অন্তঃদহন পর্ব ৪

অন্তঃদহন পর্ব ৪
DRM Shohag

সন্ধ্যা কি বলবে বুঝলো না। আকাশের অবস্থা দেখে তার যেমন খারাপ লাগছে, সাথে হাসি-ও পাচ্ছে, লোকটা পড়েছে তো পড়েছে,, একদম বাচ্চাদের মতো করে পা ছড়িয়ে পড়ায় হাসি পাচ্ছে। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
আকাশ মেঝে থেকে উঠতে চাইছিল, অনেকটা জায়গাজুড়ে তেল, যার ফলে আকাশ ঠিক সুবিধা করতে পারছে না।
বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকালে সন্ধ্যার হাসিমুখ চোখে পড়ে। আকাশের রে’গে যাওয়ার কথা, কিন্তু সে রা’গ’লো না। শীতল দৃষ্টিতে সন্ধ্যার মুখপানে তাকায়। সন্ধ্যার গালের বা পাশে বড়সড় একটি টোল পড়ে, যা আকাশের দৃষ্টিতে নিখুঁতভাবে আটকায়।

সন্ধ্যা বহুকষ্টে নিজেকে সামলালো। আকাশের দৃষ্টিতে খানিক বিব্রতবোধ করে। তেলের বোতল-টি মেঝেতে রাখে। তখন-ই বাড়ির বেল বেজে ওঠে। সন্ধ্যা দরজার দিকে তাকায়। আকাশদের বাড়ির কাজের লোক গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
সন্ধ্যার দৃষ্টি দরজার পানে ছিল। এক অপরিচিত ছেলের মুখ দেখে সন্ধ্যার ভ্রু কুঁচকে যায়।
ছেলেটি কোনোদিকে তাকালো না। আকাশকে পিছন থেকে দেখে-ই চিনতে পেরেছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে একদৌড়ে আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় সমানে ক্লিক করে আর বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– বাতাস বাবু স্মাইল পিলিজ!
আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে ছিল, পরিচিত কণ্ঠ পেয়ে সেদিকে তাকায়। ততক্ষণে ছেলেটি তার হাতে থাকা ক্যামেরা দ্বারা অনেকগুলো ছবি তুলেছে আকাশের।
সন্ধ্যা ছেলেটির মাথা থেকে পা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলায়। ছেলেটি অনেকটা বিদেশিদের মতো দেখতে, হাইট ৬ ফুটের কাছাকাছি। চুলগুলো হালকা ব্রাউন টাইপ, গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, গালে দাড়ি নেই, গলায় ক্যামেরা ঝুলানো, গায়ে সাদা রঙের শার্ট, প্যান্ট জড়ানো,, পিঠে একটি ব্যাগ।
আকাশ রে’গে বলে,

– অরুণ, ক্যামেরা ভাঙতে না চাইলে সবগুলো পিক ডিলিট করবি।
অরুণ দাঁত কেলিয়ে বলে,
– ঝাক্কাস আসছে পিকগুলো। সবগুলো ভার্সিটিতে ভাইরাল করব আজকেই। জোশ হবে না মামা!
আকাশ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বা হাত কোমরে রেখে চোখমুখ কোঁচকালো। ভালোই ব্য’থা পেয়েছে। অরুণ এগিয়ে এসে আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার ক্যামেরায় উঠানো পিকগুলো একটা একটা করে আকাশকে দেখায় আর বলে,
– তুই আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেলিনা, এতো সুন্দর সারপ্রাইজ দিবি বলে! তোকে সত্যিই বাবু লাগছে রে!
আকাশ খপ করে অরুণের ক্যামেরা ধরতে গেলে অরুণ দ্রুত তার ক্যামেরা সরিয়ে নেয়। আকাশ তার দিকে এগিয়ে আসলে অরুণ লাফ দিয়ে কয়েকপা সরে যায়। আকাশ অরুণের পিছে যায় অরুণের ক্যামেরা ধরতে। অরুণ দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,

