অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫০ (২)

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫০ (২)
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি আরহামের কাধে মাথা দিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছে। আরহাম আরুশিকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে সেটা বুঝতে পারছে না। মারিয়াকে নিজের চোখে মরতে দেখার পর থেকেই আরুশি যেন এক অন্যজগতে চলে গেছে৷ বারবার তার ঐদিনের ঘটনা মনে পড়ে ও প্যানিক অ্যাটাক হয়। রাজীব মাশরাফিকে কোলে নিয়ে আরুশির রুমে এসে উপস্থিত হয়৷ এসেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আরুর এই অবস্থা আমি আর দেখতে পারছি না। মাশরাফিও নিজের মায়ের শোক ভুলে স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু আরু..”

আরহাম বলে,”আরুশি নিজের চোখে মারিয়াকে শেষ মুহুর্তে বাস সমেত পড়ে যেতে দেখেছে। ঐ দৃশ্যটা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না। তাই আজ এক মাস পেরিয়ে গেলেও ও এক গভীর শকডের মধ্যে আছে। আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আরুশির চেকআপ করিয়েছি, উনি বলেছেন আরুশিকে সম্পূর্ণ নতুন কোন পরিবেশে নিয়ে যেতে হবে। যাতে ও এসব কিছু ভুলতে পারে। আবার আমি লন্ডনের একটা সফটওয়্যার কোম্পানি থেকে একটা জবের লেটারও পেয়েছি৷ তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জাঈদ ও আরুশিকে নিয়ে লন্ডনে চলে যাব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এমন সময় আফিফা খান জাঈদকে কোলে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,”কি বলছ তুমি আরহাম? এতদিন পর আরুশিকে আর আমার নাতিকে আমরা সবাই ফিরে পেয়েছি। এখন তুমি আবার ওদের নিয়ে দূরে চলে যাবে।”
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আমার নিজেরও যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না, মম। কিন্তু আরুশির ভালোর জন্য এছাড়া কোন উপায় নেই। তাছাড়া লন্ডনে গেলে আমরা ওকে আরো ভালো চিকিৎসকের কাছে দেখাতে পারব।”
আফিফা খান আরো কিছু বলতে যাবেন এমন সময় নির্ঝর খান হুইল চেয়ারে করে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,”আরহাম একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আফিফা। আরুশি এমনিতেই এত অল্প বয়সে অনেক ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে। অনেক আপনজনকে হারিয়েছে। ওর সুস্থতার জন্য এখন এটুকু আমাদের করতেই হবে।”

আমানও তখন আমিনাকে কোলে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। আমানকে দেখেই আরহাম এগিয়ে এসে বলে,”ভাই, আমি লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি জানি, এমনিতেই সায়রা এখন প্রেগন্যান্ট, তার উপর তোর উকিলের ক্যারিয়ার এসব কিছু সামলে পরিবারের দিকে নজর দেয়া তোর জন্য কঠিন হবে। তবুও চেষ্টা করিস। আমি যে বড্ড অসহায়।”
“এভাবে বলো না, ভাইয়া। আমি সবটা সামলে নেবো। তুমি নিশ্চিতে জাঈদ এবং আরু আপাইকে নিয়ে লন্ডনে যাও।”
আরহাম আমানকে জড়িয়ে ধরে।

আরহামদের লন্ডনে যাবার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ শেষ হয়েছে। আজকেই তাদের ফ্লাইট। আরহাম ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত সব কাগজপত্র ভালো করে চেক করে নিচ্ছে। আফিফা খান এসে বলেন,”সবকিছু ঠিকভাবে দেখে নিয়েছ আরহাম?”
“হ্যাঁ, মম। আমাদের জন্য দোয়া করো। যেন যেই কাজে যাচ্ছি তা সফল হয়। আরুশি যেন আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়।”
আফিফা খান ও নির্ঝর দুজনেই তাদের জন্য দোয়া করে। নিঝুম খানের কাছে গিয়েও দোয়া চেয়ে আসে আরহাম। রাজীব জাঈদকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে। মাশরাফিও ছিল তার কাছে। জাঈদের মনটা বড্ড খারাপ। কারণ আজ তাকে সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে লন্ডনে চলে যেতে হবে। রাজীব জাঈদকে বলে,”মন খারাপ করো না।”
“তোমাদের সাথে আবার কবে দেখা হবে ভালো আঙ্কেল?”

এমন সময় আমিনা এসে বলে,”আরে জেদি ছেলে তুমি লন্ডনে যাচ্চ৷ ওকানে গিয়ে তো আমাদের বুলেই যাবা।”
জাঈদ বলে,”আর যাকেই ভুলি, তোমার মতো পাকা বুড়িকে ভুলব না।”
তাদের একথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। আরহাম যেতে যেতে রাজীবের হাত ধরে বলে,”আপনি আমাদের সবার জন্য যা যা করেছেন তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। মাশরাফির মতো একটা অসহায় বাচ্চার দায়িত্বও আপনি নিজের কাধে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু এসব কিছু ভাবতে গিয়ে আপনি নিজের কথা ভাবতে ভুলে গেছেন। এবার অন্তত নিজের কথা ভাবুন। আমি মম ড্যাডকে বলে যাচ্ছি, আপনার জন্য যেন একটা যোগ্য পাত্রী দেখা। এবার আপনি জীবনটা নতুন করে শুরু করুন।”

“এসবের কি দরকার ছিল?”
“দরকার ছিল ভাইয়া। আজ আরুশি স্বাভাবিক থাকলেও এই কথাটাই ভাবত। ওর অবর্তমানে তাই আমাকেই ভাবতে বলে।”
রাজীব ও আরহাম একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর আরহাম আরুশি ও জাঈদকে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা থেকে লন্ডনগামী একটি বিমানে চড়ে উড়াল দেয়।

৩ বছর পর,
খান বাড়ি আজ মেতেছে নতুন আনন্দে। আফিফা খান থেকে শুরু করে নির্ঝর খান এমনকি বাড়ির সবথেকে প্রবীণ সদস্য নিঝুম খানের মাঝেও আজ আনন্দের রেশ। দীর্ঘ ৩ বছর পর আজ খান বাড়ির বড় ছেলে আরহাম সপরিবারে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরছে। আরুশি এতদিন অসুস্থ ছিল৷ তবে এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। লন্ডনে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় সে শোক থেকে বেরিয়ে এসেছে।

আজকের এই শুভ দিনে আমান ও সায়রার প্রস্তুতি নিচ্ছে জোরকদমে। সায়রা তো সকাল থেকে রান্নাঘরে আফিফা খানের সাথে মিলে একের পর এক খাবার বানাচ্ছে। আফিফা খান এত তোড়জোড়ের জন্য হাসপাতালেও যান নি৷ তার বড় ছেলে ফিরছে বলে কথা। এরমধ্যে একটা বড় টেডি বিয়ার নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে আমিনা। সেই ছোট্ট আমিনা এখন ৭ বছরের হয়ে গেছে৷ আগের মতো তার কথা আর অস্পষ্ট নয়। এখন একদম সাবলীল ভাবে কথা বলে। তবে এখনো আগের মতোই চঞ্চল সে। চঞ্চল পায়ে রান্নাঘরে এসেই সে বলে,”আম্মু..বড় আব্বু আর বড় আম্মু কখন লন্ডন থেকে ফিরবে?”
সায়রা নিজের মেয়ের এমন কথায় হালকা হেসে বলে,”কেন? কার জন্য এত অপেক্ষা করছ?”
আফিফা খান হেসে বলেন,”কার জন্য আবার বুঝতে পারছ না? ওর জেদি ছেলের জন্য।”
বলে দুজনেই হেসে ওঠে। আমিনা গাল ফুলিয়ে বলে,”ঐ জেদি ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে আমার বয়েই গেছে। আমি তো আমার বড় আব্বু, বড় আম্মু আর সেই ছোট্ট বার্বির জন্য অপেক্ষা করছি।”
সায়রা বলে ওঠে,”আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। তোমার ভাইয়ু কোথায়? তাকে দেখেছ?”
আমিনা বলে ওঠে,”ভাইয়ু..ও আবার কি করবে৷ দেখো আব্বুর সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়া আর ওর কি কাজ আছে।”

এমন সময় আমান নিজের কাধে করে নিজের আড়াই বছর বয়সী ছেলে আকাশকে নিয়ে এসে বলে,”কি ব্যাপার? আমাকে আর আমার আকাশ বাবুকে নিয়ে কি কথা হচ্ছে মা-মেয়ের মাঝে?”
“কিছু না আব্বু। তুমি তো ভাইয়ুকে পাওয়ার পর আমাকে ভুলেই গেছ সেটাই বলছিলাম।”
বলেই গাল ফুলায় আমিনা। আকাশ এগিয়ে এসে আমিনাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”আমার আম্মাকে আমি ভুলতে পারি? তোমরা দুইজন হলে আমার কলিজার দুটো টুকরো।”
এমন সময় হঠা কলিং বেল বেজে ওঠায় আমিনা বলে ওঠে,”বড় আব্বুরা এসে গেছে!”

বলেই সে আনন্দে মেতে ওঠে। সায়রা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তবে আরহামরা আসে নি। রাজীব এসেছে সপরিবারে। এতবছর পর আরহামরা ফেরায় তাদের সাথে দেখা করতে এসেছে। রাজীবের সাথে তার স্ত্রী রুমিও এসেছে। রুমিও একজন পুলিশ অফিসার। আফিফা খানের এক চেনা বান্ধবীর বোনের মেয়ে সে। আফিফা খানই তাদের বিয়ের ঘটকালি করেছেন। রুমির কোলে তার ১ বছর বয়সী মেয়ে রিয়া। আর রাজীবের হাত ধরে আছে বয়স ৯ এর মাশরাফি। মাশরাফিকে নিজের ছেলের মতোই মানুষ করেছে তারা দুজনে। রুমিও তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসা দিয়েছে। কখনো পর করে নি।

মাশরাফিকে দেখেই আমিনা ছুটে এসে তার সাথে গল্প জুড়ে যায়। মাশরাফিও হালকা পাতলা গল্প করছিল। মূলত সে ভীষণ গম্ভীর একটা ছেলে তাই বেশি কথা বলে না। একটু পর আবারো কলিং বেল বেজে ওঠে। এবার আরহামরাই এসেছে। আমান তো দরজা খুলেই আরহামকে জড়িয়ে ধরে। দীর্ঘ ৩ বছর পর বড় ভাইকে দেখে সে আবেগাপ্লুত। আরহামকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোমায় অনেক মিস করেছি ভাইয়া।”
“আমিও মিস করেছি।”
এরপর আরহাম এগিয়ে এসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। জাঈদ এখন ৮ বছরের হয়ে গেছে৷ তবে তার স্বভাব আগের মতোই। এসেই তার পাখির চোখ খুঁজে নেয় আমিনাকে। আমিনার কাছে গিয়ে বলে,”হ্যালো, পাকা বুড়ি। হোয়াটস আপ, লেইট মি সি, তোমার কয়টা চুল পেকেছে।”

আমিনা বলে ওঠে,”এই যে এলেন ইংরেজ সাহেব। ৩ বছর লন্ডনে থেকেই নিজেকে ইংরেজ বাবু ভাবতে শুরু করেছে। এই যে শোনো, তুমি যতোই লন্ডনে থাকো আগেও জেদি ছেলে ছিলে এখনো জেদি ছেলেই থাকবে।”
এমন সময় আরুশিও সেখানে চলে আসে। সে দরজার বাইরে থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,”জনগণ, এদিকে তাকান৷ আজ এই বাড়িতে প্রথমবারের মতো পদার্পণ করতে চলেছে আমার আর আরহামের মেয়ে আরহা।”
সবাই মিলে আনন্দে চেচিয়ে ওঠে। আরুশি তার ১ বছর বয়সী মেয়ে আরহাকে নিয়ে প্রবেশ করে। লন্ডনেই তার জন্ম। আমিনা ছুটে আসে ছোট্ট আরহাকে দেখতে। এসেই হাত বাড়িয়ে বলে,”আমি একটু বার্বিকে কোলে নেই..ভিডিও কোলে তো দেখেছি কত্ত কিউট ও। একদম কিউটের ডিব্বা।”

