অন্তঃদহন পর্ব ৩
DRM Shohag
আকাশের কথা শুনে সন্ধ্যা আবারও মাথা উঁচু করে তাকায়। আকাশের মুখাবয়ব এর পরিবর্তন নেই। সন্ধ্যা দু’হাতে পান্তার প্লেট ধরে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মাথায় থাকা শাড়ির আঁচল ডান হাতে একটু টেনে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। আকাশ কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করে,
– তুমি শুনতে পাও?
সন্ধ্যা বোকাচোখে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ ভ্রু কোঁচকায়। আবারও জিজ্ঞেস করে,
– ক্লিয়ার শুনতে পাও?
সন্ধ্যা কিছুটা মাথা নিচু করে নেয়। এরপর মাথা উপর-নীচ করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানায়। আকাশ কেমন অদ্ভুদভাবে তাকায়। এটা কীভাবে সম্ভব হয়? কথা বলতে পারে না অথচ স্পষ্ট শুনতে পায়? আপনা-আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
– ইন্টারেস্টিং তো!
সন্ধ্যার কানে কথাটা যায়। মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আনিকা আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– কি ইন্টারেস্টিং রে!
আকাশ থতমত খেয়ে তাকায় আনিকার দিকে। আনিকা সন্ধ্যাকে পান্তার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
– পান্তা খাও না-কি তুমি? আমার-ও বেশ লাগে খেতে।
সন্ধ্যা চুপচাপ আনিকার দিকে চেয়ে রইল। আনিকা বুঝতে পারছে না সন্ধ্যা আসলে কে। সন্ধ্যার মেঝেতে বসে খাওয়ার ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল। সে ভেবেছে সন্ধ্যা আকাশদের বাড়ির কাজের লোক। ভাবনা অনুযায়ী আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
– নতুন কাজের লোক আনাইছিস না-কি?
কথাটা আকাশ সহ তার মা আসমানী নওয়ান-ও শুনতে পায়। রান্নাঘর থেকে আনা হাতের পায়েসের বাটি টেবিলের উপর রেখে এসে সন্ধ্যার হাত ধরে শক্ত গলায় বলে,
– ওয় আমার মেয়ে।
আনিকা অবাক হয়। আকাশের বোন কবে জন্মালো? তাও আবার এতো বড়?
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে টেনে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। এরপর হাতের প্লেট টেবিলের উপর রেখে বলে,
– চেয়ার টেবিল রাইখা মাটিতে বইসা খাস ক্যান? আর একদিন দেখলে মা’র খাবি আমার হাতে।
সন্ধ্যা মন খারাপ করে বোঝায়, আর মাটিতে বসে খাবে না। আসমানী নওয়ান আনিকার উদ্দেশ্যে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তুমিও আসো মা। বইসা খাও।
আনিকা সন্ধ্যার দিকে চেয়ে ছিল। আসমানী নওয়ান এর কথায় এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার পাশে বসল। মেয়েটি কে, এটা নিয়ে তার মনে বেশ কৌতূহল জাগছে। আসমানী নওয়ান রান্নাঘরের দিকে গেলে আনিকা সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– তোমার নাম কি?
সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে নিরবে চেয়ে আছে আনিকার দিকে। আনিকা সন্ধ্যার থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে আরও বেশ কয়েকবার নাম জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সন্ধ্যার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বেচারি হতাশ হয়। এর মধ্যে আসমানী নওয়ান রান্নাঘর থেকে এসে আনিকাকে সন্ধ্যার নাম জিজ্ঞেস করছে শুনতে পেয়ে বলে ওঠে,
– ওর নাম সন্ধ্যা। ওয় কথা কইতে পারে না।
কথাটা শুনে আনিকা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা আনিকার দিকেই চেয়ে ছিল। আনিকা মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি! আমি আসলে বুঝতে পারিনি।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে মৃদু হাসলো। সামনে তাকালে দেখল আকাশ তার দিকেই চেয়ে আছে। সন্ধ্যার বিব্রত লাগে। মাথা নিচু করে বাকি খাবারটুকু খাওয়ায় ব্যস্ত হয়।
আসমানী নওয়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আকাশ একবার আমার ঘরে আইসো তো!