– তুই ভার্সিটির বড় ভাই, তোকে সবভাবে দেখার অধিকার আছে জুনিয়রদের। তুই এভাবে ওদের বঞ্চিত করতে পারিস না।
আকাশ অরুণের পিছে দৌড়ায় আর বলে,
– তোর নু’ড ছেড়ে জুনিয়রদের হক পূরণ করব বে’য়া’দ’ব।
অরুণ সোফার উপর লাফ দিয়ে অপর পাশে যায়, ডানদিকে আসমানী নওয়ানকে দেখে বলে,
– আন্টি তোমার ছেলে অ’শ্লী’ল কথা বলে। আমি কিন্তু পেকে যাচ্ছি।
আসমানী নওয়ান একবার অরুণের দিকে তাকায়, আরেকবার আকাশের দিকে। সন্ধ্যা নিজেও চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে, দু’টো বাচ্চা ছেলে বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ করছে।
আকাশ সোফা ডিঙিয়ে লাফ দিয়ে অপরপাশে যায়। তাদের ভার্সিটির গ্রুপে এসব পিক দিলে তার সব মানসম্মান যাবে। যেকোনোভাবে অরুণের থেকে ক্যামেরা নিয়ে সব ডিলিট করতে হবে৷ সেজন্য-ই আকাশ সব রেখে অরুণের পিছু নিয়েছে।
অরুণ দৌড়াতে দৌড়াতে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– আরে এটা কে? হাই সুইটি!
কথাটা বলে আকাশকে তার কাছে দেখে বামদিকে দৌড় দিতে গেলে তেলের উপর পিছলা খেয়ে ঠাস করে পড়ে যায়। বেচারা চেঁচিয়ে ওঠে।সন্ধ্যার চোখ আগের চেয়েও বড় হয়ে যায়। হায় আল্লাহ! তার জন্য এসব কি হচ্ছে! আকাশ হাঁটু মুড়ে বসে অরুণের হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়। এরপর একটা একটা করে সব পিক ডিলিট করে ঠাস করে অরুণের পায়ের উপর রাখে ক্যামেরা।
অরুণ অসহায় মুখ করে চেয়ে আছে। আকাশ উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে তার ফোন বের করে একটি পিক অরুণের দিকে ধরে সূক্ষ্ম হাসে। অরুণ চোখ বড় বড় তাকায়। আকাশের ফোনের স্ক্রিনে অরুণের একটি পিক, যেখানে অরুণের পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার পরা পিক। অরুণ অসহায় কণ্ঠে বলে,

– আসতাগফিরুল্লাহ! এসব ডিলিট করে দে। এসব রাখলে আল্লাহ পাপ দেয়।
আকাশ ফোনের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
– যাহ তুই ভাইরাল! এটাই তোর সারপ্রাইজ!
অরুণ চেঁচিয়ে ওঠে,
– আন্টি তোমার অ’শ্লী’ল ছেলেকে কিছু বলো। আমার ই’জ্জ’ত খেয়ে দিল!
আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে বলে,
– তুমি কহন আইলা? আকাশ তোমারে আনতে যায়নাই?
অরুণ ইনোসেন্ট মুখ করে বলে,
– তোমার ছেলের আপ্যায়ণ কত বা’জে দেখলে? এখন তুমি একটু আমায় আপ্যায়ণ কর নাও।
বলতে বলতে অরুণ উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা বিস্মিত! এরকম বিদেশি একজন ছেলে দিব্যি বাংলা বলছে, ব্যাপারটা সন্ধ্যাকে ভীষণ অবাক করেছে।

আকাশ তার ফোন পকেটে রেখে তার প্যান্ট ঝাড়ে কয়েকবার। প্যান্টে, পায়ে পুরো তেল তেল হয়ে গিয়েছে। উল্টো ঘুরে সামনে এক পা বাড়ালে সন্ধ্যাকে দেখে থেমে যায়। সন্ধ্যা অরুণের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সামনে আকাশকে খেয়াল করেনি সে। আকাশ সন্ধ্যার দৃষ্টি অনুসরণ করে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে দেখল অরুণের দিকে চেয়ে সন্ধ্যা হাসছে। আকাশ বিরক্ত হলো। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
– ওর আনলিমিটেড গার্লফ্রেন্ড আছে।

কথাটি কানে আসতেই সন্ধ্যা দ্রুত তার সামনে দাঁড়ানো আকাশের দিকে তাকায়। চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময়। আকাশ কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকিয়ে না চাইতেও হেসে ফেলল। আকাশ অবুঝ নয়নে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে মুখে হাত দিয়ে হাসি থামাতে চায়, মেয়েটির হাসির শব্দ নেই। কিন্তু গালের বা পাশে সৃষ্ট গভীর টোল স্পষ্ট দৃশ্যমান। আকাশের দৃষ্টি সেথায় আটকায়। সন্ধ্যার হাসি থামছে না। শেষ কবে এতো হেসেছে তার মনে পড়েনা।
আকাশের মাথার ডানপাশের কিছু পরিমাণ চুলে একটি প্রজাপতি আকারের ক্লিপ আটকানো। সন্ধ্যা বাচ্চাকালে এভাবে তার মাথার চুল আটকাতো। আকাশকে জোকারদের মতো লাগছে।
সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালে আকাশের দৃষ্টি তার দিকে বুঝতে পেরে মুখে লেপ্টানো হাসির রেশ মুছে ফেলে। ফলস্বরূপ গালে সৃষ্ট টোল অদৃশ্য হয়। আকাশ বিরক্ত হয়। একটু নয়, বরং অনেকটা বিরক্ত হয়। সন্ধ্যার চোখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলে,

