অন্তঃদহন পর্ব ৪৮

অন্তঃদহন পর্ব ৪৮
DRM Shohag

সন্ধ্যা টেবিলের উপর থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়িয়েছে৷ ফোন চেক করলে আকাশের পাঠানো মেসেজটিতে একবার চোখ বুলায়,
– বে’য়া’দ’ব মেয়ে! আমার হক ন’ষ্ট করছ তুমি। থা’প্প’ড় কিন্তু একটাও মাটিতে পড়বে না। বি কেয়ারফুল!
আকাশের মেসেজটি পড়ে সন্ধ্যার হাসি পায়। ঠোঁট টেনে একটুখানি হাসল। আকাশকে রিপ্লে করে,

– দেশে এসে নিজের হক নিজে বুঝে নিন। তাছাড়া যাদের জামাই বিদেশ থাকে, তারা বেশিরভাগ প’র’কী’য়া’য় লিপ্ত হয়। তাই আমাকে কেয়ারফুল হতে না বলে আগে আপনি কেয়ারফুল হন।
আকাশ ফোনে নোটিফিকেশন পেয়ে ফোন চেক করে। সন্ধ্যার মেসেজে নজর করলে, তার রা’গের মাত্রা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়। আর নিতে পারছে না এই মেয়েকে। তার সন্ধ্যামালতী প’র’কী’য়া করবে মানে কি? এপাশ-ওপাশ পায়চারি করে আর চোয়াল শ’ক্ত করে টাইপ করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– এ্যাই মেয়ে এ্যাই আমাকে চেনো তুমি?
সন্ধ্যার থেকে রিপ্লে আসে,
– না তো। কে আপনি?
আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। কি পরিমাণ বে’য়া’দ’ব। তাকে না-কি চেনেনা। দু’দিনে তাকে ভুলে যাচ্ছে। রে’গে বোম হয়ে যায়। মেসেজ লেখে,
– বে’য়া’দ’ব মেয়ে। তোর জ’ম আমি।
লেখাটি সন্ধ্যার নম্বরে সেন্ড করে ফোন মুঠো করে ধরে আকাশ। তার পায়চারি থামেনি বরং রা’গের প্রভাবে আরও খানিক বাড়লো। নাহ! আর সম্ভব হচ্ছে না নিজেকে দমানো। রে’গে-মেগে হাতের ফোন উল্টোদিকে ছুড়ে মা’রে।
তখন-ই অরুণ আকাশের ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে নেয়। দরজার সামনে দাঁড়াতেই আকাশের ছুড়ে ফেলা ফোন তার দিকে ধেয়ে আসে। এসেছে তো এসেছে, একদম জায়গা মতো। অরুণ দু’হাতে মেইন জায়গা চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে। অরুণের চেঁচানোয় আকাশ ঘাড় বাঁকিয়ে রে’গে তাকায় অরুণের দিকে। এমনিতেই মাথা গরম, তার মধ্যে এ এসে প্যাঁ পোঁ শুরু করছে। অরুণকে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বিরক্তি কণ্ঠে বলে,

– কি প্রবলেম? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিস না?
অরুণ কটমট চোখে তাকালো আকাশের দিকে। আকাশ বোধয় বুঝল অরুণের অবস্থা দেখে। থমথমে মুখে তাকায় অরুণের দিকে। এগিয়ে এসে বলে,
– বেশি লেগেছে না-কি?
অরুণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রে’গে বলে,
– আমার ভবিষ্যতের দিকে এভাবে হাত বাড়াতে পারলি?
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,

– কে’টে ফেলে দে। তাহলে আর কেউ হাত বাড়াবেনা। এমনিতেও অনামিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন এটা দিয়ে আর কি করবি?
অরুণ হতভম্ব চোখে তাকায়। এটাই শোনার বাকি ছিল। অরুণ কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে,
– তুই আমার বন্ধু? ছিঃ ছিঃ! ভাবতেই আমার ল’জ্জা লাগছে।
আকাশ মেঝেতে পড়ে থাকা তার ফোন উঠিয়ে বেডের উপর উল্টো হয়ে শুয়ে চোখবুজে বলে,
– ভাবিস না।
অরুণ অসহায় কণ্ঠে বলে,

– তুই বিদেশে থাক বাবা। আমি কালকেই বাংলাদেশে চলে যাচ্ছি।
আকাশ অরুণের দিকে তাকিয়ে রে’গে বলে,
– তোর পা কাটতে বোরিং লাগবে আমার।
অরুণ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। কি সুন্দর করে একেকটা বোমা ফাঁটা কথা বলছে! অরুণ ধীরে ধীরে হেঁটে এসে আকাশের পাশে শুয়ে নাটকের ভঙ্গিতে বলে,
– আল্লাহ গো তুমি আর কাউকে এমন বন্ধু দিও না আল্লাহ!
আকাশ পাত্তা দিল না। চোখ বুজে রইল। আর ফোন চেক করল না। ফোনের ওইপাশে যে আছে, ওকে তো হাতের কাছে পাচ্ছে না। বে’য়া’দ’ব মেয়ে বে’য়া’দ’বি মেসেজ দিয়ে তার মাথা পুরো গরম করে দিচ্ছে। বিড়বিড় করে,
– একবার শুধু বাংলাদেশে ফিরি সন্ধ্যামালতী! সব সুদে-আসলে ফেরত দিয়ে দিব।

আকাশের পাঠানো শেষ মেসেজ, – বে’য়া’দ’ব মেয়ে তোর জ’ম আমি।’
লেখাটির দিকে চেয়ে সন্ধ্যা তখন থেকে থম মে’রে বসে আছে। আকাশের থেকে এমন ধারার কথা পেয়ে সন্ধ্যার খারাপ লাগছে। আকাশ তাকে সোনা বউ ছাড়া ডাকতো না। আর সেখানে আজ এরকম ব্যবহার পেয়ে সন্ধ্যার কাঁদতে ইচ্ছে করল। আকাশ দেশে আসছে না, তার সাথে ঠিক করে কথা বলছে না। সন্ধ্যার মনে হচ্ছে সে অপারেশন না করালেই ভালো হত। কথা না বলতে পারলেও আকাশের কত ভালোবাসা পেত! আজ মনে হচ্ছে জীবনে হাজারটা অপূর্ণতা থাকলেও শুধু ভালোবেসে ভীষণ সুখী হওয়া যায়। যেমনটা সন্ধ্যা বোবা থেকে আকাশের এতো এতো ভালোবাসা পেয়ে ছিল। কিন্তু এখন কথা বলে, আকাশকেই কাছে পায়না। এই কথা বলার চেয়ে বোবা হয়ে থাকাই ভালো ছিল। কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার দু’চোখ বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।

অরুণ বেডের উপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে। আকাশ বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে কে জানে! ঘড়িতে সময় দেখল, সকাল ১০ টা। রাতের কথা মনে পড়তেই অটোমেটিক বা হাত প্রায়ভেট জায়গায় চলে গেল। শুধু আল্লাহ একটু দয়া করেছে বলে এরকম বন্ধু থাকা সত্ত্বেও সে বেঁচে আছে। অরুণ চোখমুখ কুঁচকে নেয়।
এরপর বেড থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলে অলিভিয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয়। এগিয়ে এসে বলে,
– কিছু বলবে অলিভিয়া?

অলিভিয়ার ধ্যান নেই। তার দৃষ্টি একদিকে স্থির। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। বাড়ির দরজা খোলা দেখে বুঝল, আকাশ হয়ত দরজা খুলে রেখেছিল এজন্য অলিভিয়া ভেতরে এসেছে। কিন্তু এ দেখছে টা কি? অলিভিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালে দেখল আকাশ পা ডিভানের উপর রেখে, একদম ডিভানের উপর বসেছে। হাতে গিটার। গিটারটি তার। আকাশ মাত্র গিটারে টুংটাং শব্দ তোলে। অরুণ কোমরে হাত রেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– আমার ভবিষ্যৎ গিটারের বাতি নিভিয়ে, আসল গিটারে আলো জ্বালাচ্ছিস বে’য়া’দ’ব!
অলিভিয়া গালে হাত দিয়ে হেসে বলে,
– আকাশ কি কিউট!
অরুণ শুনতে পায়ে শব্দ করে বলে ওঠে,
– একটু পর তোমার মুখ থেকে বের হবে সাউট!
অরুণের কথায় অলিভিয়া ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মানে?

গিটারে চলানো আকাশের আঙুল থেমে যায়। এদিক ফিরে অরুণ আর অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে বিরক্ত হলো। অতঃপর ডিভানের উপর থেকে নেমে অরুণ আর অলিভিয়ার পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে গেল। অলিভিয়া আকাশের পিছু পিছু যেতে নিলে অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তুমি আকাশের পিছে ঘুরঘুর করছ কেন?
অলিভিয়া বিরক্ত হয়ে বলে,
– তোমার প্রবলেম কি? আমার ভালো লাগছে।
অরুণ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
– উষ্টা খেয়ে আবার ম্যা ম্যা করতে এসো না।
অলিভিয়া বিরক্ত হলো। তবে কিছু বলল না। দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

অলিভিয়া বাইরে এসে দেখল আকাশ রাস্তার এক পাশে বা পা সামান্য মেলে রেখে, ডান পা তার চেয়ে আরেকটু ভাঁজ করে রেখে বসে গিটারে টুংটাং করে সুর তুলছে। অলিভিয়া তার প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত ক্যামেরা অন করে আকাশের দিকে তাক করে। মেয়েটা আকাশকে যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। কি সুন্দর গিটার বাজায় ছেলেটা! সাথে গান তো আছেই। দেখতেও মারাত্মক!
প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় বাড়ির ভেতর থেকে অরুণ বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে আকাশ গান গাওয়া ছেড়ে শুধু গিটারে সুর তুলছে। অরুণ অলিভিয়াকে আকাশের দিকে ক্যামেরা তাক করে ধরে রাখতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,

– তুমি আবার কি করছ?
অলিভিয়া ফোনের ব্যাক বাটনে ক্লিক করে ভিডিওটি অন করে বলে,
– দেখ অরুণ, তোমার বন্ধু আকাশ কি সুন্দর করে গিটারের তালে তালে গান গায়! আমি তো একদম ফিদা!
অরুণ হতাশ কণ্ঠে বলে,
– আরে অলিভিয়া আকাশের বউ আছে। তুমি তোমার ফিদা এবার আটকাও।
অলিভিয়া অবাক হয়ে তাকায় অরুণের দিকে। বলে,
– মানে? তুমি তো সিঙ্গেল। তোমার বন্ধু তাহলে বিবাহিত হয় কিভাবে?
অরুণ বলে,
– আমার সাথে আমার বন্ধুর কি কানেকশন? আজব! ও বউয়ের সাথে ঝামেলা করে বিদেশে এসে বসে আছে। দু’দিন পর……
মাঝ থেকে অলিভিয়া বলে,

– ঠিকআছে ঠিকআছে। আমার-ও অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল। আমি এডজাস্ট করে নিতে পারব।
অরুণ কেশে ওঠে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।বিড়বিড় করল,
– আকাশের উস্টা না খেয়ে এ থামবে না।
এরপর কিছু একটা ভেবে একটু হেসে বলে,
– হ্যাঁ দেখ, তুমি আকাশকে পটাতে পারো কি-না! তোমার জন্য অগ্রিম অভিনন্দন।
অলিভিয়া হেসে বলে,
– থ্যাঙ্কিউ অরুণ। তুমি অনেক ভালো।
অরুণ হাসল। সে বাড়ি বসে একা একা আকাশের মার খাচ্ছে! আরেকজন সঙ্গী হলে মন্দ হয় না!
এরপর অলিভিয়াকে আকাশের গান গাওয়া ভিডিওটি তাকে সেন্ড করতে বললে অলিভিয়া কজটি করে দেয়। অরুণ আকাশের গাওয়া গানের ভিডিও আকাশের আইডিতে আপলোড করে দেয়। উপরে লিখেছে,
– মুই সিঙ্গেল পোলা!
এরপর ভিডিওর লিংক সন্ধ্যার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয়। কাজ শেষে অরুণ হাসল। এইবার আকাশ ঠ্যালা বুঝবে। একজন রা’গ দেখালে আরেকজন ঠান্ডা হয়। এবার সন্ধ্যা-ও একটু-আধটু রা’গুক। এই বাতাস বাবুকে বউয়ের রা’গ দেখার-ও সুযোগ করে দিক।

বাংলাদেশে ঘড়ির কাটায় রাত ৮ টা বেজে ৩০ মিনিট। সন্ধ্যা মনমরা হয়ে বিছানার উপর বসে ছিল। কিছুই ভালো লাগেনা তার। পাশ থেকে ফোন নিলে সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে একটি নোটিফিকেশন পেয়ে সন্ধ্যা সেখানে ক্লিক করলে আকাশের আইডিতে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা খেয়াল করল, এটা আকাশের আইডি। ১০ মিনিট আগে আকাশের আইডিতে একটি ভিডিও আপলোড হয়েছে। সন্ধ্যা ভিডিওটির উপর ক্লিক করলে ভিডিওটি চালু হয়।
আকাশ একটি ফাঁকা রাস্তার ধারে বসে,
গিটারে সুর তুলে গাইছে,
কন্যার চিরল বিরল চুল,তাহার কেশে সন্ধ্যা ফুল
কন্যার চিরল বিরল চুল,তাহার কেশে সন্ধ্যা ফুল,
সেই ফুল পানিতে ফেইলা, কন্যা করল ভুল,
কন্যা ভুল করিস না, কন্যা ভুল করিস না,
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না।

এরপর ভিডিওটি বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা অবাক হয়ে আকাশের গলায় গাওয়া গানটি শুনলো। এই গান তার আগে কখনো শোনা হয়নি। আজকেই প্রথম শুনলো। খুব বুঝল, গানটি আকাশ তাকে ডেডিকেট করে গেয়েছে। অবাক হলো, আকাশের মুখে বলা সন্ধ্যা ফুল নাম শুনে। আর শেষ লাইনে যে বলল,
আকাশ ভুল করা মেয়ের সাথে কথা বলবে না। সে তো ভুল করেছে। তবে কি আকাশ সত্যিই তার সাথে আর কথা বলবে না? কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার দমবন্ধ লাগলো। সন্ধ্যার মনে আছে, অপারেশনের দিন সকালে আকাশ তাকে সন্ধ্যামালতী ফুলের মালা এনে দিয়েছেল। বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে আকাশের দেয়া সেই মালা বের করে দেখল, ফুলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা এই শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলোর দিকে অপলক চেয়ে রইল। ফুলের সৌন্দর্য হারিয়েছে অথচ সন্ধ্যার চোখে মুগ্ধতার রেশ একটুখানি-ও কম নয়। কি করে কমবে মুগ্ধতা? এখানে যে তার আকাশের হাজারো ভালোবাসা মিশে আছে। আকাশ নিজ হাতে তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। আর তারপর সে আকাশের অবাধ্য হয়েছে বলে আকাশ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যার ভীষণ ক’ষ্ট হয়। আকাশ কবে বুঝবে আকাশ তাকে এভোয়েড করলে, আকাশ তার থেকে দূরে থাকলে তার ভীষণ ক’ষ্ট হয়?
এসব ভাবতে গিয়ে সন্ধ্যার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা বেদনার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে,

– আপনি আসুন প্লিজ!
সন্ধ্যা নিজেকে সামলে হাত বাড়িয়ে ফোন নেয়। আবার-ও আকাশের পোস্টটি দেখল। ক্যাপশনে ‘মুই সিঙ্গেল পোলা’ লেখাটি পড়ে সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশ সিঙ্গেল হলে সে কে? সন্ধ্যার আরও কান্না পায়। আকাশ তাকে ভুলে যাচ্ছে না-কি! এমন হলে সে ম’রেই যাবে। কথাটা ভেবে সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে উঠল। ডান হাতে চোখ মুছে পোস্টটির কমেন্ট বক্স চেক করলে দেখল, শত শত কমেন্ট। খুব কম ছেলেদের কমেন্ট। মেয়েদেরই বেশি। সন্ধ্যা বুঝল, আকাশ সাবেক সভাপতি ছিল বলে তার পরিচিতি মোটামুটি অনেক। সন্ধ্যা কমেন্টগুলো পড়তে লাগলো,

– ভীষণ সুন্দর আপনার গানের গলা!
– আপনি দেখতে যেমন সুন্দর, গানের গলা আরও সুন্দর!
– আপনি পুরাই আ’গু’ন সভাপতি মশাই!
– আপনি এত্তো সুন্দর!
– ক্রাশ খেয়ে গেলাম!
লাস্ট কমেন্ট বেহিসাব। আর কমেন্ট পড়ার ধৈর্য হলো না সন্ধ্যার। এই কয়েকটা কমেন্ট পড়েই সন্ধ্যা রে’গে গেল। কত্ত বড় সাহস, তার আকাশের দিকে এই শাঁকচুন্নিগুলো কিভাবে নজর দিচ্ছে! সন্ধ্যা রা’গে ফোঁসফোঁস করতে করতে একজনকে রিপ্লে করল,

– বে’য়া’দ’ব শাঁকচুন্নি! উনি আমার স্বামী। নজর দিলে তোর চোখ তুলে নিয়ে টেনে টেনে মার্বেল থেকে টেনিস বল বানিয়ে খেলোয়ারদের হাতে খেলতে দিয়ে আসব। অ’স’ভ্য মেয়ে কোথাকার!
একজনকে রিপ্লে দিয়ে সেই লেখা কপি করে আরও অনেকজনকে পেস্ট করে দিল সন্ধ্যা। এরপর ফোনের দিকে তাকিয়ে থম মে’রে বসে থাকলো। লেখাটি পড়ে সন্ধ্যার নিজের নিজেকেই অদ্ভুদ লাগলো। এরকম লজিকলেস কথা সে এই জন্মে শোনেনি। অথচ সে নিজেই বলে দিল! ভাবলো, বলেছে ভালো করেছে। এই মেয়েগুলো তার স্বামীর দিকে এভাবে নজর দিচ্ছে কেন? এত্তো রা’গ লাগছে তার।

এদিকে আকাশ এখন-ও রাস্তায় বসে গিটারে সুর তুলছে। সন্ধ্যার অপারেশনের আগের দিন রাতে তার সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে গিটারের তালে কয়েক লাইন গান গেয়েছিল বলে, তার সন্ধ্যামালতী হেসেছিল। ভীষণ খুশি হয়েছিল। আকাশের আজ-ও ভীষণ ইচ্ছে করল, সন্ধ্যাকে তার কোলে বসিয়ে ঠিক সে রাতের মতো করে গিটারের সুরে কয়েক লাইন গান গেয়ে সন্ধ্যাকে শোনাতে। কিন্তু….
আকাশের মন ভার হয়। সেদিন তার সন্ধ্যামালতী যদি অপারেশন থিয়েটার থেকে না বের হতো, তবে আজ কি হত! আকাশ এসব ভাবতে পারেনা। সন্ধ্যামালতী কতবড় দুঃসাহস দেখিয়েছে! এটা কি সন্ধ্যামালতী একবার-ও বুঝেছে? সে কি জানে আকাশ তার সন্ধ্যামালতী ছাড়া ঠিক কতটা নিঃস্ব? জানেনা। জানলে নিশ্চয়ই তার প্রাণকে নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করত না!

কথাগুলো ভেবে আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গিটারে চালানো হাত থেমে যায়। দৃষ্টি খোলা রাস্তায়। মেয়েটা এতো চালাক কেন! সিসিটিভি ফুটেজ অকেজ করে রেখেছে। সে আর দেখতে পারছে না। আগে জানলে আসার আগে পুরো রুমের আনাচে-কানাচে ক্যামেরা লাগিয়ে রেখে আসত। এখন পারবে না এমন নয়। তার পরিচিত অনেকেই আছে। কল করলেই তার বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু সে ইনসিকিউর ফিল করছে। কোনো অপরিচিত বাইরের ছেলেকে সে ওই বাড়ি পাঠাতে চায় না। যেখানে তার সন্ধ্যামালতী আছে, অথচ সে নেই, সেখানে অন্যকাউকে পাঠানোর প্রশ্নই আসেনা। তার ক’ষ্ট টুকুই মানলো। রা’গলো-ও খানিক সন্ধ্যার উপর। সে সন্ধ্যাকে একটা ব্যাপার বোঝাতে গিয়ে, এই চালাক বউটা তাকে আরও ক’ষ্ট দিচ্ছে। আর নেয়া যায় না। ইচ্ছে করছে দৌড়ে বাংলাদেশে চলে যেতে। কিন্তু সে যাবে না, মানে যাবে না। সে নিজেই নিজেকে টলাতে পারলো না। অসহায় কণ্ঠে বিড়বিড় করে,

