অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৮

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৮
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মাঝে। কিছু জরুরি কাজে সে একটু বাজারে এসেছিল৷ জাঈদই তাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন জাঈদ কিছু জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় এখনো আসতে পারছে না। যার দরুণ আরহাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আরহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ভাইয়া যে কখন আসবে। এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব।”
আরহার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে একটি মোটরসাইকেল এসে তার সামনে দাঁড়ায়। আরহা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে মোটরসাইকেলে বসে আছে মাশরাফি। মাশরাফিকে দেখে আরহা চোখ নামিয়ে নেয়। মাশরাফি আরহাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”উঠে বসো।”

আরহা প্রথমত বুঝতে না পের অবাক চোখে মাশরাফির দিকে তাকায়। মাশরাফি আরো একবার বলে,”আমার মোটরসাইকেলে উঠতে বললাম।”
আরহা বলে,”আসলে ব্রো আমায় নিতে আসবে আর তাই..”
মাশরাফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তোমার ব্রো তো প্রতিদিনই তোমায় এভাবে নিয়ে যাওয়া আসা করে। সারাজীবন কি এই দায়িত্ব সেই পালন করবে নাকি?”
আরহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”মানে?”
“বুঝবে না। বাদ দাও, আমার মোটরসাইকেলে ওঠো আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি।”
“কিন্তু ব্রো তো রেগে যাবে..”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমার ব্রোর মাথায় এমনিতেও সবসময় ইঁদূর লাফায় এজন্য সেও সবসময় লম্ফঝম্প করে। ওর রাগ আর নতুন কি? সবসময় তো মাথায় পাড়া হাই থাকে। তুমি ওত কিছু না ভেবে চলে এসো। বাকিটা আমি সামলে নিব।”
আরহা আর মানা করতে পারে না। মাশরাফির কথা মতো তার মোটরসাইকেসের মাঝে উঠে বসে। মাশরাফি মোটরসাইকেল চালানো শুরু করে। আরহা শুরুতে মাশরাফিকে ধরে বসতে দ্বিধা বোধ করে পরে মাশরাফিই বলে,”শক্ত করে ধরে বসো। নাহলে পড়ে যাবে।”
মাশরাফির কথায় আরহা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে,”না, ঠিক আছে..আমি সামলে নিতে পারব।”

অনেকটা পথ পেরিয়ে মাশরাফি বাইকটা থামাল একটা নির্জন নদীর ধারে। চারপাশে সবুজ ঘাস আর গাছপালা, পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। আরহা বাইক থেকে নামতেই মাশরাফিও নেমে দাঁড়াল। আরহা অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে বলল,”এখানে কেন নিয়ে এলেন?”
মাশরাফি কোনো উত্তর না দিয়ে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়াল। মাশরাফির চোখে মুখে এক ছিল ভীষণ অস্থিরতা। আরহা কিছু বুঝতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করল,”কিছু বলবেন?”
মাশরাফি গভীর একটা শ্বাস নিয়ে আরহার দিকে ফিরল। ওর চোখে চোখ রেখে বলল,”হ্যাঁ, কিছু কথা বলার ছিল। এমন কথা, যা অন্য কোথাও বলা যেত না।”
আরহা চুপ করে রইল, মাশরাফির চোখে সে এক ভিন্ন আর অচেনা অনুভূতি দেখতে পাচ্ছিল। মাশরাফি এবার সরাসরি আরহার দিকে তাকিয়ে বলল,”জানি না কীভাবে শুরু করব, আর তুমি কী ভাববে। কিন্তু আমি আর লুকোতে পারছি না।”

আরহা ঘাবড়ে গেল। মাশরাফির কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, মাশরাফিকে এরকম অবস্থায় সে আর কখনো দেখে নি। মাশরাফি এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করল,”আমি তোমাকে পছন্দ করি আরহাকে। কবে থেকে, কিভাবে জানি না। তবে যবে থেকে আমি অনুভূতি নামক শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছি তবে থেকেই আমার এই মন শুধু তোমার কথাই ভাবে। তোমার কথা ভেবেই আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়। তোমাকে দেখলে আমি অনুভব করতে পারি যে..তোমাকে আমি কতটা পছন্দ করি।”
মাশরাফি কয়েক পা হেঁটে আরহার সামনে এসে দাঁড়াল। ওর চোখে ছিল স্পষ্ট অস্থিরতা। সে আরো বলল,”তোমার সরলতা, তোমার নিষ্পাপ হাসি, তোমার শান্ত শিষ্ট ব্যবহার… সব কিছু আমাকে মুগ্ধ কর প্রতি মুহুর্ত। প্রথম দিকে আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে এটা শুধু একটা সাময়িক ভালো লাগা। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এটা শুধু ভালো লাগা নয়।”

আরহার বুক ধড়ফড় করছে। সে এক মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। মাশরাফির কথাগুলো যেন তাকে ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে। মাশরাফি আরহার দিকে হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরল। আরহা চমকে উঠল। মাশরাফির হাত কাঁপছে। মাশরাফি ফিসফিস করে বলল,”আরহা,” “আমি… আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি।”
কথাটা শুনে আরহা যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে হতবাক হয়ে মাশরাফির দিকে তাকিয়ে রইল। মাশরাফির মুখে এমন গভীর একটা অনুভূতি, যা সে আগে কখনো দেখেনি। আরহা ভাবতেই পারেনি মাশরাফি তাকে এমন কথা বলবে। সে যেন এক স্বপ্ন দেখছে। তার মনে হাজারো প্রশ্ন ভিড় করছে। সে কী বলবে, কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। কেবল মাশরাফির চোখের গভীরতা তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।

মাশরাফি আরহার নীরবতা দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,”জানি, এটা তোমার জন্য অপ্রত্যাশিত। তুমি হয়তো ভাবছ আমি এসব কথা কেন বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমি তোমাকে আমার জীবনে চাই।”
আরহা শুধু তাকিয়েই রইল। তার মনে হচ্ছে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। তার মনের ভাবনা সব কিছু যেন এক নিমিষে ওলটপালট হয়ে গেছে। মাশরাফির চোখে এক গভীর আকুতি। আরহা কী উত্তর দেবে, তা সে ভেবেই পাচ্ছে না।
মাশরাফি অধীর আগ্রহে আরহার দিকে তাকিয়ে ছিল উত্তরের আশায়। আরহাকে চুপ দেখে সে বলে,”আমার প্রশ্নের উত্তর কি পাবো না আরহা?”

আরহা যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছিল। কোনরকমে চোখ বন্ধ করে সে বলে,”আমি এইসব নিয়ে কখনো ভাবি নি। দয়া করে আমাকে এখনই বাসায় রেখে আসুন।”
মাশরাফি বুঝল আরহা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছে তার এই আচমকা প্রেম নিবেদনে। তাই সে বললো,”বেশ, তুমি একটু সময় নিয়ে ভাবো। তারপর আমায় উত্তর দিও। আপাতত আমি তোমার উত্তর নেতিবাচক ভাবছি না। আমি শুধু নিজের কাছের সৎ থাকতে চেয়েছি জন্য তোমায় নিজের অনুভূতি জানালাম। এখন বাকিটা তোমার হাতে। আমি না চাইলে আমি এক পাও আগাব না।”
বলেই মাশরাফি নিজের মোটরসাইকেলে উঠে বসল এবং আরহাকেও বসতে বলল৷ আরহার যেন এবার ধৈর্যের বাধ কমে এলো। মাশরাফির মোটরসাইকেলে উঠতেও তার অস্বস্তি হচ্ছিল। তবুও অনেক কষ্টে সে উঠে বসে।

রিয়াশা রাস্তার ধার দিয়ে একা হেটে যাচ্ছিল। আরহা এবং মিম তার দুই বান্ধবীই যেন তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। অথচ রিয়াশা সবসময় তাদেরও ভালোই চেয়েছে। এসব ভাবনার মাঝেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে। এমন সময় রাস্তায় মাঝে জটলা দেখে ছুটে গেল সেদিকে। সেখানে যেতেই রিয়াশা যা দেখল তাতে অবাক হয়ে গেল। মিমকে তার বাবা বাজারভর্তি মানুষের সামনে মারধোর করছে! রিয়াশা বুঝতে পারল না এর কারণ কি। অবাক চোখে দেখতে থাকত। মিমের বাবা বলছিল,”ভুল আমারই। তোর মায়ের কথা শুনে তোকে পড়াচ্ছিলাম। আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল যে, বেশি ওড়ার স্বাধীনতা দিলে তুই এত উপরে উড়বি যে আমাদের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিবি। তোর সাহস কি করে হয়, আমার মেয়ে হয়ে একটা ছেলের সাথে নষ্টামি করে বেড়ানোর? রাস্তায় তার হাত ধরে হাটা, একসাথে ফুচকা খাওয়া,পার্কে গিয়ে গল্প করা এসব দিন দেখার জন্য তোকে জন্ম দিয়েছিলাম।”

মিম বলে,”আমার ভুল হয়ে গেছে আব্বু। আমায় ক্ষমা করে দাও।”
“কোন ক্ষমা পাবি না তুই। আমার মান সম্মান তুই শেষ করে দিয়েছিস। এবার তোকে আমি ঘরে রাখব না। অনেক হয়েছে লেখাপড়া এবার তোর বিয়ের পালা। আজ থেকে তোর লেখাপড়া বন্ধ, খুব শীঘ্রই তোর বিয়ে দেব আমি।”
মিম কাঁদতে থাকে। হাজার অনুনয় করে কিন্তু কোন লাভ হয় না। এর মধ্যে রিয়াশা এসে বলে,”আঙ্কেল, আমার কথাটা..”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৭

কিন্তু মিমের বাবা আর কিছু না শুনে মিমকে টানতে টানতে নিয়ে যান। যাওয়ার সময় মিম অসহায় চোখে রিয়াশার দিকে তাকায়। তার চোখে ছিল অনুশোচনা। রিয়াশা বলে ওঠে,”এসব কিছু হয়েছে ঐ আকাশের জন্য। ওকে তো আমি ছাড়ব না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৯