অন্তঃদহন পর্ব ২৬

অন্তঃদহন পর্ব ২৬
DRM Shohag

আকাশ সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। যেন কত শান্ত এক প্রেমিক! অথচ কয়েক সেকেন্ড আগে রা’গে টগবগ করছিল। সৌম্যকে কিভাবে বলল। সন্ধ্যা আকাশের বলা কথাগুলো এখানে দাঁড়িয়েই শুনলো। সন্ধ্যার ঠিক হজম হয় না। মানুষ এতো দ্রুত কীভাবে রঙ পাল্টে ফেলে! আকাশের দৃষ্টি সাথে তার দু’গালে হাত রাখায় সন্ধ্যার কেমন যেন অস্বস্তি হলো। সে আকাশের থেকে দূরে সরতে চাইলো। তখন-ই আসমানী নওয়ান ভেতরে প্রবেশ করে সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে তার পাশে এনে দাঁড় করায়। আকাশ বিরক্ত চোখে তাকায়। মাকে দেখে কিছু বলতে চায়, তার আগেই আসমানী নওয়ান চোখ পাকিয়ে বলে,

– তুমি আবার আমার জান্নাতরে নিয়া টানাটানি করতাছ?
আকাশ অসহায় চোখে তাকালো। যেন আকাশ এক বাচ্চা, আর তার মুখের সামনে থেকে তার প্রিয় খাবার ছিনিয়ে নিয়েছে। রিয়েকশনটা এমন। দৃষ্টি ফিরিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা তার দিকেই চেয়ে ছিল, সে তাকাতেই মাথা নিচু করে নিল। আসমানী নওয়ান এর দিকে একটু চেপে যায়। আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তোমার জান্নাতকে তো আমি খাচ্ছিলাম না। শুধু একটু ধরেছিলাম।
কথাটা বলে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে এসে রে’গে বলে,
– দেখি তো, তোমার জান্নাতের কোথাও ফোসকা পড়ল না-কি! ফোসকা পড়লে মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।
সন্ধ্যা আসমানী নওয়ান এর পিছনে লুকায়। ভীত চোখে তাকায় আকাশের দিকে।
আসমানী নওয়ান আকাশকে ঠেলে জবাব দেয়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ধরতেও পারবা না ওরে। বুঝছ?
আকাশ অসহায় চোখে তাকালো। সন্ধ্যার দিকে তাকালো। ভাবনায় আসে, সন্ধ্যা তাকে দেখে ভ’য় পায় কেন? আবার ভাবলো, দেখা হওয়ার পর থেকে যা হাইপার হয়ে ছিল, ভ’য় পাওয়াটা-ও হয়ত স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটি তাকে ভুলেই গিয়েছে। স্মৃতিশক্তি ন’ষ্ট হয়ে গেলে যেমন হয় তেমন। আবার ভাবলো, তাদের কি প্রেমের সম্পর্ক ছিল? না তো। ১১ মাস আগে যখন সন্ধ্যা তাদের বাড়ি ছিল, সন্ধ্যার রিয়েকশন এখনকার মতোই সেইম ছিল।
মাঝখানে শুধু আবেগের বসে তাকে দু’টো চিঠি দিয়েছিল। অর্থাৎ তাদের শুধু নামেই বিয়েটা হয়েছিল। তারপর সে মানে না মানে বলতেই বউ হারিয়ে প্রায় বছর ঘুরে বউয়ের বিরহ পালন করল! মানে প্রেম না হতেই সে বিরহের আ’গুনে পু’ড়ে হৃদয়ের ছার’খার অবস্থা। এদিকে বউ তার নামেই রয়ে গেল। সে একা একাই ভালোবেসে এখন কন্ট্রোললেস হয়ে যাচ্ছে। আর ওদিকে সন্ধ্যা তাকে দেখে শুধু ভ’য় পাচ্ছে।

আকাশ হতাশার শ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে, তাকে এখন ওই ১৮ বছরের বাচ্চাদের মতো তার বউয়ের পিছনে ঘুরঘুর করতে হবে। ঠিক যেমন কোনো কিশোরী বয়সের ছেলে কোনো মেয়েকে পছন্দ করে দিনের পর দিন সেই মেয়ের পিছনে ঘুরঘুর করে মেয়েকে রাজি করায়।
তেমনি সে ৩০ বছর বয়সী এক সভাপতি হয়ে, বউয়ের পিছে ঘুরঘুর করে কোনো একদিন হয়তো তার সন্ধ্যার হাত ধরার অনুমতি পাবে।
আকাশের চোখেমুখে অসহায়ত্ব। তার বউয়ের মনে প্রেম তো নেই-ই উল্টে তাকে ঘৃ’ণা করে বসে আছে। সে কবে তার সন্ধ্যামালতীর মন থেকে ঘৃ”ণা দূর করবে? কবে একটু ভালোবাসার ফুল ফোটাবে! তারপর গিয়ে বউয়ের হাত ধরতে পারবে। বাকিসব তো দূরেই থাকলো। এসব ভেবেই আকাশের ঘাম ছুটল।
বিরক্ত হয়ে বলে,

