অন্তঃদহন শেষ পর্ব
DRM Shohag
সৌম্য ইরাকে কোলে নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে হসপিটালের ভিতর প্রবেশ করে। নিয়াজ মাত্র হসপিটাল থেকে বেরোচ্ছিল, তখন-ই সৌম্যকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে নিয়াজ অবাক হয়৷ সে কিছু বলার আগেই সৌম্য ভাঙা গলায় বলে,
– আমার ইরাবতীকে বাঁচিয়ে দিন ভাইয়া। ওকে কে যেন গু’লি মে’রে দিয়েছে। আর আর ওর মুখের চামড়া ঝ’লসে গিয়েছে। দেখুন!
নিয়াজ হতভম্ব হয়ে যায়। তার মাথা চক্কর কাটে। ইরা, সৌম্য দু’জনের অবস্থা ভ’য়া’ব’হ লাগছে।
নার্স স্ট্রেচার নিয়ে আসলে সৌম্য ইরার নিথর শরীর টা স্ট্রেচারের উপর শুইয়ে দেয়৷ দু’জন নার্স দ্রুতপায়ে ইরার স্ট্রেচার নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে যায়।
সৌম্য নির্জীব চোখে ইরার বিধ্বস্ত মুখটার দিকে চেয়ে থাকে। কি-জানি, এই মেয়েটা তাকে আর কখনো সৌম্য বলে ডাকবে কি-না! একবার ভালোবাসি শুনতে চাওয়ার আবদার করবে কি-না! আবার কখনো কথা বলবে কি-না! হঠাৎ সৌম্য তার দুর্বল, কম্পন শরীর নিয়ে মেঝেতে ধপ করে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে। নিয়াজ খেয়াল করে সৌম্যকে টেনে তুলতে চাইল, তবে সৌম্যকে একটু-ও নাড়াতে পারলো না। মৃদুস্বরে বলে,
– সৌম্য এখান থেকে ওঠো।
সৌম্য হঠাৎ নিয়াজকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আপনি আমার ইরাবতীকে বাঁচাতে কেন যাচ্ছেন না? ইরাবতী ম’রে যাবে তো! ওকে বাঁচিয়ে দিন না নিয়াজ ভাইয়া! ইরাবতী আমায় ভালোবাসতে বাসতে নিজের জীবন দিয়ে দিচ্ছে। দয়া করে ওকে বাঁচিয়ে দিন।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে সৌম্য’র চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। নিয়াজ ঢোক গিলে বলে,
– আমার স্যার তোমার ইরাবতীর ট্রিটমেন্ট করছে সৌম্য৷ তুমি একটু শান্ত হও।
সৌম্য মাথা নিচু করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের বাচ্চা চকলেট না পেয়ে হসপিটালের নোংরা জায়গায় বসে কান্না করছে৷ সৌম্যকে সেসব বাচ্চাদের চেয়ে কমকিছু লাগছে না৷
হসপিটালে রাখা টিভির নিউজ চ্যানেল থেকে কিছু কথা ভেসে আসে,
– বাংলাদেশের ঢাকা উত্তর মহানগরীর সাবেক সভাপতি ‘আকাশ নওয়ান’ ঢাকা থেকে চট্রগ্রামের পথে হেলিকপ্টারে যাত্রারত ছিল। আজ বিকাল ৫ টায়, তার হেলিকপ্টার ক্র্যাশ হয়েছে।
কথাগুলো সৌম্য আর নিয়াজের কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো৷ মাথা উঁচু করে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকলো উঁচুতে সেট করে রাখা টিভির পানে, যেখানে একজন সাংবাদিক অনবরত ঠোঁট নাড়িয়ে দুঃসংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কানে কানে। সৌম্য স্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে৷ চোখের কোণে বিন্দুবিন্দু অশ্রুকণা জমতে শুরু করেছে। আকাশ ভাইয়া ঘণ্টাখানেক আগেই তাদের সবার সাথে হেসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, সেই মানুষটার এখন এই অবস্থা? আকাশ ভাইয়ার জন্য যে তার বোনু অপেক্ষা করছিল, তবে কি তার বোনুর কাছে পৌঁছাতে পারেনি আকাশ? সৌম্য’র কানের কাছে আকাশের হাসির শব্দ বাজে। সেই সাথে কিছু কথা,
– সৌম্য আমি ফিরছি। তোমার বোনুকে একটু বুঝিয়ো,, তার ভাই গাধা হলেও তোমার বোনু যেন ভাইয়ের এর লেজ ধরে গাধী না হয়।
সৌম্য রা’গতে গিয়ে হেসে ফেলেছিল আকাশের কথা শুনে। আকাশ হেসে বলেছিল,
– তুমি, সন্ধ্যামালতী আমার মন থেকে ভীষণ আপন, বুঝেছ? প্লিজ আমাকে আর আর ক’ষ্ট দিওনা তোমরা৷ আমি সন্ধ্যামালতীর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করতে চাই। তুমি সন্ধ্যামালতীর বড় ভাই, সেই হিসেবে দোয়া করে দিও,, আমাকে বড় ভেবে, পা’ষা’ণ ভেবে শুধু ক’ষ্ট ছুঁড়ে দিও না। আমি-ও কিন্তু দুঃখ পাই সৌম্য।
সৌম্য বুঝেছিল, আকাশকে না বলে সন্ধ্যার অপারেশন করার জন্য আকাশ তাকে এভাবে বলেছিল৷ সৌম্য ছোট করে বলেছিল,
– স্যরি! আর কখনো এরকম ভুল হবে না আকাশ ভাইয়া।
কথগুলো ভেবে সৌম্য’র বুকটা চিনচিন করে উঠল। ধরা গলায় বিড়বিড় করে,
– আকাশ ভাইয়া??
এটুকু বলতে গিয়ে সৌম্য’র ডান চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে৷ আবার-ও বিড়বিড়িয়ে বলে,
– যাবেন না আকাশ ভাইয়া৷ আপনাকে ছাড়া আমার বোনু তো ম’রে যাবে!
