অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫১
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি আরহাম দুজনেই কোর্ট চত্ত্বরে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের সাথে আছে সায়রা, রাজীব, আফিফাসহ বাড়ির সবাই। আজকেই আদৃতার সব অপরাধের শাস্তি হিসেবে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হবে৷ যা শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে৷ মাঝখানে সে জেল থেকে পালিয়ে গেছিল তবে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। আমান আদৃতার বিরুদ্ধে কেইস লড়ছে এতদিন ধরে। একের পর এক তার সব অপকর্মের প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। অবশেষে আজ কোর্ট একটা রায়ে পৌঁছাতে পারল।
জজসাহেব ঘোষণা করলেন,”সমস্ত উপস্থাপিত প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং যুক্তি-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, এই আদালত মনে করে যে অভিযুক্ত মিসেস আদৃতা কবীর একাধিক খুন, অর্থ আত্মসাৎ, অপহরণ ও গুমের মতো গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত। সুতরাং, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, মহামান্য আদালত অভিযুক্তকে ফাঁসির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করছে।”
আদৃতা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। আজ তার সব অপরাধের শাস্তি দেওয়া হলো। এদিকে আরুশি যে নিজের ১ বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে আরহাকে কোলে নিয়ে আদালতে উপস্থিত ছিল রায়ের ঘোষণা হতেই খুশিতে ফেটে পড়ে। নিজের মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,”অবশেষে তোমার নানা-নানু ন্যায়বিচার পেল!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এছাড়া বাকি সবাইও ভীষণ খুশি হয়। আরহাম তো সবাইকে মিষ্টি বিলি করতে থাকে আনন্দে। সায়রাও আজ আনন্দিত তার মায়ের খু*নির শাস্তি দেখে। সে আমানের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়।
১৬ বছর পর,
সময়ের নদী বয়ে গেছে নীরব নিঃশব্দে,
চোখের পলকে কেটে গেছে একটি প্রজন্ম,
আরও ১৬টি বছর পেরিয়ে গেছে। সবার জীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
ঢাকা শহরের দালালগুলো আজ আরো গগণচুম্বী হয়েছে। ঢাকার একটি অভিজাত এলাকা বনানীর মাঠে আজ বসেছে এই এলাকার ভিন্ন দুটি ব্লকের ভিন্ন দুটি টিমের ক্রিকেট ম্যাচ। ক্রিকেট ম্যাচ উপলক্ষে চারিদিকে দর্শক শ্রোতারও কমতি নেই।
স্টেডিয়ামের একেবারে উপরের সারিতে চুপচাপ বসে আছে বছর ১৭ এর একটি মেয়ে। দুশ্চিন্তার ভারে ক্লান্ত দুই হাত জোড় করে রেখেছে সে। তার পাশেই বসে আছে ১৮ বছর বয়সী আরেক যুবক। মেয়েটিকে দুশ্চিন্তায় দেখে সে বলে,”চিন্তা করো না আরহা, জাঈদ ভাই’ই এই ম্যাচটা জিতবে। আমি শতভাগ নিশ্চিত।”
নিজের চাচাতো ভাই আকাশের মুখে এই ভরসার বানী শুনে শান্ত হতে পারে না আরহা। তার চোখ দুটি ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠের ব্যস্ত প্রস্তুতির দিকে। এমন সময় হঠাৎ করে আরহার পাশে এসে বসে তারই সমবয়সী আরেকটি মেয়ে। সে এসেই দাঁত কেলিয়ে বলে,”যে যাই বলুক, জিতবে তো আমার ভাইয়া। আমার ভাই হলো একজন প্রফেশনাল ক্রিকেটার, পার্ট টাইম ক্রিকেটার নয়! ছোটবেলা থেকে কত টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে। তাকে হারানোর সাধ্যি কি ঐ বুয়েট পড়ুয়া ইঞ্জিনিয়ারের আছে নাকি?”
নিজের প্রিয় বান্ধবী রিয়াশার মুখে কথাটা শুনে তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকালো আরহা। স্বভাবে সে ভীষণ শান্ত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কথা বলে না৷ কিন্তু নিজের বড় ভাই জাঈদকে ভীষণ ভালোবাসে। তার বিরুদ্ধে কোন কথাই শুনতে পারে না। এজন্য তো শান্তস্বরে জবাব দিল,”আমার ব্রো প্রফেশনাল ক্রিকেটার নাই হতে পারে বাট উনি যথেষ্ট ট্যালেন্টেড। আমার স্থির বিশ্বাস, আমার ব্রোই আজ এই ম্যাচটা জিতবে।”
কথাটা শুনে রিয়াশা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”অন্য কেউ হলে হয়তোবা জেতার চান্স ছিল কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন মাশরাফি হোসেন তখন জেতার চান্স একদম জিরো।”
আরহা আর কথা বাড়ালো না৷ শুধু চোখ বন্ধ করে দোয়া করতে লাগল নিজের বড় ভাইয়ের জন্য। রিয়াশার তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করল। তারা দুজনেই সমবয়সী এবং একই কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে সাইন্স নিয়ে পড়ছে। যদিও তাদের দুজনের স্বপ্ন ভিন্ন৷ আরহার স্বপ্ন তার দাদির মতো ডাক্তার হওয়া, মানুষের সেবা করা। অন্যদিকে রিয়াশা পড়াশোনায় ভালো হলেও তার গানের গলা আরো বেশি চমৎকার, সে চায় অনেক বড় গায়িকা হতে। এমনিতে তাদের সব বিষয়ে গলায় গলায় ভাব। একে অন্যের বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যখনই তাদের ভাই-জাঈদ ও মাশরাফির ব্যাপার আসে যারা আবার সেই ছোট্টবেলা থেকে একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী তখন যেন তারা দুজন দুই ভিন্ন মেরুতে চলে যায়।
আকাশ, আমিনার ছোট ভাই, সে আবার সেই ছোটবেলা থেকেই জাঈদের ভীষণ বড় ভক্ত। নিজের চাচাতো ভাইকে সে নিজের আইডল ভাবে। তাই তো সবসময় তাকেই সাপোর্ট করে। বর্তমানে সে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে এখন এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার শখ নিজের বাবার মতো একজন আইনজীবী হওয়া। রিয়াশা যখন জাঈদের নামে এমন কথা বলল তখন সে চুপ থাকতে পারল না। তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,”যাও, যাও দেখা যাবে কে জেতে। আমি শিওর, জাঈদ ভাইয়ার টিমই আজ জিতবে। ওনার চোখের এগ্রেসিভনেস দেখেছ? তোমার ভাইয়াকে না জাস্ট ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে!”
রিয়াশাও আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলে,”লেইট সি! কে কাকে উড়িয়ে দেয়।”
তাদের তর্কের মাঝেই সেখানে এসে দাঁড়ায়, আমিনা। সে এসেই তাদের মাঝে বসে পড়ে পপকর্ন নিয়ে। বয়সে ২৩ এর কোঠায় পা দিলেও এখনো ঠিক আগের মতোই চঞ্চল আছে সে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত সে। এসেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,”এসব ফালতু তর্ক বাদ দিয়ে সবাই পপকর্ন নিয়ে খেলা উপভোগ করতে শুরু করো৷ হার জিত তো লেগেই থাকে। আসল ব্যাপার হলো খেলার থ্রিলটা ফিল করা।”
রিয়াশা অনেক আগ্রহ নিয়ে আমিনাকে জিজ্ঞেস করে,”তুমি কার পাশে আপাই?”
আকাশ বলে ওঠে,”এটা আর জিজ্ঞেস করার কি আছে? আমার আপাই আমাদের বাড়ির ছেলে জাঈদ ভাইয়ার পাশেই আছে।”
আকাশের সব আশায় পানি ঢেলে আমিনা বলে ওঠে,”নাহ, ভাইয়ু। আমি ঐ জেদি রামছাগলটার পাশে নেই!”
