অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৪

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৪
ইয়াসমিন খন্দকার

জাঈদ তার মায়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এদিকে আরুশি তেজ নিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের ছেলের দিকে। তার একটুও আফসোস হচ্ছে না জাঈদকে এভাবে থাপ্পড় মারায়। জাঈদ বলে ওঠে,”তুমি আমায় মারলে মাম্মা?”
“হ্যাঁ, মেরেছি। বেশ করেছি একদম। তুমি এটাই ডিজার্ভ করো। মাশরাফিকে তোমার পছন্দ নাই হতে পারে কিন্তু ওর মৃত মায়ের সম্পর্কে তুমি যেই মন্তব্য করেছিস তাতে এটা তোমার প্রাপ্য ছিল। আমার তো তোমাকে নিজের ছেলে ভাবতেই লজ্জা করছে।”

আরহাম এগিয়ে এসে বলে,”তোমার মাম্মা একদম ঠিক করেছে। তুমি ভুলে গেছ, মারিয়ার মৃত্যুর ঘটনা? সেদিন ও চাইলে আগেই বাস থেকে নেমে যেতে পারত, তাহলে আজ ও আমাদের মাঝেই থাকত। শুধুমাত্র তোমার মাকে একা ছাড়বে না বলে ও বাসে উপস্থিত ছিল। আর যার জন্য ওকে মরে যেতে হয়েছিল। তারপরও তুমি কিভাবে এই কথা বলো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জাঈদ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। রাজীব হাসান এগিয়ে এসে বলেন,”মাশরাফি এই কাজটা ঠিক করে নি৷ আরহা এখনো অনেক ছোট। আমি মাশরাফিকে বোঝাব এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে।”
বলেই তিনি মাশরাফির হাত ধরে বেরিয়ে যেতে নেন এমন সময় আরুশি বলে ওঠেন,”দাঁড়ান রাজীব ভাই! এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আগে আমরা সিদ্ধান্ত নেব তারপর আপনারা এখান থেকে যাবেন।”
বলেই আরুশি আরহার মুখোমুখি দাঁড়ান। অতঃপর তাকে প্রশ্ন করেন,”তুমি কি মাশরাফিকে পছন্দ করো আরহা?”
আরহা চুপ থাকে। আড়চোখে একবার মাশরাফি তো একবার জাঈদের দিকে তাকায়। আরুশি আরহাকে চুপ দেখে বিরক্তির স্বরে বলেন,”চুপ করে থেকো না, আমি একটা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও।”

আরহা মনে করে বিগত কিছুদিন ধরে মাশরাফি কিভাবে তাকে সামলাছে। আগে তার মাশরাফির প্রতি আলাদা করে কোন অনুভূতি ছিল না৷ কিন্তু সে যেই সময় মানসিকভাবে চরম ভেঙে পড়েছিল তখন মাশরাফিই ছিল তার পাশে তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। এই সময় আরহা মাশরাফির প্রতি মানসিকভাবে ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়েছে। তাই সে আর নিজের অনুভূতি গোপন না করে বলে দেয়,”হ্যাঁ, মাম্মা। আমি ওনাকে পছন্দ করি..”

জাঈদ রাগী চোখে নিজের বোনের দিকে তাকায়। মাশরাফির চোখেমুখে সন্তুষ্টির হাসি। সায়রা খান বলে ওঠেন,”কিন্তু আরহা তোমাদের মধ্যে তো বয়সের একটা পার্থক্য আছে আর তোমার তো এখনো ১৮ হয়নি!”
আরহাম বলে ওঠে,”কোন ব্যাপার না। আরহা এবং মাশরাফি যদি একে অপরকে পছন্দ করে তবে আমাদের তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে কোন সমস্যা নেই। তবে, আরহা আমার একমাত্র মেয়ে। ওকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। আরহাও তো চায় ডাক্তার হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তাই আমি চাই না, এত জলদি ওর বিয়ে দিতে।”
মাশরাফি বলে ওঠে,”আমি আরহার স্বপ্নপূরণে ওর পাশেই থাকব আঙ্কেল। আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন।”

আরুশি বলেন,”আমরা তোমার উপর ভরসা করি মাশরাফি। আমরা জানি, আমাদের মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলে, তুমি ওকে অনেক ভালো রাখবে। আর তাই আমরা তোমাদের এই সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছি৷”
মাশরাফি ও আরহা দুজনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। আরহাম খান বলেন,”আরহার ১৮ বছর পূর্ণ হলে আর ও মেডিকেলে চান্স পেলেই আমরা তোমাদের এনগেজমেন্ট এর দিন ঠিক করব। তারপর একদিন ভালো একটা তারিখ দেখে তোমাদের চারহাত এক করে দেব।”
জাঈদ বলে ওঠে,”বাহ, খুব ভালো। আমার বোনের জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে অথচ সেখানে আমার মতামতের তোয়াক্কা কেউ করছে না।”

আরুশি বিরক্তির স্বরে বলেন,”ওরা একে অপরকে পছন্দ করে, মাশরাফি ছেলে হিসেবে ভালো। তাহলে এখানে আপত্তি করার কি আছে? আমরা তো তোমার মতো ব্যক্তিগত অপছন্দের জের ধরে নিজেদের মেয়ের পছন্দকে হেলাফেলা করতে পারি না।”
জাঈদ বলে,”আরহা কি তোমাদের উপর এতটাই বোঝা হয়ে গেছে যে এভাবে যার তার গলায় আরহাকে ঝুলিয়ে দেবে? মাশরাফির কি কোন স্ট্যাবল ক্যারিয়ার আছে?”
মাশরাফি দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,”এসব নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার বোন কখনো বিন্দুমাত্র অভাবে থাকবে না। ওর সব চাহিদা আমি পূরণ করবো।”
রাজীব হাসানও বলেন,”মাশরাফির উপর আমার ভরসা আছে৷ ও নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সফল হবেই। তাছাড়া, আমি যা সম্পদ অর্জন করেছি সেসব তো রিয়া ও মাশরাফিরই! তাই ওদের অন্তত অর্থনৈতিক কোন সমস্যা পোহাতে হবে না।”

“ভালো আঙ্কেল, মাশরাফি আপনার নিজের ছেলে হয় আপনার পালিত ছেলে। আপনার স্ত্রী, সন্তান কি মেনে নেবে যদি আপনি ওকে নিজের সম্পত্তির ভাগ দিতে চান?”
আরহাম রেগে বলে,”এসব কেমন কথা জাঈদ? তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার মেয়ে ও মাশরাফি দুজনেই নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। তাছাড়া আমি তো এখনো মরে যাইনি, আমার মৃত্যুর আগে আমার সম্পত্তি তোমাদের দুই ভাইবোনের মাঝে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে যাব। আরহাকে কখনোই অভাবের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না।”

মিসেস রুমি এতক্ষণ চুপ ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি বলে ওঠেন,”মাশরাফিকে আমি জন্ম নাই দিতে পারি কিন্তু কখনো ওকে রিয়াশার থেকে আলাদা করে দেখিনি। রিয়াশা তো আমার আর ওর আব্বুর থেকেও নিজের ভাইয়াকে বেশি ভালোবাসে। রাজীব যদি নিজের পুরো সম্পত্তিও মাশরাফিকে লিখে দেয় তবুও আমার বা আমার মেয়ের কোন সমস্যা নেই৷ এতটা নিচু মানসিকতা আমাদের নেই।”
মাশরাফি মিসেস রুমির দিকে আবেগঘন চোখে তাকিয়ে বলে,”আমার শুধু তোমাদের ভালোবাসা চাই আব্বু, আম্মু। আর কিছু না। আমি নিজের ক্যারিয়ারে সফল হবোই।”

জাঈদ আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় আমিনা বলে ওঠে,”অনেক হয়েছে জেদি ছেলে! এবার তোমার এসব আজেবাজে কথা বন্ধ করো। নিজের বোনের ভালোবাসার পথে আর বাধা হয়ে দাঁড়িও না। মাশরাফি ভাই অনেক ভালো মানুষ। ওনার জীবনসঙ্গী হলে আরহা অনেক সুখী থাকবে। ”
জাঈদ আর কোন কথা না বলে স্থান ত্যাগ করে। বাকি সবাই নতুন আত্মীয়তা জোড়ার আনন্দে মিষ্টিমুখ করে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে। মাশরাফি ও আরহা একে অপরের দিকে হাসি মুখে তাকায়।

কয়েক দিন পর,
আমিনা নিজের রুমে বসেছিল। বিগত কিছুদিন ধরে তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল ন। কিছু সময় পর জাঈদ রুমে প্রবেশ করে। কাভার্ডে নিজের একটা পছন্দের শার্ট খুঁজে না পেয়ে জাঈদ আমিনাকে জিজ্ঞেস করে,”আমার অফ হোয়াইট শার্টটা কোথায় আমিনা? এখানেই তো রেখেছিলাম।”
আমিনা উঠে দাঁড়িয়ে শার্টটা খুঁজতে যায়। জাঈদকে বলে,”সরো আমি খুঁজে দিচ্ছি।”
জাঈদ সরে দাঁড়ায়। এদিকে শার্ট খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ করে আমিনার মাথা ঘুরে যায়। সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে নেয় এমন সময় জাঈদ আমিনাকে আগলে নেয়। আমিনার এই অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলে,”আমিনা! কি হয়েছে তোমার? চোখ খোলো..”

আমিনাকে দেখতে একজন ডাক্তার এসেছে। আশেপাশে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা নিয়ে কথা তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার আমিনাকে চেক করতে থাকে। সায়রা খান অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন,”হায় আল্লাহ! তুমি আর আমাদের কত পরীক্ষা নেবে? আমার স্বামীকে তো আমার থেকে কেড়ে নিলে। আমার মেয়েটার আবার কি হলো?”
আকাশ নিজের মাকে সান্ত্বনা দেয়। জাঈদ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে ডাক্তার? সব ঠিক তো?”
ডাক্তার হাসিমুখে বলেন,”কংগ্রাচুলেশনস, আপনি বাবা হতে চলেছেন।”
জাঈদ চরম আশ্চর্য ও খুশি হয়। সে তো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন! আকাশ খুশি হয়ে বলে,”আমি মামা হতে চলেছি।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৩

আরুশিও নিজের ফুফু হওয়ার খবরে আনন্দিত হয়। তার মিষ্টি হাসিই সেই খুশি ফুটিয়ে তোলে। বাড়ির বড়রাও সবাই খুশি। আমিনা ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায়। জাঈদ তার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কারণ আমিনা আজ তাকে তার জীবনের সবথেকে বড় খুশির খবরটা দিয়েছে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬৫