অন্তঃদহন পর্ব ১৭ (২)

অন্তঃদহন পর্ব ১৭ (২)
DRM Shohag

সাধন, সোহা সাইকেল নিয়ে যাওয়ার পর, রিয়া সোহাদের ঘরে যায়। সোহার টেবিলের উপর তার একটি বই নিয়ে চলে আসতে গিয়ে-ও একটি ডায়েরি দেখে রিয়া থেমে যায়। ডায়েরি মেলে ভেতরে কিছু দেখে রিয়ার চোখজোড়া চকচক করে ওঠে। ডায়েরি হাতে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মাটির তৈরী বড়বড় সিঁড়ি উঠে দোতলায় নিজ ঘরে আসে। এরপর দরজা ভিড়িয়ে বিছানার এক কোণায় গিয়ে বসে। সাধনের পু’ড়ি’য়ে দেয়া ডায়েরিতে যেটুকু লেখা ছিল, এই ডায়েরিতে এরপর থেকে লেখা আছে। রিয়া ডায়েরিটি মেলে পড়তে শুরু করে।
সেই রাত,

নিয়াজ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে কলে কথা বলে কারো সাথে। হঠাৎ কেমন ধস্তা’ধস্তি’র আওয়াজ কানে ভেসে আসে। জায়গাটি বেশ নির্জন। ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলছিল কলে, কিন্তু এমন গা ছমছমে পরিবেশে সামান্য শব্দটুকু-ও যেন জোর শব্দ তুলে কানে বাজছে। নিয়াজ কলের ওপাশের ব্যক্তিকে ওয়েট করতে বলে কল কেটে দেয়।
এরপর যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে, নিয়াজ ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে সেদিকে তাক করে একটু একটু করে এগিয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাস্তার ধারে অন্ধকারের মাঝে বেশ বড়সড় কিছু নড়ছে মনে হলো। নিয়াজ আরেকটু এগোলো। তার ফোনের আলো সামনের দিকে স্থির, নিয়াজ স্পষ্ট দেখল, একটি মেয়ের দু’টি পা, যা রীতিমতো যুদ্ধ করছে। নিয়াজ শুকনো ঢোক গিলল। উপর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখল বিশালদেহী কোনো পুরুষ। ব্যাপারটি বুঝতে তার দু’সেকেন্ড-ও সময় লাগলো না। নিয়াজ এক সেকেন্ড-ও সময় ন’ষ্ট করল না।

ফোন পকেটে রেখে একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে সন্ধ্যার উপর থেকে লোকটিকে টেনে হিঁচড়ে তুলে গায়ের জোরে নাক বরাবর দু’টো ঘুষি মা’রে। লোকটি বুঝতে না পারায় দু’টো ঘুষি খেয়ে ছিটকে পড়ে যায়।
সন্ধ্যা বোধয় এখনো গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, যে কান্নার আওয়াজ নেই। মাটিতে শরীর ছেড়ে দেয়া। যখন বুঝল তার উপরটা হালকা, সন্ধ্যার জানে পানি আসে। পেট থেকে অনেকটা নিচে নামানো পায়জামা দু’হাতে টেনে উপরিদিকে তোলে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। সন্ধ্যা খুব ক’ষ্ট করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়।
তখন নিয়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে সন্ধ্যার দিকে তাক করে, চোখেমুখে অজস্র বিস্ময় ভর করে নিয়াজের,, সাথে সাথে লাইট সরিয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় সে।

সন্ধ্যার জামার প্রায় অর্ধেকের বেশি জায়গায় ছেঁড়া। পেটের কাছে, দু’হাতের কাছে, অসংখ্য জায়গায় ছেঁড়া।
সন্ধ্যা দুর্বল শরীর নিয়ে অন্ধকারের মাঝে আশেপাশে ঘুরে ঘুরে তার ওড়না খুঁজল, না পেয়ে হাত দিয়েই ছেড়া জামা দু’হাতে টেনে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করে।
নিয়াজ মৃদুস্বরে বলে,
– আমি হেল্প করছি।
সন্ধ্যার কানে কথাটি যেতেই সন্ধ্যা ভ’য়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পুরো শরীরে মৃদু কম্পন মেয়েটার। সন্ধ্যা আর দাঁড়ায় না এখানে। তার সৌম্য ভাইয়া ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করেনা সে।
অতঃপর এক সেকেন্ড-ও না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৌড় দেয় সন্ধ্যা।

নিয়াজ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। যাকে দু’টো ঘুষি মে’রে’ছে সে উঠে দাঁড়াচ্ছে খেয়াল করতেই নিয়াজ ফোনের লাইট আশেপাশে ঘুরিয়ে কছু খুঁজল। রাস্তার ধার থেকে কিছুটা নিচু জয়গায় একটি বাঁশের মতো অংশ পেয়ে নিয়াজ সেটি হাতে তুলে নেয়। এরপর লোকটির মাথায় বারি মা’রে। এতো রা’গ লাগছে তার। খু’ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। একটি মেয়েকে ধ’র্ষ’ণ করতে যাচ্ছিল এটা। এসব নিয়াজ মানতে পারেনা। কোনো ভদ্র ঘরের ছেলেই মানতে পারবে না।

লোকটি মাথার বারি খেয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যায়। পিছন থেকে আরেকজন লোক ভাই ভাই বলে দৌড়ে এসে অজ্ঞান হওয়া লোকটির পাশে বসলে নিয়াজ সেই লোকটিকে-ও কায়দা করে দু’টো আ’ঘা’ত করে। অজ্ঞান হওয়ার জন্যই এমন ট্রিকস্। আপাতত এদের জ্ঞান হারিয়ে রেখে পু’লি’শকে খবর দিতে হবে। নয়তো এরা পালিয়ে যাবে।
দু’জনের অবস্থা সাইলেন্ট করে দিয়ে নিয়াজ সামনের দিকে তাকালো। সন্ধ্যা বেশ খানিকটা দূরে গিয়েছে। মেয়েটি এলোমেলো পায়ে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই।
নিয়াজ সন্ধ্যার পিছু দৌড় দেয়। ডান হাতে ফোন কানে। পুলিশ স্টেশনে কল করেছে। লোকেশন বলে দেয়, দু’জন ধ’র্ষ’ক এর খোঁজ দেয়। এরপর কল কেটে সন্ধ্যার পিছু দৌড়ায় আর বলে,
– হ্যালো মিস! দাঁড়ান।

সন্ধ্যা শুনতে পায় কি-না! শরীরে শক্তি নেই। মনে হচ্ছে এক্ষুনি পড়ে যাবে। কিন্তু ভীতি তার মনে ভ’য়ং’ক’র প্রভাব ফেলেছে। মেয়েটির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এখনো মনে মনে তার ভাইকে ডাকছে। জামার ডান কাঁধের মাঝে পুরোপুরি ছিঁড়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা জামা টেনে তুলে উম্মুক্ত কাঁধ ঢাকে। তবুও পড়ে যায় কাঁধ থেকে। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ওঠে। ভেতর থেকে চিৎকার করে কয়েকটি শব্দ ভেসে আসে,
– সৌম্য ভাইয়া??? আকাশ???

নিয়াজ চিন্তিত হয়। মেয়েটি আবার-ও একা কোথায় বের হচ্ছে। রাস্তাটি নির্জন, রাত হয়েছে বেশ। এ তো আবার খারাপ লোকের চক্করে পড়বে। এসব চিন্তা করে মূলত সন্ধ্যার পিছে দৌড়ায়।
সন্ধ্যা ঝাপসা দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ রেখে দৌড়ায়। পায়ের গতি কমে এসেছে। এতো দুর্বল শরীর আর টেনে নিতে পারেনা। হঠাৎ-ই পায়ের সাথে কিছু বেঁধে ঠাস করে পড়ে যায়। দুর্বল শরীর টায় একটু ধাক্কা খেয়ে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেনা মেয়েটি। ঝাপসা চোখজোড়া বা হাতে ডলে সামনে তাকালে বিস্ময়ে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।

ল্যামপোস্টের হলদে আলো সৌম্য’র মুখের উপর এসে ঠাই নিয়েছে। নাক-মুখ র’ক্তে মাখা। পেটের কাছে র’ক্ত দিয়ে মাখামাখি। সৌম্য’র হুশ নেই। যেন কি নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছে। সন্ধ্যা স্তব্ধ হয়ে যায়। মুখ হা করে কথা বলতে চাইলো, তার ভাইকে ডাকতে চাইলো, একটুখানি উঠতে বলার আর্জি জানাতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। এ কি অবস্থা হয়েছে তার সৌম্য ভাইয়ার? সন্ধ্যা কাঁপা দু’হাত তুলে সৌম্য’র গালে রাখে। একটু ঝুঁকে সৌম্য’র দু’গাল ঝাঁকায়। অনবরত নোনাজল ঝরছে, আর কত সহ্য করতে হবে তাদের দু’ভাইবোনের? তার ভাইয়ের এই অবস্থা কে করেছে?

সন্ধ্যা কাঁদতে কাঁদতে বা হাত সৌম্য’র পেটে উপর রাখে। র’ক্তে মাখামাখি হয়ে যায় তার হাত। সন্ধ্যার মাথা কাজ করেনা। দু’হাত সৌম্য’র বুকে রেখে সৌম্য’কে ঝাঁকিয়ে মনে মনে আত্মচি’ৎ’কা’র করে,
– সৌম্য ভাইয়া ওঠো। আমি কোথায় যাবো তোমার কিছু হলে? ও সৌম্য ভাইয়া ওঠো প্লিজ! আমাকে একা রেখে যেও না। আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই সৌম্য ভাইয়া। তুমি ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই।
বোবা মনে আহাজারি করতে করতে সন্ধ্যা সৌম্য’র বুকে কপাল ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ একজনের কণ্ঠ পেয়ে সন্ধ্যা দ্রুত মাথা তুলে তাকায়। সন্ধ্যা নিয়াজকে পুরোপুরি না চিনলেও বুঝল তখনকার তাকে বাঁচানো লোকটি-ই এটা। কিন্তু সন্ধ্যার যে বিশ্বাস হয়না কাউকে। অন্যদের থেকে বাঁচিয়ে নিজে ভো’গ করবে না তো! সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। আচ্ছা সে নাহয় সব করবে, কিন্তু এর বিনিময়ে তার ভাইকে বাঁচিয়ে দিবে তো?
সন্ধ্যা ভ’য় চেপে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে নিয়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার ভাইকে দেখিয়ে দু’হাত তুলে রিকুয়েস্ট করে বোঝায়,