“মানে? তাহলে কার পাশে আছ তুমি?”
আমিনা পপকর্ন খেতে খেতে বলে,”যে জিতবে তার পাশে।”
রিয়াশা বলে ওঠে,”তাহলে তো তুমি আমার ভাইয়ার পাশেই আছো।”
সবার এত কথার মাঝে আরহা শান্তচোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। বরাবরই সে এমনই। খুব একটা যুক্তিতর্কে যায় না, শান্ত থেকে শুধু সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আর অনেক হিসাব করে কথা বলে।
এরইমধ্যে মাঠে নামে দুটি বিপরীত টিম। একদিকে ছিল জাঈদ খান, ২৪ বছর বয়সী এক টগবগে যুবক। ভীষণ রাগী ও জেদি সে। যদিও সে বাবার পদচিহ্ন ফলো ইঞ্জিনিয়ারিংকেই বেছে নিয়েছে৷ বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত সে। ইঞ্জিনিয়ারিং তার পেশা হলেও ফুটবল হলো তার নেশা। ছোটবেলা থেকে সে হার শব্দটাকে ভীষণ ঘৃণা করে।
সদা জয় ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর সে৷ তার চোখেও এখন সেই জেদ প্রকাশ পাচ্ছে কেননা, আজকের ম্যাচে তার প্রতিপক্ষ এমন একজন যাকে সে শুরু থেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দী ভাবে।
অন্যদিকে ঠিক তার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নিজের টিমের সবার সাথে পরামর্শ করছে মাশরাফি হোসেন। বছর ২৫ এর গম্ভীর স্বভাবের এই যুবকের চোখে রাগ বা জেদ কোন কিছু নেই। আছে শুধু আত্মবিশ্বাস ও মনোবল। ভীষণ কৌশলী ও বুঝদার সে। ছোটবেলা থেকেই নানান টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে সে। তার স্বপ্নও একজন বড় ক্রিকেটার হওয়া। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল টিমে অভিষেকের যথেষ্ট সম্ভাবনাও আছে তার।
প্রথমেই দুজনকে টসের জন্য মাঠের মধ্যে দাঁড়াতে হলো যেহেতু তারা দুজনেই দুটি টিমের ক্যাপ্টেন। জাঈদ টসে জিতে একটা বিজয়ীর হাসি দিল। সে প্রথমে ব্যাটিং বেছে নিলো। মাশরাফি ভদ্রতাসূচক হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেও জাঈদ তাকে কোন পাত্তা না দিয়ে নিজের টিমের কাছে চলে গেলো। মাশরাফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
ম্যাচ শুরু হলো। প্রথম ওভারেই জাঈদ আগ্রাসী ভঙ্গিতে চার মেরে শুরু করে। তার প্রতিটি শটে যেন জেদ আর দম্ভ ঝরে পড়ছে। জাঈদ তার স্বভাবসুলভ জেদি মনোভাব নিয়ে ব্যাট চালাচ্ছে, কিন্তু মাশরাফির বোলিং তাকে বারবারই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
মাশরাফি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে একের পর এক কৌশল বের করছে। তার বোলিংয়ে নেই কোনো অতিরিক্ত আগ্রাসন। খেলা জমে উঠল। একপাশে জাঈদের ব্যাটের তাণ্ডব, অন্যদিকে মাশরাফির নিখুঁত বোলিং। জাঈদ একবারে বলকে উড়িয়ে মারতে পছন্দ করে, আর মাশরাফি চেষ্টা করে তাকে ফাঁদে ফেলার। একসময় জাঈদ একটি শর্ট বলে মাশরাফিকে স্কয়ার লেগে একটি দুর্দান্ত ছয় মারল। জাঈদ অহংকারী হাসি হেসে মাশরাফির দিকে তাকাল, যেন বোঝাতে চাইল,”আমাকে আউট করা এত সহজ নয়।”
