অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৭
ইয়াসমিন খন্দকার
নিঝুম ঘরে বসে নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। আজ রাতেই তার লন্ডন থেকে সিলেটে ফেরার ফ্লাইট। তাই দেশে ফেরার জন্য সে শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিঝুম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পোশাক ঠিক করছিল। এমন সময় তার দরজায় কেউ নক করে। নিঝুম দরজা খুলতেই দেখতে পায় আবরাজ দাঁড়িয়ে আছে৷ আবরাজ এগিয়ে এসে নিঝুমকে বলে,”তুমি তৈরি হয়ে নিয়েছ?”
“হুম।”
“ধন্যবাদ, আমার কথাটা রাখার জন্য। আজকের দিনটা আমার সাথে কাটানোর জন্য। চলো, তোমাকে লন্ডন শহরটা ঘুরে নিয়ে আসি।”
নিঝুম মূলত আজ আবরাজের অনুরোধেই সেজে উঠেছে। কারণ আবরাজ তাকে শেষ একটা অনুরোধ করেছিল তাকে নিয়ে লন্ডন শহর ঘুরছে দেখার। নিঝুম বাইরে আসে। আবরাজ নিজের গাড়ি বের করতেই নিঝুম সেই গাড়িতে উঠে বসে। গাড়িতে উঠে বসে সে বলতে থাকে,”কোথায় যাব আমরা?”
“চলো আজ লং ড্রাইভে তোমায় গোটা লন্ডন শহর টা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
নিঝুম ও আবরাজ দুজনে গাড়িতে করে বসে যেতে থাকে। আবরাজ নিঝুমকে গাড়িতে করে অনেক দূরে নিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে,”আজ আমার একটা বাংলা গান ভীষণ মনে হচ্ছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কোন গান?”
“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?”
নিঝুম কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। আবরাজ নিঝুমকে বলে,”তবে আমাদের পথ চলা বুঝি আজকে এখানেই শেষ হবে। তাই না?”
“হয়তো।”
নিঝুম কথাটা বলে মাথা নিচু করে নেয়। আবরাজ নিঝুমকে বলে,”শুরুর দিকে তোমার এই জেদটাই আমার ভালো লাগত না। তবে তোমার এই জেদটা আমি বুঝতে পেরেছি৷ তুমি এটাই চাও তো, যাতে করে নিজের মতো করে নিজের জীবন কাটাতে পারো? নিজে একা একাই সাবলম্বী হতে চাও। বেশ, তুমি যেন সফল হতে চাও সেই কামনাই করি।”
“সাবধানে ড্রাইভ করুন।”
“অসুবিধা নেই, আমার অভ্যাস আছে।”
নিঝুম জানালা দিয়ে লন্ডনের রাস্তা দেখতে থাকে। চারিদিকের সৌন্দর্য, উঁচু উচু দালান কোঠা। আবরাজ নিঝুমকে বলে,”জানো এই লন্ডনে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। আমি এই লন্ডনে মামীর হাত ধরে প্রথম স্কুলে আসি, লন্ডনে আমার জীবনের অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি৷ তবে সিলেটে আমার জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে আমি এমন কিছু পাই, যা আমার কাছে সবথেকে দামী ছিল। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। তোমায় প্রথমে আমি ভুল বুঝেছিলাম সেসময় আমারো কিছু ভুল ছিল। তবে আমার পরিস্থিতি টাও তখন ঠিক ছিল না।”
“এসব কথা বলে কোন লাভ নেই।”
“জানি, তুমি আজ সিলেটে ফিরবে। আমি বাধা দেব না। তুমি যাতে করে সুখী হবে আমি তাতেই রাজি আছি। তোমার ভবিষ্যত জীবন সুখী হোক। তুমি একজন ভালো ডাক্তার হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারো সেই কামনা করি।”
নিঝুম চুপচাপ আবরাজের কথা শুনছিল। আবরাজের চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল। যেন কোনো চিন্তা বা স্মৃতি তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। আবরাজের কথাগুলো তাকে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করছিল, কিন্তু সে নিজের মনোভাব স্পষ্ট করতে পারছিল না। আবরাজ যতই বলছিল, “তোমার ভবিষ্যত জীবন সুখী হোক,” ততই যেন সেই অজানা দুঃখ আর বেদনা তাকে ঘিরে ধরছিল।
গাড়িটি ধীরে ধীরে চলতে থাকে। আবরাজ চোখে-মুখে এক ধরনের নিরবতা রেখেই ড্রাইভ করছিল। নিঝুম জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিন্তা করছিল, আজকের দিনটা তার জীবনে কী মানে রাখবে? আবরাজের জন্য, লন্ডন শহর, তার মিষ্টি স্মৃতি, সবই যেন এক নতুন সূর্যের আলোয় দেখা হচ্ছিল। তবে নিঝুম জানত, তার পথচলা কখনোই সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উতরাই, একাধিক বেদনা তাকে পার করতে হয়েছে। সেই বেদনা তাকে আরও শক্তিশালী করেছে, কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছিল না তার হৃদয়ের সত্যিকারের চাওয়া কী।
“তুমি কী ভাবছো?” আবরাজ প্রশ্ন করল।
“ভাবেছি, জীবন আসলে কতটা অনিশ্চিত। কেউ জানে না আগামীর কথা,”
নিঝুম আস্তে করে বলল।
“হ্যাঁ, জীবন কখনোই একরকম থাকে না। আজ যা মনে হয়, কাল তা হয়তো আর মনে নাও হতে পারে। আমাদের ভাবনা সব সময় পরিবর্তন হয়।,” আবরাজ বলল গম্ভীর কণ্ঠে।
গাড়ি এক জায়গায় থেমে গেল। আবরাজ পেছন ফিরে দেখল, “আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম?”