– সর তো! নিজের মা-ই আমার শত্রু।
কথাটা বলে ইরার বেডের দিকে এগিয়ে যায়। আসমানী নওয়ান কিছু বললেন না। এক হাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে আসমানী নওয়ান এর দিকে চেয়ে রইল। তার মাকে তার ঠিক করে মনেই নেই। তাকে যে জান্নাত নামে ডাকতো, সেটাও মনে নেই। শুধু জান্নাত নামটি তার পরিচিত ঠেকত! আসমানী নওয়ান কেন তাকে একদম নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতো, আজ সন্ধ্যা বুঝল। কেমন অদ্ভুদ অনুভূতি হচ্ছে। এই মানুষটা তার-ই মায়ের বোন?
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার গালে হাত বুলিয়ে বলে,

– কাঁদিস না মা। আমি তো ম’রে যাইনি।
সন্ধ্যা ডান হাতে ঝাপসা চোখজোড়া ডলে স্বাভাভিক করে। এরপর তার ফোনে কিছু লিখে আসমানী নওয়ায়ন এর দিকে তাক করে, যেখানে লেখা,
– তুমি সত্যি আমার নিজের খালাম্মা?
আসমানী নওয়ান লেখাটি পড়ে মলিন মুখে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। মলিন গলায় বলে,
– হুম। তোর মা জ্যোৎস্না আমাগো সব ভাইবোনের খুব আদরের আছিল।
সন্ধ্যা আবার-ও টাইপ করে,

– তাহলে তুমি আমাকে কেন বলেছিলে আমার মা তোমার বান্ধবী? তুমি আমার খালাম্মা এইটা আগে কেন বলো নি?
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার কপালে চুমু খেয়ে ধরা গলায় বলে,
– কোন মুখে কইতাম মা? তোর খালা বাঁইচা থাকতে তুই এতো ক’ষ্ট করলি। আমি বাঁইচা থাকতে আমাগো জ্যোৎস্নার কলিজার টুকরা ডা এতো ক’ষ্ট করছে। এসব ভাবলে আমার দম আটকায় আসতো। নিজের কাছেই ল’জ্জা লাগতো। তাই তখন কইতে পারিনি। পরে যে কমু, তার আগেই তো হারায় গেলি! তোর ভাইটা নিজের, এইটা জানার পর ওর সাথে বইসা দুইডা কথা কমু, কিন্তু কাউরেই আর খুঁইজা পাইলাম না।
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। দু’হাতে আসমানী নওয়ানকে জড়িয়ে ধরে। তার ভাইয়ের পর আসমানী নওয়ান একজন মানুষ ছিল, যে সন্ধ্যাকে খুব ভালোবাসতো। সন্ধ্যার খুব পছন্দের একজন মানুষ আসমানী নওয়ান। সন্ধ্যার খুব মনে পড়ত, আসমানী নওয়ানকে।

আর আজ যখন জানলো সেই পছন্দের মানুষটি তার নিজের মানুষ, তখন সেই অনুভূতি কাকে বোঝাবে? সে তো জানতো, তার আর সৌম্য ভাইয়ার, তার একে-অপর ছাড়া আর কেউ নেই।
আসমানী নওয়ানের চোখে কোণে পানি। সন্ধ্যার পিঠে আলতো হাত বুলায়। তার জ্যোৎস্নার কলিজা দুইটা বেঁচে আছে দেখার পর দেখে সে যেন নতুন একটি জীবন ফিরে পেয়েছে।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে তার মা আর সন্ধ্যার দিকে। এখানে কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই রুমে প্রবেশ করার পর সে সন্ধ্যাকে দেখছিল, আশেপাশের কোনো কথা তার কানে ঢোকেনি। এখন তার মা আর সন্ধ্যার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বড়সড় কিছু ঘটে গিয়েছে। কিন্তু কি? তার মায়ের সব কথা তো তার মাথার উপর দিয়ে গেল! ভ্রু কুঁচকে বলে,

– কি হয়েছে মা?
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে ছাড়িয়ে তার চোখ মুছল। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকায়, সন্ধ্যাকে কাঁদতে দেখে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– ও কাঁদছে কেন মা?
কথাটা বলে আকাশ সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে আসমানী নওয়ান বিরক্ত হয়ে বলে,
– আবার এদিকে আসতাছ ক্যান? তোমারে আমি বাড়িতে বুঝাইয়া কইলাম না?
মায়ের কথায় আকাশ থেমে যায়। অসহায় চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার হাত ধরে ইরার বেডের দিকে যেতে যেতে মৃদুস্বরে বলেন,

– একটু পর সব বুঝাইয়া কইতাছি। ধৈর্য ধর।
আকাশ আর কিছু বললো না। তবে দৃষ্টি মাথা নিচু করে রাখা সন্ধ্যার পানে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরার বেডের অপর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ইরার ঘুমন্ত মলিন মুখটা দেখে তার খুবই খারাপ লাগলো। সে জানতো না ইরা তার মামাতো বোন, ইরার বাবা তার মামা এটাও জানতো না। ভদ্রলোকের সাথে ব্যবসায় সূত্রে অনেকবার দেখা হয়েছিল তার, অথচ তার বাবা, মা, মামা কেউ তাকে এই সম্পর্কের কথা জানায়নি। না জানানোর কারণ-ও জানেনা। এমনকি তার যখন ইরার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সে তখন-ও জানতো না এসব। কথাটা ভাবতেই কেমন যেন লাগলো আকাশের, মামাতো বোন যদিও, কিন্তু বোন তো! শিমুর মতোই বোন। পার্থক্য শুধু শিমু খালাতো বোন আর ইরা মামাতো বোন। বোনের সাথে বিয়ে! একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা! কথাটা ভাবতেই আকাশের মুখে বিরক্তির ভাঁজ ফুটে ওঠে।
ইরাকে সে প্রথম দেখেছিল, যেদিন ইরা তাকে একটি ক্যাফেতে ডেকে বলেছিল, বিয়ে ক্যান্সেল করতে। সে-ও বলেছিল,

‘ মিস ইরা বিয়ে ক্যান্সেল। ‘ সাথে আপনি সম্মোধন করেছিল। ছোট বোনকে কত সম্মান দিয়ে দিয়েছিল!
কথাটা ভেবে আকাশ মনে মনে একটু হাসলো। কিন্তু ইরার অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়।
আগের আকাশ হলে ভালোবাসা শব্দটা শুনলে সে বিদ্রূপ করতো। কিন্তু এখন ইরার অবস্থাটা সে নিজেই ফিল করতে পারছে।

সবচেয়ে বড় কথা একটি ছেলের জন্য ইরার এই অবস্থা! ইরার মা তো তাই বলল। তাও আবার ছেলেটি না-কি সৌম্য! সৌম্য’র উপর আগে থেকে তো মে’জা’জ ন’ষ্ট হয়ে ছিল-ই,, সন্ধ্যাকে তার থেকে নিয়ে আসার জন্য।
এখানে এসে আবার জানলো, সৌম্য’র জন্য ইরার এই অবস্থা। ইরার বাবার দোষ সেটা আকাশ জানে। কিন্তু সৌম্য কি কম ক’ষ্ট দিয়েছে ইরাকে? ইরা তো একদিনের ঘটনায় কোমায় চলে যায়নি। দীর্ঘদিন চাপা ক’ষ্টের ফল এটা।
সন্ধ্যা হারিয়ে যাওয়ার পর তার মা হঠাৎ ইরাদের খোঁজ করে। মায়ের কথা অনুযায়ী আকাশ ইরাদের খোঁজ করলেও কোনো খোঁজ পায়না। ইরাদের জন্য মায়ের এতো হাইপারে সে অবাক হয়েছিল। এরপর তার মাকে জিজ্ঞেস করলে, আসমানী নওয়ান ছোট করে বলেছিল, ইরা তার ভাইয়ের মেয়ে।
আকাশ আরও অবাক হয়েছিল, তার বাবা-ও এই কথা জানতো। আকাশ আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল। কিন্তু আসমানী নওয়ান প্রায় সবসময় অসুস্থ থাকতো। সে-ও সন্ধ্যার জন্য পুরো ছন্নছাড়া টাইপ হয়েছিল, যার ফলে এসব নিয়ে আর ঘাটেনি।

কথাগুলো ভেবে আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বা হাত বাড়িয়ে ইরার মাথায় রাখে। বড় ভাইয়ের স্নেহের আলতো স্পর্শ দেয় ইরার মাথায়। মনে মনে বিড়বিড় করে,
– দ্রুত সুস্থ হও। তোমার সাথে পরিচিত হতে চাই বোন-টু।
আকাশের কাজে সন্ধ্যার চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময়। সে জেনেছে তাদের সকলের সম্পর্ক। সবসময় তার ভাইকে নিজের প্রতি যত্ন নিতে দেখেছে। ইরার প্রতি আকাশের এটুকু যত্ন সন্ধ্যার ভালো লাগলো।
একটু পর আকাশ ইরার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেয়। সামনে তাকালে সন্ধ্যার সাথে চোখাচোখি হলে সন্ধ্যা সাথে সাথে মাথা নিচু করে নেয়। আকাশ একটু হাসলো। এরপর বাইরে যেতে নিলে আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– কোথাও যাই-ও না আব্বা। আমার কথা আছে। পারলে একটি কেবিন নাও।

আকাশ মায়ের কথা শুনে নিরব সম্মতি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আসমানী নওয়ান ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। নরম মনের মানুষ তিনি। ইরার এমন অবস্থা দেখে সে না চাইতে-ও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। একটু ঝুঁকে ইরার কপালে একটা চুমু খায়। মৃদুস্বরে বলে,
– আম্মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হইয়া যাও।
সন্ধ্যা ডান হাতে চোখের কোণে লেগে থাকা পানি মুছে নেয়। ইরা খুব চঞ্চল মেয়ে। সন্ধ্যার সাথে কত হেসে হেসে কথা বলতো! যদি-ও ভিডিও কলে। কিন্তু ফোনের ভেতরে-ই যেন তাকে কত আদর করতো! সন্ধ্যার শুধু সেসব দিনের কথা মনে পড়ছে।

আকাশ তার মায়ের কথা অনুযায়ী একটি কেবিন নেয়, যেখানে আপাতত সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। আসমানী নওয়ান, তার ছোট বোন তারা (যিনি শিমুর মা) শিমু, ইরার মা সবাই।
অন্যদিকে আকাশ আর সৌম্য কিছুটা পাশাপাশি, তবে মাঝে অনেক দূরত্ব আছে। দু’জনের মুখের এক্সপ্রেশন এমন যেন, দু’জন দু’জনের শ’ত্রু। যদি-ও সৌম্য একটু পর পর আকাশকে দেখছে। ইরা তার মামাতো বোন, এটা তার একটু-আধটু হ’জম হলেও আকাশ যে তার খালাতো ভাই, এটা একদম-ই হ’জ’ম করতে পারছে না সে। মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। সৌম্য’র দৃষ্টি খেয়াল করেছে আকাশ। বিরক্ত হচ্ছে সে। আজব! সে কি এলিয়েন না-কি! এভাবে দেখছে কেন এই ছেলে? এক পর্যায়ে না পেরে রে’গে বলে,

– কি প্রবলেম তোমার? জীবনে দেখনি আমাকে? এমনিতেই মে’জা’জ খা’রা’প আছে তোমার উপর। তার উপর একটু পর পর আমার দিকে এভাবে চোরা দৃষ্টি দিয়ে কি বোঝাতে চাও?
সৌম্য থতমত খেয়ে তাকায়। আকাশে গলার আওয়াজ জোরে হওয়ায় সবাই আকাশ আর সৌম্য’র দিকে তাকায়। সৌম্য অস্বস্তিতে পড়ে যায়।
আসমানী নওয়ান বলে,
– আকাশ কি হইছে?
আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে। বিরক্ত হয়। এদের ভাইবোনের প্রবলেম কি! বোন ভাইয়ের দিকে চেয়ে থাকে। ভাই আবার তার দিকে চেয়ে থাকে! পুরাই বিরক্তিকর ব্যাপার! মানে তার বউ তাকে না দেখে, বউয়ের ভাই তাকে দেখছে। সে যে দেখা নয়, যেন চোখ সরাতে পারছে না। এর মধ্যে ইরা কি এমন পেয়েছিল কে জানে!

আকাশ দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা কনুই থেকে আরেকটু উপর দিকে উঠায়। ডান হাতে গাল চুলকায়। হাতের চেইন ঘড়ি কব্জি থেকে কিছুটা নিচের দিকে নেমেছে।
আকাশ বুড়ো আঙুল তার গালে চেপে রেখে আরেকবার সন্ধ্যার দিকে তাকায়। যার দৃষ্টি এখনো সৌম্য’র দিকে। আকাশের ইচ্ছে করল, উঠে গিয়ে সন্ধ্যার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মে’রে বলতে,
– আর কত ভাইকে দেখবে? পেট টা ভরলে, অনুগ্রহ করে আমাকেও একটুখানি দেখ!
কথাগুলো মনে মনে বিড়বিড় করে আকাশ নিজের উপর বিরক্ত হলো। কি অবস্থা! সে তার সন্ধ্যামালতীকে মা’র’তে চায়? আসতাগফিরুল্লাহ! বউকে মা’রা জায়েজ নয়। এসব ভাবা-ও পা’প!
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে আকাশ। এরপর তার মায়ের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

– মেয়েরা আমার দিকে ফিরেও তাকায় না মা। আর ছেলেদের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারিনা। আমাকে কি দেখতে মেয়েদের মতো লাগছে? না-কি, আজকালকার ছেলেদের ভেতর প্রবলেম চলছে!
আকাশের কথা শুনে সৌম্য আসমান থেকে পড়ল যেন। কি পরিমাণ মেন্টালিটির মানুষ হলে তাকে মিন করে উল্টাপাল্টা কথা বলছে! সৌম্য রে’গে বলে,
– একদম ফা’ল’তু কথা বলবেন না।
আকাশ চোখ ছোট ছোট করে বলে,

– ফা’ল’তু কথা বললে তোমার গায়ে লাগতো না। খাঁটি, নির্ভেজাল কথা বলেছি বলেই তো তোমার গায়ে লাগলো!
সৌম্য কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। কিভাবে কথার প্যাঁচে ফেলল তাকে! সৌম্য আগে ভাবতো, আকাশ কত ভদ্র! কিন্তু এনার মধ্যে ভদ্রের ভ-ও নেই। শুধু একটু-আধটু ভালো মানুষ আর কি!
আকাশ পাত্তা দিল না সৌম্য’র দৃষ্টি। সে তার মতো আরাম করে বসে, দু’হাত আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে রেখে আসমানী নওয়ান এর দিকে চেয়ে বলে,
– মা তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলো। আমার কাজ আছে।
সকলের দৃষ্টি একবার আকাশের দিকে তো আরেকবার সৌম্য’র দিকে। এদের কাহিনী কেউ বুঝতে পারছে না। সন্ধ্যা অবাক হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশের কথা তার মাথার উপর দিয়ে গেল! আকাশের দৃষ্টি মেঝেতে। চোখেমুখে বিরক্তি।
আসমানী নওয়ান বলতে শুরু করেন,

– ঢাকার স্থানীয় আমরা। বাবা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।
চারভাইবোন ছিলাম। তিন বোন এক ভাই। বড় ভাই – ইশতিয়াক আহমেদ। এরপর আমি। আমার পর ছোট বোন তারা। তারার পর আমাদের সবার আদরের ছোট্ট বোন জ্যোৎস্না। আমি যখন কলেজে উঠি, তখন আমাদের মা মা’রা যায়। এরপর আমাদের তিন বোনকে বাবা আর বড় ভাই আগলে রাখে। একসময় আমার আর তারার বিয়ে হয়ে যায়। জ্যোৎস্না তখন-ও খুব বেশি বড় নয়। মাত্র এসএসসি দিয়েছে। কলেজে পা রাখার আগেই একজনের সাথে পালিয়ে যায়। ছেলেটি গ্রামের ছিল। তার কিচ্ছু ছিল না। আমরা চিনতাম-ও না সেই ছেলেকে। আমাদের ছোট্ট আদরের বোনটা আবেগে ভেসে আমাদের কারো কথা না ভেবে চলে গেল! ও জানতো, ওর সম্পর্ক আমার বাবা, ইশতিয়াক ভাইজান কেউ মানবে না। সেজন্যই পালিয়েছিল।

মা মা’রা যাওয়ার পর, বাবা একা হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমার আর তারার বিয়ের পর বাবা আরও একা হয়ে যায়। ভাইজান ব্যবসা সামলায়। ছোট বোন জ্যোৎস্না ছিল বাবার কথা বলার সঙ্গী। সবসময় সেই বাবার পাশে থাকতো! জ্যোৎস্নার এভাবে পালিয়ে যাওয়া বাবা মেনে নিতে পারেনি। সেদিন-ই বাবা হার্ট-অ্যাটার্ক করে। দু’দিনের মাথায় বাবা তার ছোট্ট মেয়ের শোকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
কথাগুলো বলে আসমানী নওয়ান থামলেন। গলা ভিজে এসেছে। পুরো কেবিন জুড়ে নিস্তব্ধতা। আসমানী নওয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার-ও বলতে শুরু করেন,

– বাবা মা’রা যাওয়ার পর ইশতিয়াক ভাইজান সবার সামনে বলে দিল, তার ছোট বোন জ্যোৎস্না আজ থেকে মৃ’ত! যদি কেউ কখনো তার সাথে যোগাযোগ করে বা সামান্য হেল্প করে, তবে ইশতিয়াক ভাইজানের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। অথচ ছোট বোন ভাইজানের ক’লি’জা ছিল। জ্যোৎস্না খুব মায়া করত। আমি, তারা, ভাইজান সবাই ফর্সা হলেও জ্যোৎস্না ছিল শ্যামলা। ভাইজান জ্যোৎস্নাকে মায়া বলে ডাকতো। আমি আর তারা জিজ্ঞেস করলে, ভাইজান বলেছিল,,

– তোরা জানিস না? শ্যামলা মেয়েদের মুখে খালি মায়া আর মায়া। আমার ছোট মায়ের মুখে-ও খালি মায়া দিয়ে ভরা। তাই আমি ওর নাম দিছি মায়া।
সেই ভাইজান জ্যোৎস্নাকে ভুলে গেল। ভাইজান বাবা মায়ের চেয়ে জ্যোৎস্নার জন্য বেশি কাঁদতো। আমরা বুঝতাম। কিন্তু সে উপর থেকে খুব কঠোর ছিল। ভাইজান ঠিকই বলতো, শ্যামলা মেয়েদের মুখে শুধু মায়া দিয়ে ভরা থাকে। আমাদের ছোট জ্যোৎস্না, ভাইজানের মায়া আমাদের সবাইকে খুব মায়া করতো।
এটুকু বলে আসমানী নওয়ান থামেন। তার পাশে বসা সন্ধ্যার দিকে তাকায়। এরপর তার সামনে বসা সৌম্য’র দিকে। এরা দু’জনেই তাদের ছোট্ট মায়ার প্রতিচ্ছবি! সৌম্য, সন্ধ্যার চোখের কোণে চিকচিক পানি আসমানী নওয়ান এর চোখ এড়ায় না। ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে আবার-ও বলতে শুরু করেন,

– বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইজানের কি হলো কে জানে! সে সব জমিজমা আমাদের তিনভাইবোনের মাঝে ভাগ করল। দলিল করে দিল একেবারে। আমি আর তারা অবাক হয়ে শুধু ভাইজানকে দেখছিলাম। যেই ভাইজানের একদিন যায়নি জ্যোৎস্নাকে ছাড়া। সেই মানুষটা তাকে জমির এক কানা কড়ি-ও দিল না। সব আমাদের তিনভাইবোনের মাঝে ভাগ করল। ভাইজানের মুখের উপর কথা বলিনি আমরা।
প্রায় ছয়মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন জ্যোৎস্না আমার নাম্বারে ফোন করে। আমি আর তারা কথা বলি ওর সাথে। জানাই বাবা মা’রা গেছে। জ্যোৎস্না বাবার জন্য খুব কাঁদলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কোথায় আছে। কিন্তু জ্যোৎস্না বলল না। বলল,

– ভাইজান ওর স্বামীকে মে’রে ফেলবে। ও ওর স্বামী ছাড়া বাঁচবে না।
এভাবেই বলল। আমি আর তারা যে জ্যোৎস্নার সাথে কথা বলছি, এইটা ভাইজান দেখে নিয়েছিল। কোনো কথা ছাড়া-ই সেদিন ভাইজান আমাকে আর তারাকে গরুর মতো পিটিয়েছিল। আকাশের আব্বা আর শিমুর আব্বার সাথে ভাইজানের হাতাহাতি-ও হয় সেদিন। ভাইজান আমাকে আর আকাশের আব্বাকে সাথে তারা আর ওর স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বলেছিল,

– আমার বাবার খু’নি জ্যোৎস্না। ওকে সামনে পেলে, ওকেসহ ওর স্বামীকে জ’বা’ই করব।
এরপর ভাইজানের আগের কথা অনুযায়ী, আমরা জ্যোৎস্নার সাথে যোগাযোগ করায় ভাইজান আমাদের থেকে-ও মুখ ফিরিয়ে নিল। বছরের পর বছর গেল। কিন্তু ভাইজান সেই কঠোর, কঠোর-ই থাকলো।
সময় চলে যায়। ভাইজান একেবারে অচেনা হয়ে গেল।
প্রায় ১২ বছর পর জ্যোৎস্না আমার সাথে আবার-ও যোগাযোগ করে। খুব কেঁদেছিল সেদিন। এতো করে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে। কিছুই বলল না। শুধু বলল,
– আপা আমারে কিছু জমি দিবা? ভাইজান তো আমার জন্য কিছু রাখেনি। আমার একটা ছোট্ট জান্নাত আছে। আর কারো না হোক, ওর জন্য হলেও একটু জমি দিবা তুমি আর তারা আপা?
আমি জিজ্ঞেস করলাম,

– তোর মেয়ে হইছে জ্যোৎস্না?
জ্যোৎস্না ছোট করে বলেছিল,
– হুম। ভাইজানের মায়ার মতো-ই হইছে। কিন্তু ভাইজান মনে হয়, আমার মাইয়াদের পাইলে-ও মে’রে ফেলবে, তাইনা আপা?
আমি কি বলব বুঝলাম না। জ্যোৎস্নার মাইয়াদের বলা শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– তোর দুইটা মেয়ে জ্যোৎস্না?

কিন্তু আর কোনো কথা ফেরত আসলো না। এরপর জ্যোৎস্নাকে আর পায়নি। আমি কল দিয়ে কখনো জ্যোৎস্নাকে পাইনি। কই থেকে কল করত কে জানে! শান্তি করে দু’টো কথা-ও বলতে পারিনি।
এরপর আমি আর তারা আমাদের জমি থেকে অর্ধেক অর্ধেক করে জ্যোৎস্নার নামে দলিল করে দিই। জ্যোৎস্না লুকিয়ে ঢাকায় এসেছিল। দলিল হয়ে গেলে দলিলগুলো নিয়ে সে চলে যায়। একটা কথা-ও শুনতে পারিনি। কই থাকে, তাও জানিনা। জ্যোৎস্না যেন কাউকে ভ’য় পাচ্ছিল। ওইটাই ছিল জ্যোৎস্নার সাথে শেষ দেখা। অনেক খুঁজছি ওরে। খোঁজ পাইনি। বছরের পর বছর চলে গেল। মাঝখানে তারার স্বামী মা’রা গেল।
আমার আকাশ হলো। ধীরে ধীরে বড় হলো৷ কয়েক বছর পর শুনলাম, ভাইজানের-ও একটা মেয়ে হয়েছে। নাম রাখছে ইরা। আমি ভাবির সাথে যোগাযোগ করে লুকিয়ে ইরাকে দেখতে গেছিলাম।

আকাশ বড় হয়ে গেল। পড়াশোনা করতে বিদেশ গেল। ফেরত এসে ব্যবসায় জয়েন করল। সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল। কিন্তু আমি আর তারা জ্যোৎস্নার খবর পাইলাম না। ভাইজান তো এই শহরে থেকে-ও অচেনা হয়ে গেল! উপর থেকে সব স্বাভাবিক চললেও আমাদের পরিবার টা ন’ষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
অনেক বছর পর শুনলাম আকাশের আব্বার সাথে ভাইজানের ব্যবসার সূত্রে একটা সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু সেটা পারিবারিকে যায়নি। ভাইজান যেমন ছিলেন, তেমন-ই কঠোর। একদিন আকাশের আব্বা এসে বলে,
– ভাইজান প্রস্তাব দিয়েছে, ইরার সাথে আকাশের বিয়ের।
কথাটা শুনে আমি কি যে খুশি হইছিলাম। বুঝলাম ভাইজান উপর থেকে কঠোর থাকলেও এতো বছর পরে-ও ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের একটুখানি আটকে থাকা সুতো টেনে ধরতে চেয়েছেন।
কিন্তু ভাবি আমাকে জানালো,

– ইরা আকাশকে বিয়ে করতে চায়না। ইরা অন্য এক ছেলেকে ভালোবাসে। কিন্তু ইরার বাবা রাজী নয়। সে আকাশের সাথেই বিয়ে দিবে।
কথাটা শুনে আমার মন খারাপ হয়েছিল। ভাইজানের সাথে সব ঠিক হতে গিয়েও হয়তো হলো না। কিন্তু মেয়েটার মনের উপর তো জোর চলে না! এর কয়েকদিন পর আমি একজনের সাথে এক গ্রামে ঘুরতে গিয়ে জ্যোৎস্নার স্বামীকে দেখি। এরপর আমি জোর করেই তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম এক শ্যামলা মেয়ে মাটির চুলায় রান্না বসিয়ে রান্না করছে। প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝলাম ওইটার আমাদের আদরের জ্যোৎস্নার জান্নাত। জ্যোৎস্নার স্বামীর কুকীর্তি শুনলাম। আমার বোনটারে রেখে বিয়ে করছে আরেকটা। বড়লোক ঘরের মেয়ে ছিল জ্যোৎস্না। সেইজন্যই বিয়ে করেছিল আমার বোনকে।

এরপর যখন দেখল, ভাইজান জমিজমা কিছুই দিল না! তখন থেকে আমার বোনটার উপর অ’ত্যা’চার শুরু করল। এইজন্যই জ্যোৎস্না আমাকে কল দিয়ে খালি কাঁদতো, কিন্তু কিছু বলতো না। শেষ পর্যন্ত মেয়ের জন্য জমি চাইলো। জ্যোৎস্না বুঝেছিলে, তার ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নাই। ভাইজান-ও ফিরে দেখবে না।
আমি জ্যোৎস্নার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, তার বোনের কয় মেয়ে। বলল, এক মেয়ে। গ্রামের অনেকে বলছিল, সন্ধ্যার না-কি এক ভাই আছে। আমি সন্ধ্যার বাবাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, সৌম্য সন্ধ্যার সৎ ভাই। আমিও মানলাম। কারণ জ্যোৎস্না ছেলের কথা বলেনি।
থামলেন আসমানী নওয়ান। অজস্র চোখের পানিতে বুক ভিজিয়ে ফেলেছেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে শক্ত গলায় বললেন,

– জ্যোৎস্নার স্বামী আমাকে সৌম্য’র আসল পরিচয় দিল না। ভেবেছে, জান্নাতের মতো কিনে হলেও যদি সৌম্যকে আমার কাছে নিয়ে আসি। ওমন লো’ভী, অ’মানুষদের যে টাকা ছাড়া চলে না।
একটু থেমে আবার-ও বলে,
– জান্নাতের সাথে আকাশের বিয়ে দিতাম না। জান্নাত তো আমার-ই মেয়ে। ওরে আমার বাড়ি রাখার জন্য আকাশের বউ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু মেয়েদের তো বাবার বাড়ি নিজের বাড়ি হয় না। একদিন না একদিন বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি চলে যেতে হয়। জান্নাতকে-ও যেতে হতো। ওদিকে ইরা আকাশকে বিয়ে করবে না। তাই আমি আকাশের সাথে জোর করেই জান্নাতের বিয়ে দিয়ে দিই। অন্তত জান্নাতরে নিজের কাছে সারাজীবন রাখতে পারবো এই আশায়।

এরপর জান্নাতের ভাইকে দেখে আমি শক খাইলাম। আকাশ জান্নাতরে মানছিলনা বলে জান্নাতরে আটকালাম না। ও ওর ভাইয়ের জন্য কাঁদছিল। ভাবছিলাম, ভাইয়ের কাছে যাক, পরে একদিন আমি জান্নাত আর ওর ভাইয়ের সাথে কথা বলবো। কিন্তু সেই যে হারালো, আর তো পাচ্ছিলাম না। এরপর জানলাম তারা বেঁচেই নাই। তাও আবার আমার-ই স্বামীর জন্য।
আকাশের আব্বা যে মানুষ ভালো নয়, এইটা আমরা কেউ না জানলেও জ্যোৎস্না হয়তো কিছু দেখছিল। বিয়ের আগে শুধু আমারে বলতো, আপা ওই লোক ভালো না, বিয়ে কর না।
জ্যোৎস্না ছোট মানুষ ছিল, তার কথা আমরা কেউ শুনিনি। অথচ আকাশের আব্বার শ’ত্রু হয়ে উঠেছিল আমার ওই ছোট্ট বোনটা। যার ধার তার ছেলেমেয়েদের উপর দিয়ে নিতে চেয়েছিল। মানুষ খু’ন করার ধাঁত আগে থেকেই ছিল আকাশের আব্বার। সেরকম কিছুই হয়তো জ্যোৎস্না দেখেছিল।
আসমানী নওয়ান দু’হাতে মুখ মুছে নেন। এরপর ভাঙা গলায় বলেন,

– শ’ত্রু রা তো তখন-ই সুযোগ পায়, যখন কোনো সম্পর্কে ফা’ট’ল ধরে। আমাদের ভাইবোনের সম্পর্কে ফা’ট’ল ধরেছিল। ভাইজান আমাদের পর করে দিল। আমাদের ছোট্ট আদরের বোন কত ক’ষ্ট করে গেল ভাইজানের রা’গ, জেদ এর কারণে। বোনটা মা’রা গেল, সে খবর পর্যন্ত পেলাম না।
পাশ থেকে শিমুর মা তারা চোখ মুছে বলে,
– আর তোমার জেদ এর কারণে আমরা ভাইজানের মা’রা যাওয়ার খবর টুকু-ও পাইলাম না আপা। তুমি একবার, আগে গিয়ে কথা বললেই ভাইজান সব ভুলে আমাদের কাছে টানতো। তুমি-ও তোমার জেদ দেখাইলা। ভাইজান-ও তার জেদ দেখাইলো। মাঝখান থেকে আমি আর জ্যোৎস্না শুধু তোমার আর ভাইজানের রা’গ আর জেদ এর স্বীকার হয়ে গেলাম।

আসমানী নওয়ান কিছু বললেন না। যে ভাই জীবনে তাদের কোনো বোনের গায়ে ফুলের টোকা দেয়নি। সেই ভাই বিয়ের পর এতো মা’র মে’রে’ছিল যে, তাদের দু’বোনের ব্য’থার ওষুধ খেতে হয়েছে। এখানেও থামলো না। ভাইজান তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল! আসমানী নওয়ান-ও আর ফিরে তাকায়নি। সে ভাবতো, ভাইজান এতো মা’র’লো। তাহলে ভাইজান-ই আগে তাদের কাছে আসবে। ওদিকে হয়তো ইশতিয়াক আহমেদ অপেক্ষায় ছিল, তার বোনেরা কখন ভাইজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! অপেক্ষার অবসান না হলেও, মানুষটার নিঃশ্বাসের অবসান হলো৷
সন্ধ্যা দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। চোখের পানিতে যা তা অবস্থা। সকলের চোখে পানি। সৌম্য’র চোখ দু’টো লাল। মাথা নিচু তার।

আকাশের দৃষ্টি মেঝেতে। তার চোখ দু’টোর অবস্থা-ও সৌম্য’র মতো লাল। দু’হাতের কনুই দু’পায়ের উরুর উপর রেখে খানিকটা ঝুঁকে আছে। কাহিনীটা যেমন ক’ষ্ট দিয়েছে, তেমনি এখানে বসা সবার মধ্যে আকাশ সবচেয়ে বেশি শক পেয়েছে, সৌম্য আর সন্ধ্যা তার খালাতো বোন জানতে পেরে।
কিছু সময় পেরিয়ে গেলে ইরার মা বলে,
– আসমানী তুমি আকাশকে জানাওনি কেন যে, সন্ধ্যা আকাশের খালাতো বোন? তাহলে আকাশ শুরু থেকেই সন্ধ্যাকে মেনে নিত।
আসমানী নওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সিরিয়াস সময়ে তার মুখ থেকে শুদ্ধ ভা’ষা বেরিয়ে আসে। সে নিজেও বোঝে না। এবার তার স্বভাবসুলভ উত্তর করলেন,

– তুমি আকাশকে চিনো না ভাবি, তাই এই কথা কইতাছ। আকাশ যদি জানতো, জান্নাত ওর খালাতো বোন। তাহলে আমি ম’রে গেলে-ও আকাশ জান্নাতরে বিয়া করত না। দেখ না, শিমুকে কেমন নিজের বোনের মত দেখে! জান্নাতরে-ও ওমন নিজের বোন করে কাছে রেখে দিত!
অতিরিক্ত হাইপারে আকাশ পাশে একটি টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল নিয়ে, পানি খাচ্ছিল। মায়ের কথা কানে আসতেই কেশে ওঠে। পানি খেতে গিয়ে হয়তো বুকে বেঁধেছে। হাতের বোতল টেবিলের উপর রেখে আকাশ সমানে কাশে।
সকলে অবাক হয়। সন্ধ্যা ভীত চোখে তাকায় আকাশের দিকে।
পাশে বসা সৌম্য বিচলিত হয়ে পানির বোতলটি আবার-ও আকাশের এগিয়ে দিয়ে বলে,

– পানি খেয়ে দেখুন, ঠিক হয়ে যাবে।
আকাশ নিজেকে সামলাতে চাইলো। সৌম্য’র থেকে বোতলটি নিয়ে দুই ঢোক পানি খেয়ে নিজেকে একটুখানি স্বাভাবিক করে। আসমানী নওয়ান আকাশের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আকাশের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
– ঠিক আছো আব্বা?
সন্ধ্যা আকাশের অবস্থা দেখে তার জায়গায় দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে আসতে চাইছিল, আকাশকে স্বাভাবিক হতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আকাশ তার মাকে ছোট করে উত্তর করে,
– ঠিক আছি।

অন্তঃদহন পর্ব ২৫

এরপর তার সোজা দাঁড়ানো সন্ধ্যার দিকে তাকায়। ইরার রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে ভেবে আসলো, খালাতো বোন হোক, আর মামতো বোন হোক, এরা সবাই তো বোন। এদের বিয়ে করা যায় না! আর এখন তার সন্ধ্যামালতী না-কি তার খালাতো বোন! আবার তার মা বলছে, সে তার সন্ধ্যামালতীকে বোন ভেবে রেখে দিত! কথাটা ভাবতেই আকাশের ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠলো। লালিত চোখজোড়া সন্ধ্যার ফোলা ফোলা মুখের দিকে নিবদ্ধ রেখে বিড়বিড় করে,
– জ’ঘ’ণ্য ফিলিংস্!

অন্তঃদহন পর্ব ২৭