– তার ভাইকে বাঁচিয়ে দিতে।
নিয়াজ দ্রুতপায়ে সৌম্য’র কাছে এসে দাঁড়ায়। পুরো বডিতে নজর বুলিয়ে বিড়বিড় করে,
– ওহ শীট!
এরপর সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা তার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে জোর করে আছে। চোখ থেকে টুপটুপ করে ঝর্ণার ন্যায় পানি ঝরছে। নিয়াজের মায়া লাগলো। জিজ্ঞেস করে,
– ছেলেটি আপনার কেউ?
সন্ধ্যা মাথা উপর-নীচ করে হ্যাঁ বোঝায়। নিয়াজ এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসে সৌম্য’র হাত চেক করে আশানুরূপ কিছু আন্দাজ করে। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

– সামনে আমার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। আপনি দুই মিনিট অপেক্ষা করুন, কেমন?
কথাটা বলে নিয়াজ দ্রুতপায়ে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
সন্ধ্যা সৌম্য’র পাশে বসল। একটু দূরে কিছু বাজার চোখে পড়ল। চোখে পড়ল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুচকা সহ আরও কিছু খাবার। সন্ধ্যার মনে পড়ল, সৌম্য তাকে শেষবার গালে হাত দিয়ে বলেছিল, সে তার জন্য ফুচকা আনতে যাচ্ছে। শহরের ফুচকা খাওয়াবে তাকে। সন্ধ্যা-ও অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তার ভাই আর ফিরতে পারেনি। তার ভাইকে কারা যেন মে’রে দিয়েছে।
সন্ধ্যার চোখের বাঁধ থামে না। বুকভাঙা কান্নায় মেতে সৌম্য’র নিশ্চুপ ঘুমিয়ে থাকা মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকে। সৌম্য’র গালে হাত দিয়ে মনে মনে আওড়ায়,

– আমাকে রেখে যেও না সৌম্য ভাইয়া।
নিয়াজের ডাকে সন্ধ্যা দ্রুত পিছু ফিরে তাকায়। নিয়াজ গাড়ি থেকে নেমে এসে সৌম্য’কে গাড়ির পিছনে শুইয়ে দেয়। সন্ধ্যা সৌম্য’র মাথার কাছে বসলে নিয়াজ গাড়ি স্টার্ট দেয়।
কল করে কাউকে ইমার্জেন্সি অপারেশনের সব ব্যবস্থা করতে বলে।
প্রায় ১০ মিনিট খুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এক হসপিটালে এসে পৌঁছায় নিয়াজ। এরপর সৌম্য’কে নিয়ে একটি স্ট্রেচারে শুইয়ে কেবিনে নিয়ে যেতে বলে নার্সদের। নিয়াজের কথা অনুযায়ী নার্স রা সৌম্য’কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা কান্নামাখা চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল।

নিয়াজ সন্ধ্যার দিকে তাকালো। মেয়েটির অবস্থা বিধ্বস্তের চেয়ে-ও বিধ্বস্ত। ঠোঁটের কোণায় অসংখ্য কাটা, মুখের জায়গায় জায়গায় কেটে গিয়েছে। তাছাড়া-ও জামার হাতের ছেড়া অংশগুলোর ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সন্ধ্যার জখমগুলো। গলায় অসংখ্য আঁচরের দাগ। নিয়াজ ঢোক গিলল। নিচের দিকে দৃষ্টি যাওয়ার আগেই নিয়াজ দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। যদি-ও সন্ধ্যার জামার সামনে ওড়নার মতো কি যেন, পুরোপুরি ওড়নার কাজ না হলে-ও মোটামুটি চলে, তবে দেখতে খারাপ লাগছে জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়ায়। নিয়াজ গলা ঝেড়ে বলে,
– চিন্তা করবেননা। উনি ঠিক হয়ে যাবে। আপনি আমার সাথে আসুন।
সন্ধ্যা প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায় নিয়াজের দিকে। নিয়াজ তাড়া দিয়ে বলে,

– আসুন, উনার অপারেশন করাতে হবে। আপনি দ্রুত না আসলে লেট হবে আমার।
সন্ধ্যা ভীত চোখে তাকায়। তার মানে কি তার ভাইয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে বিলিয়ে দিতে হবে এই লোকটার কাছে। নিয়াজ সন্ধ্যাকে চুপ দেখে একজন নার্সকে ডেকে বলে,
– উনাকে আমার রুমে নিয়ে আসুন। ফাস্ট।
নার্সটি এগিয়ে এসে সন্ধ্যার হাত ধরে নিয়াজের পিছু পিছু যায়। নিয়াজ তার রুমে গিয়ে নার্সটিকে বলে,
– আমি যতক্ষণ না আসছি আপনি উনার সাথে থাকবেন।
নিয়াজের কথায় মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে সন্ধ্যাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেয়।