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– আচ্ছা।
আকাশ মূলত সন্ধ্যাকে সেদিনের মা’রা থা’প্প’ড় এর জন্য ভীষণ অনুতপ্ত বলা যায়। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন বিরক্ত হয় নিজের উপর। মেয়েটি কথা বলতে পারেনা, তার উপর সে মে’রে’ছে এই ব্যাপারটা সে নিজেই মানতে পারে না। প্রয়োজন পড়লে সে বেহিসাব থা’প্প’ড় সহ আরও বহু শাস্তি দিতে জানে। যেমনটা আজ রেস্টুরেন্টর মেয়েটিকে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে। তবে সে এর জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়। কিন্তু সন্ধ্যার ব্যাপারটায় তার ভীষণ গিল্টিফিল হচ্ছে। এখন উপায় কি? স্যরি বলে দেয়া? কথাটা ভাবতেই কেমন একটা তিতকুটে অনুভূতি হলো। আপনাআপনি ভেতর থেকে চলে এলো, – অসম্ভব।
এসব শব্দ সে উচ্চারণ করবে? একদম-ই সম্ভব না।
সন্ধ্যা তার খাওয়া শেষে হাতের প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। আনিকা সন্ধ্যাকে দেখছে আর একটু একটু করে পায়েস খাচ্ছে। পায়েস তার বেশ পছন্দের। কিন্তু সে মনোযোগ দিয়ে খেতে পারছে না। আকাশের মা নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিলেও – মেয়েটি কে? বেচারি এই ভাবনায় ব্যস্ত।
আনিকা চেয়ার থেকে উঠে আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
– ওই মেয়েটা তোদের কে হয়?
আকাশ বিরক্তি চোখে তাকায়। আনিকাকে পাশ কাটিয়ে তার মায়ের ঘরের দিকে যেতে নিলে আনিকা আকাশের হাত টেনে ধরে বলে,
– আরে বলে যা। এতো কৌতূহল নিয়ে থাকতে পারি না!
আকাশ রে’গে তাকায় আনিকার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– থা’প্প’ড় খাবি। হাত ছাড়।
আনিকা কিছু বলতে গিয়েও দেখল তার সামনে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে। তাদের দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালে দেখল সন্ধ্যা তার হাতে আকাশের ধরা হাতের দিকে চেয়ে আছে। আনিকা ভ্রু কোঁচকায়। আকাশ ঝাড়া মে’রে তার হাত ছাড়িয়ে নেয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– মুড ভালো আছে। তাই বেঁচে গেলি।
কথাটা বলে উল্টো ঘুরলে সন্ধ্যাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কিছু বলল না। বড় বড় পা ফেলে সন্ধ্যাকে পাশ কাটিয়ে তার মায়ের ঘরের দিকে যায়। আনিকা পিছন থেকে বলে,
– আরে ভাই, আমার বহুত সুন্দর এক জামাই আছে। ওকে রেখে তোকে নিয়ে ভাবার টাইম নাই আমার। এ্যাহ! স্বর্ণকার দের সোনা চুরি করলে-ও এমন ছ্যাঁত করে ওঠে না, আর একে টাচ করলে-ই যেন চামড়া ঝলসে যায়!
কথাগুলো বলে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা কেমন অদ্ভুদভাবে চেয়ে আছে তার দিকে। আনিকা মেকি হেসে বলে,
– তুমি আন্টির মেয়ে হলে হিসেব মতে তুমি আকাশের বোন। পেট থেকে বের না হয়েও মেয়ে হওয়া যায়, এটা কোনো ফ্যাক্ট না। কিন্তু তোমার ভাই-টা একদম সুবিধার না বুঝলে? শুধু অসুবিধা দিয়ে ভরা।
কথাগুলো বলে থামে আনিকা। ভাবলো, মেয়েটি হয়তো তার কথা শুনতে পায়নি। এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে বাকি পায়েসটুকু খাওয়ায় মনোযোগী হয়।
আসমানী নওয়ান তার আলমারি থেকে বেশ কয়েকটি কাগজ বের করে আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– এইগুলা তোমার কাছে রাহো।
আকাশ হাতের কাগজ গুলোর দিকে চেয়ে অবাক হলো। বেশ কয়েকটি মোটা অঙ্কের চেক। তার মধ্যে একটি পুরো ১৫ লাখ টাকার চেক থেকে টাকা উঠানো হয়েছে। আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও তিনি বেশ শিক্ষিত। ভদ্রমহিলার অনার্স কমপ্লিট। এরপর আর পড়েননি তিনি। আকাশ অবাক হয়ে বলে,
– এতো টাকা উঠিয়ে কি করেছ মা?
আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– আমার দরকার আছিল।
আকাশের রা’গ হয়। মানে তার মা এসব কি শুরু করেছে? একটার পর একটা কাজ করছে। কোনোটা উল্টা তো কোনোটা সোজা। সোজা কাজ-ই বা বুঝবে কি করে? এতো টাকা কি করেছে তার মা? রে’গে বলে,
– তুমি এতো টাকা কবে তুলেছ? আর করেছ টাই বা কি?
আসমানী নওয়ান রে’গে বলে,
– সেই কৈফিয়ত আমি তোমারে দিমু না।
আকাশ চোখ বুজে শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নিজেকে দমিয়ে তার মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত চাইছি না মা। কোনো কাজ করার আগে আমাকে এটলিস্ট জানানো উচিৎ। এইটুকু অধিকার তো আমার আছে।
আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– আমার ইচ্ছা করে নাই।
আকাশ হাতে থাকা কাগজগুলো হাতের মুঠোয় দলা পাকালো। এতো রা’গ লাগছে তার! রেগেমেগে দলা পাকানো চেক গুলো ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলে,
– আমার-ও ইচ্ছে করছে না, এসব ফা’ল’তু কাগজ আমার কাছে রাখতে।
কথাটা বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আসমানী নওয়ান এর খারাপ লাগলো। আবার নিজের দিকটা-ও ভাবলো। আসলেই আকাশকে বলা উচিৎ ছিল তার। তার ভুলের জন্য-ই আকাশ টা কেমন হুটহাট উদ্ভট আচরণ করছে।
আসমানী নওয়ান এর রুমের পাশের রুম সন্ধ্যার। সে তার রুমে যাওয়ার সময় আকাশের মুখে টাকার কথাগুলো শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সে আসলে বুঝলো না, এসবের কারণ। তবে সন্ধ্যার অবাক লাগে, এই ভদ্রমহিলা অনেক ভালো। অন্তত তার সাথে তো অনেক ভালো ব্যবহার করে। তার সৎ মা এমন ভালো মানুষের হাতে তাকে তুলে দিল কেন? সে তো পারলে সন্ধ্যাকে জা’হা’ন্না’মে পাঠাতে চায়। আর তার বাবা? তার মা মা’রা যাওয়ার সাথে সাথে তার বাবা হারিয়ে গেছে। সে শুধু সকাল আর সায়ন এর বাবা হয়ে গিয়েছে। তার আর সৌম্য ভাইয়াকে ভুলে গিয়েছে। মা মা’রা গেলে বাবারা বুঝি এভাবেই স্বার্থপর হয়ে যায়। কথাগুলো ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখজোড়া ভরে উঠলো মেয়েটির!
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ-ই জোরেসোরে এক ধাক্কা খেয়ে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যায়।
আকাশ তার মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে কোনোদিকে তাকয়নি, হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ-ই সন্ধ্যার সাথে ধাক্কা খায়। সন্ধ্যা তো উল্টে পড়েছেই, আকাশ নিজে-ও তাল সামলাতে না পেরে সন্ধ্যার উপর-ই ঠাস করে পড়ে যায়।
সন্ধ্যা, আকাশ দু’জনেই হতভম্ব হয়ে যায়। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কারোর ধারণায় ছিল না। আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকালে সন্ধ্যার ভেজা চোখজোড়া তার দৃষ্টিতে পড়ে। সন্ধ্যা কথা বলতে পারে না, ঢোক গিলে দু’হাত আকাশের বুকে রেখে আকাশকে ঠেললে আকাশ অদ্ভুদভাবে তাকায় সন্ধ্যার দু’হাতে দিকে। সে এখনো সন্ধ্যার উপর বুঝতে পেরে বিড়বিড় করে,
– শিট!
এরপর ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায় সন্ধ্যার উপর থেকে। সন্ধ্যা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে-ও মেঝে থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। কোমরে বেশ ব্য’থা পেয়েছে৷ তবে সেসব পাত্তা দিল না। বরং তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়ায়।
এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে একপ্রকার দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে দেখল সন্ধ্যার প্রস্থান।
পাশ থেকে আনিকা ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
– আন্টি বলল, সন্ধ্যার তার মেয়ে। হিসেব মতে, সন্ধ্যা তোর বোন। কিন্তু বোনের সাথে এমন রোমান্টিক মোমেন্ট ক্রিয়েট হয়ে যাচ্ছে কেন বুঝলাম না!
