অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৬৯

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৬৯
নুসাইবা ইভানা

নীলাঞ্জনা চিৎকার করে বলল, “নয়না!” ততক্ষণে নয়না লুটিয়ে পড়েছে ফ্লোরে।
জাহানারা বেগম কিচেন থেকে দৌড়ে এসে নীলাঞ্জনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে দ্রুত নয়নার কাছে এলেন। নয়নার মাথা কোলে তুলে নিয়ে তাকে ডাকতে লাগলেন। নয়না নিথর হয়ে পড়ে আছে।
জাহানারা বেগম নিজের ফোন থেকে মাহবুব তালুকদারকে কল করলেন। মাহবুব তালুকদার বললেন, “আমি আসছি।”

ফোন রেখে জাহানারা বেগম নীলাঞ্জনাকে বললেন, “টেবিল থেকে পানি আনো।” পানি নিয়ে নয়নার চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন, তবুও নয়নার চোখ খুলল না।
মাহবুব তালুকদার এসেই নয়নাকে কোলে তুলে নিলেন। দ্রুত বেরিয়ে গেলেন হাসপাতালের উদ্দেশে।
হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছেন মাহবুব তালুকদার, মিজান তালুকদার, আর জাহানারা বেগম।
ডাক্তার এসে বললেন, “চিন্তার কোনো কারণ নেই। অতিরিক্ত টেনশনে ব্রেন চাপ নিতে পারেনি। খেয়াল রাখবেন, এরকম পরিস্থিতি যেন আর সৃষ্টি না হয়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জিয়ানের হঠাৎ জ্বর এসেছে। জ্বরে কাল সারারাত ঘুম হয়নি। বারকয়েক নয়নাকে কল করেছিল, কিন্তু নয়নাকে পাওয়া যায়নি। জিয়ান এখন বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তার সামনে বসে আছে ইরা।
ইরা হেসে বলে, “ডাক্তার ইরা। মিস্টার পাইলট, অবশেষে আমি আপনার কাজে এলাম।”
জিয়ান বলল, “মিস ইরা, আপনাকে কর্তৃপক্ষ হয়তো এই দায়িত্ব দিয়েছে। এটা আপনার ডিউটি। আমার সঙ্গে আপনার কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই।”

ইরা বলল, “আপনি সব সময় এত কঠিন করে কথা বলেন কেন? সহজভাবে কথা বলা যায় না?”
জিয়ান উত্তর দিল, “আসলে আমি মানুষটাই ভালো না, তাই সহজভাবে কথা বলতে পারি না।”
ইরা বলল, “মেডিসিনগুলো ঠিকমতো খাবেন। আর হ্যাঁ, তিন দিন পূর্ণ বিশ্রাম। এই তিন দিনের মধ্যে কোনো ফ্লাইট অ্যাটেন্ড করতে পারবেন না। আমি বিকেলে আবার এসে একবার চেকআপ করে যাব।”
জিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার বাবাকে খুঁজে পেয়েছেন?”
ইরা বলল, “যে আমার মাকে সুখ দিতে পারেনি, তাকে খুঁজে বের করে কী হবে?”
জিয়ান বলল, “যে ছেড়ে যায়, তাকে দাফন করে ফেলতে হয়। মনে করবেন সেই মানুষটা মরে গেছে। ধোঁকাবাজ মানুষকে মনে রেখে কষ্ট পাওয়া বোকামি। তারা শুধু যন্ত্রণা দিতে জানে। আর নিজেদের মিষ্টি কথার ফাঁদে ফেলে ধোঁকা দিতে জানে।”

ইরা বলল, “আগে ইচ্ছে করতো জন্মদাতা পিতাকে একবার হলেও দেখব। তার চেহারা দেখার তীব্র ইচ্ছে জাগতো। এখন মনে হয়, ভুল করেও যেন ওই জঘন্য মানুষটার প্রতিচ্ছবি আমার দৃষ্টিতে না পড়ে।”
জিয়ান বলল, “ধন্যবাদ, মিস ইরা। ডাক্তার ইরা।”
ইরা হেসে বলল, “ওয়েলকাম, মিস্টার পাইলট। তবে একটা তিতকুটে সত্য জানেন?”
জিয়ান বলল, “জানান।”

ইরা বলল, “কোনো মানুষের সঙ্গে অন্যায় করলে ভবিষ্যতে তার ফল ভোগ করতেই হয়। হয়তো যার সঙ্গে অন্যায় করেছো, ধোঁকা দিয়েছো, যন্ত্রণা দিয়েছো, সে হাসিমুখে সবটা মেনে নিল। কিন্তু তার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, প্রতিটি আর্তনাদ তোমার জীবনের সুখটাকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে। অন্যকে কষ্ট দিয়ে সাময়িক সুখ পাওয়া যায়। তবে মনে রেখো, কর্মফল ভোগ করতেই হয়। আমি জানি, ওই মানুষটা কোনোদিন সুখী হবে না, কোনোদিন না।”
জিয়ান বলল, “মানুষ এসব ভাবে না, মিস ইরা। এইটুকু সহজ কথা ভাবলে তারা কাউকে কষ্ট দিতে পারত না। বিশেষ করে যে মানুষটা তাকে ভালোবেসেছে, বিশ্বাস করেছে, ভরসা করেছে, তাকে কখনোই ধোঁকা দিতে পারত না। তবে অপর পক্ষের মানুষটা ঠিকই ভালো থাকে। এরকম দুমুখো মানুষ জীবন থেকে সরে গেলে ভালো থাকা সহজ হয়।”

ইরা বলল, “অনেকদিন পর গল্প করার মতো মানুষ পেলাম। এখন উঠি, আরো পেশেন্ট আছে। বিকেলে কথা হবে। আচ্ছা, আপনার বাঙালি খাবার পছন্দ?”
জিয়ান বলল, “হ্যাঁ। বাঙালি ছেলে, আর বাঙালি খাবার পছন্দ হবে না!”
ইরা চলে যেতেই জিয়ান চোখ বন্ধ করল। বাংলাদেশে এখন দুপুর একটা বাজে। এখনো নয়না কল করল না কেন!
জিয়ান বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোন সুইচড অফ। সাথে সাথে ফোন অন করে। অনেকগুলো মিসড কল উঠে এসেছে। জিয়ান সাথে সাথে কল ব্যাক করে। নয়নাকে অনলাইনে না পেয়ে নয়নার নম্বরে কল করল।

নয়নার হাতে স্যালাইন চলছে, হাত নাড়াতে পারছে না। ফোন বেজেই চলেছে। নয়না জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, উনি হয়তো কল করেছেন। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরো।” লজ্জা-সংকোচ কাটিয়ে মুখ ফুটে বলল কথাটা।
জাহানারা বেগম কল রিসিভ করে নয়নার কানের পাশে ফোন ধরলেন।
নয়নার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।
জিয়ান নরম স্বরে ডাকল, “সুনয়না, ঠিক আছো তুমি? এই কথা বলছ না কেন? লাইনে আসো, দেখব তোমাকে। এই, শুনছো আমার কথা?”
নয়না কথা বলতে চাইছে, কিন্তু তার কথাগুলো শব্দ হয়ে বের হচ্ছে না। দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে।

জাহানারা বেগম ফোনটা তুলে কানের কাছে ধরলেন।
জিয়ান বলতে থাকে, “জান, প্লিজ কথা বলো। কী হয়েছে তোমার, জান? রাগ করেছো? একবার ভিডিও কলে আসো, আমার হৃদয় বিতৃষ্ণা শুরু হয়েছে। কথা বলো না।” এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছে জিয়ান।
জাহানারা বেগম চুপ করে ফোন কেটে দিলেন। এরপর নিজের বিকাশ থেকে নয়নাকে ডাটা প্যাক কিনে দিয়ে জিয়ানকে ভিডিও কল করলেন। ফোনটা নয়নার পাশে থাকা টেবিলের ওপর রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
জাহানারা বেগমের চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু। তিনি বুঝতে পেরেছেন, জিয়ান তার মেয়েকে কতটা ভালোবাসে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর সাক্ষ্য হচ্ছে নিজের মেয়ের সুখের সাক্ষী হওয়া।
জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। নয়না জিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই চুপ। তবুও তাদের চোখে চোখে যেন কথা আদান-প্রদান হচ্ছে। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর জিয়ান বলল, “কী হয়েছে তোমার? হাসপাতালে কেন তুমি?”

নয়না মৃদু হেসে বলল, “আপনার শোক। আপনার শোক আমাকে হাসপাতালের বিছানায় নিয়ে এসেছে। ভেবে দেখেছেন, আপনার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে আমার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে হয়তো।”
জিয়ান বলল, “চুপ, একদম চুপ। সোজা উত্তর দাও, বলো কী হয়েছে?”
নয়না বলল, “জানি না কী হলো। হঠাৎ করে আপনার টেনশনে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। যখন চোখ খুললাম, তখন হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম নিজেকে।”
জিয়ান বলল, “আর ইউ ক্রেজি? তুমি এত দুর্বল হলে চলবে?”
নয়না বলল, “আমার কী দোষ? ঘুম থেকে উঠে আপনার এতগুলো মিসড কল দেখলাম। দ্রুত কল করলাম, দেখি আপনার নম্বর বন্ধ। এতবার চেষ্টা করলাম, তবুও কল ঢুকল না। হঠাৎ আমার মনে হলো আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি। অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল হৃদয়ে। তারপর আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। এরপর আর কিছু মনে নেই।”

জিয়ান বলল, “ঠিকমতো খাবার না খেলে তো এমন হবেই। আর এমন উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা আসে কোথা থেকে তোমার? কী হাল করেছ নিজের? দেখো, সুনয়না, আমি বেঁচে থাকি বা না থাকি, তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে। তুমি পৃথিবীতে আছো, মানে আমার একজন ভালোবাসার মানুষ পৃথিবীতে আছে। তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে আমার জন্য।”
নয়না বলল, “আপনার চোখমুখ এত শুকনো লাগছে কেন? চোখ দুটো কেমন লালচে, কী হয়েছে?”
জিয়ান বলল, “তেমন কিছুই না। রাতে সামান্য জ্বর এসেছিল। এখন সেটাও বিদায় নিচ্ছে।”
নয়না বলল, “কত জনম ধরে আপনাকে স্পর্শ করি না। আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি না। মনে হচ্ছে, যুগ যুগ আমাদের দেখা হচ্ছে না।”

জিয়ান বলল, “এবার আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। হঠাৎ চলে আসব, না বলে। চিনতে পারবে তো?”
নয়না বলল, “আপনার স্পর্শ, আপনার শরীরের ঘ্রাণ আমার চিরচেনা। আপনি আমার সামনে দাঁড়ালেই আমার হৃদয়স্পন্দন তীব্র গতিতে চলতে থাকে। আপনার দৃষ্টির গভীরতা আমাকে অনুভব করায়, আপনি আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রিয় পুরুষ।”
জিয়ান বলল, “আহা, জান। এত ভালোবাসো আমাকে?”
নয়না বলল, “আমি বাসি নাকি ভালো! আমার হৃদয়টাকে নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছেন। এই অবাধ্য হৃদয় তো আপনাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না।”

জিয়ান বলল, “জান, তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না। দ্রুত সুস্থ হয়ে বাসায় আসো তো, পাখি।”
নয়না বলল, “এই স্যালাইন শেষ হলেই বাসায় চলে আসব। আরে, ডাক্তাররা কোনো রোগ না পেলে স্যালাইন লাগিয়ে দেয়। আমি কি অসুস্থ নাকি!”
জিয়ান হেসে বলল, “তুমি বড্ড আদুরে বাটার মাশরুম। তোমাকে দেখলেই টুপ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসি তোমাকে, আমার বাটার মাশরুম।”

অনিকেত তিন দিন ধরে হাসপাতালে যায় না।
সায়না খুন্তি সামনে ধরে কোমরে হাত দিয়ে বলে, “সমস্যা কী তোমার? এভাবে বেড়ালের মতো বাসায় বসে থাকো কেন?”
অনিকেত বলল, “আমার লজ্জা লাগে।”
সায়না বলল, “কীসের লজ্জা?”
অনিকেত বলল, “সবাই যখন জানবে আমি বিবাহিত।”
সায়না বলল, “তো, জানলে কী? আপনার জামাকাপড় খুলে নেবে?”
অনিকেত বলল, “উঁহু। সবাই বুঝে যাবে আমি ওসব করেছি।”

সায়না কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “ওসব আবার কী? আরে, বাবুটা! কচি খোকা আমার। আপনি তো মেয়ে, আপনার তো লজ্জা লাগবেই। তা দেখি, আপনার শরীরের কোথায় কোথায় লেখা আছে, ওসব করলে লজ্জা পেতে হবে? করার সময় তো লজ্জা-টজ্জা পেতে দেখলাম না।”
অনিকেত বলল, “এসব কী বলো? চুপ করো।”
সায়না বলল, “আহারে, বাবুটা লজ্জা পাচ্ছে। উঠে সোজা ফ্রেশ হয়ে হাসপাতালে না গেলে বাসার বারান্দায় বড় করে বিলবোর্ড টাঙাব। সেখানে বড় করে লেখা থাকবে, ‘ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ রাতদিন বউয়ের সঙ্গে বাসর করে।’”
অনিকেত বলল, “এই, না, প্লিজ।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৬৮

সায়না বলল, “আপনি কি পুরুষ, নাকি হাফ লেডিস? পুরুষ মানুষের এসব শরম-টরম থাকতে নেই। তাহলে জগতে আর বংশবিস্তার হতো না। উঠে দ্রুত হাসপাতালে যান। আর হ্যাঁ, যাওয়ার সময় মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন।”
অনিকেত সায়নার দিকে আড়চোখে তাকাল।
সায়না অনিকেতের দিকে ঝুঁকে বলল, “কিস খাবেন?”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭০