অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬০

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬০
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা ভয়ে একদম জমে গেল আমান খানের মাথায় ফুলের টব পড়ার দৃশ্য দেখে। সে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে চাইলো তার চাচাকে দেখার জন্য। মাশরাফিও ব্যাপারটা বুঝে দৌড় দিল।
এদিকে আরহাম খান ও জাঈদ দুজনে বাইরে বের হচ্ছিল বাড়ি থেকে কিছু জরুরি কাজে। আমানের চিৎকার শুনে তারা ছুটে যায় সামনে এবং গিয়ে আমানকে আহত অবস্থায় দেখে দুজনেই আতকে ওঠে। আরহাম বলে ওঠে,”আমান..কি হয়েছে ওর..”

জাঈদ ও আরহাম দুজনে এগিয়ে গিয়ে আমানকে আগলে নিলো। পাশে পড়ে থাকা টব এবং আমানের মাথায় রক্ত দেখে তারা বুঝতে পারল যে এই টবটা হয়তো কোনভাবে আমানের মাথায় পড়েছে। তাদের বাসার ছাদে আগে থেকেই অনেক টব ছিল তাই তারা এই নিয়ে বেশি ভাবল না। জাঈদ বলল,”হয়তো কোনভাবে চাচ্চুর মাথায় ছাদ থেকে টবটা পড়েছে। আমি এখনই এম্বুলেন্সে কল করছি।”
আরহাম আমানকে সামলে নিয়ে বলে,”হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি কর।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সায়রা ও আমিনাও বসার ঘরে ছিল। আমানের চিৎকার তাদেরও কানে এসেছিল। তাই তারাও ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে আসে। আমানকে এভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দুজনেই ছুটে যায়। সায়রা খান আমান খানের সামনে বসে পড়ে কান্না করতে করতে বলে,”এসব কি করে হলো?”
আমিনা কান্নারত স্বরে বলে,”চোখ খোলো আব্বু।”

আরহাও ততক্ষণে ভয়ে ভয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। মাশরাফিও সেখানে চলে আসে। কিছু সময়ের মধ্যে এম্বুলেন্স চলে এলে মাশরাফি, জাঈদ ও আরহাম ধরাধরি করে আমানকে এম্বুলেন্সে ওঠায়। আমিনাও তাদের সাথে উঠে পড়ে। এদিকে সায়রা পাগলামো করছিলেন৷ আরুশিও ততক্ষণে সেখানে চলে এসেছিলেন। আরুশি ও আরহা মিলে সায়রাকে সামলানোর চেষ্টা করে। আরহা তখনো অব্দি ভয়ে কাউকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে পারে নি। কিন্তু মনের মাঝে চলতে থাকা অপরাধবোধে সে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল৷ আরহা চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলে,”আল্লাহ, তুমি দেখো চাচ্চুর যেন কিছু না হয়। নাহলে যে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না।”
আরহাকে অন্যমনস্ক দেখে আরুশি বলেন,”আরহা কি এত ভাবছ তুমি? সায়রার অবস্থা দেখো, ওকে এখনই রুমে নিয়ে যেতে হবে।”

সায়রা বিড়বিড় করে বলতে থাকেন,”ওর কিছু হবে না তো? ও আমায় কথা দিয়েছিল আজ রাতে ফিরে আমাদের বিবাহবার্ষিকী একসাথে উদযাপন করব। তাহলে হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল?”
আরুশি সায়রাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,”তুমি চিন্তা করো না সায়রা। সবকিছু একদম ঠিক হয়ে যাবে।”

আকাশ তখন নিজের সাইকেল নিয়ে মিমের বাসার দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে মিমের বিয়ের কথা জানতে পারে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। তাই কোন কিছু না ভেবে মিমের সাথে একবার দেখা করার উদ্দ্যেশ্যে ছুট দিয়েছে সে। তার ফোন বেজে চললেও সে এটা রিসিভ করছে না। মিমের বাসার কাছে পৌঁছানো মাত্রই হঠাৎ করে রিয়াশা তাকে দেখতে পেয়ে তার সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আকাশ দ্রুত সাইকেলে ব্রেক কষে বলে,”হচ্ছে টা কি? সরে যাও সামনে থেকে।”

রিয়াশা তুমুল রাগ দেখিয়ে বলে,”কেন এসেছ তুমি এখানে? মিমের এতবড় সর্বনাশ করেও তোমার শান্তি হয়নি? এখন কি ওকে আরো অপদস্ত করলে তোমার শান্তি হবে?”
আকাশ বলে ওঠে,”কি বলছ তুমি এসব? মিম এবং আমি একে অপরকে ভালোবাসি। আর..”
“আর তোমার এই ভালোবাসাই মিমের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিমের বাবা ওর সাথে দ্বিগুণ বয়সী একজন ব্যক্তির বিয়ে ঠিক করেছে শুধুমাত্র তোমার এই ভালোবাসার কথা জানতে পেরে। মিম আর আন্টির দিকে তো আমি তাকাতেই পাড়ছি না। এসব কিছুর জন্য তুমি দায়ী। না তুমি মিমের সাথে প্রেম করতে আর না এসব কিছু হতো।”
“মিমকে আমি ভালোবাসি, ওকে আমি বিয়ে করবো!”

রিয়াশা রেগে চিৎকার করে বলে,”চুপ থাকো তুমি। তোমার মা-বাবা যদি তোমায় একটুও শিক্ষা দিয়ে থাকে তাহলে চলে যাও। আর এক পাও সামনে বাড়িও না। এমনিতেই মিম ঝামেলার মাঝে আসে। এরপর তুমি যদি গিয়ে আরো কাহিনি করো তাহলে মেয়েটার নিজেকে শেষ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।”
“দেখো, তোমার যা বলার আমাকে বলো। আমার বাবা-মা তুলে একদম কথা বলবে না।”
“একশোবার বলব। তোমার বাবা-মা যদি তোমায় ভালো শিক্ষা দিত তাহলে তুমি এভাবে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিতে না।”

আকাশ আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার ফোনটা আবার বেজে ওঠে। সে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ কর‍তেই বিপরীত দিক থেকে আমিনা কান্নারত সুরে বলে,”ভাইয়ু কোথায় তুই? কখন থেকে ফোন দিচ্ছি তোকে.. তাড়াতাড়ি সিটি হাসপাতালে চলে আয়..আব্বুর অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল। হয়তো ওনাকে আর বাঁচানো যাবে না..”
কথাটা শোনামাত্রই আকাশের হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। সে নিজের হুশ হারিয়ে ফেলে। আমিনার বলা কথাগুলো তার কানে বাজতে থাকে। সে দ্রুতই নিজের সাইকেল ঘুরিয়ে নেয়। এদিকে রিয়াশা অবাক চোখে সবটা প্রত্যক্ষ করে।

আরহা নিজের রুমে চুপচাপ বসেছিল। এমন সময় হঠাৎ করে মাশরাফি চলে আসে তার রুমে। সে এখনই হাসপাতাল থেকে ফিরলো। মাশরাফিকে দেখেই আরহা তার কাছে ছুটে গিয়ে বললো,”চাচ্চু এখন কেমন আছে মাশরাফি ভাইয়া? উনি ঠিক হয়ে যাবেন তো?”
“আরহা..নিজেকে সামলাও।”
“আমি পারছি না..নিজেকে কোনমতেই সামলাতে পারছি না। শুধুমাত্র আমার জন্য আজ চাচ্চুর এই অবস্থা..আমি এসবের জন্য দায়ী।”

আবেগপ্রবণ আরহা আজ যেন আরো বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। মাশরাফি আরহার কাধে হাত বুলিয়ে বলল,”যা হয়েছে তাতে তোমার কোন দোষ নেই আরহা। এটা পুরোটাই একটা দূর্ঘটনা ছিল। তোমার হাত লেগে টবটা নিচে পড়েছে। তুমি তো আর ইচ্ছা করে ফেলোনি!”
আরহা বলে,”কিন্তু আমার জন্যই তো..সবাই যদি এটা জানতে পারে তাহলে সবাই আমার উপর রাগ করবে। আমিনা আপু, আকাশ ভাইয়া, চাচি, পাপা, মাম্মা, গ্র‍্যানি, গ্রান্ডপা সবাই আমাকে দোষী ভাববে।”
“নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো। আর তোমার কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।”
“কি বলছেন কি? সত্যটা কাউকে জানাবো না?”

“নাহ, এমনিতেই সবাই অনেক টেন্স। এরমধ্যে সবটা জানলে সবাই আরো বেশি চিন্তা করবে এবং তোমার উপর সাথে ব্যবহার করবে অকারণে। তাই ব্যাপারটা কাউকে বলো না। পরে তোমার চাচ্চু সুস্থ হলে সবাইকে বুঝিয়ে বলো। আর চিন্তা করো না, আমিও থাকব তোমার পাশে। আমি সবটা নিজের চোখে দেখেছি।”
“কিন্তু চাচ্চুর যদি ভালোমন্দ কিছু হয়ে যায়..তাহলে যে সারাজীবন এই গিল্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।”
“এখন এসব নেতিবাচক ভাবনা বাদ দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আকাশ দ্রুত নিজের সাইকেল নিয়ে সিটি হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়। অতঃপর আমানের কেবিনের সামনে উপস্থিত হয়। আরহাম ও জাঈদ সেখানে পায়চারি করে চলছিল৷ রাজীবও ততক্ষণে উপস্থিত হয়েছে। আমিনা সিটে বসে কাঁদছে। আকাশ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আরহাম ও জাঈদকে জিজ্ঞেস করে,”আব্বু এখন কেমন আছে?”
জাঈদ বলে,”তুই এসেছিস আকাশ! চাচ্চুর চিকিৎসা চলছে ভেতরে। ডাক্তার জানিয়েছেন ওনার অবস্থা ভীষণ খারাপ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে বলেছেন।”

আকাশ বলে,”আমার আব্বুর কিছু হবে না..আল্লাহ তুমি ওনায় ঠিক করে দাও প্লিজ।”
এমন সময় কেবিন থেকে একজন ডাক্তার বের হয়। তাকে বের হতে দেখেই আরহাম, জাঈদ ও আকাশ ছুটে যায়। আমিনাও উঠে দাঁড়ায়। আরহাম জিজ্ঞেস করে,”আমার ভাই কেমন আছে এখন?”
ডাক্তার কোন জবাব দেয় না। আকাশ বলে ওঠে,”চুপ করে আছেন কেন? বলুন আমার আব্বু কেমন আছে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৯

ডাক্তার হতাশার শ্বাস ফেলে বলেন,”দুঃখিত..আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু মাথায় আঘাত লাগার ফলে ওনার ব্রেন বাজেভাবে ড্যামেজ হয়ে গেছিল..ইন্টারনাল হ্যামারেজও হয়েছিল..তাই আমাদের কিছু করার ছিল না। আমরা ওনাকে বাচাতে পারি নি।”
আমিনা আর্তনাদ করে কেদে ওঠে নিজের বাবার মৃত্যুর কথা শুনে। আকাশ বলে ওঠে,”নাহ, এটা হতে পারে না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬১