অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২২
ইয়াসমিন খন্দকার
নিঝুমের ঘরে গভীর নীরবতা। মিটমিটে আলোয় বিছানায় শুয়ে থেকেও তার চোখে ঘুম নেই। আবরাজের কথাগুলো তাকে অস্থির করে তুলেছে।
“কাউকে এতোটা বিশ্বাস করো না, নিঝুম। বিশ্বাসই একদিন তোমার সর্বনাশ ডেকে আনবে।”
আবরাজের মুখ থেকে বলা এই কথাগুলো যেন কানে বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছে।
নিঝুম ভাবছে, ইমরান কি সত্যিই তার ক্ষতি চাইতে পারে? ছোটবেলা থেকে ইমরান তো সবসময় তার পাশে থেকেছে, তার অন্যতম বড় একটা ভরসার জায়গা ছিল ইমরান। জীবনের কঠিনতম সময়ে ইমরানই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল স্কুলজীবনে। তাহলে আবরাজ কেন এমনটা বলছে?
নিঝুমের মনের গভীরে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকল। ইমরানকে বিশ্বাস করতে গিয়ে সে কি কোনো ভুল করছে? নাকি আবরাজ ইমরানকে ভুল বুঝছে?
“উনি কি আমার ভালো চান? নাকি এটা শুধুই ওনার রাগ বা হিংসা?” নিজের মনের প্রশ্নে বারবার জবাব খুঁজতে গিয়ে নিঝুম আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অন্যদিকে আবরাজেরও ভেতরে তোলপাড় চলছে। বিছানায় শুয়ে থাকা তার জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে আপন মনে বলে,
“আমি কি নিজের অধিকারের বাইরে চলে যাচ্ছি? নিঝুমের জীবনে আমার হস্তক্ষেপ করার অধিকার আসলেই কি আছে? ওকে বলা আমার কথাগুলো কি ওর জন্য বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?”
নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আবরাজ ধীরে ধীরে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। সে ভাবে,
“আমি কি নিঝুমকে শুধু একজন দায়িত্ব হিসেবে দেখি, নাকি সে আমার জীবনের এমন এক অংশ হয়ে গেছে যাকে ছাড়া আমি অচল?”
গভীর রাত। নিঝুম চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেও তার মনে শান্তি নেই। আবরাজের বলা কথাগুলো তার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ইমরান কি সত্যিই এমন কিছু করতে পারে, যা তার ক্ষতির কারণ হবে? নাকি এটা আবরাজের মনগড়া অভিযোগ? নিঝুম বুঝতে পারছে না কাকে বিশ্বাস করবে।
কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিল। গত কিছুদিন ধরেই আবরাজের ব্যবহার তার সুবিধার লাগছে না। তার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো, আবরাজ কি সত্যিই স্মৃতি হারিয়েছে? নাকি এটা নিছকই একটা নাটক? যদি এটা নাটক হয়, তাহলে এর পেছনে উদ্দেশ্য কী?
“আমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য কি অবস্থা উনি নতুন ফাঁদ পাতছেন?”
নিজেকে প্রশ্ন করল নিঝুম।
এমন সময় তার মুঠোফোন বেজে উঠল। ইমরান কল করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে একটু দ্বিধা করলেও শেষমেশ কলটা রিসিভ করল।
ইমরান বলল,”কিরে, তুই কেমন আছিস এখন? এত রাতে ফোন করার জন্য আমি দুঃখিত কি করবো বল, তোর জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছিল।”
নিঝুম বলল,”ভালোই আছি।”
ইমরান যেন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই ঠিক ভালো নেই। আমি বুঝতে পারছি। আবরাজ ব্রো যা করল, সেটা আমার একদম ভালো লাগেনি। তুই কি ভেবেছিস ওর এই রাগ আর অধিকারবোধ কি সত্যি নাকি তার অভিনয়?”
নিঝুম চুপ। ইমরানের কথা শুনে তার মনে সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো।
“আমি জানি না, ইমরান। সবকিছুই এখন যেন একটা ধাঁধা হয়ে গেছে। ওনার কথাবার্তায় কখনো কখনো মনে হয় সত্যিই উনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। আবার কখনো মনে হয় উনি আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এসব করছেন।”
ইমরান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,”তাহলে পরীক্ষা করে দেখ। সত্যিটা বের কর।”
“পরীক্ষা? সেটা কীভাবে করব?”