নিয়াজ ধীরে ধীরে সৌম্য’র পাশ থেকে উঠে টিভির সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা ঝিমঝিম করছে। টিভির স্কিনে একটু পর পর দেখাচ্ছে, হেলিকপ্টারের বিধ্বংসী রূপ,, চারিদিকে শুধু আ’গু’ন আর কালো ধোঁয়া৷ নিয়াজ ডান হাত দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখে। দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে। কতক্ষণ যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, সে নিজেও জানেনা। কানের কাছে আকাশের বলা শেষ কথা বারবার বাজছে,
– এতো বড় সুসংবাদ দেয়ার জন্য, দেশে ফিরে সন্ধ্যামালতীর সাথে দেখা করার পর, সর্বপ্রথম তোমাকে একটি লজেন্স এর চার ভাগের এক ভাগ ট্রিট দিব। চিন্তা কর না। তোমার কিপ্টামির স্বভাব থাকলেও, আমার এসব নেই।
এসব কথা আকাশ ছাড়া আর তো কেউ বলেনা৷ আকাশ হারিয়ে গেলে, এসব কথা আর কে বলবে? আকাশকে কেউ জিজ্ঞেস করলে, কে উত্তর দিবে,, নিয়াজ তার শ’ত্র!
নিয়াজের দমবন্ধ লাগলো। কেমন ছটফট লাগে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে বহুক’ষ্টে উচ্চারণ করে,
– আকাশ?
এরপর নিয়াজ কয়েকপা পিছিয়ে এসে চিৎকার করে বলে,
– এসব নিউজ বন্ধ কর। বন্ধ কর এসব।
বলতে বলতে হাতের কাছে শ’ক্ত কিছু পেয়ে টিভিরি দিকে ছুঁড়ে মা’রে৷
হসপিটালের অনেকে নিয়াজকে আটকাতে এগিয়ে আসে। নিয়াজ দু’হাতে কান চেপে ধরে কি যেন বিড়বিড় করে।
বাংলাদেশের প্রতিটি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে, ঢাকা উত্তর মহানগরীর সাবেক সভাপতি আকাশ নওয়ান, হেলিকপ্টার ক্র্যাশে মৃ’ত্যুবরণ করেছে। হেলিকপ্টার চালকের ক্ষ’ত-বিক্ষ’ত দেহ উদ্ধার করেছে। যার দেহের অবস্থা ভ’য়া’বহ। তবে আকাশের দেহ কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। সকলের ধারণা, আকাশের দেহ অতিরিক্ত পু’ড়ে যাওয়ার কারণে তাকে শনাক্ত করা যায়নি।
রাত ৯ টায় বায়ান সন্ধ্যা আর শিমুকে রওয়ানা দিয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাত ৩ টায় ঢাকায় এসে পৌঁছেছে৷ আকাশকে চট্টগ্রাম তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু কোথাও পায়নি৷ এখন-ও তল্লাসি চলছে।
সৌম্য নিউজটি পেয়ে বায়ানকে কল করে বলেছে, তার বোনুকে নিয়ে এক্ষুনি ঢাকা ফিরতে৷
সৌম্য কথাটা বলেছে, কারণ সন্ধ্যা চট্টগ্রাম থাকলে তার বোনুর অবস্থা আরও খারাপ হবে৷ এজন্য আসমানী নওয়ানকে-ও চট্টগ্রাম যেতে দেয়নি৷ আকাশকে পাওয়া গেলে সাথে সাথে ঢাকাতেই ব্যাক করতে হবে৷ চট্টগ্রাম গিয়েও লাভ নেই। তাছাড়া ইরার জীবন আশঙ্কায়। সৌম্য কোনদিকে যাবে, বুঝে পায়না৷ তার নিজেকে দিশেহারা লাগে।
বায়ান গাড়ি থেকে নেমে ব্যাকসিটের দরজা খুলে দিলে, গাড়ির ভেতর থেকে সন্ধ্যা নেমে আসে৷ অপর পাশ থেকে শিমু বেরিয়ে আসে৷ সন্ধ্যা একবারের জন্য-ও কারো দিকে তাকালো না। রোবট এর মতো স্ট্যাচু হয়ে এলোমেলো পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো৷ চট্টগ্রাম থেকে আসবেনা বলে অনেক কেঁদেছিল, আকাশের জন্য কেঁদেছিল গলা ফাটিয়ে,, যা আশেপাশের মানুষ সা’র্কা’স এর মতো দেখেছে। কিন্তু সন্ধ্যা গাড়িতে ওঠার পর কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। একদম চুপচাপ, শান্ত হয়ে গেল।
সন্ধ্যার দৃষ্টি স্থির৷ পরনের সাদা শাড়ির আঁচল মাটির অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে৷ লম্বা চুলগুলো খোলা,যা ভীষণ এলোমেলো। বাড়ির দরজা খোলা থাকায়, সন্ধ্যা সরাসরি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। মেয়েটা এবারে-ও কোনোদিকে তাকালো না৷ তার দৃষ্টি সামনে স্থির।
বাড়ির ডাইনিং-এ সকলে উপস্থিত। আসমানী নওয়ান, শিমুর মা, অরুণ, অলিভিয়া, সৌম্য। সন্ধ্যাকে সবার আগে সৌম্য-ই খেয়াল করেছে। বোনের এমন বিধ্বস্ত রূপ দেখে সৌম্য’র বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সন্ধ্যার পায়ের গতি একটুখানি বাড়লো বোধয়, সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন-ই সৌম্য অস্পষ্ট স্বরে ডাক দেয়,
-বোনু?
সন্ধ্যা বোধয় শুনলো না। শাড়ির আঁচল তার থেকে প্রায় চার হাত দূরত্ব পর্যন্ত ছেঁছড়িয়ে যায়। কালো কিচকিচে চুলগুলোয় বালির কণা লেগে সাদা সাদা হয়ে আছে। সকলে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে। আসমানী নওয়ান নিশ্চুপ। ‘অধিক শোকে পাথর’ কথাটা আপাতত আসমানী নওয়ান আর সন্ধ্যার জন্য বেশ প্রযোজ্য মনে হচ্ছে। সৌম্য আবার-ও কিছুটা শব্দ করে ডেকে ওঠে,
-বোনু??
সন্ধ্যা পা থেমে যায়। মিনিট দুই একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর দিক ফিরিয়ে সন্ধ্যা তার ভাইয়ের পানে তাকায়৷ সন্ধ্যার চোখ দু’টো টকটকে গোলাপী হয়ে আছে। মুখের অবস্থা যাচ্ছেতাই৷ অধিক কান্নার ফল। বোনুর অবস্থা দেখে সৌম্য’র বুকটা ধ্বক করে ওঠে। দুর্বল শরীরটাকে আরও ভীষণ দুর্বল লাগতে শুরু করে।
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সৌম্য’র সামনে দাঁড়ায়৷ দু’ভাইবোন, দু’ভাইবোনের দিকে তাকায়৷ এতোক্ষণের নিশ্চুপ, রোবটের ন্যায় সন্ধ্যা, ভাইকে দেখে যেন ভেতরের সব উগলে দিতে চাইলো। গত কয়েক ঘণ্টার খড়খড়ে চোখজোড়া থেকে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে৷ সৌম্য ঢোক গিলল৷ কিছু বলতে চাইছে বোধয়, খুব চেষ্টা-ও করল ছেলেটা৷ কিন্তু কথাগুলো গলায় এসে বারবার বেঁধে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হঠাৎ-ই ভাইয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দু’হাতে সৌম্য’কে সাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সৌম্য পাথরের মূ’র্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। তার বোনুর কান্না যে একদম তার বুকে গিয়ে লাগে। তার বোনু তো তার ছোট মা। কি করে সহ্য করবে তার ছোট মায়ের এত ক’ষ্ট মিশ্রিত কান্না? কি বলেই বা সান্ত্বনা দিবে? সে কিচ্ছু জানে না। সে শুধু জানে তার ভীষণ কষ্ট হয় তার বোনু কাঁদলে। সে চায় তার বোনু অনেক সুখে থাকুক। কিন্তু সে ব্যর্থ। তাদের কপাল যে ভালো নয়। সে কি করে তার বোনুর কপালে সুখ লিখবে? সুখ লেখার দায়িত্ব তো আল্লাহ তাকে দেয়নি। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা মাথা উঠিয়ে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
-আমি ওনার জন্য অপেক্ষা করেছি। কিন্তু উনি আসেননি ভাইয়া। উনি আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছে৷
সন্ধ্যার কথা বেঁধে আসে। তবুও কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-উনি আমাকে শাড়ি পরতে বলেছিল, আমি পরেছি দেখ। আমাকে সাজতে বলেছিল, আমি সেজেছি। উনি বলেছিল আমার কণ্ঠ সামনে থেকে শুনবেন। আর তাই সেই সুদূর নিউইয়র্ক থেকে ছুটে আসছিল। আমি উনাকে আমার কণ্ঠ শোনাবো বলে পাতের খাবার রেখে, উনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু উনি আসেননি। উনি কি সত্যিই আর নেই ভাইয়া? বলো না উনি কোথায়?
সন্ধ্যা কথাগুলো বলতে বলতে দু’হাতে সৌম্য’র শার্টের কলার ধরে ঝাঁকায়। সৌম্য’র বুক ব্য’থা ক্রমশ বাড়ে। নির্জীব চোখে কান্নারত সন্ধ্যার পানে চেয়ে থাকে। সন্ধ্যা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-উনি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে কেন চলে গেল বলো? আমি এখন কিভাবে থাকবো? উনি আমার উপর কতদিন অভিমান করেছিল, তাতেই আমার দমবন্ধ লাগতো। আর এখন….ও সৌম্য ভাইয়া উনাকে আমার কাছে এনে দাওনা! আমি উনাকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারিনা বিশ্বাস কর। তোমরা কেউ তো দয়া কর আমার উপর,, আমার আকাশকে আমার কাছে এনে দাও। আমার আর কিচ্ছু চাইনা।
সন্ধ্যা কান্নামাখা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে ধীরে ধীরে সৌম্য’র পা বরাবর বসে সৌম্য’র পায়ের সাথে মাথা ঠেকিয়ে দেয়৷ দুর্বল শরীরটায় একটু-ও জোর নেই, অথচ প্রিয় মানুষের জন্য কোথা থেকে যেন এতো এতো অশ্রু, এতো আ’র্তনাদ বেরিয়ে আসছে৷ সৌম্য চোখজোড়া বুজে নিল। দু’চোখ বেয়ে টুপ করে দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।
আসমানী নওয়ান স্তব্ধ চোখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। যেন তার মাঝে প্রাণ নেই। তবে ছেলের জন্য চোখের কোণ ঘেঁষে নিরব অশ্রু ঝরাতে একবারের জন্য-ও ভোলেনি তার দু’চোখ।
সকলের দৃষ্টি ক্রন্দনরত সন্ধ্যার উপর। যে মেয়েটার কান্না এই নিস্তব্ধ মাঝরাতে, প্রতিটি দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়৷ আজ যদি আকাশ তার সন্ধ্যামালতীকে এভাবে কাঁদতে দেখতে পেত, তবে কি সে ঠিক থাকতো? সন্ধ্যার বুকফাটা কান্না সহ্য করার ক্ষ’মতা আল্লাহ আকাশের থেকে কে’ড়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজ যে সন্ধ্যাকে আটকানোর মতো সন্ধ্যার ব্যক্তিগত পুরুষ নেই। সেই যে হারিয়ে গিয়েছে।
আজ তো আকাশের সন্ধ্যামালতীর খুশির দিন ছিল। সবচেয়ে খুশির দিন। দুনিয়ার বিস্তৃত আকাশের বুকে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে, পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র মানব আকাশের বুকে মানব সন্ধ্যা নামার কথা ছিল। কিন্তু তা হলো না৷ দুনিয়ার আকাশের বুকে সন্ধ্যা নেমে, তা পেরিয়ে রাত পেরিয়ে সকাল হতে চলল। অথচ মানব আকাশ তার বুকে সন্ধ্যা নামানোর আগেই কোন অদূরে হারিয়ে গেল কে জানে!
সন্ধ্যার নজরে অরুণকে পড়লে, সে তার দুর্বল শরীরটা টেনে তোলে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অরুণের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ অরুণ চোখ নামিয়ে নেয়। সে এরকম সন্ধ্যাকে কিভাবে দেখবে? সে তো সন্ধ্যাকে বলেছিল, আর একটু পর সন্ধ্যা আকাশের দেখা পাবে। কিন্তু তার কথা যে ফলেনি৷ সন্ধ্যা কান্নামাখা গলায় বলে,
-ভাইয়া আপনি তো বলেছিলেন আপনার বন্ধু আর দুই মিনিটের মাঝেই আসবে। কিন্তু দেখুন কযত ঘন্টা পেরিয়ল গেছে কিন্তু তার খবর নাই। আপনার বন্ধুকে একটু বলুন না আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য। একবার আসতে বলুন।
অরুণ ঢোক গিলল। চোখের কোণে বিন্দুবিন্দু জলকণা৷ অরুণের পাশে দাঁড়ানো অলিভিয়া মলিন মুখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। সে সন্ধ্যাকে দেখতে চেয়েছিল, কারণ আকাশ মেয়েটাকে কেন এতো ভালোবাসে, এটা বুঝতে৷ আর এখানে এসে সন্ধ্যার এরকম চেহারার চেয়ে ভালোবাসার রূপ দেখে, তার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। এরা দু’জন দু’জনকে কত ভালোবাসে৷ আকাশ যদি সুস্থ থাকতো! তার আকাশকে ভালো লেগেছিল। আর এখানে এসে সন্ধ্যাকে দেখে মনে হচ্ছে, ইশ! সে আকাশ আর সন্ধ্যাকে যদি একসাথে দেখতে পেত!
অরুণকে চুপ দেখে সন্ধ্যা দু’হাত জমা করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-বলুন না ভাইয়া, আপনি কেন বললেন, উনি আর দুমিনিট পর আসবে? আপনার বন্ধু আমাকে বলল, এইতো আসছি। আপনি বললেন, আর দু’মিনিট পর আমার আকাশের সাথে দেখা হবে৷ আপনারা কেউ আপনাদের কথা রাখলেন না৷
অরুণ আর নিতে পারলো না৷ সে সন্ধ্যাকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যায়৷ কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে।
সৌম্য এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে সন্ধ্যার সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ে। সন্ধ্যার ডান গালে হাত দেয়। সন্ধ্যা তাকায় ভাইয়ের পানে। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
-আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বুঝেছি, আমার কপাল পুরোটাই পো’ড়া৷ ক’ষ্ট করতে করতে যখন-ই একটু সুখের দেখা পাই, তখন-ই সব এলোমেলো হয়ে যায়। এটা তো নতুন নয়। তবুও তুমি কেন আমাকে এত যত্ন করে বড় করেছিলে ভাইয়া? এখন দেখো, আমাদের আল্লাহ আমাকে তার চেয়ে বেশি যত্ন করে ক’ষ্ট দিচ্ছে। আমি কি অ’প’রাধ করেছি? যদি অ’প’রা’ধ করেই থাকি, তবে আমার অ’প’রাধে আল্লাহ আমাকে কেন মৃ’ত্যু দেয় না?
কথাগুলো বলে সন্ধ্যা একটু শ্বাস নেয়। এরপর আবার-ও বলে,
-তুমি ঠিকই বল ভাইয়া, আল্লাহ আমাদের বারবার বাঁচিয়ে নেয় ক’ষ্ট দেয়ার জন্য। আমাদের ভাগ্যের খাতা থেকে, দুঃখ পাওয়ার পরিমাণ এখনো কমেনি। আমি আর পারছিনা ভাইয়া৷ আমাকে মায়ের সাথে ক’ব’র দাওনি কেন বলো তো? তুমি, মা দু’জনেই খুব স্বা’র্থপর। আমাকে ক’ষ্ট দেয়ার জন্য কেউ আমায় ম’র’তে দাও নি।
কথাগুলো বলতে গিয়ে সন্ধ্যা হাঁপিয়ে যায়৷ কান্নার তোড়ে শরীর ভেঙে আসছে মেয়েটার। সৌম্য’র চোখ দু’টো টকটকে লাল। সে কি বলবে তার বোনুকে? তার নিজেরই তো বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সৌম্য মাথা নিচু করে নিলে চোখ থেকে টুপটুপ করে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সে যদি জানতো, তার বোনুর জীবনে একটুও সুখ নেই, তবে তার বোনুকে আর বাঁচাতে চাইতো না৷ মুক্তি দিয়ে দিত। কথাটা ভাবতেই সৌম্য’র বুকে তীব্র ব্য’থা অনুভূত হয়। সন্ধ্যার মাথা তার বুকে চেপে ভাঙা গলায় বলে,
-এসব বলিস না বোনু। তোর মাঝে আকাশ ভাইয়ার দিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি প্রাণ আছে। নিজেকে শ’ক্ত কর বোনু।
সন্ধ্যা শরীর ছেড়ে দিয়েছে। কান্না থামেনি। এতো ক’ষ্ট আর নিতে পারেনা সে। সে যে পারলো না, তার আর আকাশের ঘর একটি ছোট্ট প্রাণ আসবে। আকাশ কি আর তাকে সোনা বউ বলে ডাকবে? ডাকবে না তাইনা? তাকে আর সন্ধ্যামালতী বলেও ডাকবে না। কথায় কথায় আর তাকে চুমু খাবে না৷ সন্ধ্যা-ও আর বিরক্ত হবে না৷ আকাশ আর তাকে জড়িয়ে ধরবে না৷ তার দিকে তাকিয়ে আর হাসবে না৷ কেউ বলবে না, সন্ধ্যামালতী কাঁদলে আমার বুক ব্য’থা হয়৷
আসমানী নওয়ান অনেকক্ষণ পর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আওড়ায়,
-মা হয়ে সন্তানের মৃ’ত্যু দেখার সৌভাগ্যবতীদের তালিকা থেকে আল্লাহ আমায় বাদ দেয়নি তাহলে!
এটুকু বলতে গিয়ে ভদ্রমহিলার র’ক্তলাল চোখ থেকে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। একটু হাসল বোধয়। ক’ষ্ট পেলে মানুষ কাঁদে। আসমানী নওয়ান কাঁদে কেন? কি-জানি!
শিমু, শিমুর মা দু’জনেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
অরুণ ফাঁকা রাস্তার ধারে বসে আছে। দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে রেখেছে। তার শুধু মাথায় ঘুরছে আকাশের সাথে শেষবার দেখা হওয়ার মুহূর্তটা৷ সে আকাশের সাথে মজা করে, হেসে কথা বলে তাকে হেলিকপ্টারে উঠিয়ে দিল। কত আশা বুকে বেঁধেছিল, কত স্বপ্ন বুনে নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, তার সন্ধ্যামালতীর কণ্ঠ শুনবে বলে! সব এক নিমিষেই ভেঙে গেল! আল্লাহ কেন এমন করল?
অরুণ ঢোক গিলে করুণ কণ্ঠে আওড়ায়,
-তুই কোথায় আকাশ? দেখ তোর সন্ধ্যামালতি কাঁদছে। তুই কেন গেলি না তোর সন্ধ্যামালতীর কাছে? এখন আমি তোর সন্ধ্যামালতীকে কি জবাব দিব?
এটুকু বলতে গিয়ে অরুণের চোখের পাতা বেয়ে কয়েকফোঁটা পানি শুকনো রাস্তায় টপ করে পড়ে।
পেরিয়েছে দু’দিন।
বাংলাদেশের প্রতিটি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে, ঢাকা উত্তর মহানগরীর সাবেক সভাপতি আকাশ নওয়ান, হেলিকপ্টার ক্র্যাশে মৃ’ত্যুবরণ করেছে। হেলিকপ্টার চালকের ক্ষ’ত-বিক্ষ’ত মৃ’তদেহ উদ্ধার করেছে। যার দেহের অবস্থা ছিল ভ’য়া’বহ। তবে আকাশের দেহ কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। সকলের ধারণা, আকাশের দেহ অতিরিক্ত পু’ড়ে যাওয়ার কারণে তাকে শনাক্ত করা যায়নি।
সন্ধ্যা ঘরের এক কোণায় চুপচাপ হাঁটুমুড়ে বসে আছে। এই দু’দিন না ঠিক করে খেয়েছে, না তো কারো সাথে কথা বলেছে৷ ঘরের একটি কোণায় মিডিয়াম সাইজের একটি বক্স৷ বক্সটি কিছুক্ষণ আগে অরুণ তাকে দিয়ে গিয়েছে। আকাশের গাড়িতে ছিল এটা। সেদিন আকাশ হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় বক্সটি সাথে নিতে ভুলে গিয়েছিল।
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে বক্সটির সামনে বসল। বক্স খুলে ভেতর থেকে সবকিছু বের করে এক এক করে। যেখানে পাঁচটি সাদা শাড়ি, দশটি আলতার কৌটা। চার ডজন চুড়ি, একজোড়া রূপোর নুপুর, একপাতা কালো ছোট্ট টিপ। আর সবশেষে একটি খাম পায়।
সবগুলো বক্স থেকে মেঝেতে নামিয়ে রেখেছে। তবে খামটি ডান হাতে ধরে রাখা। কাঁপা হাতে খামের ভেতর থেকে একটি চিঠি বের করে। খাম মেঝেতে রেখে ধীরে ধীরে চিঠির ভাঁজ খুলে মেলে ধরে সামনে।
প্রিয়তমা সন্ধ্যামালতী,
জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো নারীর কাছে চিঠি লেখার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে বসেছি। কীভাবে শুরু করব জানি না, কিন্তু প্রতিটি শব্দের সঙ্গে বুকের ভেতর তীব্র ঝড় বইছে, মনের কোণে জাগছে অচেনা অনুভূতির ঢেউ। শরীরে বইছে অন্যরকম শিহরন।
সন্ধ্যামালতী?
মনে আছে কি, একদিন তুমি বকুল-গাছতলার নীচে ফুল কুড়াচ্ছিলে? দীঘল কেশ মাটিতে নুইয়ে পড়েছিল, বাতাসে তার গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি তখন বাতাস থেকেই তোমার চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম, মুগ্ধ নয়নে দেখেছিলাম সেই দৃশ্য, কেন যে দেখছিলাম, জানি না। কবে, কখন কিভাবে তোমায় ভালোবাসলাম, বুঝলাম না। তবে ভালোবাসলাম। তোমাকেই ভীষণরকমভাবে ভালোবাসলাম৷ অথচ প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা ছিল না, নয়তো তোমার প্রতি আমার তখনকার অনুভূতি বা ভালোবাসাকে নিজের কাছে নিজেই ধরা দিতাম না।
তারপর তুমি হঠাৎ ভাইয়ের সঙ্গে কোথায় যেন হারিয়ে গেলে। সেদিন থেকে তোমার প্রতি আমার টান অসহনীয় হয়ে উঠল, ভালোবাসা নামক সুঁতো অমোঘ বন্ধনে আমায় বেঁধে ফেলল। তুমি জানো সন্ধ্যামালতী, সেই থেকে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন আমি তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি। কিন্তু কোত্থাও পাইনি তোমাকে। যে আমি কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবিনি, আমার মনে কখনো কোনো নারীর জন্য দুর্বলতা জাগে নি। সেই আমি তোমার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ছটফট করেছিলাম।
তারপর হঠাৎ শুনলাম, তুমি আ’গু’নে পু’ড়ে গেছ, তখন আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজের অস্তিত্বকে ভুলে পা’গ’লপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম তখন। পুরো একটি বছর জীবন্ত লা’শ হয়ে বেঁচেছি। সেই দিনগুলোর কথা কখনো স্মরণ করতে চাইনা। ভেবেছিলাম আর কখনোই হয়তো তোমার দেখা পাব না।
কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত,পরবর্তীতে আবার-ও তোমার দেখা পেলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার, আবারও তোমাকে ছেড়ে এত দূর চলে এলাম!
তুমি কেন আমায় না জানিয়ে অপারেশন করলে, সোনা বউ? আমি তো তোমার কণ্ঠ শুনতে চাইনি, চেয়েছিলাম শুধু তুমি বেঁচে থাকো,চিরকাল আমার পাশেই থাকো। তুমি কেন এমন করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিলে? যদি তোমার কিছু হতো, আমি কীভাবে বাঁচতাম? কাকে নিয়ে বাঁচতাম বলো? এতোটা স্বা’র্থপর কেন হলে তুমি?
