব্দে সন্ধ্যা বুঝতে পারল, সেই দু’জন ব’দ লোক তার পিছু পিছু দৌড়ে আসছে। সন্ধ্যা প্রাণপণে দৌড়ায়, নিজের ই’জ্জ’ত বাঁচাতে। নিজেকে বাঁচাতে।
কয়েক ঘণ্টা আগে আকাশ বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সেই সকালে এই পোষাকে বেরিয়েছিল। বাইরে থেকে এসে কখনো এমন হয়নি, সে ১০ মিনিট পর ফ্রেশ হতে গিয়েছে। অথচ আজ কয়েক ঘণ্টা পেরিয়েছে, আকাশের মাঝে কোনো হেলদোল নেই।
ভেতর টা ভীষণ ছটফট করছে। আকাশ এপাশ-ওপাশ করে হাঁটলো বেশ অনেকক্ষণ। এরপর তার ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। কোনোদিকে তাকালো না। সোজা সন্ধ্যার ঘরে যায়, যে ঘরে এতোদিন সন্ধ্যা থাকতো।
সন্ধ্যার ঘরে এসে আকাশ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। পুরো রুমটিতে দৃষ্টি ঘোরায় আকাশ। ঘরটি খুব সুন্দর করে গোছানো। কিন্তু যে গুছিয়েছে সেই মানুষটি নেই। আকাশ ঢোক গিলে এগিয়ে যায়। প্রথমেই চোখে পড়ে টেবিলের কোণায় রাখা একটি প্যাড, যার উপর একটি বকুল ফুলের মালা রাখা। আকাশের মনে পড়ল, সন্ধ্যার হাতে এরকম একটি বকুল ফুলের মালা দেখেছিল। আকাশ ডান হাত বাড়িয়ে ফুলের মালাটি হাতে নেয়। দৃষ্টি পড়ে প্যাডের সাদা পৃষ্ঠায় আঁকানো দু’টি ছবির উপর। আকাশ বা হাতে প্যাডটি তুলে তার সামনে ধরে।
সাদা পাতায় দু’টো ছবি আঁকা।
পাতার বাম পাশে আকাশকে পিছন থেকে আঁকানো। দেখে বোঝা যাচ্ছে আকাশের পরনে পাঞ্জাবি। আর তার পাশেই হাঁটুর নিচ পর্যন্ত চুলের অধিকারী শাড়ি পরিহিত সন্ধ্যা।
কাঁচা হাতের আঁকা। প্রফেশনালদের মতো ভালো না হলে-ও দেখে বোঝায় যায়, সন্ধ্যা আকাশ আর নিজেকে আঁকতে চেয়েছে।
আকাশের দৃষ্টি ছবি দু’টির নিচের লেখার উপর পড়ে। যেখানে লেখা ~
শুভ্র-পাঞ্জাবিওয়ালা,
একটি শেষ কথা রাখবেন?
বকুল ফুলের এই মালাটি শুকিয়ে গেলে-ও, আপনার কাছে রেখে দিবেন?
আর আপনার পাশে এই মূল্যহীন মেয়েটির ছবি মুছবেন না। আমি মিনতি করে গেলাম!
রাখবেন কি এই মিনতি?
ইতি
সন্ধ্যা শেখ
পাশাপাশি দু’টো ছবি সাথে ৩৭ টি শব্দের ছোট্ট চিঠির লেখাটুকু আকাশকে যেন ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। আকাশ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল লেখাগুলোর দিকে। সময়ের সাথে তার ছটফটানি বাড়লো। হাতের প্যাডটি শব্দ করে টেবিলের উপর রাখে। সামান্য ঝুঁকে ডান হাত টেবিলে ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তার। বেশ কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যার দেয়া বকুল ফুলের মালাটি পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– তোমার সকল মিনতি রেখে দিলাম সন্ধ্যা।
আকাশের ছটফটানি কমলো না। একপর্যায়ে সে এই ঘরেই হাঁটাহাঁটি শুরু করে। অতিরিক্ত টেনশন, ক’ষ্ট, খারাপ লাগা,, এসবের মাঝে হাঁটাহাঁটির অভ্যেস টা তার আছে। তার এতো বেশি অস্থির কেন লাগছে?
হঠাৎ-ই দাঁড়িয়ে গিয়ে দু’হাতে মাথার চুল টেনে অসহায় কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– সন্ধ্যা? তুমি কোথায়? ঠিক আছো তুমি?
সন্ধ্যা দৌড়াতে দৌড়াতে কোনদিকে চলে এসেছে নিজে-ও জানেনা। যত সামনে এগোয়, তত নির্জন জায়গা। লম্বা চুলগুলো খুলে গিয়েছে। সন্ধ্যার পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে যেন।
তার পিছু পিছু সেই লোক দু’টো এখনো দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ-ই একজন বড় ইটের টুকরো নিয়ে সন্ধ্যার পিঠ বরাবর ছুঁড়ে মা’রে। সন্ধ্যা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
চারিপাশ থেকে বুক চেপে আসে। তার মনে হলো, সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা।
পায়ের শব্দ পেয়ে সন্ধ্যা বহু’ক’ষ্টে পিছু ফিরল। লোকদু’টো তার দিকে লা’ল’সা’র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। একজন শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বি’দ’ঘু’টে হেসে বলে,
– এর সৌন্দর্য তো আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছে। আগে আমি ম’জা, মা’স্তি করি। তারপর তুই আসিস, যাহ!
লোকটি সন্ধ্যার দিকে চেয়ে একটি বি’শ্রী হাসি দিয়ে জায়গাটি প্রস্থান করে। সন্ধ্যার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। একটু একটু পরে পিছিয়ে যায় সে। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তার তো সেই কণ্ঠস্বর টুকু-ই নেই। কেউ তাকে বাঁচাতে-ও আসবে না।
আজ যেন সন্ধ্যার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো, আল্লাহ আর কত পরীক্ষা নিবে তার? এর শেষ কবে? সে ম’রে গেলে? তবে ম’রে যাক। কিন্তু এই ন’র’প’শুদের হাত থেকে বাঁচাক। তাকে গাড়ির নিচে পি’ষে ফেলুক। এতো রাস্তা রেখে আল্লাহ কেন তাকে এই পথে পাঠালো মা’র’তে?
সন্ধ্যা বেদনার অশ্রু বিসর্জন দেয়,, হঠাৎ-ই লোকটি তার উপর জা’নো’য়া’রের ন্যায় ঝাঁ’পি’য়ে পড়ল। বোবা মেয়েটি বোবা চি’ৎ’কা’র দিল। আজ হয়তো তার স্বর থাকলে এই জমিন কেঁপে উঠতো,, কিন্তু তার চি’ৎ’কা’র যে তার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো,, একটু-ও শব্দ হলো না সেই চি’ৎ’কা’রে’র। শব্দ হলো না, বোবা মেয়েটির আ’ত্ম’চি’ৎ’কা’রে’র।
সন্ধ্যা খুব করে ডাকলো তার সৌম্য ভাইয়াকে, ডাকলো আকাশকে। কেউ এলো না তাকে বাঁচাতে। শুধু সঙ্গ হলো কিছু বোবা আ’র্ত’না’দ, সাথে তীব্র বর্ষণের ন্যায় নোনতা জলকণা।
ডক্টর রিয়াজ হাসফাস কণ্ঠে বলে,
– তারপর? সন্ধ্যা, সৌম্য কি বাঁচতে পেরেছে? আর সৌম্য’র ইরাবতীর কি হয়েছিল? সে কি বেঁচে আছে?
ছেলেটি ভারী স্বরে জবাব দেয়,
– জানিনা।
ডক্টর রিয়াজ ছটফটানি কণ্ঠে বলে,
– জানোনা মানে? একটি গল্পের এরকম একজায়গায় থামলে! আমার তো দম আটকে আসছে।
ছেলেটি ধরে আসা গলায় বলে,
– আর আমি গত আড়াই বছর যাবৎ, প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড এভাবেই ছটফট করি।
ডক্টর রিয়াজ অবাক হয়ে বলে,
– গল্পটি তার মানে আড়াই বছর আগের? আর সত্য ঘটনা?
ডক্টরের কথায় ছেলেটি নিঃশব্দে হাসলো। যে হাসিতে প্রাণ নেই।
ডক্টর রিয়াজ তার ঝাপসা চোখজোড়া মুছলেন। তার বউ তাকে সবসময় পা’ষা’ণ বলে। বলে, ডক্টররা পা’ষা’ণ হয় আগে শুনেছে। তাকে বিয়ের পর এই কথাটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি-ও করেছে। কিন্তু আজ সেই পা’ষা’ণ ডক্টর রিয়াজের চোখজোড়া ভিজল তিনটে অসহায় মানুষের জন্য।
এরপর নিজেকে সামলে রিয়াজ নিজ মনে বলে,
– এরপর কি হয়েছিল? সন্ধ্যা কি ধ’র্ষ’ণ হয়েছিল? সে কি সেদিন বাঁচতে পেরেছিল ওই প’শু’দের হাত থেকে? সৌম্য, ইরাবতী কি বাঁচতে পেরেছিল? না-কি সৃষ্টিকর্তা তাদের অধ্যায়ে সেখানেই সমাপ্তি এঁকে দিয়েছিল?
কেবিনের ভেতর থেকে একজন ডক্টর বেরিয়ে এসে ছেলেটির উদ্দেশ্য বলে,
– আপনার মা আপনাকে ডাকছে।
ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলে ডক্টর রিয়াজ জিজ্ঞেস করে,
– তোমার নাম কি?
ছেলেটি দাঁড়িয়ে যায়। মৃদুস্বরে বলে,
– আকাশ নওয়ান।
ডক্টর রিয়াজ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটির পানে। অবাক হয়ে বলে,
– এই গল্পে-ও তো….
ছেলেটি উল্টো ঘুরে ডক্টর রিয়াজকে থামিয়ে দিয়ে মলিন হেসে বলে,
– গল্পটা তো আমার-ই ছিল।
একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আর আমার সন্ধ্যামালতীর।
ডক্টর রিয়াজ অবাক হয়ে বলে,
– সন্ধ্যামালতী কে?
অন্তঃদহন পর্ব ১৫
আকাশের দৃষ্টি ঝাপসা। অজায়নায় দৃষ্টি রেখে কণ্ঠে মুগ্ধতা সাথে মলিনতা মিশিয়ে বলে,
– শ্যামলা গড়নের এক মেয়ে, যার স্নিগ্ধ হাসিতে বাম গালে সৃষ্টি হয় এক গভীর টোল। যে নৃত্য করলে তার দীঘল কালো চুলগুলো তাকে সঙ্গ দেয়। যে ফুল কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, তার কালো রেশমি চুলগুলো পরম যত্নে মাটি ছুঁয়ে দেয়। যার দু’চোখ কথা বলে, দু’হাত কথা বলে, কিন্তু কখনো মুখ নাড়িয়ে শব্দ খরচ করতে হয় না। যার অনুপস্থিতি আমার হৃদয় ভ’য়ং’ক’র’ভাবে পু’ড়ি’য়ে দিতে সক্ষম। সে আমার সন্ধ্যামালতী।