“ওনার স্মৃতিশক্তি হারানোর বিষয়টা খুব সাধারণভাবে মেনে নিয়েছিস তুই। অথচ এটা যদি সত্যি না হয়, তবে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ ধরা পড়বেই। ওনার পুরোনো জীবন, পুরোনো স্মৃতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন কর। এমন কিছু যা শুধু একজন আবরাজ খান জানে। যদি নাটক হয়, তবে ধরা পড়ে যাবে।”
“কিন্তু ডাক্তারি রিপোর্ট, সেগুলো তো বলছে উনি সত্যিই স্মৃতি হারিয়েছেন।”
“টাকা দিয়ে এমন হাজারো মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করা যায়৷ তুই সত্যিটা খোঁজার চেষ্টা কর।”
ইমরানের কথা শুনে নিঝুমের মাথায় চিন্তার নতুন একটা দরজা খুলল। সে সেদিনের মতো ফোন রেখে দিয়ে বলল,”এবার আমি সত্যটা খুঁজে বের করবোই।”
পরের দিন সকালে আবরাজ ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছিল। নিঝুম তার জন্য চা নিয়ে এলো। চায়ের কাপ টেবিলে রাখার সময় তার চোখ আবরাজের মুখের দিকে গেল। সেই চিরচেনা গম্ভীর মুখটা যেন আজ কিছুটা নরম।
নিঝুম আবরাজের দিকে খেয়াল করে অনেকক্ষণ ধরে ইমরানের বলা কথাগুলো মনে মনে বিশ্লেষণ করছিল। সন্দেহ যেন তাকে শান্তি দিচ্ছিল না। আবরাজের স্মৃতি হারানোর নাটক কি সত্যিই বাস্তব? নাকি সে সবকিছু পরিকল্পিতভাবে করছে?
এই সমস্ত ভাবনা থেকেই, নিঝুম একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে জানত আবরাজের চিংড়ি মাছে এলার্জি। যদি আবরাজ সত্যিই তার স্মৃতি হারিয়ে থাকে, তবে সে হয়তো ভুলে গিয়ে চিংড়ি মাছ খাবে। আর যদি তার স্মৃতি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে সে এই খাবার দেখেই সতর্ক হয়ে যাবে।
নিঝুম রান্নাঘরে গিয়ে চিংড়ি মাছের কারি বানাতে শুরু করল।
দুপুরের খাবারের সময়ে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানো হলো। নিঝুম স্বাভাবিক থাকার ভান করছিল, কিন্তু তার ভেতরে অস্থিরতা যেন বেড়ে যাচ্ছিল।
নিঝুম রান্না শেষ করে আবরাজকে পরিবেশন করার পর হেসে বলল,”আজ একটা স্পেশাল ডিশ বানালাম,চিংড়ি মাছের কারি। আশা করি, এটা আপনার খুব পছন্দ হবে।”
আবরাজ প্লেটে খাবার তুলল, আর কোনো দ্বিধা না করেই চিংড়ি মাছ খেতে শুরু করল। যদিও আবরাজ জানে এতে তার এলার্জি কিন্তু এখন যেহেতু তার স্মৃতি নেই সেই অনুযায়ী অভিনয় করতে গিয়েই আবরাজ এই ঝুঁকিটা নিল।
নিঝুম থমকে গেল। তার চোখ বড় হয়ে গেল। আবরাজের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো, সে সত্যিই চিংড়ি মাছের প্রতি তার এলার্জির ব্যাপারে কিছুই জানে না।
কিন্তু খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবরাজ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, আর কপালে ঘাম জমে গেল।
“আবরাজ! আপনি কি ঠিক আছেন?”
আবরাজ কোনো উত্তর দিল না। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল।
নিঝুম ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ কি করবে না করবে ভেবে ম্যাক্সকে ফোন দিল। ম্যাক্স তাদের পাশের এপার্টমেন্টেই ছিল। সে দ্রুত এসে আবরাজকে ধরে গাড়িতে তুলল এবং হাসপাতালে ছুটে গেল।
হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা জানালেন, আবরাজ চিংড়ি মাছ খাওয়ায় প্রচণ্ড এলার্জি আক্রান্ত হয়েছে। তাকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলো। তারা ভীষণ রাগও হলো যে কেন আবরাজকে চিংড়ি মাছ খাওয়ানো হলো। নিঝুম অপরাধবোধে মাথা নিচু করে রইল। ম্যাক্স নিঝুমকে জিজ্ঞেস করল,”আপনি কি জানতেন না আবরাজের চিংড়িতে এলার্জি?”
“আমি আসলে..”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২১
নিজের পক্ষে কিছু বলার আগেই নিঝুম কেবিনের মধ্যে শুয়ে থাকা আবরাজের দিকে তাকায়। শক্তপোক্ত মানুষটা কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে৷
আবরাজকে দেখে নিঝুমের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ দানা বাঁধতে শুরু করল।
নিজের মনে মনে সে বলল, “আমি কি ঠিক করলাম? এমন পরীক্ষার জন্য ওনার জীবন বিপন্ন হতে পারত। এটা আমার করা উচিত হয়নি। তবে আজ আমি নিশ্চিত হলাম উনি সত্যিই স্মৃতি হারান নি। উনি ঠিক হয়ে গেলে এর জন্য অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নেব।”