অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৭

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৭
ইয়াসমিন খন্দকার

নিঝুম ও আবরাজ দুজনকেই হতবাক চোখে ইমরানের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ এত দিন পর এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আবারো তাদের যে ইমরানের মুখোমুখি হতে হবে এটা তাদের কেউই আশা করে নি৷ আবরাজ তো ইমরানকে দেখেই ক্ষেপে গেল। ছুটে গিয়ে ইমরানের কাছে গিয়ে তার গলার কলার চেপে ধরে বলল,”কেন এসেছ এখানে?”
ইমরান আবরাজের থেকে চোখ সরিয়ে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”নিজের অতীতে করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এসেছি।”

মিজানুর রহমান আবরাজকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”ইমরানকে ছেড়ে দাও আবরাজ। ওর থেকে তোমার অনেক কিছু জানার আছে। ও আজ এখানে কোন ঝামেলা তৈরি করতে আসে নি বরং সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে দিতে এসেছে। এত দিনের জমা সব ভুল বোঝাবুঝি আজ মিটিয়ে দেবে ও।”
ইমরান মাথা নাড়িয়ে বলে,”জ্বি। আমার আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে আবরাজ ব্রো। আপনি এতদিন ধরে অনেক ভুল ভেবেছেন, আমার জন্যই আপনার আর নিঝুমের মধ্যে ৫ বছর আগের এত বিশাল ঝামেলা হয়েছিল যার ফলে আপনারা দুজন আলাদা হয়ে পড়েছেন।”
আবরাজ অবাক স্বরে জানতে চায়,”এসবের মানে কি?”
ইমরান নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে,”প্রথমেই আমি তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নিঝুম৷ আমি জানি, আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। আমি তোর মতো পবিত্র চরিত্রের মেয়ের চরিত্রে কালিমা লেপন করেছি, আমাকে কতটা বিশ্বাস করতিস তুই নিজের বন্ধু না ভাইয়ের মতো দেখতি অথচ আমি সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারি নি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিঝুমের চোখে তখনো জল ছলছল করছিল। আবরাজ অধৈর্য হয়ে বলে,”যা বলার স্পষ্ট করে বলো।”
“৫ বছর আগে আমি আপনাকে যা বলেছিলাম তার সবই মিথ্যা ছিল। আমার সাথে নিঝুমের কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল না৷ বরং সেদিন কফিশপের মধ্যে আমিই নিঝুমকে জোরপূর্বক নিজের কাছে টেনে নিয়ে…”
ইমরান নিজের পুরো কথা শেষ করার আগেই আবরাজ তার নাক বরাবর একটা ঘু*ষি মারে। ইমরান দূরে ছিটকে পড়ে। আবরাজ গর্জে উঠে বলে,”শয়তানের বাচ্চা! তুই জানিস না তোর জন্য কত কি ঘটে গেছে৷ তোর জন্য আমি নিঝুমকে ভুল বুঝেছি, নিঝুমের মাকে মদ্যপ হয়ে এমন সব কথা বলেছি যার ফলে ওর মা মারা গেছে, এমনকি আমি আজো নিঝুমের চরিত্র নিয়ে কত খারাপ কথা বলেছি৷ আমি ভেবেছি নিঝুমের বাচ্চাটা তোর। তোকে আজ আমি শেষ করে দেব..”

বলে যখন না আবরাজ ইমরানের দিকে এগোতে নেবে তখনই তার মামা তার পথ আটকে ধরে বলেন,”দাঁড়াও, আবরাজ। ও নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং নিজের ভুলের যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে। ও ক্যান্সারে আক্রান্ত, লাস্ট স্টেজে ও আর বেশি দিন বাঁচবেও না। ওকে আর এভাবে মেরো না।”
মিজানুর রহমান এর কথা শুনে আবরাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ নিঝুমও অবাক হয়৷ ইমরান উঠে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে বলে,”আর বেশি দিন সময় নেই আমার হাতে। তাই মৃত্যুর আগে, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে এলাম। এতে যদি পাপের বোঝা একটু কমে!”

ইমরানের এমন কথা শুনে আবরাজের মন কিছুটা নরম হয়। একইসাথে সে আত্মোপোলব্ধি করে অনেক কিছু। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”সব দোষ আমারই..আমি সব সময় নিঝুমকে ভুল বুঝে গেছি। ওকে কষ্ট দিয়েছি। আমার জন্যই নিঝুমের মা আজ আর এই পৃথিবীতে নেই। নিঝুম..আমি তোমার অপরাধী, দয়া করে আমার সব অপরাধের শাস্তি তুমি আমায় দাও। তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব।”
মিজানুর রহমান নিজের ভাগ্নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”না,আবরাজ। সব দোষ তোমার একার নয়। নিঝুমও অনেক অন্যায় করেছে৷ ওর অন্যায়ের মধ্যে ছিল তুমি যখন নিজের সাথে ওর সম্পর্ক ঠিক করতে চেয়েছ তখন ও তোমার বারবার অনুরোধ করার পরেও সম্পর্ক ঠিক করেনি, তোমার বারণ সত্ত্বেও ইমরানের সাথে মেলামেশা করে গেছে, তুমি যখন ইমরানক কেন্দ্র করে ওকে ভুল বুঝেছিলে ও তখন নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট কিছুই করেনি। আর সবথেকে বড় অপরাধ ও যা করেছে তোমার থেকে এত গুলো বছর তোমার সন্তানের কথা লুকিয়ে রেখেছে। দীর্ঘ ৫ বছর যাবত তুমি জানতে পারো নি, তোমার একটা সন্তান আছে। তোমার ছেলের শৈশব কেটেছে তোমার সান্নিধ্য ছাড়াই। এসব ভুলের জন্য নিঝুমকেও আমি অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি।”
আবরাজ অবাক হয়ে বলে,”মানে? নির্ঝর..ও কি তাহলে?”

“হ্যাঁ, নির্ঝর তোমারই ছেলে আবরাজ। আর এই হলো তোমার আর নির্ঝরের ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট। যা দ্বারা তুমি শতভাগ নিশ্চিত হতে পারো যে নির্ঝর তোমারই সন্তান। ছবি বেগম তোমার আর নির্ঝরের চুল নিয়ে একটা ল্যাবে দিয়েছিলেন। আমি সেটার রিপোর্টই নিয়ে এসেছি। এই রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে নির্ঝর তোমারই ছেলে।”
আবরাজ ডিএনএ রিপোর্ট টা হাতে নিয়ে দেখে অবাক হয়ে তাকায় নিঝুমের দিকে। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নিঝুমের দিকে। নরম অথচ অভিযোগের সুরে বলে,”কেন নিঝুম কেন? কেন করলে আমার সাথে এমন? আমার প্রতি তোমার রাগ থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে এত গুলো বছর আমার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে রাখলে! আমাকে আমার সন্তানের থেকে বিছিন্ন রাখলে এত গুলো বছর। এটা তোমার কেমন বিচার নিঝুম? কি পেলে এসব করে তুমি?”

নিঝুম কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,”তো কি করতাম আমি? আপনি তো আমাকে বিশ্বাসই করেন নি কখনো। যদি আমি আপনাকে এই সন্তানের ব্যাপারে বলতাম তাহলে এখন যেমন আপনি নির্ঝর আমার ছেলে এটা জানার পর অবলীলায় ভেবে নিলেন যে এটা ইমরানের সন্তান তখনও নিশ্চয়ই তাই ভাবতেন। আমাকে আরো অপমান করতেন। আমার সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। সেসব কিভাবে মেনে নিতাম আমি?”
আবরাজ রেগে বলে,”তুমি সবসময় আমার দোষটাই কেন দেখতে পাও নিঝুম? নিজের ভুলগুলো কি তুমি দেখো না? একেই তুমি এতগুলো বছর আমার থেকে আমার সন্তানের কথা লুকিয়ে রাখলে, আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রাখলে, আবার দেশে ফেরার পর আমার সন্তানের কথা না জানিয়ে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে সায় জানালে অতঃপর আমি যখন তোমার সন্তানের ব্যাপারে জেনে ওর ব্যাপারে তোমায় প্রশ্ন করলাম তখনো তুমি একবারো বললে না যে নির্ঝর আমার সন্তান। এমনকি ডিভোর্স পেপারে সই করা অব্দি এই কথাটা জানালে না। আজ যদি ডিভোর্সটা হয়েও যেত আর মামা এসে সব সত্য না বলতেন তাহলেও বোধহয় কখনো আমার জানা হতো না যে, নির্ঝর আমার সন্তান। তুমি সব সময় নিজের টাই ভেবে গেলে নিঝুম। কখনো আমার ব্যাপারে ভাবলে না। তোমার ইগো, তোমার স্বার্থপরতা তোমাকে সম্পূর্ণ অন্ধ বানিয়ে দিয়েছে।”

নিঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছবি বেগমের হাত ধরে কোর্টের মধ্যে ছুটে এলো নির্ঝর। আলমগীর খান এমনকি নববিবাহিত দম্পত্তি আবির-আনিকাও এসেছে এখানে। নির্ঝর এসেই ছুট লাগালো নিঝুমের দিকে এবং নিঝুমের সামনে এসে বললো,”আম্মু..সুপারহিরো কি আমার বাবা? গ্রানি বলল যে এই সুপারহিরোই নাকি আমার বাবা?”
নিঝুম কিছু বলার আগেই আবরাজ নির্ঝরকে নিজের কোলে তুলে নিলো এবং বলল,”হ্যাঁ, বাবু, আমি তোমার বাবা। তুমি আমার ছেলে। আমাকে একবার বাবা বলে ডাকো।”
নির্ঝর হেসে বলে,”বাবা..”

আবরাজ আবেগঘন হয়ে পড়ে। নির্ঝরের গালে ও কপালে অনেক গুলো চুমু খায়। সবাই বাবা-ছেলের এই মিলনের দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। ছবি বেগম, আলমগীর খান দুজনের চোখেই জল। আলমগীর খান বলেন,”আমি আর কখনোই আবরাজের মুখোমুখি হতে পারব না ছবি। একেই তো আমি ওর থেকে ওর শৈশব কেড়ে নিয়েছি আর ওর পিতৃত্ব কেড়ে নেয়াও নীরবে সহ্য করেছি।”
ছবি বেগমও কান্নারত স্বরে বলেন,”আমিও।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৬

এদিকে নির্ঝর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”আম্মু..তুমি দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমাদের কাছে এসো? গ্রানি তো বলল আমরা সবাই একই ফ্যামিলি আমাদের একসাথে থাকা উচিত..তুমি এসো না আমাদের পাশে।”
ছবি বেগমও নিঝুমকে বললেন,”নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকতেই পারে কিন্তু নিজের সন্তানের উপর তার প্রভাব পড়তে দিও না। যাও, আবরাজ আর নির্ঝরের পাশে গিয়ে দাঁড়াও।”
নিঝুম সমস্ত ভাবনা শেষে ছুটে যায় আবরাজের পাশে গিয়েই নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কান্না করে ফেলে। বলে,”সরি সোনা..তোমার থেকে এতদিন সবকিছু লুকিয়ে রেখেছিলাম।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৩৮