অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩২
ইয়াসমিন খন্দকার

নিঝুম ঘরে এসে ঘুমন্ত নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে হাসল। অতঃপর ছেলের মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”তোমাকে ঘিরেই এখন আমার পুরোটা জীবন। আমার এই কষ্টে ভরা জীবনে তুমি আশা নিয়ে এসেছ। তোমার জন্যই আমি আজ অব্দি বেঁচে আছি নাহলে কবেই নিজেকে শেষ করে দিতাম! এখন আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করি,কেউ যাতে কোনদিনও তোমার থেকে আমায় আলাদা করতে না পারে।”

দরজায় দাঁড়িয়ে এসমস্ত দৃশ্য দেখেন ছবি বেগম। মা-ছেলের বন্ধন দেখে তার ভীষণ ভালো লাগে। তবে একইসাথে নিজের বক্ষে তীব্র ব্যাথাও অনুভূত হয়। তার কেন জানি বারংবার এটাই মনে হয় যে, তিনি ছোটবেলায় যেমন আবরাজকে তার বাবার থেকে আলাদা করে তার শৈশবের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়েছেনে ঠিক তেমনি একইভাবে তার সন্তানের কথা তার থেকে গোপন রেখে তাকে পিতৃত্বের স্বাদ থেকেও বঞ্চিত করছেন। এই অনুশোচনা নিয়ে তিনি প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে গিয়েও শান্তি পান না। এসব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি সরে আসেন। ড্রয়িংরুমে এসে দেখতে পান তার স্বামী আলমগীর খান বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন।
ছবি বেগমকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন,”কি হলো? তোমায় এমন লাগছে কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছবি বেগম আফসোস এর সুরে বলেন,”ঐ একই ভাবনা যা আমায় দীর্ঘ ৫ বছর থেকে শান্তিতে দিচ্ছে না।”
আলমগীর খান গম্ভীর স্বরে বলেন,”এই ব্যাপারে আমি আগেও তোমাকে বলেছি। দেখো, নির্ঝর আমার বংশের সন্তান, ও আমার নাতি হয়..অথচ ওর নিজের বাবাই ওর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। ব্যাপারটা কি এতটাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পেরেছি আমি? মোটেই না, আমি নিজেও তোমার আর নিঝুমের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত এটা নিয়ে। এমনিতেই ছোটবেলায় আমি নিজের ছেলেকে ওভাবে একা ফেলে যাওয়ায় আজ অব্দি ওর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি, আমার ছেলেটা আমাকে বাবা বলে ডাকে না। তার উপর ও যখন জানবে, ওর সন্তানের পরিচয় আমি এত গুলো বছর লুকিয়ে রেখেছিলাম তখন তো আমার মুখের উপর থু থু ছিটাবে। কিন্তু আমারও যে হাত-পা বাঁধা৷ নিঝুম আর তোমার জেদের কাছে বারংবার হার মানতে হলো আমায়। তবে এবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আর চুপ থাকব না। এতদিন যা হওয়ার হয়েছে এবার আমি আবরাজকে সমস্ত সত্যটা জানাবো। সামনেই তো আবিরের বিয়ে। আবরাজকেও আমি আবিরের বিয়ে উপলক্ষে দেশে আসতে বলব। তারপর ও দেশে ফেরার পর ঠাণ্ডা মাথায় বসে ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলব। তারপর যা হবার হবে।”

নিজের স্বামীর মুখে এহেন কথা শুনে চমকে ওঠেন ছবি বেগম। বলে ওঠেন,”এটা তুমি কি বলছ? এমনটা হলে যে নিঝুম আর আবরাজের মধ্যে আবার একটা নতুন লড়াই বেধে যাবে!”
“তো আর কি করব আমি? হাত-পা গুটিয়ে অনেক বসে থেকেছি আর নয়।”
“আমার কথাটা মনযোগ দিয়ে শোন, আবরাজ ও নিঝুমের মধ্যকার সম্পর্কটাকে কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। আমি নিঝুমকে নানা ভাবে বুঝিয়ে এই পাঁচ বছর ওদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছি৷ তাই, আমি চাই এবার ওদের পুনঃমিলনের ব্যবস্থা করতে। আমি চাই আবরাজ, নিঝুম, নির্ঝর সবাই একত্রে মিলে একটা সুখী সংসার গঠন করুক।”
“সেটা কিভাবে সম্ভব?”
“সবটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি নিজে আবিরের বিয়ে উপলক্ষে আবরাজকে দেশে আসতে বলব। তারপর সমস্ত ব্যাপার আমি সামলে নেব।”

কয়েক দিন পর,
আবরাজ নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় দৌড়াতে দৌড়াতে এলেক্স এগিয়ে আসছে। সে এসেই আবরাজকে বলে,”আঙ্কেল, তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?”
আবরাজ হেসে এলেক্সকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”হ্যাঁ, এলেক্স আমি সিলেটে যাচ্ছি।”
এলেক্স অনেক কষ্টে বলে,”সি…সিল.. এটা কোথায়?”
“এটা বাংলাদেশে। আমার বাসা তো ওখানে।”
“ও, তাহলে আমাকেও ওখানে নিয়ে চলো না আঙ্কেল। আমিও তোমার সাথে যেতে চাই।”
“ওখানে যেতে তো অনেক সময় লাগবে। এখন তো তোমায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এরপর যদি আমি কখনো যাই, তাহলে তোমায় নিয়ে যাব। কেমন?”
“আচ্ছা।”

এমন সময় এলিনাও চলে আসে। সে এসে আবরাজকে বলে,”তাহলে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার নিজের দেশে ফিরছ?”
আবরাজ বলে,”হুম। আমার সৎমা ভীষণ অনুরোধ করল যেতে। বলল, পরশু নাকি ওনার ছেলের বিয়ে। তাছাড়া আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিল ফেরার। এবার আমি দেশে ফিরেই নিঝুমের মুখোমুখি হবো৷ নিঝুমের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে সেসব মিটিয়ে নেব।”
“যাই করো ভেবে চিন্তে করো। তোমাদের সম্পর্ক এমনিতেই খুব একটা ভালো না আর..”
“আমি নিঝুমের উপর আর কোন জোর করব না। এবার শুধু ওর কাছে এটুকুই জানতে চাইব ও এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চায় কিনা৷ যদি ও মুক্তি চায় তো মুক্তি দিয়ে ফিরে আসব।”
বলেই আবরাজ নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এলিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তুমি মুখে যতো যাই বলো, আমি জানি তুমি নিঝুমকে কতটা ভালোবাসো। আমি গডের কাছে প্রার্থনা করব যেন তোমরা নিজেদের মধ্যে সব ভুল-বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে পারো।”
অতঃপর সেও এলেক্সকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

১ দিন পর,
পুরো খান ভিলা যেন এখন এক নতুন রূপে সেজে উঠেছে। আগামীকাল আবিরের সাথে আনিকার বিয়ে। সেই বিয়েরই আয়োজন চলছে পুরো বাড়িজুড়ে। নির্ঝরের জন্য যেন এই বিয়ে এক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করেছে। সে তো আজ সারাদিন বাড়িজুড়ে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। নিঝুমও নিজের ছেলের এই আনন্দে আনন্দিত। তবে তবুও সে নির্ঝরকে সতর্ক করে বলল,”নির্ঝর শোনো, গুড বয় হয়ে থাকবে। আমি এখন হাসপাতালে যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন তোমার গ্রানির কাছে না শুনি যে তুমি কোন দুষ্টামি করেছ, কেমন?”
“আচ্ছা, আম্মু। নির্ঝর কথা দিচ্ছে সে কোন দুষ্টামি করবে না।”
নিজের ছেলের মুখে এই কথা শুনে নিঝুম তার গালে একটা হামি দেয়। অতঃপর সামনের দিকে পা বাড়ায়। ছবি বেগম নিঝুমকে যেতে দেখে তার মুখোমুখি হয়ে বলেন,”আজকের দিনে হাসপাতাল না গেলেই নয়?”
“আসলে চাচি অনেক রোগী এসেছে সিলেট মেডিকেলে..আমার এমনিতেই আগামীকাল ছুটি নেয়া। তাই আজ আর নতুন করে ছুটি ম্যানেজ করা যায়নি।”

‘ওহ, ঠিক আছে। তবে চেষ্টা করো আজ তাড়াতাড়ি আসার।’
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব আজ যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার।”
বলেই নিঝুম বেরিয়ে যায়। নিঝুম বেরিয়ে যেতেই ছবি বেগমের মুখে রহস্যময় হাসি দেখা যায়। মনে মনে বলেন,”এবার সবকিছু ঠিক হবার পালা। একটি ভাঙা পরিবার জোড়া লাগার পালা।”
নির্ঝর তখনো নিজের মতো খেলার ছলে ব্যস্ত ছিল। ছবি বেগম নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বলেন,”এই ছোট্ট ছেলেটার জীবনেও এবার বাবার ভালোবাসা আসুক।”
এমন সময় নির্ঝরের খেলনা বলটি গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার দিকে যায়। নির্ঝর বলটি নিতে ছুটে যায় দরজার দিকে। এমন সময় দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় কেউ। অতঃপর নিজের হাতে সেই বলটা তুলে নেয়। নির্ঝর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা আমার বল, আমায় দিয়ে দাও।”
আগন্তুক বলে,”তাই বুঝি? তোমার বল এটা?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩১

“হুম, দাও আমায়। অন্যের জিনিস নেয়া পচা কাজ।”
“এটা তোমায় কে বলেছে?”
“আমার আম্মু বলেছে।”
“তোমার আম্মু কোথায়?”
“আমার আম্মু হাসপাতালে গেছে। আমায় বলটা দাও।”
আগন্তুক বিস্মিত চোখে নির্ঝরের দিকে তাকায়। এমন সময় ছবি বেগম দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠেন,”আবরাজ, তুমি এসেছ!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৩