অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৪
ইয়াসমিন খন্দকার
আবরাজ অবাক চোখে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিঝুমের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। দুজনেই এত বছর এভাবে একে অপরকে দেখবে সেটা বোধহয় আশা করে নি৷ আবরাজ নিঝুমকে দেখেই ধীর পায়ে তার দিকে আগাতে লাগল। এদিকে নিঝুম আবরাজকে দেখে প্রথমে ভাবছিল সে ঠিক দেখছে নাকি ভুল। যখন নিশ্চিত হলো যে সে ঠিক দেখছে তখন আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। পিছন ফিরে চলে যেতে চাইল৷ এমন সময় আবরাজ দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,”অনেক পালিয়ে বেড়িয়েছ তুমি! এবার আর নয়। এবার আমার মুখোমুখি তোমায় হতেই হবে। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”
নিঝুম আবরাজের চোখে চোখ রেখে তাকায়। গম্ভীর স্বরে বলেন,”আমার মতো দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে আপনার কি কথা থাকতে পারে?”
“নিঝুম! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, আমাদের কথা বলাটা জরুরি।”
“কিন্তু আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। আপনি আমার মায়ের খু**নি। আপনার জন্যই আমার মা মা*রা গেছে। আমি আপনাকে ঘৃণা করি জাস্ট ঘৃণা করি।”
আবরাজ কাতর স্বরে বলে,”তোমার সব অভিযোগ আমি মেনে নিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি জ্ঞানত তোমার কাকে কিছুই বলি নি। সেই সময় আমি ড্রাংক ছিলাম আর তাই না বুঝেই জানি না কি বলতে কি বলে ফেলেছি। আমি এর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। জানি, তোমার যেই ক্ষতি আমি করেছি তা অপূরণীয়। তবে এত কিছুর পরেও তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বেশ করলাম আপনাকে ক্ষমা। এখন চলে যান আমার সামনে থেকে।”
আবরাজ আকুল চোখে তাকাল নিঝুমের দিকে। এত গুলো বছরেও নিঝুমের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে নি। আবরাজ যদিও নিজের ইগো, অহংকার সব কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কিন্তু নিঝুম সেই আগের মতোই জেদি রয়ে গেছে। এসব ভেবেই আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,”আমার উদ্দ্যেশ্য তোমায় বিরক্ত করার নয়, নিঝুম। আমি মোটেই তোমায় বিরক্ত করার জন্য এই দেশে আসি নি। আমার দেশে আসার মূল কারণ ছিল তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা বলা। আমি তো ভেবেছিলাম এখানে এসে তোমায় খুঁজতে হবে কিন্তু তোমাকে এখানে পেয়ে গিয়ে ভালোই হলো।”
“যা বলার বলুন, আমি শুনছি।”
“আমি তোমাকে মুক্তি দিতে এসেছি নিঝুম।”
“মুক্তি?”
“হ্যাঁ, মুক্তি। আমি চাই তুমি নিজের জীবনে এগিয়ে যাও। আর এজন্য আমি তোমার পথে কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। এমনিতেই তুমি আমার জন্য অনেক সাফার করেছ। যাইহোক, আমি এখানে একজন ভালো উকিলের সাথে যোগাযোগ করব ভাবছি। আমাদের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলার জন্য।”
নিঝুম অবাক চোখে আবরাজের দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,”বেশ। আপনি কোন ভালো উকিলের সাথে কথা বলে আমাকে জানান। আমি ডিভোর্সের যাবতীয় কার্যক্রম পূরণ করব।”
“ঠিক আছে।”
আবির হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে আসে। সে দূর থেকেই নিঝুম আর আবরাজের সব কথা শোনে। এসব শুনে সে আর থাকতে পারে না। তাই তো এগিয়ে এসে বলে,”এভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না। আপি, তুমি একটাবার ভেবে দেখো এই সম্পর্কটা এভাবে ভেঙে না দিয়ে তো সম্পর্কটাকে নতুন একটা সুযোগ দিতে পারো। এটা তো এখন শুধু তোমাদের দুজনের ব্যাপার নয় এখন এখানে আরো একজনের ভাগ্য জড়িয়ে আছে।”
আবরাজ অবার স্বরে জানতে চায়,”আরো একজনের ভাগ্য মানে?”
আবির নির্ঝরের কথা আবরাজকে বলতে যাবে এমন সময় দেখতে পায় নিঝুম তার দিকে হাতজোড় করে অনুরোধ করছে। ইশারা করে বোঝাচ্ছে নির্ঝরের কথা আবরাজকে না জানাতে। তাই আবির একটা দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে বলে,”আমাদের এই পুরো পরিবারটাও খুশিও তো তোমাদের সাথে জড়িয়ে। তোমরা সুখী হলে আমরাও ভালো থাকব।”
আবরাজ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই সম্পর্কটা ভাঙলেই বোধহয় নিঝুম সুখী হবে। আমি আর ওর সুখের পথে বাঁধা হতে চাই না।”
আবির প্রশ্ন করে,”আর আপনি? এই সম্পর্কটা ভাঙলে আপনি সুখী হবেন তো?”
আবরাজ স্লান হেসে বলে,”হয়তো!”
নিঝুম তখনো কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ আবরাজকে বলে,”তাহলে আপনি উকিলের সাথে যোগাযোগ করুন। আমি ডিভোর্স পেপারে সই করে দেব।”
বলেই নিঝুম সামনের দিকে পা বাড়ায়। আবরাজ নিঝুমের যাওয়ার পানেই তাকিয়ে থাকে। আবির এসব দেখে মনে মনে বলে,”তুমি কেন এতটা নিষ্ঠুর হচ্ছ নিঝুম আপি? আবরাজ ভাইয়াকে দেখে কি তুমি বুঝতে পারছ না, সে আর আগের মতো নেই। সে বদলে গেছে। কেন তাকে একটা সুযোগ দিচ্ছ না?”
নিঝুম নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে। এমন সময় ঘরে কারো প্রবেশের শব্দ পেয়ে সে পিছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় ছবি বেগমকে। নিঝুমের চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ছিল। ছবি বেগমকে দেখেই সে সেই চোখের জল মুছে নেয়। ছবি বেগম এগিয়ে এসে নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলেন,”চোখের জল লুকিয়ে কি লাভ? মনের কষ্ট তো লুকাতে পারবে না!”
নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তাহলে আমি কি করব চাচি? জীবন আমাকে আজ এমন পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে যে, এছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।”
“তুমি নিজে থেকেই বিষয় গুলোকে জটিল করছ নিঝুম। চাইলেই কিন্তু তুমি বিষয় গুলো ঠিক করে নিতে পারো। তবে তুমি সেটা করছ না। আচ্ছা, আবরাজ কি একটা সুযোগ ডিজার্ভ করে না?”
“কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই মূল। উনি তো আমায় বিশ্বাস না করে ইমরানের বলা মিথ্যা অভিযোগ গুলা বিশ্বাস করেছেন। আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছেন। সেখানে এই সম্পর্কটাকে আমি কিভাবে আরেকটা সুযোগ দেই?”
“মানছি, দোষটা আবরাজেরই বেশি। কিন্তু তুমিই বলো তুমি কি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলে?”
“কিভাবে করব আমি চাচি? উনি তো আমায় কোন সুযোগই দেন নি নিজেকে প্রমাণ করার। একপাক্ষিক ভাবে ইমরানের কথা শুনে আমায় দোষারোপ করে গেছেন।”
“আমি তো বললাম, আবরাজের দোষ এক্ষেত্রে বেশি ছিল কিন্তু তোমারও কিছু ভুল ছিল। তুমি ইমরানের সাথে যেভাবে মেলামেশা করেছ এটা তোমার ঠিক হয়নি৷ মানছি ও তোমার ভালো বন্ধু কিন্তু বিয়ের পর একটা মেয়ে তার স্বামী বাদে অন্য কোন ছেলেকে এতটা গুরুত্ব দিলে যে কেউ মাইন্ড করবে। হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো তোমাদের সম্পর্ক আর চার-পাঁচটা দম্পত্তির মতো ছিল না। কিন্তু তবুও তোমরা তো বিবাহিত ছিলে। এই বিষয়টা অন্তত তোমার মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। আর সবথেকে বড় কথা বিষয়টা এখন শুধু আর তোমার কিংবা আবরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নির্ঝরও আছে তোমাদের মাঝে। ওর কথাটা একটু ভাবো। বাচ্চাটা ছোটবেলা থেকেই বাবা থাকার পরেও বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। মানছি তুমি ওকে যথেষ্ট ভালোবাসা দিচ্ছ আমরাও আছি। কিন্তু বাবার অভাবটা তো পূরণ করার মতো হয়। আজ নাহয় ও ছোট আছে জন্য এতটা বোঝে না। কিন্তু সামনের মাসেই তো তুমি ওকে স্কুলে ভর্তি করাবে ভাবছ। স্কুলে যাওয়ার পর যখন ও দেখবে ওর সব বন্ধুদের বাবা আছে কিন্তু ওর নেই তখন ওর কেমন লাগবে ভেবেছ একবারও?”
নিঝুম আর কিছু বলতে পারে না। ছবি বেগম বলেন,”তাই বলছি,ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।”
নিঝুম হঠাত করেই বলে ওঠে,”যতো যাই হোক, আমি কখনো এটা ভুলব না যে ওনার জন্য আমার মা মারা গেছে। এটার পর আমি কখনোই ওনার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারব না। কোন ভাবেই না। আর আমার ছেলের জন্যও আমি একা যথেষ্ট।”
ছবি বেগম বুঝতে পারেন নিঝুমকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই৷ এবার যা করার তাকেই করতে হবে। কোনভাবেই তিনি নিঝুম আর আবরাজের ডিভোর্স হতে দিবেন না।
এদিকে, নির্ঝর খেলছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ পড়ে যেতে নিতেই আবরাজ তাকে ধরে নেয়। নির্ঝর এটা দেখে হেসে বলে,”আপনি কি সুপারহিরো? আমাকে সুপারহিরোর মতো বাচিয়ে নিলেন?”
আবরাজ হাল্কা হেসে বলে,”না, আমি তো সাধারণ মানুষ।”
“কিন্তু আমি তো মুভিতে দেখেছি সুপারহিরোরাই এভাবে বাঁচায় বাচ্চাদের। আমার আম্মুও তো তাই বলে।”
“তাই বুঝি?”
“হুম।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৩
এমন সময় নির্ঝর দেখতে পায় নিঝুম একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই সে বলে,”ঐ তো আমার আম্মু। আমার আম্মুকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
নির্ঝরের কথামতো পিছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় আবরাজ। বলে ওঠে,….