আকাশ ধমকে বলে,
– তখনকার থা’প্প’ড় এখন খেতে না চাইলে মুখ বন্ধ রাখ।
ঘরের ভেতর থেকে আসমানী নওয়ান বেরিয়ে এসে বলে,
– এইহানে কি পড়ার শব্দ হইলো?
আকাশ কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে তার ঘরের দিকে। আনিকা মৃদু হেসে বলে,
– আকাশ পড়ে গিয়েছিল আন্টি। তোমার ছেলের শরীরে মনে হয় পুষ্টির অভাব পড়েছে, একটু বেশি বেশি খাওয়াই-ও তো।
আসমানী নওয়ান হাসলো। তিনি ভাবলেন আনিকা মজা করছে। আনিকার বাবা আর আকাশের বাবা বিজনেস পার্টনার। তবে আকাশ আর আনিকার বন্ধুত্ব তাদের বাবার জন্য নয়, বরং কলেজ লাইফ থেকে আকাশ, আনিকা সহ তাদের আরও দু’জনের একটি ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল। তখন থেকেই সবাই বেশ ভালো ফ্রেন্ড। বাকি দু’জনের খোঁজ পাওয়া যায়না। আনিকার-ই আকাশের বাড়িতে একটু-আধটু যাওয়া আসা হয়।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে। প্রকৃতিতে হালকা দিনের আলো এখন-ও বিদ্যমান। ইরা কার্জন হলের সামনের মাঠে বসে আছে, দু’হাঁটু জমা করে তার উপর চিবুক ঠেকিয়ে মলিন মুখে চেয়ে আছে। তার কিচ্ছু ভালো লাগে না। সকালের পর পর সৌম্য চলে গেলে ইরা-ও বাড়ি চলে গিয়েছিল৷ কিন্তু ওই আলিশান বাড়িতে ইরার মন টিকে না। তাই বিকেলে আবারও এই ফাঁকা জায়গাটায় এসে বসেছে। সৌম্য’র নাম্বারে কল করেছিল, সে কল রিসিভ করেনি। ইরা জানে সৌম্য ইচ্ছে করেই তার কল রিসিভ করে না। সৌম্য তাকে ইচ্ছে করে কতশত অবহেলা করে, সেসবের হিসেব কষে শেষ করা যাবে না। ইরার খুব মন কাঁদে। ভাবনায় কথাগুলো আসতে-ই ইরার চোখের কোণে পানির কণা জমে।
– ইরা?
হঠাৎ-ই পিছন থেকে সৌম্য’র শক্ত কণ্ঠে ইরা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সৌম্য দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– এখন-ও এইখানে বসে আছিস কেন? থা’প্প’ড় খাবি?
ইরা পিছু ফিরে সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– তুই যা। আমার ভালো লাগছে না। এখানে কিছুক্ষণ থাকি।
সৌম্য আশেপাশে তাকায়। এসব জায়গা মেয়েদের জন্য সেভ? এ এসব জানেনা? রে’গে বলে,
– এক্ষুনি বাড়ি যাবি তুই। এসব জায়গা সেভ নয়, জানিস না?
ইরা গাট্টি মে’রে বসে থেকে বলে,
– আমার জন্য কেন ভাবিস তুই?
সৌম্য’র বিরক্ত লাগে। রে’গে বলে,
– ইরা এমনিতেই আমার মন মে’জা’জ কোনোটাই ভালো নেই। ওঠ এখান থেকে।
ইরা মাঠ থেকে উঠে সৌম্য’র সামনে দাঁড়ায়। অনুরোধের সুরে বলে,
– তোর কি হয়েছে আমাকে বলছিস না কেন সৌম্য? তোর প্রবলেম সলভ্ করতে আমি হেল্প করতে পারিনা?
সৌম্য কিছু না বলে তার ডান হাতে ইরার বা হাতের কব্জি ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ইরা অবাক হলো। সৌম্য’র পিছু পিছু যায় আর তার ধরে রাখা সৌম্য’র হাতের দিকে চেয়ে থাকে। মুখে একটুখানি হাসি ফুটল,, তবে তা মিলিয়েও গেল। সে জানে সৌম্য একদিন তার থেকে হারিয়ে যাবে! ও সবসময় তার থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
সৌম্য কিছুটা হেঁটে গিয়ে একটি রিক্সা দাঁড় করায়। ইরাদের বাসা চাংখারপুল পর্যন্ত ভাড়া মিটিয়ে ইরার উদ্দেশ্যে ছোট করে বলে,
– রিক্সায় ওঠ।
ইরা কথা বাড়ালো না। চুপচাপ রিক্সায় উঠে বসল। সৌম্য গম্ভীর গলায় বলে,
– চেপে বোস।
ইরা অবাক হয়ে তাকায়। সৌম্য তার সাথে যাবে? যখন তারা শুধু বন্ধু ছিল, তখন কত একসাথে বসেছে। কিন্তু হঠাৎ-ই কেন যেন তাদের মধ্যে একটা প্রাচীর তৈরী হয়ে গিয়েছে। সৌম্য-ও তাকে এভোয়েড করতে শুরু করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডানদিকে একটু চেপে বসলে সৌম্য রিক্সায় উঠে বসে। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– মামা চলো।
ভদ্রলোক রিক্সা চালানো শুরু করে। ইরা দু’হাত জমা করে রাখে। রিক্সার ঝাঁকুনিতে সৌম্য’র হাতের সাথে ইরার হাতে ধাক্কা লাগে। সৌম্য খুব স্বাভাবিকভাবে বসে আছে, দৃষ্টি সামনে রাস্তার পানে। আবার একটু পর পর ফোনে কিছু করছে। ইরা মাঝে মাঝে আড়চোখে সৌম্য’র দিকে তাকায়। শ্যামবর্ণের ছেলে সৌম্য। ইরার চোখে সৌম্যকেই ধরে, হাজারো ফর্সা ছেলেদের ভীরে বারবার ইরার চোখ আটকে যায় শ্যামবর্ণের সৌম্যতে।
সৌম্য’র চোখ দু’টো বেশ সুন্দর। চোখে লাগে ভীষণ। প্রথম যেদিন সৌম্য তাদের বাড়িতে গিয়েছিল, সেদিন তার মা সৌম্যকে দেখে মন্তব্য করেছিল, ‘ছেলেটির চোখদু’টো মনে হয় আর্ট করা।’
ইরা ভীষণ হেসেছিল সেদিন তার মায়ের কথায়। সৌম্য বিব্রতবোধ করেছিল। ইরা কত মজা করেছিল সৌম্য’র সাথে। সৌম্য রে’গে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারছিল না। সেসব দিনগুলো কেমন যেন হারিয়ে গেল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি। সৌম্য ঘেমে গিয়েছে বুঝতে পেরে ইরা সৌম্য’র দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিলে সৌম্য তার ফোনে দৃষ্টি রেখেই বলে,
– লাগবে না।
ইরার মলিন মুখখানি আরও মলিন হয়। মন খারাপ করে বলে,
– তুই আমার কল রিসিভ করিস না কেন সৌম্য?
সৌম্য’র কাটকাট জবাব,
– ভালো লাগে না তাই।
ইরার চোখ দু’টো ভরে ওঠে। মেয়েটির বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে ইচ্ছে করল। মাথা নিচু করে নিল। হাজার চেষ্টা করেও নোনা পানি আটকাতে পারলো না। টুপ করে হাতের উপর দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। আরেকবার আড়চোখে সৌম্য’র দিকে তাকালে দেখল সৌম্য ফোনে ব্যস্ত। ইরা মাথা নিচু করে আড়ালে তার ভেজা চোখজোড়া মুছে নেয়। বেশ কিছুক্ষণের মাঝে রিক্সাওয়ালা ইরার বাসার সামনে রিক্সা দাঁড় করালে ইরা চুপচাপ রিক্সা থেকে নেমে যায়। সৌম্য’কে বাসায় আসতে বলতে চেয়েও বললো না। আসবে না তো! উল্টে এমন কিছু বলবে, যা তাকে শুধু ক’ষ্ট-ই দিবে। সৌম্য ইরার দিকে চেয়ে বলে,
– ভেতরে যা।
ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরে এগিয়ে যায়। সৌম্য তাকিয়ে রইল ইরার দিকে।
ইরার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। চোখে লাগে খুব। দীর্ঘ কপাল, গোলগাল মুখ। হাইট ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। চোখে পড়ার মতো সুন্দর ইরা। বাবার টাকার অভাব নেই। এক বাবার এক মেয়ে। অথচ এই মেয়ে সব পিছে ফেলে সৌম্য’র পিছে পড়ে থাকে।
কি আছে সৌম্য’র? কিচ্ছু নেই তার। যা আছে সব তো দুঃখ!
সৌম্য কথাগুলো ভেবে চাপা শ্বাস ফেলে। ইরাকে যতক্ষণ দেখা গেল, দেখল। একবারের জন্য-ও চোখ এদিক-ওদিক নেয়নি। ইরা মেইন গেইটের ভেতর পা রেখে সৌম্য’র দিকে তাকালে সৌম্য সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।
সৌম্যকে ফোনে ব্যস্ত দেখে ইরার চোখজোড়া আরেকবার ঝাপসা হয়। নিজেকে সামলে দরজা আটকে ভেতরে চলে গেলে সৌম্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ইরাদের বন্ধ দরজার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে,
– তোর সুখ প্রাপ্য ইরা, কিন্তু আমার খাতায় সুখের পরিমাণ যে শূণ্য!
সৌম্য রিক্সা থেকে নামতে গেলে ফোনে কারো কল আসলে পরিচিত কারো কল দেখে রিক্সা থেকে নামলো না। কল রিসিভ করে সালাম দেয়। ওপাশ থেকে কিছু বলল বোধয়। সৌম্য আর রিক্সা থেকে নামলো না। ফোন পকেটে রেখে রিক্সা ঘুরিয়ে নাজিরা বাজারের দিকে যেতে বলে রিক্সাওয়ালাকে।
রাত প্রায় ৮:৩০।
আকাশ নাজিরা বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে। কারো জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পর পর হাতঘড়িতে সময় দেখতে আবার ফোনে কিছু করছে।
সৌম্য আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে সালাম দেয়। আকাশ ডান হাত বাড়িয়ে সৌম্য’র সাথে হাত মেলায়, সাথে সালাম এর উত্তর নেয়। সৌম্য’কে বসতে বললে সৌম্য আকাশের সামনের চেয়ারে বসে। একে-অপরকে জিজ্ঞেস করে কেমন আছে।
এরপর আকাশ হালকা কিছু অর্ডার করে, সাথে দু’কাপ কফি অর্ডার করে দেয়। এরপর সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– শিমুকে পড়াতে আসছো না কেন?
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– ভাইয়া আমার কিছু প্রবলেম এর কারণে যেতে পারছি না। দু’একদিনের মাঝেই যাবো।
আকাশ ছোট করে বলে,
– ওহ ওকে।
এরপর পকেট থেকে একটি খাম বের করে সৌম্য’র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– এটা রাখো। আমি নেক্সট এক সপ্তাহ থাকবো না। এজন্যই মূলত তোমাকে ডেকেছি।
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।
আকাশের দেয়া প্যাকেট টি তার পাশে রাখলো সৌম্য।
আকাশের খালাতো বোন শিমুকে প্রায়ভেট পড়ায় সৌম্য। আকাশের খালু বেঁচে না থাকায় আকাশ তার খালাদের মোটামুটি সব দেখাশুনা করে। সৌম্যকে টিচার হিসেবে সে-ই ঠিক করে দিয়েছিল। শিমু ক্লাস টেন-এ পড়ে।
আকাশ সৌম্যের খোঁজ পেয়েছিল তার ভার্সিটিতে অনেক পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে। আকাশ ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিল, সেই হিসেবে সৌম্য’দের বড় ভাই। আকাশকে মাস্টার্সের এক বছর ভার্সিটিতে পেয়েছিল সৌম্যদের ব্যাচ। এরপর আকাশ বিদেশ চলে যায়।
আকাশ সৌম্যকে যে টিউশন ফি দিল, এটা মূলত শিমুকে পড়ানোর ফিস। আজ মাসের তিন তারিখ। সৌম্য গত একবছর থেকে শিমুকে পড়ায়, সে একমাত্র শিমুর ফিস প্রতিমাসের ১ম তারিখে পায়, যেটা তাকে আকাশ দিয়ে থাকে। এইবার সৌম্য না যাওয়ায় আকাশ নিজেই ডেকে তাকে ফিস দিয়ে দিল। কত টিউশনের টাকা তো ১০ তারিখ পেরিয়ে যায়, আবার ১৫ তারিখ-ও পেরিয়ে যায়।
আকাশ কফির কাপে চুমুক দিয়ে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– কি অবস্থা? পড়াশোনা কেমন চলছে?
সৌম্য ভদ্রতাসূচক মাথা নেড়ে বলে,
– জ্বি ভাইয়া, ভালো।
আকাশ অর্ধেক কফিটুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফোন পকেটে রেখে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– তোমার বেশি প্রবলেম হলে কয়েকদিন গ্যাপ দিতে পারো। প্রবলেম নেই।
সৌম্য দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি ভাইয়া।
এরপর আকাশের দিকে হাত বাড়ালে আকাশ পুনরায় হাত মেলায় সৌম্যের সাথে। দু’জন একসাথে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সৌম্য পেমেন্ট করতে গেলে আকাশ সৌম্য’কে ধমকে সরিয়ে দেয়। এরপর সে বিল মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে,,
– শিমু ফাঁকি দিলে আমাকে ইনফর্ম করবে অবশ্যই।
সৌম্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, সাথে একটু হাসে। শিমু মেয়েটি বেশ চঞ্চল, আর একটু-আধটু ফাঁকিবাজ। যখন মেয়েটির মা তার সাথে পারেনা, তখন আকাশকে বাড়িতে ডাকলে শিমু তার কাছে সুড়সুড় করে পড়তে বসে। বেশ ভ’য় পায় আকাশকে।
ভার্সিটিতে আকাশের জুনিয়ররা-ও আকাশকে বেশ ভ’য় পেত! তাদের মধ্যে সৌম্যদের ব্যাচ-ও ছিল। অবশ্য ভ’য় পাওয়ার-ই কথা। কোথাও কোনো ঝামেলা হলে সেখানে আকাশ হকিস্টিক নিয়ে হাজির হয়ে যেত। যে আসলে দোষী, কোনো কথা ছাড়া-ই তাদের এলোপাথাড়ি পেটাতো। সৌম্য পার্সোনালি আকাশকে পছন্দ করত না আকাশ ভার্সিটি থাকাকালীন।
তবে সৌম্য লাস্ট একবছর আকাশের বোনকে পড়াতে এসে বুঝেছে আকাশ ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ। খুবই বিবেকবান, সাথে মনমানসিকতা-ও বেশ ভালো।
সৌম্য রাস্তার ধার দিয়ে একা একা হাঁটছে। দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা। টাকা পেয়ে তার মেয়েদের মতো কান্না পাচ্ছে।
শিমুকে পড়িয়ে সৌম্য পুরো ১২ হাজার টাকা পায়। এই টাকা থেকে সে সবার আগে সন্ধ্যার জন্য কিছু টাকা সরিয়ে রাখে। কিন্তু তার সেই বোনটা যে আজ কোথায়, সেটাই জানতে পারলো না! ও ভালো আছে তো? সে কী খুঁজে পাবে না তার বোনটাকে?
সন্ধ্যা কি আর তার দিকে মায়া ভরা চোখে তাকাবে না? সে এই শহরেই তার বোনকে রাখবে, তার কাছে রাখবে। তার বোনের স্বামী কে? কোনো মানুষ রূপি অ’মানুষ নয়তো? তার বোনকে সেখানেও কি অ’ত্যা’চার করা হয়? সৌম্য’র নিজেকে দুর্বল লাগে। রাস্তার পাশে বসে পড়ে।
চোখের পর্দায় শেষবারের মায়ের অসহায় চাহনী ভেসে উঠল,, যে চাহনীতে হয়তো ছিল, সন্ধ্যাকে দেখে রাখার আকুতি!
ভেসে উঠল সন্ধ্যার মায়া ভরা মুখ, প্রতিবার শহরে ফেরার সময় সন্ধ্যা তার দিকে ভেজা চোখে চেয়ে থাকতো,, যে দৃষ্টিতে মিশে থাকতো, তার ভাই কেন ওই নরক থেকে তাকে বের করে আনে না?
এরপর ইরার টলমলে চোখজোড়া ভেসে ওঠে। যে চোখজোড়ায় কতশত অভিমান, অভিযোগ সৌম্যকে ঘিরে। কিন্তু সৌম্য’র সেসব দেখার সাহস হয় না। তার জীবনটা অ’ভি’শ’প্তে’র মতো! সবাই হারিয়ে যায় তার থেকে। আর যে পাশে থাকতে আসে, সৌম্য তো তার নখের যোগ্য-ও নয়। মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়, দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে।
ঘড়ির কাটা জানান দেয় রাত ১০:৩০।
সন্ধ্যা তার ঘরের বেলকনির এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা মলিন। ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। তার ভাই এরকম তারিখে গ্রামে যায়। সে গ্রামে ক’ষ্ট করে থাকলেও মাসে কয়েকবার করে তার সৌম্য ভাইয়াকে দেখতে পেত। কত শান্তি পেত! সৌম্য ভাইয়া তাকে মজা করে বলতো,
– বোনু আমার একটা কুড়িয়ে পাওয়া বোন আছে বুঝলি? ওর নাম শুনবি?
সন্ধ্যা আগ্রহের সাথে তার ভাইয়ের দিকে চেয়ে থাকতো। সৌম্য মনে মনে হেসে বলতো,
– ওর নাম সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা রে’গে সৌম্যর বাহুতে কিল দিয়ে মুখ ফুলাতো। সৌম্য সন্ধ্যার জন্য আনা কেনা জামা বের করে সন্ধ্যার সামনে ধরলে সন্ধ্যার ভাইয়ের প্রতি সব অভিমান মুছে যেত। সৌম্য জামা পরতে বললে সন্ধ্যা ঝটপট তার ভাইয়ের দেয়া জামা পরে এসে তার ভাইকে দেখাতো।
সারা সপ্তাহের সৎ মায়ের অ’ত্যা’চা’র এক নিমিষেই ভুলে যেত, যখন তার একটামাত্র আপন ভাইয়ের সাথে একটুখানি খুনশুটিতে ব্যস্ত হতে পারতো!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ে। বেলকনির গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজল। সৌম্য ভাইয়া কি তাকে নিতে আসবে না? গ্রামে যায়নি তার ভাই? বাবার থেকে শুনে কেন তাকে নিতে আসছে না সৌম্য ভাইয়া?
বেশ অনেকক্ষণ নিরবে চোখের পানি ফেলে মেয়েটি।
এরপর ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দেয়। আসমানী নওয়ান তার ঘরে যেতে বলেছে।
বলেছে, তাকে মাথায় তেল দিয়ে দিবে। সন্ধ্যা না করেনি। ভদ্রমহিলা তার কথা খুব ভাবে। সন্ধ্যার ভালোই লাগে। অনেকটা মায়ের আদরের মতো লাগে। টেবিলের উপর থেকে একটি তেলের বোতল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ বোতল থেকে বেশ অনেকটা পরিমাণ তেল মেঝেতে পড়ে যায়। বোতলের মুখ আলগা থাকায় এমন হয়েছে। সন্ধ্যা বুঝতে পারেনি। বিরক্ত হলো নিজের উপর। আবার উল্টো ঘুরে এগোয়, জায়গাটুকু মুছে ফেলবে বলে।
আকাশ অফিস থেকে ফিরেছে। তার কাছে থাকা চাবির দ্বারা দরজা খুলে মাত্র বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছে। দরজা লাগিয়ে উল্টো ঘুরলে দেখল শাড়ি পড়া একটি মেয়ে, মাথায় ঘোমটা টানা, ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাশ বুঝল এটা সন্ধ্যা। তাদের বাড়িতে সন্ধ্যা ছাড়া এভাবে কেউ থাকে না। সন্ধ্যার দিকে চেয়েই আকাশ এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ তেলের উপর পা পড়ায় আকাশের পা ফিছলে যায়, বেচারা ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যায়। ধপ করে শব্দ হয়। আকাশ হতভম্ব হয়ে নিজের দিকে চেয়ে আছে। মেঝেতে একদম ছড়িয়ে বসে পড়েছে সে।
অন্তঃদহন পর্ব ২
ওদিকে সন্ধ্যা কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে দ্রুত পিছু ফিরে তাকায়। আকাশকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ তার সামনে দাঁড়ানো সন্ধ্যার দিকে তাকালে সন্ধ্যার হাতে তেলের বোতল দেখে যা বোঝার বুঝল। পায়ের নিচে পিচ্ছিল কিছু পড়েছে, এটা তো বুঝেছে। তেলের বোতল দেখে পুরোটা-ই বুঝল।
সন্ধ্যা বারবার ঢোক গিলছে। আকাশ সন্ধ্যার দিকে শক্ত চোখে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ইডিয়েট! চোখে দেখো না?