– আমার সন্ধ্যামালতী তুমি।
এটুকু বলে থামে। সন্ধ্যার কারণেই তো সে তার সন্ধ্যামালতীকে দেখতে পারছে না। কথাটা ভাবতেই
শ’ক্ত কণ্ঠে আওড়ায়,
– বে’য়া’দ’ব মেয়ে একটা। ইচ্ছে করছে থা’প’ড়ে বে’য়া’দ’বি, ব’দ’মা’ইশি সব ছুটিয়ে দিতে।
পকেটে ফোন। অনবরত নোটিফিকেশনের অ’ত্যা’চারে আকাশ পকেট থেকে ফোন বের করল। ফোন অন করে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গেলে দেখল, তার গাওয়া গানের ভিডিও তার আইডিতে ছাড়া। সে সিঙ্গেল এই ক্যাপশনটা-ও খেয়াল করল। বিরক্ত হলো। এই কাজ অরুণের ছাড়া আর কারো নয় বুঝল। কমেন্ট অপশনে সন্ধ্যামালতী নামের আইডি থেকে করা কমেন্ট উপর থেকেই উঠে আছে। আকাশ দ্রুত কমেন্ট অপশনে ক্লিক করে সন্ধ্যামালতী নামের আইডি থেকে রিপ্লে দেয়া কমেন্টগুলোয় নজর বুলায়, যেখানে লেখা,

– বে’য়া’দ’ব শাঁকচুন্নি! উনি আমার স্বামী। নজর দিলে তোর চোখ তুলে নিয়ে টেনে টেনে মার্বেল থেকে টেনিস বল বানিয়ে খেলোয়ারদের হাতে খেলতে দিয়ে আসব। অ’স’ভ্য মেয়ে কোথাকার!
একই মেসেজ অনেকজনকে সেন্ড করা। আকাশ মেসেজগুলো পড়ে কেশে উঠল। এটা যে সন্ধ্যার আইডি, এটা সে বুঝল। কিন্তু এই মন্তব্য দেখে কি রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছে না। বা হাতে ফোন ধরে রাখা। ডান হাত মুখের উপর রেখে হঠাৎ-ই হেসে ফেলল। বউয়ের এমন রূপ ফার্স্ট টাইম দেখল। এতো ভালো লাগে আগে জানা ছিল না। বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,

– এসব কি করছ তুমি সন্ধ্যামালতী? আমাকে দুর্বল করছ! জ্বালিয়ো না বউ! ভুল করলে শা’স্তি পেতে হয়। তোমাকে শা’স্তি দিতে দাও।
আকাশ নিজেকে সামলে নেয়। পোস্টটি ডিলিট করতে চেয়েছিল, কিন্তু করল না। বে’য়া’দ’ব বউ টা তাকে দেখতে না দিয়ে জ্বা’লাচ্ছে। এবার নিজেও জ্ব’লুক। মনে মনে অরুণকে একটা ধন্যবাদ দিল। তখন-ই তার পাশে হাঁটু গেড়ে অলিভিয়া বসে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলে,
– Hi Akash! I’am Olivia. Wanna be friends?
আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায় অলিভিয়ার দিকে। মুহুর্তেই চোখেমুখে বিরক্তি এসে যায়। শুধু চেহারা আর গলার ভয়েজ মেয়ে। আর সব ছেলে। একে দেখলেই চটকানা দিতে ইচ্ছা করে আকাশের। আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

– No.
অলিভিয়া ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। থমথমে মুখে তাকায়। দ্রুত নিজেকে সামলে বলে,
– আমি একটু ছোট হলেও অরুণ আমার ফ্রেন্ড। তুমিও আমার ফ্রেন্ড হবে, প্লিজ!
আকাশ বিরক্ত হলো। কিছু বলল না। গিটার হাতে নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। দু’পা এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা ভাবনায় আসলে আকাশের পা থেমে যায়। একটু হাসল। এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে পিছিয়ে এসে অলিভিয়ার সামনে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,

– অলিভিয়া রাইট?
অলিভিয়া একই জায়গায় বসে আছে। মেয়েটার মন খারাপ হয়েছে। আকাশের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে অলিভিয়া দ্রুত মাথা তুলে তাকায়। ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়। আকাশ সামনের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলে,
– আমার সাথে এসো।
অলিভিয়ার চোখ চকচক করে ওঠে। সময় ন’ষ্ট না করে দ্রুত উঠে আকাশের পিছু পিছু যায়। আকাশ অরুণের সামনে গিয়ে তার ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,

– দু’টো পিক উঠিয়ে দে।
অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশের কথাটা তার জীবনের প্রথম শোনা এক অদ্ভুদ কথা মনে হচ্ছে। আকাশ মেয়ে মানুষের মতো তাকে ছবি তুলে দিতে বলছে কেন? আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– কালকের ডোজে হয়নি মনে হচ্ছে!
অরুণ কেশে উঠল। দ্রুত আকাশের হাত থেকে ফোন নিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– তুই আমার একমাত্র শ’ত্রু!
আকাশ পাত্তা দিল না। দু’পা পিছিয়ে এসে মৃদুস্বরে বলে,

– অলিভিয়া আমার পাশে এসে দাঁড়াও।
অলিভিয়া অবাক হলো। আকাশ প্রথমে ওভাবে কথা বলে এখন আবার এতো সুন্দর করে কথা বলছে কেন! সবচেয়ে বড় কথা, এতো দ্রুত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পিক উঠাতে চাইছে। অলিভিয়া ভীষণ খুশি হলো। আকাশের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আকাশকে ঘেঁষে দাঁড়াতে নিলে আকাশ ধমকে বলে,
– দূরে থাকো।
অলিভিয়া ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। আকাশ একটু পিছিয়ে গিয়ে এক বাহু অলিভিয়ার পিছনে রেখে দাঁড়ালো। সামনে থেকে মনে হচ্ছে,, আকাশ, অলিভিয়া একদম ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটি আকাশ ইচ্ছে করেই করল। যেন বোঝা যায় তারা দু’জনে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। অলিভিয়া একটা ধমকে খেয়ে চুপসে গেলেও এখন হাসছে।
ওদিকে অরুণ হা করে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে আকাশ মাত্র মঙ্গল গ্রহ থেকে এক অদ্ভুদ প্রাণী রূপে নেমে এসেছে, আর সে শুধু অবাক হয়ে আকাশকে দেখছে। অলিভিয়া হেসে বলে,

– অরুণ আমাদের পিক উঠাও।
অরুণের মনে হচ্ছে সে এই জগৎে নেই। আকাশ অরুণকে হা করে চেয়ে থাকতে দেখে রে’গে ডাকে,
– অরুণ?
অরুণ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঢোক গিলে,
– আরে অলিভিয়া এটা আকাশ নয়। বিশ্বাস কর। বাঁচতে চাইলে চলে এসো।
অলিভিয়া অবাক হয়ে বলে,

– মানে?
অরুণ কিছু বলার আগেই আকাশ ডান পা উঁচু করে পা থেকে জুতো খুলতে নিলে অরুণ কথা ঘুরিয়ে দ্রুত বলে ওঠে,
– এই তুলছি তুলছি। সোজা হয়ে দাঁড়া বাবু। একটু প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম।
আকাশ পা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অরুণ ক্যামেরায় দু’টো ক্লিক করে ফোন আকাশের দিকে এগিয়ে দেয়। আকাশ ফোনটি নিলে সাথে সাথে অলিভিয়া আকাশের দিকে চেয়ে বলে,
– দেখি পিক কেমন উঠেছে?

আকাশ বিরক্তি নিয়ে অলিভিয়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে অলিভিয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে আকাশের হাত ধরে ফেলে। একে তো মেয়েটা বিদেশি কালচারে বড় হয়েছে। আকাশের এটুকু আশকারায় সে এটাকে একদম পানির মতো সহজ ভেবেছে। কিন্তু আকাশ এটাকে পানির চেয়েও সহজ ভাবলো না। বরং তার মনে হলো, মারাত্মক কঠিন এক অকাজ ঘটিয়েছে অলিভিয়া। রা’গে আকাশের কপালের র’গ ফুলে ওঠে। চোখ বুজে মাথাটা ডানদিকে সামান্য কাত করে। এরপর চোখের পলকে ঘুরে এসে অলিভিয়ার ডান গালে ক’ষিয়ে এক থা’প্প’ড় মে’রে দেয়।
অলিভিয়া পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। গালে হাত দিয়ে হতভম্ব চোখে তাকায়। অরুণ থমথমে মুখে চেয়ে আছে। আকাশের এখনকার বিহেব তার কাছে নরমাল লাগলো। এতোক্ষণের কাহিনী তার কাছে অবাস্তব লাগছিল৷
আকাশ ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে রে’গে বলে,

– আমার আশেপাশে দেখলে এক আছাড় মে’রে সব নাড়িভুঁড়ি বের করে, বাংলাদেশে গিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসব।
অলিভিয়া ঢোক গিলল। অসহায় কণ্ঠে বলে,
– একটু আগেই তো ভালো করে কথা বললে। আর এখন……
আকাশ বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
– একটু আগে কাজ ছিল। এখন কাজ শেষ।
কথাটা বলে আকাশ এখানে আর দাঁড়ালো না। ফোন পকেটে রেখে ডান হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে যায়। বা হাতে গিটার একটু উপর দিকে ছুঁড়ে আবার-ও কেচ ধরে নেয়।
অরুণ অলিভিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে বলে,

– কেমন লাগলো?
অলিভিয়ার গালে এখনো হাত। কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলে,
– মজা দেখছ তুমি? তোমার বন্ধু একটা স্বা’র্থ’পর।
অরুণ দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলে,
– সেটা তো আমি জানিই। আমার একজন সঙ্গী পেয়ে ভালোই লাগছে।
অলিভিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মানে?
অরুণ কিছু বলল না। সে-ও বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,
– আরও ডোজ পেতে চাইলে আমার বাড়িতে তোমার আমন্ত্রণ রইল অলিভিয়া!

