অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ১৩
তেজস্মিতা মুর্তজা
-“কতটা নিচে নেমেছ তুমি, ভাবো না সে নিয়ে তাই না?ʼʼ
-“ম্যাম! ভাবিনা, তার একটা কারণ আছে। ভাবলে নিচে নামতে কষ্ট হয় অথবা নিচে নামার ইচ্ছেটা আর থাকে না, এইজন্য ভাবিনা।ʼʼ
মনোয়ারা কপালে হাত চাপলেন, “ফাজলামি পেয়েছ? আর একটা বাজে কথা বললে থাপ্পড় মারবো একটা।ʼʼ
-“রেগে যাচ্ছেন কেন?ʼʼ
-“খুশি হবো তোমার বাদরামিতে?ʼʼ
-“খুশি হওয়াই তো উচিত। দুঃখিত হবার কিছু দেখছি না।ʼʼ
-“মানুষ বড় হবার সাথে সাথে বদলায়, তোমার আরও অবনতি হচ্ছে। যখন অনার্সে ভর্তি হলে, ভাবলাম ছোটো মানুষ, শুধরে যাবে। আজ অবধি একটুও শুধরেছো?ʼʼ
-“আপনি খামোখা রেগে যাচ্ছেন, ম্যাম! করেছি টা কী?ʼʼ
-“তুমি জানো না, তাইনা?ʼʼ
-“আমার মাথায় তো জট নেই। ধ্যান-ট্যান করিনা। জানব কীভাবে?ʼʼ
-“তর্ক করছো?ʼʼ
জয় মুখে আঙুল দিলো।
-“তুমি নিজেই বলো তো, একজন ছাত্রনেতার সাথে এরকম অসভ্য কর্মকাণ্ড যায়? ভার্সিটিতে মেয়েরা যদি তোমার কাছেই নিরাপদ না হয়, তাহলে জুনিয়ররা তোমার কাছে কী শিখবে? তোমার শাসন মানবে তারা?ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “জি না, মানবে না। আমি হলেও মানতাম না।ʼʼ
ধমকে উঠলেন ম্যাম, “চুপ্প, ফাজিল। তোমায় আমি কী করব, জয়? এত দায়সারাভাবে জীবনযাপন কোরো না, কোথায় গিয়ে আঁটকে যাবে, তখন কিন্তু ছটফটানিতে লাভ হবে না বিশেষ!ʼʼ
জয় হাসলো, “ম্যাম, আমি জানি, আমার পরিণতি খুব একটা ভালো না। কিন্তু আমার সেই পরিণতিকে ভয় লাগেনা। এই রোগের ওষুধ নেই?ʼʼ
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“তুমি পাগল, জয়।ʼʼ
-“বেশি না। অল্প।ʼʼ
-“একসময় আসবে আমার কাছে সময় করে, কথা বলব। জীবনে পাপ তো কম করলে না, এখন থামা উচিত নয়?ʼʼ
-“না। থামবো কোন সুখে? ট্যাকা-পয়সা দেবেন থামলে?ʼʼ
মনোয়ারা চুপচাপ চেয়ে রইলেন। জয় আলগোছে হাসল ম্যামের চোখের দিকে তাকিয়ে, “পাপ করতে করতে থামলে মানুষ আর বাঁচে না, ম্যাম। আমি আর কিছুদিন বাঁচবো, ভাবছি। বিয়েশাদী না করে মরা ঠিক না।ʼʼ
মনোয়ারা জয় আমিরের এক হাসিতে ঝলসে গলে গেলেন যেন। জয়ের চোখের দিকে তাকাতে নেই। এটা তিনি মানতেন আগেও। যখন ভার্সিটিতে ছিল, এত্ত সব কুকর্ম করে বেড়াতো। অথচ গালি ঝারলে বা মারলে যে ছেলে রাগেনা, কখনও যে সিরিয়াস হয়না, ঠোঁটের দুষ্টু হাসি অথবা রসিক কথাবার্তা থামেনা, তাকে শাস্তি দেবার উপায় কী?