মাশরাফি এক মুহূর্তের জন্য বিরক্ত হলেও নিজেকে সামলে নিল। তার চোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। পরের ওভারেই মাশরাফির একটি স্লোয়ার বলে জাঈদ আউট হয়ে গেল। জাঈদ রাগে গজগজ করতে করতে প্যাভিলিয়নে ফিরল। জাঈদের চোখে মুখে ছিল সুস্পষ্ট হতাশা।
আরহা জাঈদের কাছে এসে সান্ত্বনা দিতে চাইল,”ব্রো তুমি চিন্তা করো না, আমার মনে হয় তোমার টিমই জিতবে।”
জাঈদ তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,”আমি তো নিশ্চিত আমিই এই ম্যাচটা জিতব। জাঈদ খান কখনো হারতে শেখেনি।”
অন্যদিকে, জাঈদকে আউট করে মাশরাফির দল আনন্দে ফেটে পড়ল। রিয়াশা করতালি দিয়ে মাশরাফিকে উৎসাহ দিল। আমিনা রান আউট করার আনন্দে লাফাতে লাগল। ম্যাচ গড়িয়ে চলল। জাঈদের দল মাঝারি মানের স্কোর গড়তে পারল। এবার মাশরাফির দলের পালা।
মাশরাফি ওপেনিংয়ে নামল। তার শান্ত ও পরিপক্ক ব্যাটিং দেখে জাঈদের রাগ আরও বেড়ে গেল। মাশরাফি প্রতিটি বল সাবধানে খেলছিল এবং সুযোগ পেলে বাউন্ডারি মারছিল। জাঈদ ফিল্ডিংয়ে নেমেছিল, আর তার জেদি মনোভাব তাকে আরও বেশি আগ্রাসী করে তুলছিল। সে চাইছিল মাশরাফিকে যত দ্রুত সম্ভব আউট করতে। জাঈদ নিজেই বল তুলে নিল, দ্রুত রানআপে এসে মাশরাফির দিকে একটি ফাস্ট বল ছুড়ল। মাশরাফি সেই বলটি ডিফেন্স করল।
খেলা শেষের দিকে, মাশরাফির দল জয়ের খুব কাছাকাছি। শেষ ওভারে জিততে দরকার মাত্র ৪ রান, হাতে আছে ২ উইকেট। জাঈদ বল করতে আসল। তার চোখেমুখে জেদ, অহংকার আর আগ্রাসিভাব স্পষ্ট। সে চাইছিল, মাশরাফিকে আউট করে ম্যাচ জিততে। জাঈদ নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে বল করল। মাশরাফি শান্তভাবে সেই বলটা অফ সাইডে ঠেলে দিয়ে ২ রান নিল। পরের বলে মাশরাফি আরও ২ রান নিয়ে ম্যাচটা জিতে গেল।
মাশরাফির দলের সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। রিয়াশা ছুটে এসে মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরল। আমিনাও এগিয়ে গিয়ে মাশরাফিকে শুভেচ্ছা জানালো। আকাশ ও আরহা দুজনেই দুঃখী দুঃখী ভাব করে দাঁড়িয়ে রইল। জাঈদ হতাশায় মাথা নিচু করে ফেলল। আরহা তার ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। সে জানত, জাঈদ এই হার সহজে মেনে নেবে না।
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫০ (২)
ম্যাচ শেষ হওয়ার পর মাশরাফি এগিয়ে এসে জাঈদের হাত বাড়াল,”তুমি খুব ভালো খেলেছ জাঈদ। আজ হয়তো আমরা জিতেছি, কিন্তু তোমার টিমের পারফরম্যান্স দুর্দান্ত ছিল।”
জাঈদ অবশ্য সেই হাতে হাত মেলাল না। সে কেবল মাশরাফির দিকে এক ঝলক কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। তার অহংকারী মন এই হার মেনে নিতে পারছিল না।