আকাশ ঘরে এসে তার আর অলিভিয়ার উঠানো দু’টো পিক সন্ধ্যার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল। সাথে লিখল,
– ছোট বউ হিসেবে আমার সাথে মানাবে? যদিও রে’গে আছি তোমার উপর। তবে হিসাব ক’ষলে যেহেতু তুমি আমার বড় বউ হও। তাই তোমার ডিসিশনের 50% প্রায়োরিটি পাবে।
মেসেজটি সেন্ড করে আকাশ হাতের গিটার রেখে ডিভানের উপর বসল। দৃষ্টি ফোনের দিকে। মেসেজটি সিন হয়েছে। অর্থাৎ সন্ধ্যা মেসেজটি দেখেছে। আকাশ দেখতে চাইছে সন্ধ্যা কি রিপ্লে দেয়। সে আশা করছে, সন্ধ্যা সেই মেয়েদের যেমন একটি রিপ্লে দিয়েছিল, তেমন কিছু রিপ্লে করবে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেপ্টে।

ফোনের অপর পাশে সন্ধ্যা আকাশের পিক আর মেসেজ দেখে স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছে। এতো ক’ষ্ট কখনো হয়নি। যখন সে অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছিল, তখন ভেবেছিল সে আকাশের বুকে না-ও ফিরতে পারে। তখন-ও এতো ক’ষ্ট হয়নি। তখন মনে হয়েছিল, সে ম’রে গেলেও আকাশ তারই থাকবে। কিন্তু এখন আকাশকে ঘেঁষে এতো সুন্দর একটা মেয়ে সাথে আকাশের এরকম মেসেজ দেখে সন্ধ্যার ছটফট লাগে, দমবন্ধ লাগে। দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে। হাসফাস করে। চোখ বুজে নিলে, বন্ধু চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ফোঁপালো বসে বসে। আকাশ এরকম কিছু করলে তার কি হবে? সন্ধ্যা ভাবতে পারেনা। আকাশ এতো ক’ষ্ট কেন দিচ্ছে তাকে?
সন্ধ্যা অনেকক্ষণ যাবৎ বসে বসে কাঁদলো। এরপর নিজেকে সামলে দু’হাতে চোখমুখ মুছে নিয়ে
তার বান্ধবী লামিয়ার কাছে কল করে। লামিয়া তার অপারেশনের কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছিল। মেয়েটা ভীষণ ভালো। অল্প কয়েক মাসের পরিচয়ে তাকে ভীষণ আপন মনে করে। লামিয়া কল রিসিভ করে বলে,

– কি অবস্থা তোর?
সন্ধ্যা কান্না গিলে নিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– স্বামী রা’গ করে বিদেশ চলে গেলে স্বামীকে দেশে ফিরিয়ে আনার উপায় কি লামিয়া?
সন্ধ্যার কথা শুনে লামিয়া শব্দ করে হেসে ওঠে। নিজেকে দমিয়ে বলে,
– আরে বাবা, তোর সভাপতির স্বভাব ন’ষ্ট এই উপাধি তো তুই এই শহরে পা রেখেই তোর স্বামীকে দিয়ে দিয়েছিলি। আর এখন সে বিদেশে গিয়েছে তোর কথা প্রুফ করার জন্য। সো, তুই তাকে ভুলে যা। আমার বড় ভাই পাত্রী খুঁজছে। তোকে আমার ভাই দেখলে অপছন্দ করবে না। আমার তো তোকে মারাত্মক পছন্দ। কাহিনী খতম।
সন্ধ্যার কান্না পায়। খুব করে চাইলো না কাঁদতে। কিন্তু সে পারলো না। ফুঁপিয়ে উঠল। ওপাশে লামিয়া অবাক হয়ে বলে,

– আরে তুই কাঁদছিস কেন? আমি মজা করলাম ইয়ার! তুই কালকে কলেজ আয়। আমি তোকে ৩০১ টা টিপস শিখিয়ে দিব। তারপর দেখবি তোর জামাই ফুরুৎ করে উড়ে এসেছে।
সন্ধ্যা লামিয়ার কথায় ভুললো না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
– উনি আমাকে ভুলে গিয়েছে।
লামিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এ্যাঁ? এতো তাড়াতাড়ি? ভালোবাসতেও টাইম নেয় না, ভুলতেও টাইম নেয় না। ভালোই ফার্স্ট তো!
সন্ধ্যা বিরক্ত হয়ে কল কেটে দেয়। অতিরিক্ত কথা বলে এই মেয়ে। সে একটা সমাধান চাইছে, আর ও তাকে আরও উল্টাপাল্টা কথা বলছে।
লামিয়া সন্ধ্যার নাম্বারে একের পর এক কল দিলেও সন্ধ্যা ফোনের দিকে আর তাকালোই না। দু’হাতে মুখ লুকিয়ে ফোঁপালো। তার ভীষণ ক’ষ্ট হচ্ছে। বুক ফেটে যাচ্ছে মনে হয়। আকাশের পাশে অন্য মেয়ে দাঁড়িয়েছে কেন? সে তো খুব সুন্দর নয়, আর এজন্য আকাশ বিদেশি সুন্দর মেয়ে দেখে তাকে ভুলে গেল? সন্ধ্যা ফোন হাতে নিয়ে কাঁপা হাতে টাইপ করে,

– আমি কালো, তাই আপনি ফর্সা মেয়ে পেয়ে আমাকে ভুলে যাচ্ছেন তাইনা? আমি আগেই জানতাম সুদর্শন পুরুষেরা কালো মেয়েদের বেশিদিন মনে রাখেনা।
মেসেজটি আকাশের নাম্বারে সেন্ড করে দেয়। বোকা সন্ধ্যা শুধু কয়েক মিনিটের ঘটনার কথা ভেবে কতবড় কথা বলে ফেলেছে নিজেও বুঝতে পারল না।