জাঈদ বলে ওঠে,”নো ওয়ে, আগে হাত ফ্রেশ করে এসো। তার আগে আমার সিসকে টাচ করবে না।”
আমিনা মুখ বাকিয়ে বলে,”উম, এসে গেছে আমার হেলথ মিনিস্টার।”
এমন সময় মাশরাফি ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মাশরাফি দেখেই চিনতে পারে আরুশি। তাকে এগিয়ে আসার ইশারা করে। মাশরাফি আসতেই আরহা তার দিকে তাকিয়ে হাসে এবং নিজের আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে নিজের ছোট হাত দিয়ে তার মুখ স্পর্শ করে। মাশরাফির মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি বয়ে যায় আরহার এই স্পর্শে! আরুশি মাশরাফির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”মারিয়ার ছেলে..আজ কত বড় হয়ে গেছে অথচ..”
আরুশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। আরহাম তাকে সামলায়। আরহা তীক্ষ্ণ চোখে মাশরাফিকে দেখছিল। মাশরাফিও তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। আরুশি মাশরাফিকে বলে,”ওকে কোলে নাও, মনে হয় তোমার কোলে যেতে চাচ্ছে।”
বলে আরহাকে মাশরাফির কোলে দিতে যাবে এমন সময় জাঈদ এসে আটকে বলে,”নাহ, হ্যান্ড ওয়াশ না করে কেউ আমার সিসকে কোলে নিবে না।”

মাশরাফি মনোক্ষুণ্ণ হয়। আরহাও কেমন ঠোঁট উলটে ফেলে।
আরহাম বলে,”এমন বলতে নেই জাঈদ।”
মাশরাফি বলে,”ব্যাপার না, আমি হ্যান্ড ওয়াশ করে আসছি।”
অতঃপর মাশরাফি হাত ধুয়ে এসে আরহাকে কোলে নেয় এবার আর জাঈদ বাধা দিতে পারে না। আরুশি এতদিন পর সবাইকে দেখে অনেক খুশি। আরহামের হাত শক্ত করে ধরে সে বলে,”এতদিন আরহাম আমার পাশে ছিল বলেই আমি এত কঠিন সময় পেরিয়ে আসতে পেরেছি। একসময় তো মানসিক ভাবে এত ভেঙে পড়েছিলাম যে, ভাবতেও পারিনি ঐ পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারব তবে আরহামের ভালোবাসার জোরে বেরিয়ে এসেছি। এখন আল্লাহর কাছে শুধু একটাই চাওয়া, আমাদের জীবন যেমনি হোক আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন খুব সুন্দর একটা জীবন কাটায়। ওদের জীবনে যেন আমার মতো কঠিন সময় ফেইস করতে না হয়। আর যদি কঠিন সময় আসেও তাহলে আমি থাকব ওদের পাশে। ”

বলেই সে নিজের ছেলে ও মেয়ের দিকে তাকায়। নিঝুম এগিয়ে এসে বলে,”হয়তো আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। কিন্তু বহ্য প্রজন্মের জীবনের সাক্ষী হয়েছি। নিজের জীবনে, নিজের ছেলে-মেয়ের জীবনে এমনকি নিজের নাতি-নাতনীদের জীবনেও অনেক চড়াও উতড়াই দেখেছি। জীবনের মানেই এটা। তবে আমার দোয়া নতুন প্রজন্মের সবার প্রতি থাকবে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫০

এরপর তারা সবাই মিলে একত্রিত হয়ে সুন্দর করে একটা ফ্যামিলি ফটো তোলে। খান বাড়ির চার যুগের সাক্ষী হয় সেই ছবি। যেখানে নিঝুম, আফিফা, আরিশার সাথে ছিল ভবিষ্যতের আরহা, আমিনা, জাঈদ ও আকাশও! একইসাথে ছিল মাশরাফি এবং রিয়া।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫১