অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৬

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৬
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা ও মাশরাফির বিয়ে সম্পন্ন হবার পর আরহা এসে উপস্থিত হয়েছে তাদের নতুন কক্ষে। ফুল দিয়ে ভীষণ সুন্দর ভাবে সাজানো এই কক্ষেই আজ রাতে তাদের বাসর হবে। আরহা লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। একটু আগেই রিয়াশা এসে এখানে তাকে বসিয়ে দিয়ে গেছে। রিয়াশা আরহাকে বলে গেছে এভাবেই থাকতে। তাই সে এভাবেই আছে। এদিকে রিয়াশা তার আরো কিছু বান্ধবীদের নিয়ে বাসর ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবাইকে পরামর্শ দিয়ে বলছে,”এই শোন, ভাইয়া যতই বলুক, ১০ হাজারের কম হলে কিছুতেই বাসর ঘরে ঢোকা হবে না। আমরা কত কষ্ট করে বাসর ঘর সাজিয়েছি, বল? তার তো একটা দাম আছে নাকি?”

“হুম, ঠিক।”
একটু পর মাশরাফি এলো। রিয়াশা তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল,”ভাইয়া, এত ইজিলি বাসর ঘরে যাওয়া হবে না। আগে ১০ হাজার টাকা দাও তারপর।”
মাশরাফি ভ্রু কুচকে বলে,”এত টাকা নিয়ে কি করবি?”
“এত কোথায়? আমরা প্রায় ১০-১২ জন বান্ধবী আছি। সবাই মিলে এনজয় করতে এটুকু তো লাগবেই।”
“আমি দিতে পারব না এত টাকা।”
“তাহলে বেশ, আজ আর তোকে বাসরও করতে হবে না।”
মাশরাফি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে জানে, তার বোন যা নাছোড়বান্দা এখন এই টাকা না দিলে তার বাসর সত্যিই ক্যান্সেল হবে যাবে৷ অগত্যা পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে রিয়াশার হাতে দিয়ে বলে,”এই নে আর খুশি হয়ে যা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রিয়াশা মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরে,”থ্যাংকিউ ভাইয়া। ইউ আর দা বেস্ট।”
এরপর সে তার বান্ধবীদের নিয়ে চলে যায়। মাশরাফি বাসর ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়৷ আরহা নড়েচড়ে বসে। মাশরাফি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আরহার পাশে বসে। আরহা লজ্জায় লজ্জাবতী লতার মতো মিইয়ে যায়। মাশরাফি আরহার ঘোমটা তুলে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,”মাশাল্লাহ, আমার বউকে তো অনেক সুন্দর লাগছে!”

আরহার দুই গাল লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মাশরাফির বলা “আমার বউ” শব্দটা তার কানে বাজতে থাকে বারংবার। মাশরাফি আচমকা আরহাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,”এত লজ্জা পেতে হবে না। স্বাভাবিক হও।”
আরহা স্বাভাবিক হবে কি, সে মাশরাফির বুকে মুখ লুকায়। মাশরাফি আরহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমার জীবনে অনেক কষ্ট আছে আমি জানি। এই বিয়েতেও কিছু কারণে তোমার বাবা অনুপস্থিত থাকায় তুমি সম্পূর্ণ খুশি নও। আমি তোমার এই আক্ষেপ তো দূর করতে পারব না তবে কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে যাতে কখনো তোমায় আক্ষেপ করতে না হয় সেই ব্যবস্থা আমি করবো।”

আরহা যেন ভরসা পায় মাশরাফির কথায়। মাশরাফি ধীরে ধীরে আরহার ঠোঁটের কাছে নিজের ঠোঁট নিয়ে আসে। দুজনের নিঃশ্বাসের গতি বাড়ে। মাশরাফির ঠোঁট যখন আরহার ঠোঁট ছুঁলো, আরহার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এটা তার জীবনে প্রথম এমন অভিজ্ঞতা, যেখানে শারীরিক নৈকট্য এমন মাদকতা নিয়ে এসেছে।আরহার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে মাশরাফির শার্ট খামচে ধরে। মাশরাফি আলতো করে আরহার ঠোঁটে গভীর চুমু আঁকে। এই চুমুতে কোনো জোর ছিল না, ছিল শুধু আদর আর গভীর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। আরহা প্রথমদিকে জড়সড় থাকলেও, ধীরে ধীরে তার দ্বিধা কেটে যেতে শুরু করে। মাশরাফির প্রতিটি স্পর্শে সে এক অদ্ভুত উষ্ণতা অনুভব করে।

চুম্বনের গভীরতা বাড়তে থাকে, আর তাদের নিঃশ্বাসের গতিও তাল মিলিয়ে বাড়ে। মাশরাফি ধীরে ধীরে আরহাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়, তবে তার চোখে-মুখে ছিল পরম মমতা। সে আরহার কপালে, গালে, চোখের পাতায় হালকা চুমু এঁকে দেয়। আরহা লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মাশরাফির স্পর্শগুলো তাকে সাহস যোগাচ্ছিল। সে অনুভব করছিল, এই মানুষটি তাকে জোর করছে না, বরং প্রতিটি পদক্ষেপে তার সম্মতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। মাশরাফি মাঝে থেমে জিজ্ঞেস করে,”আরহা, তুমি প্রস্তুত?”
আরহা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলে,”হুম।”

এই একটা শব্দেই যেন মাশরাফির সব দ্বিধা দূর হয়ে যায়। সে আরহার দিকে আরও ঝুঁকে আসে। তাদের দেহ একে অপরের সাথে মিশে যায়, যেন দুটি নদী দীর্ঘ যাত্রার পর অবশেষে সাগরে বিলীন হলো। ঘরের মৃদু আলোয় তাদের ভালোবাসার দৃশ্য আরও রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে। একে অপরের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে তারা, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি চুমু যেন একে অপরের প্রতি তাদের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করছিল।
আরহা মাশরাফির প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে অনুভব করে এক পরম শান্তি। এতদিন যে অস্থিরতা আর একাকীত্ব ছিল তার জীবনে, এই মুহূর্তে যেন সব দূর হয়ে গেছে।

মাশরাফির বাহুডোরে সে নিজেকে নিরাপদ অনুভব করে। মাশরাফি আরহার চুলে বিলি কেটে দেয়, তার কপালে আলতো চুমু এঁকে বলে,”এখন থেকে তোমার কোনো আক্ষেপ থাকবে না। আমি আছি তোমার পাশে।”
আরহার চোখ ভিজে আসে। এই মানুষটা সত্যিই তার সব কষ্ট দূর করতে চাইছে। তার বাবাকে পাশে না পাওয়ার কষ্টটা হয়তো মাশরাফি দূর করতে পারবে না, কিন্তু তার ভালোবাসায় আরহার মন ভরে ওঠে। মাশরাফি আরহার অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে দেয়। মাশরাফি জিজ্ঞেস করে,”কাঁদছো কেন?”

আরহা ফিসফিস করে বলে,”খুশিতে। আমার মনে হচ্ছে আমি সব পেয়ে গেছি।”
মাশরাফি আরহাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই রাতের প্রতিটি মুহূর্ত তাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে রইল। এই বাসর রাত তাদের মধ্যে ভালোবাসার বীজ বুনে দিল। দুটি ভিন্ন মানুষ, দুটি ভিন্ন জীবনধারা, আজ একাকার হয়ে গেল একই ভালোবাসার সুতোয়। তাদের নতুন জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরু হলো এই রাতে, যেখানে শুধু প্রেমই নয়, ছিল পরস্পরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর দায়িত্ববোধের প্রতিজ্ঞা।

আমিনা মন খারাপ করে বসেছিল। তার প্রেগ্ন্যাসির ৮ মাস চলছে এখন। এই সময়ে তার মনের আনছান ভাব বেড়েছে। আজকাল জাঈদও তার সাথে ঠিকভাবে কথা বলে না। সবসময় তাকে এড়িয়ে চলে। আমিনাও ইগো বজায় রাখার জন্য জাঈদকে নিজে থেকে কিছু বলে না। তবে আমিনার কাছে এখন মনে হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে তাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। যার খারাপ প্রভাব পড়বে তাদের সন্তানের উপর। তাদের সন্তান নিজের মা-বাবার এমন দূরত্ব দেখলে একটা সুস্থ শৈশব থেকে বঞ্চিত হবে। তাই আমিনা সিদ্ধান্ত নিলো, আজ জাঈদ ফিরলে সে জাঈদের সাথে কথা বলে তাদের সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করে নেবে। আমিনা নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না বাবু, তোমার বাবা-মাকে তুমি একসাথে খুশি দেখবে।”

কিছু সময় পরেই জাঈদ রুমে প্রবেশ করে। এক্ষুনি সে মাশরাফিদের বাড়ি থেকে ফিরল। আমিনা জাঈদকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,”তুমি এসেছ, একটু বসো আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”
জাঈদ কাঠ কাঠ গলায় বলে,”তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি খেয়ে এসেছি।”
“আচ্ছা, তাহলে কাল সকালে কি খাবে বল অনেকদিন থেকে তো আমি তোমার জন্য কিছু বানাই না, কাল নাহয়…”
“বাড়িতে রান্না করার জন্য মেইড আছে, তোমাকে এই অবস্থায় রান্নাঘরে যেতে হবে না। আমার সন্তানের কোন ক্ষতি হোক সেটা আমি মেনে নেব না।”

“ক্ষতি কেন হতে যাবে, আমি সাবধানে..”
“সাবধানে? তুমি কিছু সাবধানে করতে জানো আদৌ? তুমি তো শুধু ধ্বংস করতে জানো। যেমন আমার সাথে আমাদের সংসারটা ধ্বংস করেছ।”
“আমি?”
“তোমার এসব আদিখ্যেতা আর ভালো লাগছে না।”
বলেই জাঈদ ওয়াশরুমে চলে যায়। আমিনা ক্রন্দনরত নয়নে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৫

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমিনা দেখে জাঈদ তার পাশে না শুয়ে রুমে রাখা সোফায় শুয়েছে। এটা দেখে সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে জাঈদের আচরণগুলো ভাবতে গিয়েই অন্যমনস্ক হয়ে তার হাত থেকে সাবান পড়ে যায় আর সেই সাবানে পা ফসকে আমিনা পড়ে যায়। সাথে সাথেই গগণবিদারী চিৎকার করে ওঠে। জাঈদ ছুটে এসে দেখে আমিনা ফ্লোরে পড়ে কাতড়াচ্ছে। সে দ্রুত আমিনাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”আবারো সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চাইছ! আমার সন্তানের কিছু হলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৭