অপরপাশে আকাশ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যার মেসেজের অপেক্ষায় ছিল। না ছিল ক্লান্তি আর না বিরক্তি। হাসছিল ছেলেটা। অথচ সন্ধ্যার মেসেজ দেখে মুহূর্তেই মুখাবয়ব গম্ভীর হয়ে যায়। চো’য়াল শ’ক্ত হয়ে যায়। ডিভানের উপর থেকে উঠে দাঁড়ায়। রা’গে কাঁপছে মনে হলো। পায়চারি শুরু করেছে ইতোমধ্যে। এই মেয়ে বোকা নাকি গাধা। না-কি এই বে’য়া’দ’ব বউটা তাকে বুঝবেনা বলে পণ করে রেখেছে? ওকে বোঝানোর জন্য সে এখানে ক’ষ্ট করে ম’র’ছে। আর এই বউ নামের প্যারা তাকে ভুল বুঝেই যাচ্ছে।
এক পর্যায়ে আকাশ ডিভানে একটা লাথিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
– সন্ধ্যামালতীর বাচ্চা। তুই আজ আমার হাতের কাছে থাকলে নিশ্চিত ম’র’তি!
অরুণ আকাশের রুমে প্রবেশ করতে গিয়ে থেমে যায় আকাশকে এমন রে’গে ফাঁপা হয়ে থাকতে দেখে। এর আবার কি হলো?

সৌম্য সন্ধ্যা কি করছে দেখতে এসেছিল। ঘরে এসে সন্ধ্যাকে মাথা নিচু করে ফোঁপাতে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসে। সন্ধ্যার সামনে বসে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– বোনু তুই কাঁদছিস?
সন্ধ্যা মাথা তুলল না। সৌম্য অস্থির কণ্ঠে বলে,
– বোনু তুই আবার কাঁদছিস কেন? আকাশ ভাইয়াকে একটু টাইম দে।
সন্ধ্যা মাথা তুলে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলে,
– হ্যাঁ তোমার আকাশ ভাইয়াকে আমি শুধু টাইম দিতে থাকি। আর উনি আমাকে ভুলে গিয়ে ওখানে আরও ১০০ টা বিয়ে করুন। তোমরা সবাই এটাই চাইছ আমি বুঝে গেছি।

সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার কথা সাথে সন্ধ্যার চোখমুখের অবস্থা দেখে সৌম্য ঢোক গিলল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। সিরিয়াস কিছু না-কি! আকাশের জন্যই তো কাঁদছে। সৌম্য কি করবে? সে অরুণ ভাইয়ার থেকে নাম্বার নিয়ে আকাশকে অনেকবার কল করেছিল। আকাশ ফোন উঠায় না। কি করবে এখন? সৌম্য বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে আকাশের নাম্বারে কল করল। যদিও জানে কল রিসিভ হবেনা, তবুও করল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, প্রথমবারেই কল রিসিভ হয়। সৌম্য খুশি হলো। ফোন লাউড দিয়ে আকাশকে সালাম দিয়ে দ্রুত বলে,

– আকাশ ভাইয়া প্লিজ! একটা কথা শুনুন।
আকাশ রে’গে কয়েকটা কথা বলতে চাইছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো, তার বউয়ের মাথায় যেন একটু ঘিলু দেয়া হয়। তবে সৌম্য’র কথায় চুপ হলো। তাছাড়া ফোঁপানোর আওয়াজ পাচ্ছে একটা। সন্ধ্যা কাঁদছে না-কি! ক্যামেরাটা-ও নেই। কিছু দেখতেও পারছে না। মে’জা’জ খারাপ লাগে। সৌম্য গলা ঝেড়ে বলে,
– আপনি যেভাবে বলবেন, সেভাবেই ক্ষমা চাইব। আপনি দেশে আসুন প্লিজ আকাশ ভাইয়া! বোনু কাঁদছে।
আকাশ থমথমে মুখ করে নেয়। প্রায় এক মিনিট চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ৪৭

– কাঁদতে দাও। পানি জমানোর জন্য দেশি বালতি না হলে বিদেশি বালতি পাঠানোর ব্যবস্থা করব, চিন্তা নেই।
আকাশের কথা শুনে সৌম্য হতভম্ব হয়ে যায়। সে হাসবে না কাঁদবে সেটাই বুঝতে পারছে না।
ফোন লাউডে থাকায় সন্ধ্যা আকাশের কথা শুনতে পায়। মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এর মাঝে আকাশের কথা শুনে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। সে কাঁদছে আর আকাশের কোনো কেয়ার-ই নেই? সন্ধ্যার আরও খারাপ লাগলো। দু’চোখ থেকে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এবার ক’ষ্টের সাথে সন্ধ্যার ভীষণ রা’গ হলো আকাশের উপর। মুখ শ’ক্ত করে বিড়বিড় করে,
– কালকে যদি আমি কলেজ এর সব ছেলের সাথে বন্ধুত্ব না করেছি, তবে আমার নাম-ও সন্ধ্যা নয়। ন’ষ্ট পুরুষ কোথাকার!

অন্তঃদহন পর্ব ৪৯

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here