নিঝুম জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তাদের গাড়ি একটি পার্কের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে অনেক পরিবার ও তরুণ-তরুণী ঘুরছিল। চারিদিকে সবুজ ঘাস, ফুলের গন্ধ আর দূরে দেখা যাচ্ছিল লন্ডনের উজ্জ্বল আলোকমালা। নিঝুম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর বলল,”এই জায়গাটা খুব ভালো।”
“হ্যাঁ, এটা আমার খুব প্রিয় জায়গা। এখানে আসলে মনটা কিছুটা শান্ত লাগে।”
তারা দুজনই পার্কের মধ্যে হাঁটতে শুরু করল। নিঝুম আর আবরাজ একসঙ্গে চলতে থাকল, তবে তাদের মাঝে কোন কথোপকথন ছিল না। শুধু নিঝুমের মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা বড়, কিন্তু তার ভেতর কিছু নিঃসঙ্গতা, কিছু কষ্ট জমে থাকত।
এমন সময় হঠাৎ করে নিঝুমের ফোন বেজে ওঠে। নিঝুম দেখে ইমরান ফোন দিয়েছে। নিঝুম এটা দেখে আবরাজের দিকে তাকায়। আবরাজ বলে,”ফোনটা রিসিভ করো।”
নিঝুম ফোনটা রিসিভ করতেই ইমরান বলে,”কিরে নিঝুম? কোথায় তুই?”
“আমি তো একটু বাইরে এসেছি। কেন?”
“তুই নাকি আজ রাতেই সিলেটে ফিরবি?”
“হুম, তেমনই কথা আছে।”
“ওহ, তাহলে যাওয়ার আগে একবার অন্তত আমার সাথে দেখা করে যা। তোর সাথে অনেক কথা বলার আছে আমার।”
“কি কথা?”
“তুই আমার কফিশপে আয় তারপর বলছি।”
“বেশ।”
বলেই নিঝুম ফোনটা রেখে দেয়। আবরাজ নিঝুমকে জিজ্ঞেস করে,”কে ফোন দিয়েছিল, ইমরান?”
“হুম।”
” কি বলল?”
“ও আমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”
“বেশ, চলো। আমি তাহলে তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
“আপনার কোন আপত্তি নেই?”
“আপত্তি করার জন্য তো অধিকার থাকা লাগে। আমার কি তোমার উপর কোন অধিকার আছে?”
আবরাজের এই কথা যেন নিঝুমের বুকে তীরের মতো বিদ্ধ করে। তারা দুজন আবার গাড়িতে উঠে বসে। আবরাজ নিঝুমকে নিয়ে গিয়ে ইমরানের কফিশপের সামনে নামিয়ে দেয়।
নিঝুম কফিশপে ঢুকেই দেখতে পায় ইমরান অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল। নিঝুমকে দেখেই সে বলে,”তুই এসেছিস।”
‘হুম, এখন বল তো কি হয়েছে? হঠাৎ এভাবে আমায় ডাকলি কেন?’
“তুই ভেতরে চল। এখানে সবার সামনে বলা যাবে না। ভেতরের রুমটা যে আছে ওখানে বসে কথা বলি।”
“আচ্ছা।”
ইমরানের কথামতো নিঝুম তার সাথে যেতেই নিঝুমকে ইমরান বলে,”তুই ঐ আবরাজকে ডিভোর্স কবে দিবি?”
“মানে?”
“দেখ, আমি আর এত কথা ঘোরাতে চাই না। তাই স্পষ্ট করে বলি, আমি তোকে শুধু বন্ধুর নজরে দেখি না। তার থেকে আরো বেশি কিছুর নজরে দেখি। আমি তোকে ভালোবাসি নিঝুম!”
“ইমরান! এসব কি বলছিস তুই?”
“ঠিকই বলছি। সেই ছোটবেলা থেকে আমি তোকে ভালোবাসি। তুই ঐ আবরাজকে ডিভোর্স দিয়ে আমার হয়ে যা।”
“এটা আমি তোর থেকে আশা করি নি।”
“ও কাম অন, শোন হয়তো বা এখনো তোদের বিয়ের ৬ মাস হয়নি তাই ডিভোর্স হচ্ছে না কিন্তু কোন অসুবিধা নেই। তুই একটা কাজ কর, আজ সিলেটে না ফিরে আমার এখানে চলে আয়। লন্ডনে রুলস আছে বিয়ে ছাড়াই আমরা একসাথে লিভ ইন রিলেশনশিপে থাকতে পারব।”
নিঝুম ভীষণ রেগে ইমরামকে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। রাগী কন্ঠে বলে,”তুই এত জঘন্য আমি ভাবতেই পারি নি। ভালো চাইলে সরে যা আমার সামনে থেকে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৬
ইমরান নিঝুমকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জোর করে তার ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে বলে,”ঐ আবরাজ যখন জোর করেছিল তখন তো ভালো লেগেছিল তাহলে এখন কেন খারাপ লাগছে? এর আগে তোকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের করতে পারিনি ঐ আবরাজের জন্য কিন্তু আজ তোকে আমার হওয়ার থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
“ইমরান ছাড় আমায়!”
এমন সময় আবরাজ এসে বলে,”কি হচ্ছে এখানে?”