অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ২৪
তেজস্মিতা মুর্তজা
অন্তূর ধারণা পলাশের ছেলেরা এসেছে। সে দরজায় কান বাধালো। বেশ লোক জমেছে। আজকাল তাদের বাড়িটা মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা। একটু কিছু হলেই মানূষ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে।
দুটো শ্বাস ফেলে গেইট খুলল সে। হাতটা থরথর করে কাঁপছে। কী আশ্চর্য! অন্তূ বুকভরে দম নিলো।
জয়ের ক্লাবের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। কবীরকে অন্তূ চেনে, সে চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিল অন্তূর দিকে। অন্তূ বেশ বিনয়ের সাথে বলল, “কেন এসেছেন আপনারা? কিছু হয়েছে?ʼʼ
-“জয় ভাইকে ডাকতে এসেছি। একটু ডেকে দেন।ʼʼ রাহাত বলল। তার অভিব্যক্তি একদম সরল-বাস্তব।
অন্তূ নিজেকে যথাযথ শান্ত রেখে বলল, “জি? বুঝতে পারছি না!ʼʼ
জয় ভাইকে ডেকে দেন। কাজ আছে ক্লাবে। কতক্ষণ হইলো ভেতরে ঢুকছে। বলেন আমরা আসছি।
অন্তূর হাতের আঙুলের ডগা লাফাচ্ছে। হাতের তালু ঘেমে উঠেছে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। সে মুঠো করে তার কামিজ চেপে ধরে বলল, “মশকরা করার মতো মেজাজ নেই আপাতত আমার। আপনারা কী বলছেন, বুঝতে পারছি না অথবা এরকম কোনো ইঙ্গিত বুঝতে চাইছি না।ʼʼ
রাহাত জয়কে ডাকতে ডাকতে ভেতরে এগিয়ে যেতে যেতেঞ বলল, “এই যে, ছোটআপু। আপনার সাথে আমাদের মশকরার সম্পর্ক না। জয় ভাই ঢোকার আগে বলছিল, একটু পর যেন ডাকি তারে। ক্লাবে ঝামেলা হইছে। উনাকে দরকার। একটু ডাকেন উনাকে। চলে যাইতে বললে চলে যাচ্ছি, কিন্তু উনাকে জানানো খুব দরকার। খবরটা জানিয়ে চলে যাব, কিন্তু তবুও ডাকেন একটু। ঘুমাচ্ছে নাকি?ʼʼ রাহাত পারফমেন্স ভালো ছিল। সন্দেহের অবকাশ নেই তার অভিব্যক্তিতে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অন্তূর মাথায় যেন টগবগিয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। ততক্ষণে পাড়ার লোক ঘটনায় বেশ আগ্রহ পেয়ে বসেছে। কেউ কেউ নিজেদের মাঝে আলোচনা শুরু করেছে, তো কেউ অপেক্ষা করছে আগামী দৃশ্য দেখার। অন্তূ অনেক কষ্টে সামাল দেয় নিজেকে, “তো আপনার ভাষ্যমতে, আপনাদের জয় আমিরের বাড়ির ভেতরে থাকার কথা?ʼʼ
রাহাত আর কথা বলল না। আত্মবিশ্বাসী গলায় ডাকা শুরু করল, “জয় ভাই? জয় ভাই? ঘুমায়ে গেছেন নাকি?ʼʼ
অন্তূর নাক শিউরে ওঠে, “বাড়াবাড়ি করবেন না যেন। ধৈর্য্যও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে বহন করি আমি। এখান থেকে জুতো দিয়ে পিটিয়ে বের করবে লোকে আপনাকে। নাটক না করে বেরিয়ে যান। অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকছেন কোন সাহসে?ʼʼ
রাহাতের কান অবধি পৌঁছালই না সেসব। তার মুখে-চোখে আত্মবিশ্বাস ভর্তি গাম্ভীর্য এবং দৃঢ়তা। সে আবার ডাকে, “জয় ভাই? ঘুমাই গেছেন নাকি? জয় ভাই…ʼʼ
অন্তূ মাথা ফাঁকা লাগছিল। সে জানে, ভেতরে কেউ নেই। তবুও বুকের ভেতরে ধুপধুপ আওয়াজ হচ্ছে, রাহাতের চোখে মুখের আত্মবিশ্বাস তাকে ভঙ্গুর করে তূলছিল। সামনের আগ্রহী জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে তার শরীরে কম্পন উঠে যাচ্ছিল।
জয় বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। সবে ঘুম ভেঙেছে তার। হাই তুলল একটা। অন্তূ দেখল সেটা কৃত্রিম। জনগণ তা বুঝল না কেবল। জয় ঘুম ঘুম গলায় বলল, “কী সমস্যা? এত ডাকাডাকি কীসের?ʼʼ
অন্তূ জমে গেল। তার মস্তিষ্ক এবং হৃৎপিণ্ড একত্রে কার্যক্ষমতা হারাল। জয়ের পরনে শুধু একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, সেই প্যান্টের ওপর দিয়ে নিচের আন্ডারওয়ারের অল্প কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। নীলচে-কালো শার্টটা হাতে ছিল, গায়ে কিছু নেই, তা কাধে রাখতে রাখতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে গেইটের কাছে দাঁড়ায় জয়। দেখতে বিশ্রী লাগছিল ব্যাপারটা। এবং তা সপষ্ট নোংরা ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অন্তূর মনে হচ্ছিল, সে মরে যাচ্ছে। আঁটকে থাকা নিঃশ্বাসটুকু কম্পিত তরঙ্গ মতো বাতাসে আঁছড়ে পড়ে। জয় অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার আরমিণ! এত লোকের ভিড় ক্যান? কী হইছে?ʼʼ
অন্তূ নির্জীব হয়ে উঠল। লোকেরা এবার একে একে নিজেদের মূল্যবান মন্তব্য পেশ করল। সর্বপ্রথম অবাক চোখে এগিয়ে এলেন পাশের বাড়ির দুজন মহিলা, “আরে? এইডা ওই যে মেম্বারের ভাগনি না? জয়! ওওও! ঘোমটার তলে খেমটা চলে মাইনষে কি আর এমনি কয়? এই যে শোনো সগ্গলে, আইজকা যা দেখতেছ নতুন কিচ্ছু না। আমরা একদিন হেরে বাড়িত যাইয়াও ওই পোলারে দেখছি। ছেঁড়ির মা কত আদর কইরা খাওয়াইতেছিল, ছি ছি ছি! থুহ! মাস্টারের মাইয়া! হুহ! আবার মুকুশ পইরে বেড়ায়। কাউরে মুখ দেহায় না। ভণ্ডামি দেখছো? ঘরের ভিত্রেই যদি প্রতিদিন এমনে বেটাছেলে পাওয়া যায় হেই আবার বাইরে কারে মুখ দেহাইবো? দরকারই তো নাই। নষ্টামি তো ঘরের ভিত্রেই চলতাছে।ʼʼ
একজন লোক জিজ্ঞেস করে মহিলাকে, “আগেও দেখছেন নাকি ওই চেংরারে… মাইনে জয়রে?ʼʼ
মহিলা তাচ্ছিল্য করে একদলা থুতু মাটিতে ফেলে, আড়চোখে উদ্দেশ্য তার অন্তূর ওপর, “হ দেখছি মানে? ওর মায় তো আব্বা আব্বা কইরা খাওয়াতেছিল। আমরা ঢুকতেই তাত্তারি বাইর হইয়া গেল। ওর বাপ আইলো, হেইও ভিত্রে চইলে গেল, কিস্যু কইল না। ওইদিনই সন্দে হইছিল। আবার এই ছেঁড়ি সেদিন দেখলাম মুকুশ না পইরাই বাইরেত্তে ঘুইরা আইলো।ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজে সজোরে শ্বাস টেনে নেয়। জয়ের ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা হয় না! এক রত্তিও ভুল বলে না জয়।ওর তো গণক হওয়া উচিত! সেদিন পলাশের ছাদে হাসতে হাসতে কী চমৎকার করে বলেছিল, “তুমি আমায় থুতু দিলে, আরমিণ? লোকেও তোমায় থুতু দেবে, সত্যি বলছি!ʼʼ
জয়ের প্রতি মুগ্ধতায় অন্তূর দুচোখ ভিজে ওঠে অন্তূর। একটা লোকের এত জেদ? নিজের অপরাজেয়, অনৈতিক শক্তির ওপর এত দম্ভ? এত তার কূটিলতা? আর শক্তিও তো অগাধ! বাঁচাতেও পারে, মারতেও! সেদিন বাঁচিয়ে এনেছে আজ মারার জন্য! ঠোঁটের কিনারায় হাসি ছলকায় অন্তূর। বহুবার সতর্ক করেছে জয় ওকে, অথচ খুব হালকাভাবে নিয়েছে সে। ভার্সিটিতে প্রতিবার জয়ের চোখে তাকিয়ে রুহু কেঁপে উঠলেও পরে ভুলে যেত জয়ের নির্লিপ্ততা দেখে। অথচ জয় বলেছিল, “সে সে থাবা দিয়ে ধরেবে না, কুকুরের ছ্যাঁচড়ামির মতো ধীরে সুস্থে নির্লজ্জতার সাথে ধরবে, ঝরঝর করে ঝরে পড়বে অন্তূ।ʼʼ
অন্তূ অবাক হলো সবচেয়ে বেশি, সবার অভিনয়ে।বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব তাদের অভিব্যক্তি। সাজানো, পরিকল্পিত ঘটনাকে জীবন্ত করে তুলেছে ওদের অভিনয়।
এক বৃদ্ধা এগিয়ে আসে, “এই ছেঁড়িরে একঘরে করো বাপু সকল। এইসব পাড়াডার বদনাম করবো। ও ছেঁড়ি, এত দেহি পদ্দা করো, তুমার পদ্দার উপ্রে থুহ। ঘরে বেডা শুয়াইয়া রাখতে দিয়া বাপ-মায় গেছে কোনে? ছি ছি ছি ছি? বাপের জর্মে এইসব দেহিনাই।ʼʼ
অন্তূ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোনে সবার মূল্যবান মন্তব্য। কেউ কেউ বলছে, ‘এইজন্যিই তো কই, দজ্জা খুলতে এত দেরি লাগাইতেছ ক্যা? সেই কখন থেকে আইসা এই ছেঁড়াগুলান ডাকতেছিল, খোলে না তে খোলেই না।’
অন্তূর বিয়ে নিয়ে এসেছে বহুলোকে বহুবার। অন্তূ অপমান করতো অথবা প্রত্যাখান। তারা আজ তাকে ছাড়বে কেন?
মহিলা এসে এক থাবায় অন্তূর মুখ থেকে ওড়নাটা টেনে খুলে ফেলে। বেরিয়ে আসে সদ্য গোসল করা গামছাটা মোড়ানো ভেজা মাথাটা। সকলে কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে হিসেব মেলায়! এবার তারা দৃঢ় বিশ্বাসে ফেটে পড়ে। চমৎকারভাবে প্রমাণ হয়ে গেল তাদের কাছে অন্তূর নোংরামি। এতক্ষণ সন্দেহ ছিল তাদের। এবার আর রইল না। ‘নষ্টামি করে লাং শুইয়ে রেখে আবার গোসল করে বের হয়েছে!ʼ—গুঞ্জন উঠল।
‘ওহ! তাইলে কুকাম করে লাংরে বিছানায় শুয়াইয়া রাইখা ফরজ গোসলে ঢুকছে মা-গী? হেরপর সেইখান থেকে বাইর হইয়া আইছো? ওরেছিঃ ছি ছিই!ʼ রব উঠল মন্তব্যের।
অন্তূ অন্তত মোড়ানো গামছাটা মাথায় রাখতে চেয়ে তাও পারল না। মহিলা টেনে হিচড়ে খুলে ফেলে গামছাটা। পিঠ বেয়ে ছিটকে পড়ল ভেজা লম্বা চুলগুলো। কাঠের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয় অন্তূ। সে অবাক হচ্ছে, তার কোনো প্রতিক্রিয়া আসছে না, কান্না পাচ্ছে না।
জয় একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ধোঁয়া গিলছে। অন্তূ না তাকিয়েও টের পায়, জয়ের চোখদুটো হাসছে। খিলানের মতো নাকের পাটা’দুটো ফুলে ফুলে উঠছে, আবার ভ্রু জোড়া অহংকারে পুরু হয়ে উঠছে। জয় খারাপ কিছু করার পর খুব সজল হয়ে ওঠে, যেন সে খানিক জীবনীশক্তি পায়। তার খারাপ হওয়ার পিছনে কোনো কারণ নেই, সে খারাপ তাই সে খারাপ।
অনেক লোক জমেছে খেলা দেখতে। এক বৃদ্ধা এবার হই হই করে উঠলেন, “ওই ওই ওই, তুমরা কি এমনেই দাঁড়াইয়া ওই মা-গীর ঢং দেখবা? চুল-নাক কাইটা বাইর করো ওসব বালাই দ্যাশ থেকা।ʼʼ
কেউ কেউ পরামর্শ দিলো, শরীয়তের বিধান অনুযায়ী ব্যাভিচারের শাস্তি মাটিতে গলা অবধি পুঁতে আশিটা বেত্রাঘাত। অন্তূ তাদের আলোচনা খুব মনোযোগ সহকারে দেখছিল এবং শুনছিল।
অন্তূর দিকে তাকাল জয়। চোখাচোখি হলো দুজনের। অন্তূর ঠোঁট দুটো হেসে উঠল। যে কেউ দেখতে পাবে না সেই হাসি। তরল রক্তের মতো চিকচিক করছিল সেই হাসি অন্তূর চোখের তারায়।
পুরুষ এবং কলঙ্ক এ দুটো শব্দ একসাথে হয় না কখনও। কলঙ্ক শব্দটি নারীসত্ত্বার জন্য প্রযোজ্য কেবল। পুরুষ কলঙ্ক বইতে জন্মায় না জগতে। তারা স্বাধীন, তারা আমরণ কলঙ্ক-বিচ্ছিন্ন। একই পাপের মাশুল পুরুষ ও নারীর জন্য ভিন্ন হয় এ সমাজে। নারীর মসৃণ চামড়ায় বরং কলঙ্কের জন্য অনুকূল পদার্থ লেগে থাকে, নারী কলঙ্কের জন্য এবং কলঙ্ক নারীর জন্য চুম্বকের মতো আকর্ষিক। একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে দুটোকে আনলে দুটো ছিটকে এসে পরস্পরের দেহে লেপ্টে যায়; চিরতরে।
জয়ের ক্ষমতা অসীম। তার দিকে আঙুল তোলার সাধ্যি কারও নেই। তারা অন্তূর দোষের কলঙ্কও অন্তূর গায়ে এবং জয়েরটুকুও একসঙ্গে অন্তূর গায়েই ছিটিয়ে দিচ্ছিল।
মৌলবী সাহেব এলেন। সব শুনলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। হামজা এসে বসেছে। তাকে চেয়ার দেয়া হয়েছে মৌলবি সাহেবের পাশে।
অন্তূর খোলা চুলগুলো শুকিয়ে গেছে। আজ সবাই পরাণভরে অন্তূকে দেখেছে। মাস্টারের মেয়েকে সেই ছোট বেলায় দেখেছিল সবাই, এরপর বহুবছর আর দেখেনি কেউ। অথচ মাস্টারের মেয়ে যে ঘোমটার তলে তলে নষ্টামি করতো তা কি কেউ আন্দাজ করতে পারেনি? কতবার তারা মাস্টারকে বলেছিল, ভার্সিটিতে না পড়িয়ে বিয়ে করিয়ে দিতে। মেয়েটার দেমাগ ছিল বেশি। আজ পণ্ড হয়েছে তো! পাড়ার পুরুষেরা মন ভরে দেখল অন্তূকে। ফর্সা শরীরে খয়েরী রঙা ঢিলেঢালি সেলোয়ার কামিজ, ওড়নাটা গায়ে আছে কোনোমতো। উস্কো-খুস্কো লম্বা লম্বা চুল পিঠে অবহেলিতভাবে ছড়ানো।
হামজার পরনে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী। মেয়র সে। তার মুখটা কঠিন মৌলবি সাহেব বললেন, “যেহেতু অবিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যাভিচারে লিপ্ত হইছে, সেই হিসাবে শরীয়তের বিধান হইল, দুইজনকে দোর্রা মারা। মরে গেলে গেল, বেঁচে থাকলে পাপ মুক্ত।ʼʼ
একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে লোকেরা। এইসব আগের কালে দেখা যেত। এখন এসব উঠে গেছে। মানুষ প্রকাশ্যে অকাম করে বেড়াচ্ছে। তবুও পাড়াটা তো আর বোডিং বা হোটেল না!—সবার আলোচনা একই রকম। তারা এর একটা বিহিত চায়। আর তাছাড়াও সকলের মাঝে একটা চাপা ক্ষোভ বোধহয় জয়ের জন্যও কাজ করছিল। জয় খারাপ তা সবাই জানে, সবাই। অথচ ভয়ে কেউ মুখে আনলো না, বোঝাতে চাইল না কিছুই।
অন্তূ আকাশের দিকে তাকায়। কয়েকবার প্রাণভরে আব্বুকে ডাকল। কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ প্রয়োজন হয়নি তাকে ব্যৃভিচারিণী বলার জন্য। জয়ের ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আর অন্তূর ভেজা চুল যথেষ্ট।
আব্বু আসবে বিকেল বা সন্ধ্যায়। অন্তূ চায়, তার আগে তাকে মেরে ফেলা হোক। এতক্ষণে তার একটা শব্দও শোনেনি কেউ বা বলার সুযোগ দেয়নি। সে আর বলতেও চাইল না। কলঙ্ক এখন অ-প্রমাণিত হলেও মুখে মুখে একটা দাগ এবং রটনা থেকে যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় মরে গেলে। অন্তূর খুশি লাগছিল খুব।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পুরো জনতার মাঝে। তা ভাঙল হামজা। মৌলবিকে বলল, “আর কোনো বিকল্প নেই এর? আপনাদের ভাষ্যমতে যা হবার হয়ে গেছে। আর কোনো গ্রহনযোগ্য শাস্তি বা মীমাংসা আছে?ʼʼ
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। এরপর একজন বৃদ্ধলোক এগিয়ে আসে হামজার দিকে। বৃদ্ধদের সাথে সামাজিক কর্মের মাধ্যেমে হামজার বেশ খাতির আছে। লোকটা হাইকোর্টের সাবেক উকিল। তিনি যেন রাগত স্বরে তাচ্ছিল্য করে চট করেই বললেন, “আর কী করবে? যা ঘটনার বিবৃতি আসছে, বিয়ে দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে?ʼʼ
সকলে সপ্রতিভ হয়ে উঠল। এই পদ্ধতিই তো চলমান এখন। দোর্রা মারার প্রচলন এবং কাল চলে গিয়েছে। এখন কেউ অকাম করলে ধরে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। হামজা নিজস্ব গাম্ভীর্য বজায় রেখে অথচ চট করে বলে ওঠে, “ধরুন যদি দিয়ে দিই? আপনারা তা গ্রহণ করবেন, সম্মতি দেবেন? সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে।ʼʼ
অন্তূ হৃদযন্ত্রটা লাফিয়ে উঠল। হামজা অতিরিক্ত চতুর। তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে এত চমৎকারভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছে, মানুষ এতক্ষণে তাকে মহান ধরে নিয়েছে।
বৃদ্ধ বললেন, “বিয়ে দিতে চাও, তুমি?ʼʼ
-“আমার যদি আপত্তি না থাকে মেয়েকে জয়ের বউ করে ঘরে তুলতে! যা করেছে জয়ের সাথেই তো করেছে! আপনাদের মতামত কী?ʼʼ
অন্তূ মাথাটা ঝিনঝিন করে ওঠে। সকলের মাঝে গুঞ্জন উঠল। মনে হলো বেশ পছন্দ হয়েছে বিষয়টা সবার।
জয় গর্জে উঠল হামজার কানে, “পাগল হইছো তুমি? ওই শালীর মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরবে, তবুও দেখা যাচ্ছে আমায় কবুল করবে না। আমিও ওরে বিয়ে করতে পারব না। ওর সাথে আমার পোষায় না, আমার ওর মাঝে বিশাল ঘাপলা আছে… মাঝে কাহিনি জটিল। এসব বাদ দাও। অন্যকিছু করো।ʼʼ
হামজার কানে গেল না সেসব।
অন্তূ হুড়মুড়িয়ে মৌলবির সামনে যায়, “হুজুর? আমার কিছু কথা বলার আছে। আমার কথাটা একবার শুনুন। আমি…ʼʼ উদ্ভ্রান্তের মতো ঢোক গিলল মেয়েটা, “….আমি কিছু কথা বলতে চাই।ʼʼ
মৌলবি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। অন্তূ অনুমতির অপেক্ষা করে না, “বিশ্বাস করুন এমন কিছুই হয়নি। যা দেখেছেন আপনারা সব চোখের ধাঁধা। মানে আমি বোঝাতে পারছি না ব্যাপারটা। আপনাদের যা দেখাতে চাওয়া হয়েছে, আপনারা তাই দেখছেন। আসলে এমন কিছুই হয়নি। কৌশলের কাছে হেরে গেছেন আপনারা। এখানে নিখুঁত একটা ট্রিক্স খাটানো হয়েছে।ʼʼ
কারও কানেই যেন গেল না অন্তূর ভারী শব্দের কথাগুলো। অন্তূর শিক্ষিত, মার্জিত, যুক্তি-তর্কের কথা হিতে বিপরীত কাজ করতে শুরু করল। অন্তূ থামে না। বলে চলে, “জয় আমির আমাদের বাড়িতে কী করে ঢুকেছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার। আমি গোসলে ছিলাম, তাই গেইট খুলতে দেরি হয়েছে। জয় আমির ভেতরে কী করে এলো সেটাই অস্পষ্ট আমার কাছে..ʼʼ
উপস্থিত জনতা বিরক্ত হয়ে গেল, “তো কী চাইতেছ? মানে এইসব নাটক দিয়া কী বুঝাইতেছ, ওইডা কও! এই ছেঁড়িরে কেউ ধরেন তো।ʼʼ
অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ২৩
অন্তূ গর্জে উঠল, “আমি কোনো পাপ করিনি, আমি বিয়ে করব না। আপনারা জুলুম করছেন আমার ওপর…ʼʼ
থপ করে একদলা থুতু এসে মুখে পড়ে অন্তূর গলার কাছে। জয় অসন্তুষ্টিতে চোখ বুজে ফেলে—ইশ! অল্পের জন্য থুতু মুখে লাগেনি। আর একটু উপরে ফেললেই মুখে পড়ত থুতুটুকু। অন্তূর ছোঁড়া থুতু জয়ের চোয়ালের ওপর দিয়ে চোখের কিনারা ঘেষে লেগেছিল। মহিলাটা ঠিকমতো থুতুও দিতে জানেনা! মহিলাকেও কিছু অশ্রাব্য গালিগালাজ করল জয়।