মনোয়ারা কপট কঠিন স্বরে বললেন, “এখন বলো, কী হয়েছে মেয়েটার সঙ্গে তোমার?ʼʼ
জয় হাঁ করে শ্বাস নিলো। কিছু বলতে প্রস্তুতি নিলো সে। এরপর সুন্দর করে বলল, “রাগারাগি হয়েছে।ʼʼ
-“রাগারাগি হয়েছে? জুনিয়রের সাথে রাগারাগি?ʼʼ
-“আরমিণ আমার প্রেমিকা, ম্যাম! কিন্তু ও এখন আর আমাকে চায়না। কথা বলতে গেলেই, ছ্যাঁত করে ওঠে শালি, এড়িয়ে চলে, এরপর গতকাল আবার অভিযোগ করেছে।ʼʼ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জয়, “এখন আপনি যদি গিয়ে ওকে এই কথা জিজ্ঞেস করেন, ও এটাও স্বীকার করবে না যে ও আমার প্রেমিকা।ʼʼ
তাজ্জব বনে গেলেন মনোয়ারা, “তোমার প্রেমিকা? তোমার মতো ক্যাঙ্গারুর প্রেমিকা? এসবও বিশ্বাসও করে মরতে হবে?ʼʼ
-“কেন বিশ্বাস করতে পারছেন না?ʼʼ
মনোয়ারা চুপচাপ জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর না চাইতেও আচমকা হেসে ফেললেন, “তুমি কী ভাবো আমায়? আমি জানিনা তোমায়?ʼʼ
জয় হাসল, “কী জানেন?ʼʼ
মনোয়ারা গম্ভীর হবার চেষ্টা করলেন। অথচ লাভ নেই। তাই তিনি কৌশলে বোঝানোরচেষ্টা করলেন বেপরোয়া ষাঁড়টাকে, “আর জ্বালাবে না মেয়েটাকে। তোমার নিজের রেপুটেশন খারাপ হয়, এই খাতিরেও তো বদমাশি ছাড়তে পারো!ʼʼ
জয় বোঝানোর চেষ্টা করল, “সত্যিই ও আমার গার্লফ্রেন্ড, ম্যাম।ʼʼ
মনোয়ারা কঠিন হতে গিয়েও হাসলেন, “গেটা আউট। কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব এবার। বের হও আমার রুম থেকে।ʼʼ
জয় বাইরে বেরিয়ে এলো হাসতে হাসতে ম্যামের কক্ষ থেকে। আপন মনেই বলল, “আরমিণ! কেন যে এত সহজভাবে নাও আমায় তুমি? কেন? হোয়াই?ʼʼ
পলাশের ডেরা উপজেলার শেষ প্রান্তে। চারপাশে বিশাল বিশাল গাছ, তার পাশে একটা পুকুর আছে। পুকুরের পেছনে দোতলা বাড়ি, ওপরে শ্যাওলা পড়া রুফটপ টাইপের।
হামজা বসল। পলাশ এলো গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, নেমে আছে কোমড়ের নিচ অবধি।
-“এমন সব সময়ে আসো, এই তো কেবলই গেলাম রুমে। এসব সময় মাঝপথে চলে আসা যায় নাকি?ʼʼ
হামজা বলল, “দরকার বলেই এসেছি। রঙ-তামাশার জন্য রাত আছে, কাজের জন্যই দিন। রাতে তো আমি আসব না, অন্তত কাজের কথা বলতে! তখন এসব কাজ সারবেন।ʼʼ
-“মন বা শরীর তো আর দিন-রাত বোঝেনা। হোটেলে গেছিলি?ʼʼ
-“ওখানে পাইনি বলেই এখানে এসেছি।ʼʼ দু’হাত একত্র করে ঝুঁকে বসল হামজা, “মাজহারের খবর পেয়েছেন?ʼʼ
-“হুম! কাজটা ঠিক করো নাই। বহুত হাঙ্গামা সইতে হবে এর বদলে। অলরেডি কিছু একটা হইছে বলেই আসছো! ঠিক বলছি না?ʼʼ
-“না, ঠিক বলেন নি। তেমন কিছুই হয়নি। তবে হবে বলে আশঙ্কা করছি। আপনি আবার মাজহারকে সাহায্য করছেন না তো?ʼʼ
-“আরে নাহ! আমার কাছে আসে, বসে, দু একটা ফুঁক মারে, চলে যায়।ʼʼ
-“অবাস্তব, পেট বানানো কথা শুনতে এখানে আসিনি, পলাশ ভাই। বাজে কথা রেখে সোজা কথায় আসুন!ʼʼ
-“তো তুই কী চাস আমার কাছে? তোর শত্রুগুলোরে আমার শত্রু বানায়ে ফেলি? এখানে বসে ব্যবসা-কারবার চালাতে গেলে দিনাজপুরের সব রাজনীতিবিদকেই দরকার আমার। আমার কারবারের কাছে আমি আপোস করিনা, জানিস তো তুই।ʼʼ
হামজার জন্য নাশতা এলো। পলাশ খেতে ইশারা করল। হামজা তা উপেক্ষা করে বলল, “আজ যদি মাজহারের লোক কোনো হাঙ্গামা করে, আপনার কারবারেও ভাটা পড়বে। এখানে বসে কলকাঠি নাড়ার সুযোগ আমি দেবোনা বোধহয় আর।ʼʼ
-“ইশ! কথা কোন দিক থেকে কোন দিক নিয়ে যাচ্ছ? আমি শুধু কারও সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাই না। আর এইটাও চাই, তুমি আর মাজহার এক হও। যেহেতু আমারও তোমাদের প্রয়োজন, তোমাদেরও আমাকে। অথচ দুজন এক হইতে পারো না, মাঝে পিষে মরতেছি আমি।ʼʼ
-“অথচ মেয়র হচ্ছি আমি। মাজহারের গোষ্ঠীশুদ্ধ রাজনীতি থেকে উপড়ে ফেলবো। তাহলে ওদের সাথে আপনার সম্পর্ক রাখার বিশেষ দরকার হবে বলে মনে হয় না!ʼʼ
পলাশ সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে বলল, “চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।ʼʼ সোফার ওপর শরীরের ভার ছেড়ে বসল।
হামজা শুনলো না বোধহয় সেই কথা, সোজা সাপটা বলল, “আজ সম্মেলনে যদি একটা আওয়াজও আসে ওদের, সামান্য পরিবেশ নষ্ট হলেও আপনার ধান্দার শিকড় একটানে উপড়ে তুলে ফেলে দেব আমি। মাজহার ঢাকায় চিকিৎসারত। ওর ছেলেরা আতঙকগ্রস্থ। অথচ আমি জানি, আপনার লোকজন মাজহারের হয়ে ক্লাবে প্রতিদিন গণ্ডোগোল করতে যাচ্ছে। আপনি ওদের নিষেধ করবেন।ʼʼ
পলাশ চুপচাপ তাকিয়ে রইল একটু হামজার দিকে, পরে গম্ভীর হলো, “আমি ওদের যেতে বলিনি।ʼʼ
-“আমিও আমার ছেলেদের যেতে বলব না। ওরা নিজেরাই দড়ি ছিঁড়তে খুব ওস্তাদ। আর জয়কে তো চেনেন!ʼʼ
-“এত হাইপার হয়ে এই লাইনে টিকবি কেমনে? তুই শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করেই এত তাড়াতাড়ি এইখানে আসছো। এখন আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো।ʼʼ
-“সংক্ষেপে শেষ করুন, সময় কম হাতে।ʼʼ
-“জয় কোথায় এখন?ʼʼ
-“বাড়িতে।ʼʼ কথাটা মুখে বললেও মনের ভেতরে খট করে উঠল হামজার। যে ডানপিটে ছেলে, আসলেই বাড়িতে আছে তো? রাগে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল হামজার। সবকিছু অসহ্য লাগছে কেন জানি।
পলাশ বলল, “জয় তোর সাধের গোয়ালের পাগলা ষাঁড়। ওরে তুই ভালো শক্ত দড়িতে আটকাস নাই কোনোদিন। এইজন্য ভুগবি খুব। যতই গুছায়ে রাখতে চাও আব্বা
গোয়ালটারে, পাগলা ষাঁড়টা যতদিন খোলা আছে, তোমার দূর্ভোগের শেষ থাকার কথা না। নির্বাচনের আগে যে কামডা করছিস তুমি, আমি খালি ভাবতেছি ওরা এখনও কেইস ফাইল করে নাই ক্যান তোর নামে? সাবধান থাক, ঝড়ের আগের নীরবতা বলেও একটা কথা আছে। ঝন্টু সাহেব ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত, চিন্তিত। কিন্তু মাজহার সুস্থ হোক, ফিরে আসুক, খেলার দিন গেল না, আসতেছে। নির্বাচন ক্যান্সেল করছিস, ছেলেটারে আধমরা করছিস মেরে। এই সময় ঠিক না এসব।ʼʼ
হামজা চুপচাপ শুনলো। পরে জিজ্ঞেস করল, “রাজন মামা আসবে কবে?ʼʼ
সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল পলাশ, রাজধানীর ব্যস্ততা মেলা। ঠিক নেই কবে আসে এক ঝলক।ʼʼ
-“আর কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। মুখের ভেতরে না রেখে বলে ফেলুন।ʼʼ
হামজার কথায় হেসে ফেলল পলাশ, “তোরে আমার খুব ভাল্লাগে, হামজা! একদম সফল গ্যাংস্টার, তুই। তবে আমারে যে পদে পদে দরকার তোর, এইটা ভুলবি না।ʼʼ
পলাশের চোখের রঙ ধূসর, ঠিক বিড়ালের মতো জ্বলজ্বল করে। হাসলে কেমন এক গা ছমছমে ভাব ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। চেহারাটা অন্যরকম দেখতে। ভ্রুর মাঝখানে ফাঁকা নেই, জোড় ভ্রু, খাঁড়া নাকের ডগায় সূক্ষ্ণ বিভাজনের কারণে নাকটা অদ্ভুত লাগে দেখতে। কথা বলার সময় ঠোঁটে একটা প্যাচপ্যাচে হাসি লেপ্টে থাকে। এই হাসি দিয়েই দিনাজপুরের কালোবাজার জমজমাট চলছে পলাশের হাতে।
হামজা বেরিয়ে এলো। তার মন অশান্ত হয়ে আছে। অস্থির হাতে ফোন করল বেশ কয়েকবার জয়কে। জয় প্রতিটা কল গুণে গুণে কেটে দিলো। ফোন ভাইব্রেট হলো হামজার। রিপন কল করেছে। মিনিট চারেকের মতো শুধু বলল ওপাশ থেকে, হামজা শুনল। মাথায় রক্ত উঠে গেল। সোজা গাড়িতে উঠল বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তরু অসময়ে হামজাকে দেখে চমকালো। হামজা রাগে না, খুব শান্ত মানুষ। রাগলে মানুষ থাকেনা, এটাও সত্য।
-“জয়! জয় কই?ʼʼ
তরু কথা বলল না। মাথা নত তার, হাত-পা শিরশির করছে। তরুর নীরবতা হামজাকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। হাতের ফোনটা এক আঁছাড়ে চার খণ্ড করল। বকে ওঠে, “জানোয়ারের বাচ্চা! বের হয়ে গেছে? বললাম, বাইরে পরিস্থিতি খারাপ, বের হোস না। বের হইছে আবার ভার্সিটিতে গিয়ে অকামও করা সারা। তোরা কেউ দেখিসনি যখন বের হইছে? দেখিস নি?ʼʼ
তরু ঠকঠক করে কেঁপে উঠল। দৌঁড়ে এলো সকলে।
-“সবগুলা ভ্যাড়াচ্চুদা একেকটা নাকে তেল মেরে ঘুমাও? ওই শুয়োরের বাচ্চা, আজ বাড়ি আসলে… ʼʼ ডাইনিং টেবিলের ওপরে থাকা জগটা এক বাড়িতে মেঝেতে ফেলল। ঝনঝন করে গুড়ো হয়ে গেল সেটা।
হুমায়ুন পাটোয়ারী এগিয়ে এলেন, “কী হইছে? ক্ষেপছিস ক্যান? জয় বাচ্চা ছেলে? ওরে নিয়ে এত ভয় পাওয়া লাগবে? কি শুরু করছিস?ʼʼ
তুলি বের হয়ে এলো, “তোমার ছেলে কি মানুষ, আব্বু? কোয়েলকে আনতে যাওয়ার কথা ছিল, জয় সেখানে গেছে হয়ত!ʼʼ
হামজা তাকালো তুলির দিকে। তুলি চুপ করে গেল। হামজার চোখ দিয়ে রক্ত ছুটে বের হচ্ছে। চোখ বুজে ক্ষেপে যাওয়া গোখরা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিলো নিজেকে শান্ত করতে। সোফার পাশে হাতের ডান সাইডে কাউচের ওপর জয়ের হেডফোন পড়ে আছে। সেটা তুলে ছুঁড়ে মারল শূন্যে। সেটা গিয়ে দেয়ালে লেগে ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।
হুমায়ুন পাটোয়ারী বললেন, “তুই শান্ত হ। ওর কিচ্ছু হবে না..ʼʼ
দাঁত আঁটকে বলল হামজা, “আব্বু কথা কম বলেন, আপনি। তুলি ভেতরে উঠে যা, যা..ʼʼ গর্জে উঠল হামজা। তুলি চোখ বুজে ফেলল সেই বজ্রকণ্ঠে। তবে নড়ল না।তরুর গা কেঁপে উঠল অজান্তেই। হাতের লোম দাঁড়িয়ে গেছে, শিউরে উঠল শরীরটা।
-“বাইরের পরিস্থিতি সম্বন্ধে ধারণা আছে আপনার কোনো? ফোন লাগান, ফোন লাগান কুত্তার বাচ্চারে। জলদি, জলদি করেন! ফোন কই আপনার, ফোন কই?ʼʼ
হুমায়ুন পাটোয়ারী দৌঁড়ে গিয়ে ফোন আনলেন। ফোন করলেন জয়কে। জয় দুবার কেটে তিনবারের বার রিসিভ করে। হামজা ফোন কানে ধরতে ধরতেই মাড়ি পিষল, “বান্দির বাচ্চা! কই মরতে গেছিস? আজ আমার সামনে আসলে তোর রুহু না বের করে নিই আমি। হারামির বাচ্চা, শালা শুয়োর! কতবার নিষেধ করে গেছি আমি তোরে? পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ি না আসলে খু ন হয়ে যাবি আমার হাতে। জীবিত পুঁতে রাখবো একদম! কথা কানেও যায়না, মাথায়ও ঢোকেনা?ʼʼ
সেই মুহুর্তে ভেতরে ঢুকল জয়। তার কানে ফোন ধরা তখনও। হামজা ফোন নামিয়ে রেখে এগিয়ে গেল জয়ের দিকে। জয় একলাফে সোফা টপকে ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল, “ভাই, থামেন বাল। আমি কিন্তু ছোটো বাচ্চা না। কাজ ছিল, বের হইছিলাম। সবার সামনে মারলে বেইজ্জতি হবে আমার।ʼʼ
হামজা তেড়ে ধরতে গেলে জয় ছিটকে দাঁড়াল, “আমারে কি তোমার ভুদাই মনে হয়? ওরা আসবে, আমার ক্ষতি করে চলে যাবে, আর আমি পেছন মারা খেয়ে চেগায়ে পড়ে থাকব ওইখানে?ʼʼ
হামজা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও পারলো না। বিশ্রী ভাষায় বকলো, “আর একটা কেইস যদি ভরে দেয় তোর পেছন দিয়ে, তারপর? এমনিতে কি চারদিকে প্যারার অভাব? কীসের সম্মেলন ডেকে এসেছিস কালকে? আর মাত্র পনেরো দিনও নেই নির্বাচনের। এই সময় তোকে টলারেট করবো নাকি যা যা ঝামেলা বেঁধে আছে চারদিকে, আরও ঝেপে ঝেপে আসছে, সেগুলো টেকেল দেবো? তোর ঝন্টু আব্বা তোর নামে কয়টা কতরকমের কেইস ফাইল করবে, তোরে ফাঁসি দড়িতে না ওড়নায় ঝুলাবে, আমার নির্বাচন চাঙে না মাচায় তুলবে সেই পরিকল্পনা আঁটছে। ভার্সিটিতে তোর বিপক্ষে আন্দোলন চলছে, নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে। শুয়োরের বাচ্চা, এবার ভালো হ। চাপ নিতে নিতে আমার ধৈর্য্যে টান লাগলে সব গুলারে একসাথে কুচি কুচি করে কেটে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেব। একেরকম কর্ম করে রাখো, তা সামাল দেয়ার জন্য একা আমি?ʼʼ
হুট করে হামজা রুখে গেল জয়ের দিকে। গায়ে হাত লাগার আগেই মাঝখানে তুলি এসে দাঁড়াল, “থাম! রাগ উঠলে পাগল হয়ে যাস? মানুষের চামড়া আছে তোর মাঝে? এই জন্যই তো ভাবী তোকে ঘেন্না করে।ʼʼ
হামজা চোখ বুজল, “তুলি সরে যা সামনে থেকে। তোর গায়ে হাত দিতে চাচ্ছি না, আমি। বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারবো না, তুই মেয়ে মানুষ।ʼʼ
-“ভুলে যা। পারলে ভুলে গিয়ে মার আমায়। ওর শরীর ভালো? তুই ওকে মারতে যাচ্ছিস, তার আগে নিজের দিকে দেখ। সব ভুল ও-ই করে, তোর কোনো ভুল নেই? তুই তোর চাচাশ্বশুরকে নির্বাচন থেকে বাদ করেছিস কেন? এখন ওরা ক্ষেপে গেলে সামাল দেয়া কষ্ট হচ্ছে, তার ভাগ জয় কেন নেবে? তুই ক্ষমতার লোভে বহু আগে জানোয়ার হয়ে গেছিস, জয়কেও বানিয়েছিস। শোধ। এ বাড়ির কোনো পুরুষ বা মেয়েলোকটা ভালো? কেউ কাউকে কাঁদা ছোঁড়ার নেই।ʼʼ
হামজা সরে এলো। জয়ে সোফা টপকে হামজার সামনে এসে দাঁড়ায়, “ভাই!ʼʼ
হামজার কাধের দুপাশে নিজের দু হাত জড়িয়ে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো হামজাকে। এরকম নির্লজ্জের সামনে চেয়েও হামজা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনা আর। মুখ কঠিন করে ভারী শ্বাস ফেলতে লাগল।
জয় পা ফাঁক করে বসল সোফাতে পাশেই, “ঠান্ডা হও, তুমি। সব ঠিক আছে। যা হয় দেখা যাবে। কিছু না হতেই তা হবে আশংকা করে যদি অশান্তি করো, তাইলে না হওয়া অবধি যে শান্তিটুকু পাওয়ার ছিল, সেটা থেকেও তো বঞ্চিত হচ্ছি আমরা।ʼʼ
হামজা দাঁত খিঁচল, “ফাক ইওর প্লেসান্ট্রি!
জয় হামজার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল, “ফাক ইউ টু ব্রো।ʼʼ
হামজা মাথা এলিয়ে বসল, “তুই কী করেছিস আরমিণের সাথে?ʼʼ
-“খবরদার ভাই, একদম এসব মেয়েঘটিত বিষয়ে জড়াবে না আমায়। আমি ভার্জিন ছেলে, ভালো ছেলে। তুমি আরমিণকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করো, ও আমার সাথে কী করেছে?ʼʼ
সকলের কানে বোমা ফাটলো যেন। তরু ভ্রু কুঁচকাল, আরমিণ আবার কে? কোন মেয়ে জয়ের সাথে কী করেছে? হামজা বলল, “কীসব বাজে কথা বলছিস? ও কী করবে তোর সাথে?ʼʼ
-“আমি কিছু না করে ভুল করছি। শালী, আমার নামে অভিযোগ করছে, আমি নাকি ইভটিজিং করি ওকে। কসম, এখন অবধি ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখিনি। মুখটাই দেখছি ভুলেভালে একবার। পাগল-ছাগল চেংরি, ইভটিজিংও বোঝেনা।ʼʼ
চাঁদনীর সাথে আবার দেখা করতে গিয়ে সেদিন ওদের পায়নি অন্তূ। ঘর-বাড়ি আছে, মানুষ নেই। আজব ব্যাপার। আঁখির লাশ মাটি হয়েছে দুই সপ্তাহও হয়নি। হতে পারে হামজারা উচ্ছেদ করে দিয়েছে ওদের।
আশেপাশের বাড়িতে খোঁজ করতে যেতে পারেনি সংকোচে। পাশেই হামজার ক্লাব। পুরো এলাকা পোস্টারময়। গাড়িতে গাড়িতে মাইকিং চলছিল। বিশ্রী অবস্থা।
শহরের ভেতর ঢুকে ভীষণ অস্বস্তি হলো অন্তূর। আব্বু ছাড়া একা চলার অভ্যাস নেই।
চার মাস আগে দুটো ছাত্র পড়াতো। নিজের ব্যস্ততায় এবং আমজাদ সাহেবের নিষেধে বাদ দিয়েছিল। একজনের কাছে দুই মাসের বেতন পাওনা ছিল। তা কোনোদিন চাইতে যায়নি অন্তূ। সেদিন ফেরার পথেই তাদের বাড়ি পড়েছিল। মহিলা দেখতে পেয়ে খুব খাতির করে ভেতরে বসিয়ে নাশতা করিয়ে সেই টাকা জোর করে হাতে ধরিয়ে দিলেন।
অন্তূর ফুরফুরে লাগছে মনটা! পুরুষেরা ভাবে, তারাই বোধহয় শুধু বেকারত্বে পিষে মরে, শখ-আহ্লাদ পূরণের ব্যর্থতায়। তারা বুঝবে না, মেয়েরাও স্বপ্ন দেখে নিজের যোগ্যতার জোরে হালাল উপার্জনের টাকায় দুটো মানুষের হাতে কিছু তুলে দিয়ে তাদের কপট রাগের স্বীকার হতে।
এখন অন্তূ পুরো টাকাটা দিয়ে একটা দামী রোলেক্স ব্রান্ডের ঘড়ি কিনে নিয়ে যাবে আব্বুর জন্য। আব্বু হাসবেন না, একটুও না, বরং গম্ভীর হয়ে বলবেন, “বেশি বড় হয়ে গেছিস? এসব আনতে কে বলেছে? তোর এটা নেই, সেটা নেই। এটা দিয়ে কিনে নেয়া যেত না? যা নিয়ে যা তোর ঘড়ি, লাগবে না আমার। আমি ঘড়ি পরি না এখন আর।ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ রেখে চলে আসবে। তৎক্ষণাৎ ঘড়িটা হাতে তুলে নেবেন আমজাদ সাহেব। উল্টে-পাল্টে দেখবেন, অল্প-বিস্তর হাসবেন। সেই হাসিও যেন গম্ভীর দেখাবে। এরপর হাতে পরবেন ঘড়িটা। আবার খুলে রেখে দেবেন পুরোনো আলমারির ডান পাশের ড্রয়ারে।
ঘড়ি কেনা শেষে ফেরার গাড়ি থামালো অন্তূ। চালক বলল, “আপা, ওঠেন। তাড়াতাড়ি ওছেন, ট্রাফিক শালারা বেশিক্ষণ দাঁড়াইতে দেয়না এইখানে।ʼʼ
গাড়ির ভেতরে ঠেসেঠুসে বসার মতো কোনোমতো জায়গা রয়েছে। সব যাত্রী পুরুষ।
অন্তূ বলল, “পরের গাড়িতে চলে যাব, যান আপনি।ʼʼ
-“আরে আপা! সমস্যা কী? সবার ঘরেই মা-বোন আছে। এরা কেউ আপনার ভাই, কেউ বাপের মতোন। বসেন, তাড়াতাড়ি চলে যাই।ʼʼ
অন্তূ হাসল, “জি একদম সঠিক কথা বলেছেন। বেগানা বলে শুধু একটা শব্দ রয়েছে, এর কোনো যুক্তি নেই। হুদাই এই শব্দটার উৎপত্তি। কারণ, যেহেতু বাড়িতে মা বোন সবার রয়েছে, সুতরাং বাইরের সবাই সবার মা-বোন। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই–পৃথিবীতে সবাই সবার মা-বোন। তো ভাই, আপনি আপনার কোন মা বা বোনকে বিয়ে করেছেন? জায়েজ হয়েছে তো বিয়ে?ʼʼ
-“ফাজলামি করার জায়গা পান না। নাটক? এইসব ঘোমটার তলে যে খেমটা চলে, তা তো লোক জানেনা? রাস্তাঘাটে বের হন ক্যান তাইলে? এত যখন দেমাগ, তখন উড়োজাহাজে চড়ে পথঘাটে চললেই পারেন।ʼʼ
অন্তূ মাথা নাড়ল, “আপনার পরামর্শ আমি মনে রাখবো, ভাই। এরপর যতদিন উড়োজাহাজ কিনতে অথবা যার তার পাশে গা লাগিয়ে চট করে বসে যেতে না শিখি, ততদিন আর বের হবো না।ʼʼ
লোকটা কিছু বলতে উদ্যত হতেই অন্তূর কণ্ঠস্বরের শীতলতা পিল্টে কঠিন, দৃঢ় হয়ে উঠল, “যান, দাঁড়িয়ে থাকবেন না আর।ʼʼ লোকটা আবার কিছু বলতে নিতেই অন্তূর কথার বিচ্ছুরণ তীব্রতর হলো, “আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে আসিনি, আমার কথাগুলো শোনার জন্য। আপনি এসে দাঁড়িয়েছেন, কথা তুলেছেন। যান…যান।ʼʼ নাকের পাটা শিউরে উঠল অন্তূর, চোখ তির্যক হলো।
অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ১২
গাড়িওয়ালা চলে গেল, অন্তূকে বাজে ভাষায় গালি দিতে দিতে। অন্তূর কানে এলো, গায়ে লাগল না। সে এদিক-ওদিক তাকাল। দৃষ্টি থামলো। অন্তিক রাস্তা পার হচ্ছে। সাথে একটা কালো কুচকুচে লোক। ভয়ংকর চেহারা-সুরৎ। গলায় কমপক্ষে বিশ-পঁচিশ রকমের চেইন। হাতে বালা, ঘাঁড়ে ট্যাট্টু। অন্তিকের মুখ-চোখ শুকনো। যে ছেলে কোনোদিন আম্মা অল্প ধমকে কথা বললে, সাতদিন হোটেলে খেত। তাকে লোকটা শাসিয়ে কথা বলছে বোধহয়, অন্তিক বাধ্যগতের মতো মাথা নাড়ছে, খুশি করার চেষ্টা করছে লোকটাকে। অন্তূ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। অন্তিক আর অন্তিক নেই, জীর্ণ-শীর্ণ এক ভিখীরি দেহে পরিণত হয়েছে। চোখের নিচটা কালো, মুখে মলিনতা।