অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আবরাজ তখনো অব্দি নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক চোখে। ছবি বেগম এগিয়ে এসে আবরাজকে বলল,”কত বছর পর তুমি দেশে ফিরলে। আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
আবরাজ হালকা হেসে বলল,”না, কোন অসুবিধা হয়নি।”
ততক্ষণে নির্ঝর তার বল নিয়ে খেলতে খেলতে আবারো সামনের দিকে চলে গেছে৷ আবরাজের চোখে রেখে গেছে হাজারো প্রশ্ন। ছবি বেগম সবটাই পরখ করছিলেন। তিনি আবরাজকে বলেন,”যাও, তোমার জন্য আমি গেস্টরুমটা পরিস্কার করে রেখেছি। ওখানে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

আবরাজ মাথা নাড়িয়ে বলে,”আচ্ছা, ঠিক আছে। তবে বাচ্চাটা কে ছিল? বেশ কিউট তো!”
ছবি বেগম আবরাজের মুখে এই কথা শুনে মনে মনে চাপা কষ্ট অনুভব করেন। তার ইচ্ছা করছিল আবরাজকে এখনই সমস্ত সত্যটা জানিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি অপারগ ছিলেন৷ তিনি চান না,এখনই আবরাজ সবটা তার মুখ থেকে শুনুক। তিনি চান, আবরাজ ও নিঝুম নিজেরাই নিজেদের সব মিটমাট করে নিক। তাই তো তিনি বলেন,”ও তো আমাদের এক আত্মীয়র ছেলে। তুমি চিনবে না। যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।”
আবরাজ গেস্টরুমের দিকে পা বাড়ায়। ছবি বেগম আবরাজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”আশা করি,এবার সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে তোমার আর নিঝুমের পুনঃমিলন ঘটবে। তোমাদের সন্তানও একটি সুন্দর জীবন পাবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিঝুম হাসপাতালে এলেও তার মনটা কেমন জানি ছটফট করছিল। নিঝুম বুঝতে পারে না হঠাৎ করে তার এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে। সে নিজের চেম্বারেই বসে ছিল৷ হঠাৎ করে একজন নার্স তার কেবিনে এসে বলে,” ডক্টর নিঝুম, আসব?”
নিঝুম নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,”জ্বি, কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ, আসলে একজন নতুন পেশেন্ট এসেছেন। উনি সম্ভবত মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন কিছু সিন আগে কিন্তু সঠিক সময় চিকিৎসা করান নি৷ এখন ওনার মাথা বেশ ফুলে গেছে। আপনি যদি ওনাকে একটু চেক করে দিতেন।”
“আপনি যান, আমি আসছি।”

বলেই নিঝুম উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ায় নিউরোলজি ডিপার্টমেন্টের দিকে। কারণ বর্তমানে সে একজন নিউরোলজিস্ট। কেবিনে প্রবেশ করতেই নিঝুম হতবাক হয়ে যায়। কারণ হসপিটাল বেডে রোগী হয়ে শুয়ে ছিলেন নাজমুল খান! নিঝুমের বাবা। এতদিন পর নিজের বাবার মুখোমুখি হয়ে নিঝুম যতটা না অবাক হয় তার থেকেও বেশি অবাক হয় তাকে এই অবস্থায় দেখে। নিজের বিস্ময়তা কাটিয়ে এগিয়ে যায়। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে আপনার?”
নিঝুমের কন্ঠ শুনে ভীষণ কষ্টে তার দিকে ফিরে তাকান নাজমুল খান। কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থাকেন নিঝুমের পানে। অতঃপর মলিন হেসে বলেন,”বেশি কিছু না। এসবই আমার পাপের ফল।”

নিঝুম নিশ্চুপ। নাজমুল খান বলতে থাকেন,”কোথাও একটা শুনেছিলাম, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না আজ সেটার সত্যতার প্রমাণ পেলাম। জানেন, ডাক্তার আমি না জীবনে অনেক পাপ করেছিলাম….আমার স্ত্রী-সন্তানের সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমার মেয়ের জীবন আমি বরবাদ করে দিয়েছি। নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও তাকে দেখতে যাইনি….নিজের আপনজনকে ভুলে অন্য এক নারীকে আপন করে নিয়েছিলাম। অথচ যার জন্য আমি নিজের পরিবারকে ত্যাগ করেছিলাম সেই আমাকে ত্যাগ করে দিল! এক বছর আগে, আমার ব্ল্যাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। এটা জানার পরপরই আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আমায় ত্যাগ করে চলে যায়। তারপর থেকে আমি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। চিকিৎসা করলে হয়তো আমায় সারানো যেত কিন্তু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমার কাছে ছিল না। তার উপর এই রোগে আক্রান্ত হবার পর আমাকে নিজের অতীতের করা পাপগুলো কষ্ট দিচ্ছিল তাই আমি নিজেই এই রোগটাকে নিজের জন্য একটা শাস্তি হিসেবে দেখতে শুরু করি৷ আর তেমন চিকিৎসাও করিনি। ধীরে ধীরে রোগটা আমায় তীব্র যন্ত্রণা দিতে থাকে। কিছুদিন আগে তো ডাক্তার বলে দিলেন,আমি লাস্ট স্টেজে আছি আর বেশিদিন বাঁচব না। এরইমধ্যে আবার একদিন বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাই। অনেক রক্তও পড়ে। আমি এটাকেও নিজেদের শাস্তি হিসেবে নেই। ডাক্তার দেখাই না।”

নিঝুমের কেন জানি এবার কিছুটা কষ্ট অনুভব হয় নাজমুল খানের জন্য। যদিও তিনি যা করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য কিন্তু হাজার হোক বাবা তো! তাই সে বলে,”আপনার উচিৎ ছিল ডাক্তার দেখানো। আপনি যা অন্যায় করেছেন তার শাস্তি আল্লাহ আপনাকে নিশ্চয়ই দেবে কিন্তু নিজে থেকে এভাবে শাস্তি ভোগ করার তো মানে হয়না।”
নাজমুল খান কেঁদে উঠে বলেন,”কি করব ডাক্তার বলুন? আমি যে একটা রাতও ঠিক করতে ঘুমাতে পারি না। অতীতের করা অন্যায় গুলো আমায় ভীষণ কষ্ট দেয়। আমার স্ত্রীর কাছে আমি ক্ষমা চাইতে পারিনি,সেই সুযোগ আর পাবো না। তবে আমি নিজের মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। আমি জানি,আমার জন্য আমার মেয়ের জীবনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে আমি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছি। এসবের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ওর কাছে ক্ষমা চাই। জানি ও হয়তো আমায় ক্ষমা করবে না কিন্তু এর থেকে বেশি যে আমার কিছু করারও সামর্থ্য নেই। জানেন, তাকে নিজের বাবা বলে পরিচালনা দেওয়ারও সামর্থ্য আমার আর নেই এতোটাই অন্যায় করেছি আমি।”

নিঝুম নিজেকে সামলে বলে,”আমি আপনার মাথায় ড্রেসিং করে দিচ্ছি আর কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। সেসব খেয়ে নেবেন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করবেন।”
বলেই নিঝুম নাজমুল খান এর মাথায় ড্রেসিং করে দিয়ে কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে চলে যায়। নাজমুল খান নিঝুমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলেন,”আমি জানতাম রে, তুই আমায় কখনো ক্ষমা করবি। আমি তোর ক্ষমার যোগ্যও না। তবে আল্লাহর কাছে এতটুকুই চাইব, যদি আমি জীবনে কোন একটাও ভালো কাজ করে থাকি তাহলে সেই ভালো কাজের বিনিময়ে হলেও তোর জন্য সুখের দোয়া করছি সেটা যেন কবুল হয়। নাহলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমার অন্যায়ের ফল তোকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হলে যে আমার রুহ শান্তি পাবে না! হে আল্লাহ, তুমি আমার মেয়েটার জীবনে একটু সুখের হদিস দাও। ওকে আর কষ্টে রেখো না।”
বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি।

আবরাজ আবিরের সাথে দেখা করে। আবির আবরাজকে দেখে ভীষণ খুশি। আবরাজকে তো সে নিজের বড় ভাই হিসেবেই সম্মান দেয়। আবরাজ আবিরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি যেই নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছ, তা যেন সুখের হয়। এই দোয়াই করি।”
“আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া।”
আবরাজ স্মিত হাসে। হঠাৎ করেই তার মনে পডে যায় নিঝুমের কথা। নিঝুমের সাথে তার বিয়ে, তারপরের সমস্ত ঘটনা। সেও তো অনেক আশা নিয়ে এভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল। অথচ বিয়ের আসরে তার সমস্ত আশা ভেস্তে যায়। এতে কি তার রাগ হওয়া স্বাভাবিক ছিল না? এজন্যই তো নিঝুমের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল সে।
এদিকে আবির ভাবে আবরাজের থেকে সে এতদিন সব সত্য লুকিয়েছে কিন্তু এবার আর না। এবার সে সমস্ত সত্য আবরাজকে বলে দেবে। এতে তার মা আর নিঝুম যা প্রতিক্রিয়া দেখায় দেখাক। তাই আবির আবরাজকে বলে,”ভাইয়া, আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।”

“হ্যাঁ, বলো।”
“আমি জানি না,এসব শোনার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। হয়তো আপনি অনেক অবাক হবেন,রেগেও যেতে পারেন। কারণ ব্যাপারটা নিঝুম আপিকে নিয়ে!”
নিঝুমের নাম শুনতেই আবরাজ চমকে ওঠে। বিস্মিত স্বরে বলে,”নিঝুম! কোথায় ও? তুমি কি ওর কোন খবর জানো?”
আবির বলে,”হুম, জানি। আপি এই বাড়িতেই আছে আর…”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩২

আবির নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না এমন সময় নিঝুম সেখানে চলে আসে। এসেই বলে ওঠে,”আবির, আনিকা নাকি তোমায় ফোন করছে বারবার। তুমি রিসিভ করছ না কেন? ও কিন্তু রেগে গেছে।”
বলেই হালকা হাসে। তখনো নিঝুম আবরাজকে লক্ষ্য করে নি। সে জানেও না আবরাজ দেশে এসেছে। একটু আগেই সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। এদিকে নিঝুমের কন্ঠ শুনেই পেছন ফিরে তাকায় আবরাজ। দীর্ঘ ৫ বছর পর নিঝুমকে দেখে সে অবাক। নিঝুমেরও নজর যায় আবরাজের দিকে। দীর্ঘ ৫ বছর পর আজ তারা আবারো মুখোমুখি!

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৪