– হাসো।
সন্ধ্যা বোকাচোখে তাকায় আকাশের দিকে।
আসমানী নওয়ান অরুণকে আকাশের সাথে যেতে বলে সন্ধ্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। এরপর আকাশের উদ্দেশ্য বলে,
– অরুণ রে নিয়া তোমার ঘরে যাও আকাশ। ওর জন্য ঘর পরিষ্কার করা হয়নি আইজ।
আকাশ দ্রুত সন্ধ্যার উপর থেকে দ্রুত নজর সরিয়ে ফেলে। নিজের কাজে ভীষণ বিরক্ত হলো। কী অদ্ভুদ! সে কি বাচ্চা না-কি!
আসমানী নওয়ান আকাশের চুল থেকে ক্লিপ খুলে দিয়ে বলে,
– মাইয়াগো ক্লিপ পইরা আছো ক্যান?
আকাশ তার মায়ের হাতের দিকে তাকালে মেয়েদের ক্লিপ দেখে বুঝল এটা অরুণের কাজ। অরুণ সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর পিছু ফিরে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আকাশ রে’গে তাকায়৷ আসমানী নওয়ান এর পাশ কাটিয়ে দুই তিন সিঁড়ি পর পর উপরে উঠতে থাকে অরুণকে ধরার জন্য। অরুণ দৌড় লাগায়৷ আকাশ আশেপাশে কিছু খুঁজল। পায়ে জুতো থাকলে এর কপালে আজ জুতোর বারি জুটাতো আকাশ। বে’য়া’দ’ব টার জন্য ওই মেয়েটা তাকে জোকার ভেবে হেসেছে, কথাটা ভাবতেই মে’জা’জ খারাপ হলো।
সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকে অরুণ আর আকাশের দিকে। আসমানী নওয়ান রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,

– সন্ধ্যা মা, তুই ঘরে যা। এই দু’টো একজায়গায় হইলে এমন-ই করে।
সন্ধ্যা মৃদু হাসে। আকাশ সবগুলো সিঁড়ি উঠে বিরক্তচোখে চেয়ে রইল অরুণের দিকে। এ বাংলাদেশে পা রাখতে না রাখতেই শুরু হয়ে গেল! অরুণ ততক্ষণে আকাশের ঘরে ঢুকে পড়েছে। আকাশ বিরক্তির শ্বাস ফেলে। ডান হাত রেলিঙের সাথে একটা পাঞ্চ মা’র’তে গিয়েও থেমে যায়, সন্ধ্যার হাসিমাখা মুখ দেখে। মেয়েটি এতো হাসে কেন? সবচেয়ে বড় কথা আকাশের বারবার মেয়েটির হাসিতে চোখ আটকে যাচ্ছে, ব্যাপারটায় আকাশ চরম বিরক্ত।
সন্ধ্যার আকাশের সাথে চোখাচোখি হওয়ায় দ্রুত মাথা নিচু করে নেয়।
আকাশ সন্ধ্যার দিকে আর তাকালো না। দ্রুতপায়ে তার ঘরে চলে যায়।
ঘরে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেয়ে বুঝল অরুণ ওয়াশরুমে। আকাশ তার হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখলো। এরপর শার্টের বোতামগুলো একে একে খুলে শরীর থেকে ছাড়িয়ে রাখলো। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। ঘরের এসি ছেড়ে ডিভানের উপর বসে চোখ বুজে দু’পা মেলে দিল। এরপর ডান পা নাড়াতে নাড়াতে বিড়বিড় করল,

– বা’লে’র গরম!
অরুণ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেডের উপর ঠাস করে শুয়ে পড়ে। শব্দ পেয়ে আকাশ চোখ মেলে তাকায়। রে’গে বলে,
– লাত্থি খাবি বে’য়া’দ’ব। আমার ঘরের একটা সুতা এলোমেলো করলে এক লাত্থি দিয়ে যেখান থেকে এসেছিস আবার সেখানে পাঠাবো তোকে।
অরুণ হেসে বলে,
– ওয়াও! তার মানে আমার যাওয়ার টিকিট, ভাড়া কোনোটাই লাগছে না! সেই তো!
আকাশ বিরক্ত চোখে তাকালো। ডিভান থেকে উঠে বড়বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে চলে যায়।
অরুণ এর বাবা বিদেশি, মা বাংলাদেশি। তবে সে দেখতে একদম তার বাবার মতো বিদেশি হয়েছে। তার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে তার যখন দশ বছর বয়স। অরুণ দশ বছর পর্যন্ত বিদেশে ছিল তার বাবা মায়ের সাথে। এরপর তার বাবা মা আলাদা হয়ে গেলে সে মায়ের সাথে বাংলাদেশে চলে আসে। এখানেই পড়াশোনা করে। আকাশ, আনিকা এরা তার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।
তবে অরুণ পিএইডি করে বাইরেই সেটেল হয়ে গিয়েছে। সে ভার্সিটি থাকাকালীন তার মা মা’রা যায়। এজন্যই মূলত আর বাংলাদেশে ফেরেনি।
অরুণ বাংলাদেশে এসেছে মূলত দু’টো বিয়েতে অ্যাটেন্ড করতে। একটা আকাশের, আরেকটি আনিকার ছোট বোনের।

ইরা আর ইতি বেডের উপর বসে আছে। ইতি মূলত ইরাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ইরাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে ইতি ইরার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– ইরা আপু কি হয়েছে গো তোমার?
ইরা বেডের সাথে হেলান দিয়ে দু’পা কিছুটা ভাঁজ করে আসে আছে। কোলের উপর ফোন রেখে একধ্যানে ফোনের দিকে চেয়ে আছে।
এখন রাত প্রায় ১২ টার কাছাকাছি। ইরা সৌম্যকে মেসেজ দিয়েছে রাত ১০ টায়, এখন-ও সিন হয়নি। অথচ সৌম্য অনলাইনে। মাঝে কতবার কল দিয়েছে, কখনো বাজতে বাজতে একাই কেটে গিয়েছে,, তো কখনো সৌম্য কল কেটে দিয়েছে।
ইরার চোখজোড়া ঝাপসা। ইতি ইরাকে ঝাঁকিয়ে ডাকে,

– ও ইরা আপু?
ইরা ঝাঁকি দিয়ে ইতির দিকে তাকায়। দ্রুত চোখজোড়া মুছে নিজেকে সামলে নেয়। এরপর মৃদু হেসে বলে,
– হ্যাঁ কিছু বলছিলি?
ইতি মন খারাপ করে বলে,
– তোমার কি হয়েছে ইরা আপু?
ইরা মাথা নেড়ে বলে,
– আরে কিছু না।
ইতি ইরার দিকে চেয়ে রইল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ইরার ফোনের দিকে তাকায়। যেখানে লেখা –
~ সৌম্য বাসায় পৌঁছেছিস? ১০:০০
~ সৌম্য? ১০:৩০
~ সৌম্য বল প্লিজ! ১১:০০
~ সৌম্য একটা রিপ্লে দিবি? ১১:৩০
~ সৌম্য? একবার মেসেজ সিন করবি? ১১:৪৫

এভাবে পাঁচটি মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করা। অথচ রিপ্লে আসেনি কোনো। ইতির খুব মন খারাপ হয়। সে সবকিছু জানে। মৃদুস্বরে বলে,
– ইরা আপু সৌম্য ভাইয়া তোমাকে অনেক ইগনোর করে তাইনা?
ইরা হাঁটু দু’টো বুকে ঠেকিয়ে ডান গাল হাঁটুতে ঠেকিয়ে রাখলো। এরপর চোখ বুজে নেয়। বন্ধ চোখের পাতা ভেদ করে দু’ফোঁটা পানি বেরিয়ে আসে।
ইতি দেখতে পেল না তা। মন খারাপের রেশ নিয়ে মেয়েটি মৃদুস্বরে বলে,
– সে তোমাকে এতো ইগনোর করে। তবুও কেন তাকে ভুলতে পারছ না?
ইরা মলিন গলায় বলে,
– কারণ আমি সৌম্য’র যত্ন বুঝতে শিখেছি।
– সে যত্ন তো তোমায়, বন্ধু হিসেবে-ও করতে পারে!
ইতির কথায় ইরা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না। ইতি আবারও বলে,
– তোমার সৌম্য ভাইয়াকে ভুলে যাওয়া উচিত ইরা আপু।

কথাটা শুনতেই ইরার বুকে চিনচিন ব্য’থা করে ওঠে। একটি টুঁশব্দ পর্যন্ত করল না। ইতি আবারও বলে,
– তুমি-ই তো গল্প করেছিলে। সৌম্য ভাইয়ার একটা নিজের বাড়ি পর্যন্ত নেই। তার বাবা বলতে গেলে তাকে ভুলে গিয়েছে। আমি জানি সৌম্য ভাইয়া খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু সে কিচ্ছু করে না। তোমার ভবিষ্যৎ একদম অন্ধকার। পরবর্তীতে সে যদি কোনো চাকরি পায়-ও, তবুও মোটামুটি কোনোরকমে চলে যাবে। তুমি ওই পরিবেশে কখনোই নিজেকে মানাতে পারবে না।
সবচেয়ে বড় কথা, তুমি তো চেনো মামাকে,, তুমি ম’রে গেলেও মামা তোমাদের মানবে না।
ইতির কথাগুলো শুনে ইরার বুকে চিনচিন ব্য’থা ধীরে ধীরে সারা শরীরে বিদুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়লো। ইরার চোখের পর্দায় শ্যামবর্ণের সৌম্য’র ক্লান্তিমাখা মুখটা ভেসে ওঠে। যার চোখেমুখে কত মায়া! ইরার চোখের কোণে পানির কণা জমা। ভারী স্বরে বিড়বিড় করল,
– সৌম্য’কে কখনো ভুলে যাওয়া যায় না। ভুলতে গেলে বরং সৌম্য’কে মনে পড়ার প্রহর আরও বেড়ে যায়।

দরজার আড়ালে ইরার বাবা ইশতিয়াক আহমেদ দাঁড়িয়ে ছিল। সে মূলত এসেছিল ইরাকে দেখতে। ভেবেছিল, ইরা ঘুমিয়েছে। সকালে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে এজন্য একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু ইরা আর ইতির কথাগুলো শুনে ইরার প্রতি তার সব খারাপ লাগা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেল! অগণিত রা’গ এসে ভর করল তার উপর।
সে আজ সন্ধ্যার পর পর ইরা আর একটি ছেলেকে রিক্সায় পাশাপাশি বসে থাকতে দেখেছে। যখন দেখেছিল তখন-ও সন্দেহ করেনি। কারণ অনেক আগে থেকেই ইরার অনেক ছেলে ফ্রেন্ড ছিল, অনেকে বাসায়-ও আসতো। তাই ব্যাপারটা প্রথমে আমলে নেয়নি। কিন্তু এখন কথাগুলো শুনতে পেয়ে ইরার বিয়ে না করার ব্যাপারে খুব ভালোভাবে ক্লিয়ার হলো। শক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করল,

– সৌম্য!
অতঃপর ইশতিয়াক আহমেদ যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নিঃশব্দে জায়গাটি প্রস্থান করল।
এরপর কাউকে কল করে বলে,
– ঢাকা ভার্সিটিতে মাস্টার্স ফার্স্ট ইয়ারের সৌম্য নামে কোনো ছেলে থাকলে সেই ছেলের এ টু জেড ডিটেইলস আমাকে পাঠাও।
ইরার ভার্সিটি থেকেই প্রথম খোঁজা শুরু করল। ছেলেটি ইরার ভার্সিটির না হলে, বাংলাদেশের যেখানেই থাকুক, ইশতিয়াক আহমেদ ঠিক খুঁজে বের করবে।

রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ আগেই ঘরে এসেছে আকাশ আর অরুণ। অরুণ ডিভানের উপর বসে ফোনে মগ্ন।
আকাশ রকিং চেয়ারে ডান পা বা পায়ের উপর তুলে বসেছে। কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে তাতে কাজ করছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে। দু’হাতে দশ আঙুল অনর্গল চলছে। দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। চোখেমুখে বিরক্তি। বেশ কিছুক্ষণ পর বিরক্তিসূচক শব্দ করে চেয়ারের হাতলে একটা পাঞ্চ মা’রে আকাশ। এরপর চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই থেকে আবারও চোখ মেলে তাকায়৷ এরপর কাউকে কল করে ল্যাপটপ থেকে। ওপাশ থেকে সাথে সাথে রিসিভ হলে আকাশ রে’গে বলে,
– বাংলা বোঝোনা তুমি? তোমার জন্য আমি এখন জাপানিজ ভাষা শিখব?
ওপর পাশে থাকা একটি মেয়ে, যে আকাশের অফিসের স্টাফ,, সে মিনমিন করে বলে,

– স্যরি স্যার!
আকাশ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– কিসের স্যরি! স্যরি তোমার কাছে রাখো। আর আমার কাজ কর।
মেয়েটি বলে,
– জ্বি স্যার!
অরুণ হঠাৎ-ই শব্দ করে বলে ওঠে,
– বাবু খাইছো?
আকাশের ফোনের এপাশের মেয়েটি থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
– জ্বি স্যার!
আকাশ খট করে কল কেটে অরুণের দিকে রে’গে তাকায়। অরুণের কানে ব্লুটুথ, আকাশের দিকে চোখ পড়লে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশের দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে সে তার কাজে ব্যস্ত হয়। আকাশ রে’গে বলে,
– তুই উল্টাপাল্টা বললি কেন? আমার অফিসের স্টাফ ভেবেছে আমি এসব উল্টাপাল্টা কথা ওকে বলেছি।
অরুণ তার কল মিউট করে ভ্রু কুঁচকে বলে,

– আরে আমি আমার গার্লফ্রেণ্ডদের সাথে কথা বলছি।
আকাশের দৃষ্টির নড়চড় নেই। অরুণ ডিভান থেকে উঠে তার কান থেকে একটি ব্লুটুথ খুলে আকাশের কানে দিয়ে দেয় আর বলে,
– বিশ্বাস করছিস না কেন? এই নে, নিজেই শোন।
আকাশ কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কতগুলো মেয়ের ভয়স! ওপাশ থেকে একসঙ্গে সবাই বলে ওঠে,
– বাবু মিস ইউ টু।
অরুণ লাজুক হেসে বলে,
– ওলে আমার বাবু টা! লাভ ইউ সোনা, ময়না, পাখি।
ওপাশ থেকে সবাই একসাথে বলে ওঠে,
– লাভ ইউ জানু টা!
আকাশ খুকখুক করে কেশে ওঠে। বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– এতোগুলোকে একসাথে সামলাস?
অরুণ নেকামো করে বলে,
– বাবু দু’মিনিট ওয়েট কর তো! আমাকে কি যেন কা’ম’ড়ে’ছে! ইশ!
কথাটা বলেই কল মিউট করে ফেলে।
ওপাশ থেকে সবাই বলে ওঠে,
– বাবু তোমাকে কি কা’ম’ড়া’লো? আমাকে বলো প্লিজ!
অরুণ হেসে আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,

– আরে আলাদা আলাদা করে কথা বলতে গেলে তো সারাদিন লাগবে। তাই এই টেকনিক।
আকাশ চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। কি পরিমাণ প্লেবয় এটা ভাবা যায়! কান থেকে ব্লুটুথ নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে রে’গে বলে,
– সবগুলোর থেকে তোর কপালে জুতার বারির ব্যবস্থা করব আমি, দাঁড়া। ক্যারেক্টারলেস একটা!
অরুণ হাসলো। আকাশকে কিছু বলল না। আবারও ডিভানে গিয়ে বসে কথা বলায় ব্যস্ত হয়।
আকাশ ল্যাপটপে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। একটি কফির অভাববোধ করল। বিরক্ত হলো খানিক। কিন্তু এটুকু বিরক্তবোধ কাজের প্রতি অনীহা আনতে পারেনি।
আকাশ আবারও টানা পাঁচ মিনিট অনর্গল ল্যাপটপের কি-বোর্ডে আঙুল চালালো। এরপর হঠাৎ-ই আঙুলগুলোকে রেহাই দেয়। ডান হাতে তার মাঝারি সাইজের দাঁড়িতে হাত চালিয়ে সূক্ষ্ম হেসে বিড়বিড় করে,

– গুড জব!
আকাশের বাবা সাইফুদ্দীন নওয়ান আকাশের ঘরে এসে অরুণের পাশে বসে। এরপর অরুণের কাঁধ চাপড়ে বলে,
– কেমন আছো ইয়াং ম্যান?
অরুণ আকাশের বাবাকে দেখে দ্রুত ফোন রেখে ভদ্রলোকের দিকে ফিরে বসে। এরপর হেসে বলে,
– এইতো ভালো। আপনি কেমন আছেন আঙ্কেল?
সাইফুদ্দীন নওয়ান জানালেন তিনিও ভালো আছেন। এরপর দু’জন আরও টুকটাক কথা বলে।
সাইফুদ্দীন নওয়ান আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
– আকাশ তুমি ইরাকে বিয়ে করবে না কেন বলেছ?
বাবার কথায় আকাশের দৃষ্টি থামে কিছুক্ষণের জন্য। এরপর আবারও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে বলে,
– আমার ইচ্ছা।
সাইফুদ্দীন নওয়ান বিরক্তি কণ্ঠে বলেন,

– তুমি কি আমার সাথে মজা করছ? ইরাকে বিয়ে করবে না কেন?
আকাশ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়,
– ইচ্ছে করছে না।
ছেলের গা ছাড়া ভাবে সাইফুদ্দীন নওয়ান রে’গে যায়। ডিভান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– তুমি কি ওই মেয়েটার জন্য বিয়ে করতে চাইছ না?
আকাশের কপালে ভাঁজ পড়ে। রকিং চেয়ার ঘুরিয়ে ডান দিকে ঘুরে তার বাবার দিকে মুখ করে বসে। বা পায়ের উপর ভাঁজ করে রাখা ডান পা নাড়াতে নাড়াতে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কোন মেয়েটা?
সাইফুদ্দীন নওয়ান বিরক্তি কণ্ঠে বলেন,
– ওই গেঁয়ো মেয়েটা, যাকে তোমার মা এনে রেখেছে।
আকাশের কপালে সৃষ্ট ভাঁজ শিথীল হয়। মৃদুস্বরে বলে,
– মেয়েটির সুন্দর একটি নাম আছে। সন্ধ্যা। নাম ধরে বলো।
আাকশের বাবা রে’গে বলে,
– ওহ! নাম-ও জানো দেখছি!

আকাশ চেয়ারে হেলান দেয়। বা হাতে ডান হাতের শার্ট এর হাতা কনুই এর উপরে তুলে গম্ভীর গলায় বলে,
– জানবো না কেন? তুমি শুধু তোমার বউয়ের খোঁজ রাখো। বাট আমি বাড়ির সবার খোঁজ রাখি। তাছাড়া আমি উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। ছয়মাসের মধ্যে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে।
আকাশের কথা শুনে তার বাবা অবাক হয়ে বলে,
– তাহলে ইরাকে বিয়ে করছ না কেন?
আকাশ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– বললাম তো, ইচ্ছে করছে না।
– তাহলে আগে করতে চেয়েছিলে কেন?
আকাশ দু’হাত চুলের ভাঁজে চালায় আর বলে,
– এক্সপেরিমেন্ট করতে। এখন ভাবলাম বিয়ে ছাড়াও আরও অনেককিছু করার আছে। এই ফা’ল’তু ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে লাভ নেই।
আকাশের কথা শুনে সাইফুদ্দীন নওয়ান সহ অরুণ অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাকায়। সাইফুদ্দীন নওয়ান বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– কখনো শুনেছ? কেউ এক্সপেরিমেন্ট করতে বিয়ে করে?
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,

– শুনিনি। নিজেকে দেখেছি। চাইলে তুমি-ও আমাকে দেখতে পারো।
অরুণ আকাশের কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেলে। সাইফুদ্দীন নওয়ায়ন বিরক্ত চোখে তাকায় অরুণের দিকে।
অরুণ হাসি আটকে বলে,
– স্যরি আঙ্কেল! ব্রেক ফেইল হয়ে গিয়েছে।
সাইফুদ্দীন নওয়ান কিছু বললেন না। তিনি ছেলের হেয়ালিপনায় চরম বিরক্ত সাথে হতাশ। বহুকষ্টে আকাশকে বিয়েতে রাজি করিয়েছিল, এদিকে এই ছেলের মনে ছিল এক্সপেরিমেন্ট করার ধান্দা!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি বিয়ে না করলে আমার ব্যবসায় কতবড় লস হবে আইডিয়া আছে তোমার?
আকাশ ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
– তাতে কি? হলে হবে।
সাইফুদ্দীন নওয়ান রে’গে বলে,

– মজা কর না আমার সাথে। বিয়ে করতে হবে তোমাকে।
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– আমি তো কবুল বলব না। তাহলে বিয়ে হবে?
সাইফুদ্দীন নওয়ান রে’গে কিছুটা শব্দ করে চেঁচিয়ে ওঠে,
– আকাশ?
আকাশ ঠাস করে ল্যাপটপ বন্ধ করে রকিং চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে যায়। হাতের ল্যাপটপ শব্দ করে টেবিলের উপর রাখে। সাইফুদ্দীন নওয়ান আবারও রে’গে বলেন,
– তোমাকে বিয়ে করতে হবে আকাশ।
আকাশ এবার প্রচন্ড রে’গে যায়। উল্টো ঘুরে রকিং চেয়ারে জোরেসোরে এক লাথি দিয়ে চিৎকার করে বলে,
– একবার বলেছি, বিয়ে করব না মানে করব না। ব্যাস। এতোক্ষণ শান্ত ছিলাম, ভালো লাগছিল না তোমার?
অরুণ দ্রুত দাঁড়িয়ে যায়। রকিং চেয়ারের দিকে তাকালে দেখল, চেয়ারটি চার থেকে পাঁচ হাত দূরে সরে গিয়ে উল্টে পড়েছে।
চেঁচামেচি শুনে আসমানী নওয়ান আকাশের ঘরে এসে বলে,

– কি হইছে?
সাইফুদ্দীন নওয়ান নিজ স্ত্রীর পানে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। নরম কণ্ঠে বলে,
– কিচ্ছু না। কথা বলছিলাম। তুমি এখানে আসতে গেলে কেন? এসো ঘুমাবো। অনেক রাত হয়েছে।
আসমানী নওয়ান আকাশের দিকে তাকালে দেখল আকাশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাইফুদ্দীন নওয়ান তার স্ত্রীর হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। অরুণ মৃদু হাসলো। আকাশের বাবা টা তার বউটাকে সেই মোহাব্বত করে!
আকাশ বিরক্ত হয়ে বেলকনির দিকে চলে গেল। ঠাণ্ডা মে’জা’জ টা নাড়িয়ে নাড়িয়ে গরম করে দিয়েছে। অরুণ আকাশের পিছন পিছন আসতে আসতে বলে,
– আমি কি আমার গার্লফ্রেণ্ডদের সাথে কথা বলতে পারি বাতাস বাবু?
আকাশ পিছু ফিরে রে’গে বলে,
– বা’ল যা তো! গার্লফ্রেণ্ডদের সাথে কথা বল, নয়তো শুয়ে থাক। শুধু আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করলে খবর আছে তোর!
অরুণ ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আকাশ বেলকনিতে চলে যায়।

সৌম্য গতকাল গ্রামে গিয়েছিল। সকাল সকাল আবার ফিরে এসেছে। সন্ধ্যার খোঁজেই গ্রামে গিয়েছিল। কোথাও মন টিকে না। সবসময় মন অস্থির হয়ে থাকে।
আজ ভার্সিটিতে যায়নি। নিজের রুমেই উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। সারাদিন এভাবেই ছিল। বিকেল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ করেনি। গোসল, খাওয়া-দাওয়া সব রেখে শুধু শুয়ে আছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সন্ধ্যা কে কবে খুঁজে পাবে সে? তার বোনটাকে ছাড়া তার সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে!

ডান হাত বাড়িয়ে হাতিয়ে হাতিয়ে ফোন নেয়। এরপর ফোনের আলো অন করলে ইরার অনেকগুলো কল মেসেজ ভেসে ওঠে। সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব নোটিফিকেশন কেটে দেয়। চাপা শ্বাস ফেলে হাতের ফোন উল্টো করে রাখে।
হঠাৎ-ই কিছু মনে পড়ল। সময় নষ্ট না করে দ্রুত উঠে পড়ে। একটি টি-শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে যায় বড় বড় পা ফেলে। পাঁচ মিনিটের মাঝে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। কিছুই ঠিকঠাক করল না। দু’হাতে শার্টের হাতা কব্জি পর্যন্ত ছেড়ে দেয়া। টেবিলের উপর থেকে ওয়ালেট আর ফোন নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
কার্জনের হলের সামনে এসে রিক্সা থামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পা চালায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আশেপাশে বারবার চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আর পায়ে গতি বাড়ায়। ডানদিকে অনেকটা দূরে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যা ভেবেছিল তাই। মেয়েটি বাড়িতে যায়নি। সৌম্য দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায়।
ইরা ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে সৌম্য’র দিকে। সৌম্য এগিয়ে এসে ইরার সামনে দাঁড়ায়। ইরার চোখদুটো লাল, ফর্সা মুখ হালকা ফোলা সাথে লাল।
সৌম্য ঢোক গিলে মৃদুস্বরে বলে,

– বাড়ি যাসনি কেন ইরা?
ইরার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদলো না। মলিন গলায় বলে,
– তুই আমায় অবহেলা করতে গিয়ে কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়িস না সৌম্য?
সৌম্য অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইরার পানে। শক্ত করে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পারলো না ইরার অসহায়ত্বে ঘেরা মুখটা দেখে। ইরাকে দেখতে অসুস্থ লাগছে! সৌম্য এগিয়ে এসে ডান হাতের উল্টোপিঠে ইরার কপাল চেক করে। জ্বরে মেয়েটির গা পুড়ে যাচ্ছে। ইরা মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে আছে। সৌম্য চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– তোর গায়ে অনেক জ্বর। এই শরীরে ভার্সিটি আসলি কেন?
ইরা মৃদু হেসে বলে,

– বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়-ও সুস্থ ছিলাম। জ্বর তো তোর অবহেলার ফসল।
সৌম্য ইরার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিল। দৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থির রাখতে পারলো না। চোখজোড়া সরিয়ে নিল। কিছু বলল না। ইরার হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি রিক্সায় উঠে বসে দু’জন। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সৌম্য একটি হোটেল এর সামনে রিক্সা দাঁড় করায়। এরপর ইরাকে নিয়ে রিক্সা থেকে নেমে দোকান থেকে দু’টো নাপা কিনে প্যান্টের পকেটে রাখে। তারপর হোটেলের ভেতর প্রবেশ করে।
ইরা নিরবে সৌম্য’র পিছু পিছু যায়। সৌম্য এক সাইডের টেবিলের সামনে গিয়ে ইরাকে ভেতরে বসতে বলে। ইরা এবারেও চুপচাপ ভেতরের চেয়ারে বসল। ইরার পাশের চেয়ারে সৌম্য বসল। এরপরডান হাত উঁচিয়ে বলে,
– মামা গরুর মাংস দিয়ে এক প্লেট খিচুরি দাও তো।
ইরা সৌম্যকে দেখল। সৌম্য’র দু’হাতের শার্টের হাতা ছেড়ে দেয়া, বোতামগুলো-ও খোলা। ইরা জানে, সৌম্য খুব গোছানো আর টিপটাপ। এজন্য একটু অবাক হয়েছে। মৃদুস্বরে বলে,

– শার্টের হাতা অগোছালো রেখেছিস কেন?
সৌম্য তার শার্টের হাতার দিকে তাকালো। যখন মাথায় আসলো ইরা এখানে একা। মেয়েটি ভীষণ পাগলাটে টাইপ। টেনশনে আর কিছু মাথায় ছিল না। শার্ট গায়ে জড়িয়েছিল, এটাই তো বেশি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– এমনি।
এরই মাঝে সৌম্য’র সামনে খিচুরির প্লেট রাখে একটি ছেলে। সৌম্য প্লেটটি ইরার সামনে রেখে বলে,
– খেয়ে নে।
ইরা সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– তুই কিভাবে বুঝলি আমি খাইনি?
সৌম্য গম্ভীর স্বরে বলে,
– জানিনা। খেয়ে নে।
ইরা মিনমিন করে বলে,
– তুই খাবি না?

সৌম্য ইরার মলিন মুখপানে চেয়ে চুপ থাকে কিছুক্ষণ। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– কথা বলাস না। ভালো লাগছে না আমার। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।
ইরা মাথা নিচু নেয়। হাত ধুয়ে খিচুরির প্লেট থেকে একবার মুখে নিয়ে কয়েকবার চিবোতেই ইরা কেশে ওঠে। মেয়েটির কাশি থামে না। সৌম্য দ্রুত জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ইরার মুখের সামনে ধরলে ইরা সৌম্য’র হাত থেকেই ঢকঢক করে পানি খায়। পুরো গ্লাস ফাঁকা হয়ে গেলে সৌম্য হাতের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে ইরার দিকে তাকায়। ইরার চোখজোড়ায় পানি জমেছে। সৌম্য বেশ কিছুক্ষণ ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর মৃদুস্বরে বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ৩

– এসব জায়গা, এসব খাবার কোনোটাই তোর জন্য নয় ইরা।
কথাটা বলে সৌম্য দু’হাতের মাঝে তার মুখ রাখে। ওভাবেই করুণ সুরে ডাকে,
– ইরাবতী?
ইরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সৌম্য’র দিকে। সৌম্য তাকে কখনো এভাবে ডাকেনি। তার ভাবনার মাঝেই সৌম্য আবারও একই সুরে বলে,
– আমাকে ভুলে যা ইরাবতী!
কথাটা শুনতেই ইরার চোখজোড়া বিন্দু বিন্দু জলকণায় ভরে ওঠে। যেন টোকা দিলেই টপটপ করে মেঘবিনে বৃষ্টি ঝরবে।

অন্তঃদহন পর্ব ৫