নিয়াজ পর্দার পিছনে গিয়ে সার্জিক্যাল অ্যাটায়ার অর্থাৎ সার্জিক্যাল স্ক্রাব, সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস, ক্যাপ সবকিছু পরে পর্দার পিছন থেকে বেরিয়ে আসে। আসার আগে তার বেশ কয়েকটি শার্ট এর মধ্যে থেকে একটি কালো শার্ট নিয়ে সন্ধ্যার সামনে টেবিলের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
– শার্ট টি পরে নিন। আপনাকে দেখতে খারাপ লাগছে।
সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিয়াজের প্রস্থানের পানে। সে কি ভাবছিল, আর এই লোকটি কি করল? সন্ধ্যা বুঝতে পারল, লোকটি ডক্টর। কারণ নিয়াজ একদম ডক্টরের পোষাক পরে বেরিয়েছে। সন্ধ্যা যথাসাধ্য নিজেকে ঢেকে রাখতে চাইছিল, কিন্তু মনমতো হচ্ছিল না, এই শার্টটি দেখে ভাবলো এটি পরলে নিজেকে একটুখানি ঢাকতে পারবে।
নার্স সন্ধ্যার পাশের চেয়ারে বসে বলে,

– তুমি স্যারের কে হও? আর তোমার কি হয়েছে?
সন্ধ্যা চুপচাপ চেয়ে রইল। সে কি জবাব দিবে? তখন-ই দরজা ঠেলে একজন মহিলা ডক্টর, যার নাম সাবিনা, তিনি প্রবেশ করে। তাকে মূলত নিয়াজ আসতে বলল। একটি মেয়ে আছে, তার প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োজন। সাথে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা-ও করতে হবে কিছু। নিয়াজ তাকে সব বলেছে।
ডক্টর সাবিনাকে দেখে নার্স সন্ধ্যার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায়। ডক্টর সাবিনা চেয়ার টেনে সন্ধ্যার পাশে বসে। সন্ধ্যা সাবিনার দিকে চেয়ে রইল। ডক্টর সাবিনা সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,

– কিছু হয়নি তোমার। এসব নিয়ে ভেবো না কেমন?
সন্ধ্যা নিশ্চুপ। ডক্টর সাবিনা স্যাভলন, তুলো সহ মলম নিয়ে সন্ধ্যার জখম হওয়া স্থানগুলোয় দিয়ে দিতে থাকে। সাবিনা তার কাজ শেষ করে টেবিলের উপর রাখা নিয়াজের শার্টটি সন্ধ্যাকে পরতে সাহায্য করে। সন্ধ্যা চুপচাপ শার্টটি পরে নেয়। আগের চেয়ে নিজেকে ভালোভাবে ঢাকতে পেরে সন্ধ্যা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। ভাইয়ের চিন্তায় সন্ধ্যার কিচ্ছু ভালো লাগে না। বারবার শুধু চোখ ভিজে যাচ্ছে। সে একটু পর পর ঝাপসা চোখ মুছছে। ডক্টর সাবিনা সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে মৃদুহেসে বলে,

– ছেলেটি কি তোমার ভাই?
সন্ধ্যা মাথা উপর-নীচ করে হ্যাঁ জানায়। সাবিনা নিজের আন্দাজ সঠিক হওয়ায় খুশি হলো। এদের চেহারায় অনেক মিল, যে কেউ বলে দিতে পারবে, এরা ভাই-বোন। সাবিনা সন্ধ্যার চিন্তিত মুখ দেখে বলে,
– চিন্তা কর না। আমার বন্ধু তোমার ভাইয়ের অপারেশন করছে। তোমার ভাই সুস্থ হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে সন্ধ্যার মনের ভ’য় একটুখানি কমলো। তবে পুরোপুরি নয়। তার সৌম্য ভাইয়া সুস্থ হয়ে তার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত তার শান্তি হবে না।
একটু পর সাবিনা জিজ্ঞেস করে,

– ওই লোক দু’টো কি তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছিল?
সাবিনার প্রশ্ন শুনে সন্ধ্যার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে চাইলেও নিজেকে থামাতে পারছে না। এতোক্ষণ ভাইয়ের চিন্তায় এসব খেয়ালে না থাকলেও এখন ভীষণ জ্বলছে। দেহ জ্বলুনির চেয়ে বেশি জ্বলুনি তার মনে। লোকটি তার কত জায়গায় ছুঁয়েছে, ভাবতেই দমবন্ধ লাগলো সন্ধ্যার। যেমন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, তেমনি চোখের বাঁধ ভেঙেছে। ডক্টর সাবিনা সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে সন্ধ্যাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সান্ত্বনা দেয়,
– এসব ভুলে যাও। কিচ্ছু হয়নি তোমার। ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা এক দমবন্ধকর অনুভূতি নিয়ে মাথা নিচু করে রইল। একটু পর পর নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে তার দু’হাতের উপর।

