অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১০

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১০
ইয়াসমিন খন্দকার

আনিকা খানের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল আরিশা। তার পায়ের তলার মাটি যেন এক মুহুর্তের জন্য সরে গেল। তার পুরো জীবন, এতদিন ধরে গড়ে তোলা সম্পর্ক কোনটাই তাহলে সত্য নয়? আফিফা তার বোন নয়, আবির খান তার বাবা নয়, আনিকা খান তার কেউ নয়…এই পরিবারের কারো সাথেই তার কোন সম্পর্ক নেই! ভাবতেই আরিশার পুরো পৃথিবীটা থমকে গেল। এদিকে জাঈদ শেখ গভীর চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। সে তো ভেবেছিল এখানে এসে আরিশার সাথে নিজের বিয়ের ঘোষণা দিয়ে সে পুরো খান ভিলাকে চমকে দেবে কিন্তু এখন তো সে নিজেই চমকে যাচ্ছে। আফিফার উপর তার প্রতিশোধ নেয়ার স্বপ্ন কি তাহলে অধরাই থেকে যাবে?
এদিকে আফিফা এগিয়ে এসে আনিকা খানের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”প্লিজ আম্মু..এমন করে বলো না তুমি। আরিশা..ও আমার বোনু। এটা মিথ্যা হতে পারে না।”

নির্ঝর এগিয়ে এসে আফিফার কাধে হাত রেখে বলে,”নিজেকে সামলাও আফিফা৷ এরকম পাগলামি করো না।”
“কিভাবে নিজেকে সামলাবো আমি বলতে পারেন? আমার বোনুকে ওরা আমার পর করে দিচ্ছে। ও নাকি আমার কেউ নয়। আচ্ছা এটা কিভাবে হতে পারে? ছোটবেলা থেকে আমি নিজ হাতে আগলে ওকে বড় করেছি, ওর সব আবদার পূরণ করেছি। যার সাথে এতগুলো দিন বেড়ে উঠলাম সে আমার কেউ নয় এটাও আমায় বিশ্বাস করতে হবে? আব্বু, তুমি কিছু বলছ না কেন? তুমি বলো না যে, আরিশাই আমার বোন।”
আবির খান নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন,”সব সম্পর্ক কি শুধুই রক্তের হয় রে মা? কিছু সম্পর্ক হয় আত্মার সম্পর্ক। আরিশার সাথেও আমাদের সম্পর্ক ঠিক তেমনই। হ্যাঁ, ওর সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই,ও আমার ঔরসজাত সন্তান নয়। কিন্তু ও আমার কাছে আফিফার থেকে কোন অংশে কম নয়। সবসময় আমি ওকে নিজের মেয়ের নজরেই দেখেছি এবং সামনেও তাই দেখে যাব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছবি বেগম রাগী কন্ঠে বলেন,”এতকিছুর পরও তোর চোখ খুলবে না আবির? আজ এই মেয়ে কিভাবে আমাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল দেখলি না? যদি সত্যিই ও আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করত তাহলে এভাবে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে কর‍ত না।”
আরিশা শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল। ছবি বেগম আরিশার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেন,”তোর এই সব নাটক বন্ধ কর৷ এসব দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমাদের কারো নেই। এক্ষুনি বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে। যাকে বিয়ে করেছিস তাকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটা যা।”
আফিফা এগিয়ে এসে বলে,”এসব তুমি কি বলছ দাদি? বোনু কোথাও যাবে না এমন করো না তুমি।”
আবরাজ খানও বলে ওঠেন,”এটা আপনি ঠিক করছেন না। ছোটরা ভুল করবেই কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতি এমন ব্যবহার করা ঠিক নয়।”

নিঝুম খানও বলেন,”হ্যাঁ, চাচি। আপনি একটু বেশিই নির্দয় হয়ে উঠছেন। দয়া করে, একটু মানবিকতা দেখান।”
আদৃতা অবশ্য ছবি বেগমের সমর্থনেই বলে,”দাদি একদম ঠিক কাজ করছে। এই রাস্তার মেয়েকে রাস্তাতেই পাঠানো উচিৎ। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও একে।”
ছবি বেগম আদৃতার কথায় উদ্বুগ্ধ হয়ে আরিশাকে জোরে একটা ধাক্কা দেন যাতে আরিশা পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু সে পড়ে যাওয়ার আগেই একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে আগলে নেয়৷ আরিশা অবাক চোখে তাকায় জাঈদ শেখের দিকে। সে রক্তিম চোখে তাকিয়ে ছিল ছবি বেগমের দিকে। আরিশাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে সে বলে,”আরিশাকে যখন আমি বিয়ে করেছি তখন ওর দায়িত্ব আমিই নেব। আপনাদের কাউকে আর ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না।”
বলেই সে আরিশার হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের সাথে নিয়ে যেতে থাকে। আফিফা তাকে আটকানোর চেষ্টা করলে ছবি বেগম আফিফাকে আটকে বলেন,”ওকে যেতে দে ওর স্বামীর সাথে। এই জীবনটা ও নিজেই বেছে নিয়েছে। আমরা এতদিন মানবতা দেখিয়ে ওকে লালন-পালন করেছি। এখন যদি ও এসবের মর্ম না বোঝে তার দায় কোনভাবেই আমাদের নয়।”

নিজের দাদির মুখে এমন নির্দয় কথা শুনে আফিফা অবাক হয়। সে বলে ওঠে,”ছাড়ো আমায়, আমি আমার বোনুকে কোথাও যেতে দেব না। বোনু, তুই ঐ বখাটে লম্পটটার সাথে যাস না। ও যে তোকে একেবারে শেষ করে দেবে। দাদি, ছাড়ো আমায়..আমার বোনুর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।”
এবার ছবি বেগমের সাথে আদৃতাও যোগ দেয়। তারা দুজন মিলে আফিফাকে আটকে ধরে। নির্ঝর রেগে বলে,”কি করছ টা কি তোমরা? ছেড়ে দাও আফিফাকে।”
ছবি বেগম রাগী কন্ঠে বলেন,”যা ঠিক তাই করছি দাদুভাই। তুমি এই বিষয়ে নাক গলিও না।”
আবির খান আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠেন। আনিকা খানের চোখেও বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণার দেখা মেলে। এদিকে আফিফা তো চিৎকার করতে করতে বলতে থাকে,”আমার বোনুর কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না, কাউকে না৷ সবার শেষ দেখে ছাড়ব আমি।”

জাঈদ আরিশাকে নিয়ে যেতে যেতে এসব দেখে বাকা হেসে মনে মনে ভাবে,”তোমাকে শায়েস্তা করার উপায় আমি পেয়ে গেছি আফিফা! নিজের বোনকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না? এবার তোমার এই বোনের মাধ্যমেই আমি তোমার উপর প্রতিশোধ নেব। ঐ নির্ঝরকে বিয়ে করে তুমি আমায় যতটা কষ্ট দিয়েছ তার দ্বিগুণ কষ্ট আমি তোমায় ফিরিয়ে দেব। এ তো কেবল আমার প্রতিশোধের শুরু হলো। সামনে দেখো, আরো কত কি হয়।”
বলতে বলতেই সে আরিশার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে। আরিশার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল এতে করে তাই সে বলে ওঠে,”আহ! লাগছে।”

এতে করে জাঈদ শেখ একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,”এটা তো কেবল শুরু। এতেই এত ব্যথা পেলে চলবে?”
জাঈদের চোখে প্রছন্ন হুমকি লুকিয়ে ছিল। যা বুঝতে পেরেই আরিশার গলা শুকিয়ে যায়। আরিশাকে খান ভিলার বাইরে নিয়ে এসেই জোরপূর্বক নিজের গাড়িতে টেনে তোলে জাঈদ শেখ। অতঃপর গাড়ি চালানো শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে আরিশা একদম ক্লান্ত। তার ভীষণ ভয়ও লাগছিল। এদিকে আরিশার কান্নায় জাঈদ শেখ বিরক্ত হয়ে বলে,”এসব ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ করো। নাহলে ধাক্কা দিয়ে তোমায় গাড়ি থেকে ফেলে দেব!”
জাঈদের থেকে এমন হুমকি পেয়ে আরিশা ভয়ে চুপ হয়ে যায়। জাঈদ আরিশার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”এখনই সব অশ্রু শেষ করলে কি হবে? এই বিয়েটার মাধ্যমে তো কেবল তোমার অশ্রুপাত শুরু হলো। সামনে দেখো, আরো কত অশ্রুজল ফেলতে হয়। কারণ এটাতো ছিল একটা অশ্রুজলে বোনা বিয়ে!”

বাসর ঘরে বসে আছে আফিফা। কিন্তু তার মনে স্বাভাবিক আনন্দ একেবারেই নেই। কিছু সময় আগেই ছবি বেগম ও আদৃতা এসে জোরপূর্বক তাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এখনো নিজের বোনের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত সে। এমন সময় নির্ঝর বাসর ঘরে প্রবেশ করল। নির্ঝর এর উপস্থিতি টের পেতেই আফিফা নিজের দুই চোখে জমা অশ্রু মুছে ফেলল। নির্ঝর ধীর পায়ে এগোতে লাগল আফিফার দিকে। আফিফার পাশে এসে বসে তার কাধে হাত রেখে বলল,”আমার থেকে নিজের কষ্ট লুকানোর দরকার নেই। তোমার দুঃখের ভাগীদার যদি না-ই হতে পারলাম তাহলে কিসের আর জীবনসঙ্গী?”

নির্ঝরের এই কথা শুনে তার বুকে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে উঠল আফিফা। কাঁদতে কাঁদতে বলল,”আমার বোনুকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো! ঐ জাঈদ শেখ ওকে শেষ করে ফেলবে। যে যাই বলুক আমি জানি আমার বোনটা ঐ জানোয়ারটাকে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেনি। নিশ্চয়ই ও জোর করে আমার বোনুকে বিয়ে করেছে। বোনুর জীবন শেষ হয়ে যাবে ঐ জাঈদের সাথে থাকলে। আপনি কিছু করুন।”
নির্ঝর আফিফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি একদম চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার পাশে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৯

এই সান্ত্বনাই যেন যথেষ্ট ছিল আফিফার জন্য। তার বেদনা কিছুটা লাঘব হয়। অতঃপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে সে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১১