আমি এই দূর দেশে এসে একটুও ভালো নেই জানো, সন্ধ্যামালতী। প্রতিটি মুহূর্ত তোমায় প্রখরভাবে মিস করি। আমার বুকের আ’গুন নিভবে না যতক্ষণ তোমায় চোখে না দেখি, যতক্ষণ তোমার কণ্ঠ না শুনি। আমি খুব দ্রুত ফিরে আসব তোমার বুকে।
অনেক দিন পর তোমাকে দেখব ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত আলোড়ন কাজ করছে। জানি না তোমার চোখে কতটা বদল এসেছে,তোমার চাহনী আরও কতোটা মায়াবী হয়েছে। কিন্তু আমি আজও সেই আগের মতোই মনে রেখেছি তোমার হাসি, যা এক মুহূর্তেই আমার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। মনে আছে তোমার লম্বা চুলের সেই বেণী, সেই খোলা চুলের ঘ্রাণ, বকুলমালার সুগন্ধ, শরীরের সেই কোমলতা, শিহরণ জাগানে সেই তোমার করা হাতের ইশারা, তোমার রক্তিম মুখকে, তোমার শান্ত স্বভাব, তোমার মুখের মায়াবী চাহনি। সবকিছু আজও আমার হৃদয়ে অমলিন।
এই ক’দিন তোমায় না দেখে যেন সময়টাই থেমে গিয়েছিল। শীতল ভোরে, রাতের নিস্তব্ধতায়, কিংবা বৃষ্টির দুপুরে প্রতিবারই তুমি এসে ভেসে উঠেছো মনে। আমার মনের এই অসীম অস্থিরতার কারণ একমাত্র তুমি সন্ধ্যামালতী।
আগামীকাল তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে, আমার চোখে পৃথিবীটা হঠাৎ করে যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গত রাতের ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন আমার সেই মিষ্টি স্বপ্নকে কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছে। সন্ধ্যামালতী? আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি, তোমাকে কি আগের মতো আলতো করে জড়িয়ে ধরতে পারব? তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে পারবো? তোমার সমস্ত মুখে আমার ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে পারব তো? তোমার ভেতরে যে আমার অস্তিত্ব আছে তাকে চোখে দেখতে পারব তো?
লাইনটি লিখতে গিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলেছি। চোখের কোণে পানি-ও জমলো খানিক। আমার সোনা বউটা আমার অংশ ধারণ করেছে তার পেটে। আমি বাবা হবো সন্ধ্যামালতী। আমার সন্ধ্যামালতীর বাচ্চার বাবা হব আমি। আর আমার সন্ধ্যামালতী আমার বাচ্চার মা হবে। আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাই এই অনুভূতি? আমার সুখের রাণী তুমি সন্ধ্যামালতী। উফ! তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারছিনা কেন বউ? একটা টাইট হা’গ দিয়ে দিলাম সোনা বউ, নাউ। নেক্সট টাইম যতবড় অভিমান-ই করি না কেন, বাংলাদেশের বাইরে পা রাখবো না৷
আমার সন্ধ্যামালতী,
আমি তোমার মুখ থেকে এই সুসংবাদ পাওয়ার পর তুমি এই চিঠি পড়বে। তাই তোমার সারপ্রাইজ ন’ষ্ট হলো না বউ। তোমার পাতানো ভাই নিয়াজ আমাকে কিছুক্ষণ আগে এই খবরটি দিয়েছে। ওকে চারটে থা’প্প’ড় দিও। আমার সোনা বউয়ের সারপ্রাইজ পুরো ঘেটে দিয়েছে বে’য়া’দ’ব টা।
যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তুমি আমাদের অস্তিত্বকে খুব যত্নে বড় করবে, বুঝেছ সোনা বউ? আমার অনুপস্থিতিতেও ভাববে আমি প্রতিটি মুহূর্ত তোমার পাশে আছি। বাস্তবে না থাকলেও তোমার অস্তিত্বে আমি মিশে আছি৷ জানি, সারাজীবন এভাবেই থাকবো। আমার সন্ধ্যামালতীর খাঁটি ভালোবাসা এতোদিনে বুঝেছি। আমাদের অংশকে এভাবেই মানুষ করবে। সে যেন, আমার সন্ধ্যামালতীর ভেতর থাকা অফুরন্ত গুণ রপ্ত করে। আমার সন্ধ্যামালতীর সকল মায়া যেন আল্লাহ আমার বাচ্চার ভেতর ঢেলে দেয়।
দেখো কেমন পাগল আমি! কীসব আবোলতাবোল ভাবছি। আমি তো আগামীকালকেই তোমার সঙ্গে দেখা করব, হাজারো অভিমানের পরিসমাপ্তিতে এবার আমাদের ভালোবাসার নতুন সূচনা হবে। তোমাকে আবারও আমার বুকে আগলে রাখব।
সন্ধ্যামালতী?
আমি আর একটুও অপেক্ষা করতে পারছিনা। এই সময়টুকু কেন পার হচ্ছেনা? কেন এই কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা এত দীর্ঘতর মনে হচ্ছে? তীব্র ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে, সামনে থেকে কণ্ঠ শুনতে। মনে হচ্ছে কয়েক হাজার বছর হয়েছে, তোমাকে দেখিনি। এতো তৃষ্ণা কেন পায় সোনা বউ?
জানি না আমাদের পথচলা কতটা দীর্ঘ হবে, কিন্তু জানি, আমৃত্যু আর তোমাকে হারাব না।
আমি আসছি সন্ধ্যা, খুব তাড়াতাড়িই আসছি। তবুও জানি না এই কয়েক ঘণ্টা কীভাবে কাটবে। আমি তোমাকে দেখতে পাব তো, সন্ধ্যামালতী? অন্তত একবার হলেও এই জীবনে তোমার কণ্ঠ শুনতে চাই।
দেখো, আমি কতটা সন্ধ্যামালতীর পাগল! লিখতে লিখতে চোখ ভিজে গেল, নিশ্বাস আটকে আসছে। আজ আর লিখতে পারছি না সোনা বউ। আমি আসছি, খুব দ্রুত আসছি। তোমাকে জ্বা’লা’নোর জন্য, তোমাকে বিরক্ত করার জন্য, তোমার কণ্ঠ শোনার জন্য আর আমাদের সন্তানের অস্তিত্বের সুসংবাদটা তোমার মুখ থেকে শুনতে।
ইতি,
তোমার শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা
পুরো চিঠিটি পড়তে গিয়ে সন্ধ্যার চোখ থেকে ক’হাজার ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে তার হদিশ নেই। তবে হাতের রঙিন কাগজটি ভিজে চুপেচুপে হয়ে গিয়েছে৷ সন্ধ্যার শরীর কাঁপছে। কাঁপা হাতে শাড়িসহ প্রতিটি জিনিস দু’হাতে বুকে চেপে সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কতবার যে উচ্চারণ করল,
-শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা, শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা, শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা, শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা,শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা, আমার শুভ্র-পুরুষ,, আপনি সত্যিই আর আসবেন না তাইনা? আমাকে কেন নিয়ে গেলেন না আপনার সাথে? আমি ম’রে যাচ্ছি। আমায় বাঁচান। আপনি ফিরে আসুন আকাশ।
সৌম্য হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। ইরাকে আইসিইউ তে রাখা হয়েছে। ডক্টর সেভাবে কিছুই বলেনি ইরার ব্যাপারে। ইরার জ্ঞান ফেরেনি এখনো।
সৌম্য এগিয়ে এসে আইসিইউ এর দরজার সামনে দাঁড়ালো। ভেতরে ইরার মা ইরার মাথার কাছে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। আর ডক্টর ইরাকে চেক-আপ করছে।
সৌম্য ইরার মুখের দিকে চেয়ে আছে। ইরার মুখে ডানপাশ পুরোটাসহ, বামদিকের-ও কিছু অংশ খুব বাজেভাবে পু’ড়ে গিয়েছে। সৌম্য’র চোখে ভাসল, ইরার হাস্যজ্জ্বল মুখ। ইরা অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ায়, মেয়েটার মুখ থেকে যেন উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়তো। সেই মুখে আজ কালো আস্তরণ পড়ে গিয়েছে।
কিছু সময় পর ভেতর থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসে। সৌম্য ডক্টরের দিকে তাকলে ভদ্রলোক বলেন,
-আপনার স্ত্রী কখনো “মা” হতে পারবেন না। পারবেন না, তা না। যদি তিনি কখনো সন্তানসম্ভবা হয়, তবে তিনি বাঁচবেন না।
সৌম্য স্বাভাবিক চোখে চেয়ে রইল ডক্টরের দিকে। ডক্টর সৌম্য’র দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। তিনি হয়ত, সৌম্যকে এমন স্বাভাবিক দেখে অবাক হলো। সৌম্য গলা ঝেড়ে বলে,
-আর?
ডক্টর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সৌম্য’র দিকে। কোনো হাসবেন্ড বাবা হতে পারবেনা, এই খবর পেয়ে এতো স্বাভাবিক কিভাবে থাকতে পারে, সেটাই বুঝতে পারছে না সে। সৌম্য ডক্টরের রিয়েকশন দেখে মৃদু হাসল। ডক্টর অবাক হয়ে বলে,
-আপনি বাবা হতে পারবেন না৷ মন খারাপ না করে হাসছেন?
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-আসলে আমার বাবা হওয়ায় ইচ্ছে অনেক বেশি ছিল। ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে গেলে আমার ভাগ্যের সাথে বেমানান লাগতো।
এরপর মনে মনে বিড়বিড় করে,
-আমার আর বোনুর জীবন অপূর্ণতাতেই মানানসই।
ডক্টর অবাক হয়ে দেখল সৌম্যকে। সৌম্য’র কথায় ঠিক কতটা আক্ষেপ ছিল? সৌম্য জিজ্ঞেস করে,
– ইরাবতীর জ্ঞান ফিরবে কবে?
ডক্টর উত্তর করে,
-এখনও বলা যাচ্ছেনা।
সৌম্য মলিন মুখে উত্তর দেয়,
-ওহ।
এরপর বলে,
-নিয়াজ ভাইয়া কেমন আছে?
ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গত দু’দিন আগে আকাশের অবস্থার কথা শুনে নিয়াজ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। ডক্টর জানায়,
-এখন নিয়াজ ভালো আছে।
সৌম্য আর কিছু বলল না। এগিয়ে গিয়ে আবার-ও করিডোরে দাঁড়ায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকায়। ধীরে ধীরে সৌম্য’র চোখজোড়া ঝাপসা হয়। তার মনে হলো, একটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে শূণ্য আকাশে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ চাইলেই সে মেয়েটির বাবা হতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ তো চায় না। সৌম্য মলিন মুখে আওড়ায়,
-আমার ইরাবতীকে শুধু আমার বুকে রেখ আল্লাহ৷ আর আমার বোনুকে ধৈর্য দিও। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।
-ছেলেটির নিঃশ্বাস চলছে কিভাবে, আমি নিজেই জানিনা। ওকে বাঁচানো সম্ভব না। পুরো শরীরের কিছু ভালো আছে বলে তো মনে হয়না৷ ওকে বাঁচানোর জন্য এরকম করছ কেন? ও কে?
সামনের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে একটি ছেলে বসা। যার পরনে কালো পোষাক। বয়স ৩০ হবে। গায়ের রঙ অত্যধিক ফর্সা৷ চোখমুখ শ’ক্ত তার। ছেলেটি তীক্ষ্ণ চোখে তার সামনে দাঁড়ানো লোকটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলায়। যে মাত্র কিছু বাণী তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে, যা ছেলেটির পছন্দ হয়নি।
ছেলেটি তার পিছনে গুঁজে রাখা একটি পিস্তল বের করে ডান হাতের কয়েক আঙুলের সাহায্যে পিস্তলটি ঘোরাতে ঘোরাতে গম্ভীর গলায় বলে,
-AV. আমার জান।
পাশ থেকে একজনের কথা JD’র কানে ভেসে আসে।
-এই লোক গেঁ না-কি? ছেলেদের জান মেয়েরা হয় শুনেছি। আর এই ছেলের জান দেখি, আরেক ছেলে।
কথাটা শুনতেই JD’র ঘাড় সাথে সাথে ডানদিকে ঘুরে যায়।
যে কথাটি বলেছে, সেসহ প্রত্যেকে কিছু বোঝার আগেই JD লোকটির কপালের মাঝ বরাবর শু’ট করে দেয়৷ এখানে কি হলো ব্যাপারটি বুঝতেই প্রত্যেকের কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল৷ লোকটি সামনের দিকে ধপ করে পড়ে গেলে সকলের টনক নড়ে। JD তার গার্ডদের উদ্দেশ্যে রাগান্বিত স্বরে বলে,
-এটাকে এখান থেকে সরা৷
JD’র কথা মেনে কয়েকজন কালো পোষাক পরা লোক, মেঝেতে পরে থাকা লোকটিকে টেনে নিয়ে গেল।
JD চেয়ার থেকে উঠে এসে তার সামনে দাঁড়ানো আধবয়স্ক ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বা হাতে লোকটির কলার টেনে ধরে। ডান হাতে পিস্তল লোকটির গলায় চেপে ধরে সিংহের ন্যায় হুংকার ছেড়ে বলে,
-প্রয়োজনে ওর পুরো বডির প্রতিটি পার্ট এক্সচেঞ্জ করবি তোর সাথে। বাট, ওকে বাঁচাবি। এট এনি কস্ট৷ আদারওয়াইজ, তোর পুরো চব্বিশ গুষ্টিকে হেলিকপ্টাররে উঠিয়ে, সেই হেলিকপ্টারসহ আরও ৫০ টা হেলিকপ্টার তোদের উপর ক্র্যাশ করাবো।
ভদ্রলোক যদিও জেডিকে খুব ভালো করেই চেনে৷ কিন্তু একে তার ছেলের বয়সী মনে করে মাঝে মাঝে অনেককিছু বলে ফেলে। যা পরবর্তীতে ভ’য়ংক’র রূপ নেয়৷ লোকটি ঢোক গিলে বলে,
-ঠি.ক.ঠিকআছে।
JD লোকটির কলার ধরে অপারেশন থিয়াটারের দিকে বড়বড় পায়ে এগোয়৷ ডানহাতে পিস্তল ধরে রাখা। ডক্টর বারবার ঢোক গিলছে। ভেতরে গিয়ে যদি দেখে সেই ছেলে ম’রে গিয়েছে। তবে তার আর তার ফ্যামিলির সকলের আজকেই শেষ দিন, সে বুঝে গেছে৷
রাত তখন ১ টার কাছাকাছি। আকাশের দেয়া শাড়ির মাঝ থেকে একটি শাড়ি সন্ধ্যা পরেছে। দু’হাত ভর্তি চুড়ি পরেছে। দু’পায়ে আলতা পরেছে। আকাশের দেয়া নুপুর পরতে ভোলেনি। কপালে কালো টিপ।
চারিদিকে অন্ধকার। সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে আকাশদের সুইমিংপুলের পাশে৷ দৃষ্টি অন্ধকারাচ্ছন্ন সুইমিংপুলের টলটলে পানিতে। তার বিয়ের প্রথমদিকে আকাচের সাথে কিছু স্মৃতি ভাসল মেয়েটার চোখে। ইতোমধ্যে চোখজোড়া ঝাপসা হতে শুরু করেছে।
ধরনীর বুকে বাতাস বইছে৷ ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়ছে৷ সন্ধ্যার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত খোলাচুল গুলো বাতাসের বেগে দুলতে থাকে। শাড়ির আঁচল এদিক-ওদিক হয়। সন্ধ্যার মাঝে ভাবান্তর নেই৷ না আছে কোনো ভ’য়৷ দৃষ্টি এখনো সুইমিংপুলের টলটলে পানিতে৷ হঠাৎ-ই ঝপঝপ বৃষ্টির ন্যায় সন্ধ্যার দু’চোখ ভেদ করে ঝপঝপ করে শব্দহীন নোনাজল গড়ায়৷ আজ কি তার পাশে আকাশের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল না? তার দিকে মুগ্ধ নয়নে নয়নে তাকিয়ে থাকার কথা ছিল না? দু’জন বসে গল্প করে রাত পার করার কথা ছিল না? কিন্তু এসব কিচ্ছু হয়নি৷ সন্ধ্যা বিড়বিড় করে,
-আপনি আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে কেন হারিয়ে গেলেন আকাশ? আপনি আকাশের বুকে আমি সন্ধ্যা নামতে পারলাম না৷ আমি নামার বুক আমার মাথার নিচ থেকে কেন কে’ড়ে নিলেন? যখন হারিয়ে-ই যাবেন, তবে আমার অন্তরে কেন এতো ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে গেলেন শুভ্র-পুরুষ?
কথাগুলো বলে অঝোর ধারায় কাঁদে সন্ধ্যা। প্রায় অনেকক্ষণ পর সন্ধ্যা নিজেকে সামলায়। নিজেকে শান্ত করে। শ’ক্ত করার চেষ্টা করে। মাথা উঁচু করে দূর আকাশপানে তাকায়। বা হাত তার পেটে রেখে ঢোক গিলে বলে,
-আমি আপনার অংশকে আপনার মতো করেই তৈরী করব আকাশ।
এরপর সময় নিয়ে সন্ধ্যা নিজেকে সামলায়। কান্না গিলে নেয়৷
সন্ধ্যার পিছন বরাবর কেউ একজন দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে সাদা চোখের মণি দু’টো জ্বলজ্বল করছে ছেলেটির। যে সন্ধ্যার কানে ফিসফিস কণ্ঠে বলে ওঠে,
-আগে আকাশের সোনা-বউ ছিলে, এখন আমার সোনাপাখি হবে। ওয়েলকাম টু মাই সোনাপাখি।
কথাটা শুনতেই সন্ধ্যার অন্তঃ আত্মা কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যা সাথে সাথে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়৷ সন্ধ্যার দৃষ্টি আটকায়, অন্ধকারের মাঝে সাদা চোখের জ্বলজ্বল করা দু’টো। ছেলেটির মুখে রুমাল বাঁধা। সন্ধ্যা ঢোক গিলল৷ ছেলেটি বোধয় হাসছে৷ চোখদুটো তো তাই বলছে। সন্ধ্যা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
-কে আপনি?
লোকটি সন্ধ্যার দিকে এগোয়, সন্ধ্যা পেছায়। সন্ধ্যা সুইমিংপুলের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকায়, একটু সরতেই সুইমিংপুলে পড়ে যেতে নিলে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়ালো ছেলেটি সন্ধ্যার হাত ধরতে নেয়, তার আগেই সন্ধ্যা ডান হাত উঠিয়ে লোকটির কাঁধ বরাবর জোরেসোরে এক বারি দেয়, ফলস্বরূপ তার হাতের কাঁচের চুড়ি ভেঙে তার হাতসহ, লোকটির কাঁধে বিঁধে যায়৷ সন্ধ্যা একই সাথে বা হাতে লোকটিকে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়, যেন লোকটি তাকে ধরতে না পড়ে৷ লোকটি সত্যি-ই সন্ধ্যাকে ধরতে পারলো না৷ সন্ধ্যা পিছনদিকে হেলে ভরা সুইমিংপুলের উপর পড়ে যায়। হেলে পড়ে যাওয়ায় সময়টুকুতে সন্ধ্যা কঠোর স্বরে বলে,
অন্তঃদহন পর্ব ৫০
-সন্ধ্যামালতীর দেহে যতদিন প্রাণ থাকবে, ততদিন সে শুধু তার শুভ্র-পুরুষের সোনা বউ থাকবে৷
সন্ধ্যা পানির তলায় তলিয়ে যেতে যেতে মনে মনে আওড়ায়,
-আপনার অস্তিত্বকে আমি যেকোনোমূল্যে রক্ষা করব আকাশ, কথা দিলাম৷ আপনি বেঁচে থাকলে, আমাদের আবার-ও দেখা হোক। নয়তো, ওপারে আমাদের দ্রুত সাক্ষাৎ হোক।