সৌম্য’র ক্ষ’ত খুব বেশি গভীর না হওয়ায় নিয়াজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। খুব বেশি কিছু করতে হয়না। সময় একঘণ্টার মতো লাগে।
চাকুর পথটুকুর সৃষ্ট ক্ষ’ত পরিষ্কার করে দেয়। ইনফেকশন এড়াতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে চামড়া ও পেশির স্তরগুলো আলাদা আলদা করে সেলাই করে দেয়।
সবকাজ শেষে অপারেশ থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসে নিয়াজ। তার রুমে গিয়ে দেখল সন্ধ্যা, সাবিনা দু’জন চুপচাপ বসে আছে। সাবিনা নিয়াজকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

– অপারেশন এর কি অবস্থা?
নিয়াজ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– সাকসেসফুলি হয়েছে। ১ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরবে।
সাবিনা মৃদু হেসে বলে,
– দেখেছ, আমার বন্ধু বেশ ভালো ডক্টর। তোমার ভাই অলরেডি সুস্থ হয়ে গিয়েছে, চিন্তা করনা।
নিয়াজ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার চোখমুখের অবস্থা বেহাল। চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। নিয়াজ সন্ধ্যার দিকে খেয়াল করলে দেখল তার শার্ট সন্ধ্যার পরনে পাঞ্জাবির মতো হয়েছে। অন্য সময় হলে হয়তো সে স্বভাবসুলভ একটু হাসতো, কিন্তু এখন সন্ধ্যার বিধ্বস্ত মুখ দেখে তার খারাপ লাগলো। মেয়েটির তখনকার অবস্থার কথা ভেবে তার নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগছে। সেখানে মেয়েটির সাথে ঘটনাটি ঘটেছে। তার উপর ভাইয়ের এই অবস্থা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবিনার উদ্দেশ্যে বলে,
– আমি বাইরে থেকে আসছি। কাজ আছে। তুই থাক তাহলে।
সাবিনা সম্মতি দেয়, সে আছে। নিয়াজ রুমের ওপাশ থেকে তার ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে যায়।

আকাশ ছাদের রেলিঙের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মনটা ভীষণ অস্থির। সে এখনো ভাবছে, সন্ধ্যাকে কিভাবে ভুলবে। অরুণ ছাদে এসে আকাশকে দেখে আকাশের পাশে সে-ও রেলিঙয়ে পা ঝুলিয়ে বসে। আকাশের কাঁধে হাত রেখে বলে,
– তোকে অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছিলাম। এখানে কি করছিস?
আকাশের কোনো সাড়া না পেয়ে অরুণ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– অধিক খুশিতে শোক পালন করছিস না-কি! সন্ধ্যা চলে গেল, খুশি হো।
আকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

– ও চলে যাওয়ায় আমি খুশি হয়নি। অস্থির লাগছে আমার।
– তাহলে যেতে দিলি কেন?
– তো কি করব?
– রেখে দিবি তোর কাছে।
আকাশ আনমনা হলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বকুল ফুলের মালাটি বের করে তাকালো মালাটির দিকে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে আকাশের হাতের বকুল ফুলটি দেখে অবাক হয়ে বলে,
– পা’গ’ল টা’গ’ল হলি না-কি? এমন শুকিয়ে যাওয়া ফুল নিয়ে পকেটে ঘুরছিস কেন?
বলতে বলতে আকাশের হাত থেকে ফুলটি কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার আগেই আকাশ টান মে’রে অরুণের থেকে নিয়ে লাফ দিয়ে ছাদের মেঝেতে নামে। এরপর অরুণ কিছু বোঝার আগেই অরুণকে ধাক্কা দেয়। অরুণ ধাক্কা খেয়ে নিচের দিকে পড়তে নিলে আকাশ ডান হাতে অরুণের গেঞ্জি টেনে ধরে। অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

– তোর সাহস কি করে হলো এটা ফেলে দেয়ার?
অরুণ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আরে তোল আমাকে। মা’র’বি না-কি! তাছাড়া এমন ভাব করছিস, যেন আমি হীরা ফেলে দিচ্ছিলাম।
আকাশ সাথে সাথে উত্তর দেয়,
– এটা হীরার চেয়ে-ও দামী!
অরুণ মুখ অদ্ভুদভাবে কুঁচকে তাকায়। দু’হাত উপরদিকে উঠিয়ে দেয়ালে রেখে বলে,
– কি জ্বালা! আমি কিভাবে জানবো ফুল বিদ্বেষী মানুষ হঠাৎ ফুল প্রেমী হয়ে গিয়েছে! তোল আমাকে।
আকাশ রে’গে বলে,

– ম’র তুই।
অরুণ কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– এ না, ম’র’ব কেন? বিয়েই তো করলাম না!
আকাশ বিরক্তি নিয়ে অরুণকে টেনে তোলে। অরুণ ছাদে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। দু’হাত কোমরে রেখে হাঁপানো কণ্ঠে বলে,
– কোথায় পেয়েছিস এটা? উফ! এটার জন্য আমি ম’র’তে যাচ্ছিলাম।
আকাশ ফুলটি পাঞ্জাবির পকেটে রাখলো। দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
– সন্ধ্যা দিয়েছে।
একটু থেমে মৃদুস্বরে বলে,
– ওর ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে চাই আমি।
অরুণ অবাক হয়ে বলে,
– ইচ্ছেগুলো কি?
আকাশ একটু হেসে বলে,

– এই যে, এই ফুল রেখে দিতে বলেছে। ওর ছবি মুছে ফেলতে নিষেধ করেছে, আর ওকে মাঝে মাঝে মনে করতে বলেছে। রাজনীতি ওর ভালো লাগে না।
কথাগুলো বলে থামলো আকাশ। এরপর তার পরনের পাঞ্জাবির দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল,
– সাদা পাঞ্জাবির কথা-ও মনে হয় বলেছে।
অরুণ আকাশের অর্ধেক কথা বুঝল, বাকি অর্ধেক বুঝল না। কিন্তু রাজনীতির কথাটা খুব ভালো করে বুঝেছে। মাথায় হাত দিয়ে বলে,
– তুই রাজনীতি ছাড়বি না-কি!
অরুণের কথায় আকাশের ধ্যান ভাঙে। অরুণের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– কি বললি?
অরুণ মেকি হাসলো। টি-শার্ট দু’বার উঁচু করে টেনে বলে,
– ডক্টর নিয়াজ সভাপতি হতে চায়, মানে তোর আসন নিতে চায় আর-কি, তাই বললাম।
আকাশ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,

– এর প্রবলেম কি? ডক্টরগিরি রেখে এইদিকে আসে কেন বুঝলাম না!
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তুই-ও তো ব্যবসাগিরি রেখে ওদিকে যাস।
আকাশ রে’গে তাকায়। অরুণ মেকি হেসে বলে,
– তুই যে বললি সন্ধ্যার ইচ্ছে পূরণ করবি। আবার বললি, সন্ধ্যা রাজনীতি পছন্দ করেনা।
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– রাজনীতির সাথে কোনোকিছুর আপস করিনা আমি। ফা’ল’তু কথা বাদ দিয়ে যা এখান থেকে।
অরুণ বিড়বিড় করে বলে,
– শা’লা সুবিধাবা’জ!
আকাশ আবার-ও আনমনা হয়। কি যেন ভেবে সৌম্য’র নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখে হতাশ হয়। সন্ধ্যার চিঠি দু’টো আকাশের মনকে বিষন্নতা ঘিরে ধরে। তার ভালো লাগছে না। ছাদের এপাশ-ওপাশ হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে। অরুণ আকাশের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। এর হয়েছে টা কি? আকাশ হঠাৎ-ই দাঁড়িয়ে গিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,

– মনে হচ্ছে সন্ধ্যাকে ছাড়া আমার চলবে না।
অরুণ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। এগিয়ে এসে বলে,
– কি বললি?
আকাশ থতমত খেয়ে তাকায় অরুণের দিকে। নিজেকে সামলে গম্ভীর গলায় বলে,
– চলবে।
অরুণ মাথা চুলকে বলে,
– কি বলছিস আ’বা’লদের মতো।
আকাশ রে’গে বলে,
– কালকে আমার অনেক কাজ। তুই ডিস্টার্ব করছিস কেন? সকাল সকাল রেডি হয়ে থাকবি। এখন যা।
কথাটা বলে আকাশ আবার-ও ছাদের রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে। একটু-ও শান্তি পাচ্ছে না। হাসফাস কণ্ঠে বিড়বিড় করে,

– সন্ধ্যা!
পাশ থেকে অরুণ আকাশের দিকে জহুরি চোখে চেয়ে বলে,
– সন্ধ্যা ওর ভাইয়ের কাছে।
আকাশ রে’গে অরুণকে থা’প্প’ড় মা’র’তে গেলে অরুণ দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। আকাশ বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল।

সৌম্য’র জ্ঞান ফিরে এক ঘণ্টা পর। সৌম্য’র পাশে সন্ধ্যা মলিন মুখে বসে আছে। সৌম্য’কে নড়াচড়া করতে দেখে সন্ধ্যা দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। সৌম্য চোখমুখ কুঁচকে নেয়। ডান হাতে মাথা চেপে ধরে। সন্ধ্যা ডান হাত সৌম্য’র কপালে রাখলে সৌম্য এদিক ফিরে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। মাথা ঝিমঝিম করছে। কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেলে হঠাৎ মাথায় কিছু বাজতেই সৌম্য ধড়ফড় করে উঠে বসে। সন্ধ্যা সৌম্য’র সামনে বসে, ডান’হাত সৌম্য’র কাঁধে রাখে। চোখের কোণে পানি তার। মুখে একটুকরো হাসি।
সৌম্য বোনকে দেখে ভাঙা গলায় ডাকে,

– বোনু?
সন্ধ্যার চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য সন্ধ্যাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার বোনের মুখের এ অবস্থা কেন? কতজায়গায় কেটে গিয়েছে, ক্ষ’ত গুলো চোখে লাগছে। সৌম্য সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– তোর কি হয়েছে বোনু? তোকে কি কেউ মে’রে’ছে? মুখে এসব কি হয়েছে?
সন্ধ্যা নিজেকে সামলাতে পারলো না। মাথা নিচু করে ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলে। সৌম্য আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল এটা হসপিটাল। মনে পড়েছে তাকে কেউ চা’কু মে’রে’ছিল। কিন্তু সে এখানে কিভাবে আসলো? সন্ধ্যাকে নিঃশব্দে কাঁদতে দেখে সৌম্য সন্ধ্যার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
– কাঁদছিস কেন বোনু আমাকে বল?
ডক্টর সাবিনা কেবিনে আসে। বেড এর পাশে চেয়ার টেনে বসে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,

– আপনার বোনকে রে’প করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
কথাটা যেন সোজা সৌম্য’র কলিজায় গিয়ে লাগলো। তার বোন তো তার কলিজা। সোখানেই তো লাগবে। সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তার বোনের দিকে তাকায়। সন্ধ্যার মাথা নিচু। সন্ধ্যার পরনে শার্ট,, সৌম্য ঢোক গিলল। সাবিনা নিয়াজের থেকে যা যা শুনেছিল, একে একে সব বলল সৌম্য’কে। এরপর দুই ভাইবোনকে স্পেস দিতে সাবিনা কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। সৌম্য ভাঙা গলায় বলে,
– তুই ঘর থেকে কেন বেরিয়েছিলি বোনু?
সন্ধ্যা ভেজা চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে। ইশারায় বলে,

– সে বের হয়নি। দু’টো লোক দরজায় গিয়ে নক করেছিল। সে সৌম্য ভেবে খুলে দিয়েছে। এরপর লোকগুলো তাকে থা’প্প’ড় দিয়েছিল। সে বাঁচার জন্য পালাচ্ছিল, কিন্তু তাকে ধরে ফেলেছিল লোকগুলো।
এটুকু বুঝিয়ে সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ওঠে। সৌম্য চোখ বুঝল। নিজেকে এতোটা ব্যর্থ কখনো মনে হয়নি। সে তার ছোট্ট বোনটার বাবা, মা, ভাই সব। অথচ একটার দায়িত্ব-ও সে পালন করতে পারলো না। ক’ষ্ট হচ্ছে তার। বুকে ব্য’থা বাড়ছে। তাকে-ও দু’টো লোক চা’কু মে’রে’ছে। সৌম্য খুব ভালো করে বুঝল, তাকে আর তার বোনকে প্ল্যান করে মা’র’তে চাইছিল। সৌম্য’র কানে ইরার বাবার কথা বেজে ওঠে, – তার বোনের লা’শ দেখতে হবে, যদি সে ইরার পিছু না ছাড়ে।

কথাটি ভেবে সৌম্য’র গা কাঁটা দেয়। সৌম্য আর বসে থাকলো না। দ্রুত বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সৌম্য’র পেটের বাম পাশে কটু চাপ লাগলো, তবে পাত্তা দিল না। সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– এটা কার শার্ট বোনু?
সন্ধ্যা বোঝায়, ডক্টরের। সৌম্য বেডের কোণা থেকে তার শার্ট তুলে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– ওটা খুলে আমার শার্ট পরে নে বোনু। যদিও নিচের দিকে ছেড়া। তবুও এটা পর।
সন্ধ্যা কিছু বলল না। পরনের কালো শার্ট খুলে বেডের উপর রাখল, এরপর সৌম্য’র হাত থেকে শার্ট-টি নিয়ে পরতে লাগলো। সৌম্য সন্ধ্যার জামার ছেড়া অংশগুলো দেখে, সাথে গলায়, হাতে আঁচড়গুলো দেখে সৌম্য’র শ্বাস নিতে ক’ষ্ট হয়। চোখের কোণে পানি। তার ফুলের মত বোনের এ কি হাল হয়েছে?
সন্ধ্যা শার্ট পরে তার ভাইয়ের দিকে তাকালে সৌম্য চোখ সরিয়ে নেয় চোখের জল আড়াল করতে। নিজেকে সামলে সন্ধ্যার হাত ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

নিয়াজ সৌম্য’র কেবিনে ঢুকতে চাইছিল, সৌম্যকে বেরিয়ে আসতে দেখে বলে,
– আপনি বেরিয়ে আসছেন কেন? আপনার বেড রেস্ট প্রয়োজন।
সৌম্য বুঝল এটাই হয়তো সেই ডক্টর। যে তার বোনকে, তাকে সাহায্য করেছে। সৌম্য কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,
– আপনার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাইনা। আমার আরেকটা উপকার করবেন?
নিয়াজ একবার সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সন্ধ্যার মাথা নিচু। অতঃপর সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে বলে,
– জ্বি বলুন?
সৌম্য তার পকেট থেকে ফোন বের করলে দেখল ফোন বন্ধ। অতঃপর বলে,
– আপনার নাম্বার টা আমাকে দিন, আমি আমার বিল আগামীকাল আপনাকে বিকাশ অথবা নগদে দিয়ে দিব।
নিয়াজ কিছু বলতে গিয়ে-ও থেমে গেল সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে। পকেট থেকে তার একটি কার্ড বাড়িয়ে দেয়। সৌম্য কার্ডটি নিয়ে বলে,

– আমাকে সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইজান।
নিয়াজ মৃদু হাসলো। অতঃপর বলে,
– আপনাকে মিনিমান ২৪ ঘণ্টা হসপিটালে থাকতে হবে।
সৌম্য ঢোক গিলে বলে,
– সম্ভব নয়। আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। আসছি।
কথাটি বলে সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে নিয়াজের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। নিয়াজ পিছু ফিরে সৌম্য আর সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত চুলগুলোর দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার হাতে একটি জামা সেট। সে মূূলত সন্ধ্যার জন্য জামা কিনতে গিয়েছিল। সে জানেনা কেন, মেয়েটির জন্য ভীষণ মায়া লাগছিল। ভেবেছিল, কতক্ষণ শার্ট পরে থাকবে, কিন্তু মেয়েটির ভাইকে জামাটি দেয়ার সাহস করল না কেন যেন। সাবিনা নিয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

– মেয়েটির জন্য জামা কিনে এনেছিস?
নিয়াজ কিছু বলল না। সাবিনা খানিক অবাক হয়ে বলে,
– তুই কি মেয়েটিকে আগে থেকে চিনিস?
নিয়াজ মাথা নেড়ে বলে,
– চিনিনা। আজকেই প্রথম দেখলাম।
কথাটি বলে জামার প্যাকেট সাবিনার হাতে দিয়ে বলে, – এটা তুই রাখ।
এরপর নিয়াজ তার রুমের দিকে যায়।

রাত তখন দেড়টা প্রায়। সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে তার মেসে আসে। পকেটে টাকা ছিল। রিক্সা করে এসেছে। ঘরের অবস্থা দেখে সৌম্য চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘরের দিকে। দু’টো প’শু তার বোনের কাছে এসেছিল, আর এজন্যই ঘরের এই অবস্থা হয়েছে। কথাগুলো ভেবে সৌম্য’র গলায় কাঁটা বিঁধে যাওয়ার মতো ক’ষ্ট হলো। সন্ধ্যা মলিন মুখে চেয়ে আছে ঘরটির দিকে। চোখের পাতা ভেদ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
সৌম্য সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দেয়। ভারী গলায় বলে,
– আমি স্যরি বোনু। তোকে আগলে রাখতে পারিনি আমি। আমায় তুই ক্ষমা করে দিস তুই।
সন্ধ্যা ভাইয়ের বুকে মাথা রাখলো। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সৌম্য’র পেটে একটু চাপ লাগলে-ও বোনকে আগলে নেয়। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি সন্ধ্যার মাথার উপর টুপ করে পড়ে।

সৌম্য আর সময় ন’ষ্ট করল না। সন্ধ্যাকে চৌকির উপর বসিয়ে সন্ধ্যার চুলগগলো শ’ক্ত করে খোঁপা করে দেয়। সন্ধ্যা দু’হাতে চোখ মুছে। তার ভাই থাকলে সে কখনো এতো বড় চুলের খোঁপা করে না। সৌম্য সব করে দেয়।
সৌম্য সন্ধ্যার সামনে বোরখা রেখে সন্ধ্যাকে বোরখা পরতে বলে নিজের গায়ে একটি শার্ট জড়িয়ে নেয়। যা যা কাপড় ছিল, সব ব্যাগে ভরে নেয়। আর টুকটাক যা ছিল সেসব সাথে নেয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খিচুড়িগুলোর দিকে তাকালো। অনেকদিন পর তার ছোট মায়ের হাতের রান্না খেতে চেয়েছিল, তা আর কপালে লেখা নেই। সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যার তার দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে আছে। সৌম্য এগিয়ে গিয়ে বিষাদ সুরে বলে,

– এই শহর আমাদের জন্য খুব বি’ষা’ক্ত বোনু। এখানে আর আমরা থাকবো না। এখানে আর কখনো আসবো না। এই শহরে আমরা কখনো এসেছিলাম এটা-ও ভুলে যাবি, কেমন?
সন্ধ্যা ভাইয়ের কথা শুনলো। এরপর বোরখা পরে নেয়। সন্ধ্যা রেডি হয়ে নিলে সৌম্য দরজা আটকে সন্ধ্যার হাত ধরে মেস থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা আকাশপানে তাকায়। আকাশের কথা মনে পড়ল খুব। সে তো আর এখানে আসবে না। আকাশ তাকে ভুলে যাবে? তাছাড়া আজকের এসব ঘটনা জানলে আকাশ হয়তো আরও আগে তাকে ডিভোর্স দিতে চাইবে। সন্ধ্যা ডান হাতে চোখের কোণে লেগে থাকা পানির কণা মুছে নেয়।

অন্তঃদহন পর্ব ১৭

সৌম্য বোনকে ডান বাহুর আড়ালে আগলে নিয়ে হাঁটতে থাকে। সৌম্য’র মন বলে, – সে তার বোনের, আর তার সাথে করা অন্যায়কারীকে শাস্তি না দিয়ে কা’পুরুষের মতে পালাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই সৌম্য মনে মনে বিড়বিড় করে,
– দায়িত্ব, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসার বেড়াজালে আটকে থাকা মানুষকে নিরাপদে রাখার তাগিদে কখনো কখনো কা’রুপরুষতা বীর পুরুষের পরিচয় বহন করে।

অন্তঃদহন পর্ব ১৮