অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৭
ইয়াসমিন খন্দকার
আরহা ও মাশরাফির বৌভাত আজকে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছে তাদের বাড়িতে। আরুশিও সেই কাজে ব্যস্ত। এমন সময় আরুশির কাছে জাঈদের কল আসে। আরুশি ফোনটা রিসিভ করতেই জাঈদ অস্থির কন্ঠে বলে,”মাম্মা,,,,”
আরুশি বুঝতে পারে জাঈদ কোন কারণে উদ্বিগ্ন। তাই সে বলে,”কি হয়েছে জাঈদ? তোমার গলার স্বর এমন লাগছে কেন? কিছু কি হয়েছে?”
জাঈদ করুণ স্বরে বলে,”মাম্মা, আমিনা..ও ওয়াশরুমে স্লিপ করে পড়ে গেছে..আমাদের বাচ্চা..জানিনা ওর কি হবে। আমি খুব চিন্তায় আছি মাম্মা। আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে চাচি আর আকাশও যাচ্ছে আমার সাথে। আমি বুঝতে পারছি না কি হবে।”
আরুশিও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন আমিনা ও নিজের নাতি/নাতনীর কথা ভেবে। তবুও তিনি নিজের ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,”চিন্তা করো না জাঈদ, আল্লাহকে ডাকো। তিনি সব ঠিক করে দেবেন।”
“আমি খুব একা বোধ করছি মাম্মা।”
“আমি আসছি,চিন্তা করো না।”
কলটা রেখেই আরুশি বেরিয়ে পড়েন। কাউকে কিছু বলেন না তিনি যাতে উৎসবের আমেজ নষ্ট না হয়। কারণ এমনিতেই এত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মাশরাফি ও আরহার বিয়েটা হলো তাই তিনি চান না তাদের খুশির মুহুর্ত ভেস্তে যাক। এজন্য একাই বেরিয়ে পড়েন তিনি। আরহাকে বললে সে নিজের বৌভাত ফেলেই চলে যেতে চাইত। ওখানে গেলে আবার অপমানিত হতে হতো। তাই তিনি আরহাকেও ব্যাপারটা জানান না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাঈদ অটির সামনে সমানে পায়চারি করছে। সায়রা বসে বসে আল্লাহকে ডাকছেন। আকাশ সায়রার পাশেই বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এমন সময় আরহাম খান চলে আসলেন। তিনি এসেই বললেন,”আমিনা..ও কেমন আছে এখন?”
জাঈদ বলে,”জানি না আব্বু..ডাক্তার কোন কিছু বলতে পারছে না।”
“কিন্তু এসব কিভাবে হলো?”
“সব দোষ আমিনার। ও ওয়াশরুমে গিয়ে পড়ে গেছে। একটুও সাবধানী না ও। যদি আল্লাহর দোয়ায় আমার সন্তান সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসে তাহলে আমি আমার সন্তানকে এক সেকেন্ডের জন্য কাছছাড়া করব না। আমিনার কাছে একা তো রাখবোই না। ওর উপর আমার আর কোন বিশ্বাস নেই।”
এমন সময় আরুশিও সেখানে চলে আসলেন। আরহাম খান করুণ চোখে আরুশিকে দেখলেন। আরুশি তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। সরাসরি জাঈদের পাশে গিয়ে বলল,”জাঈদ চিন্তা করো না। আমি এসে গেছি।”
জাঈদ নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তুমি আসায় ভরসা পেলাম মাম্মা।”
আরহাম খান একটু দূরে সরে গেলেন।
অটির ভেতরে সিজারের প্রস্তুতি চলছে। এদিকে আমিনা হঠাৎ করে ডাক্তারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ডাক্তার..যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে আমার এবং আমার সন্তানের মধ্যে যেকোন একজনকে বাঁচানো যাবে তাহলে আপনারা দয়া করে আমার সন্তানকে বাঁচাবেন। আমার সন্তানের কিছু হলে..আমার স্বামী খুব কষ্ট পাবে। উনি এই সন্তান নিয়ে ভীষণ আগ্রহী। এই সন্তানের কিছু হলে উনি আমাকেও ক্ষমা করবেন না। তাই দয়া করে আপনারা আমার সন্তানকে বাঁচাবেন। আমি চাই, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন আমার সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না,আমরা আপনাকে এবং আপনার সন্তানকে দুজনকেই বাঁচাবো, একটু ভরসা রাখুন শুধু।”
অতঃপর আমিনার উপর চেতনানাশক প্রয়োগ করে সিজারের কার্যক্রম শুরু হয়। বাইরে সকলের অস্থির পায়চারি চলছিল।
এক সময় অটি থেকে বেরিয়ে আসেন ডাক্তার। তার মুখে হাসি। জাঈদ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে ডক্টর? আমার সন্তান ঠিক আছে তো?”
আকাশ জিজ্ঞেস করে,”আমার আপু কেমন আছে?”
ডাক্তার বলেন,”কংগ্রাচুলেশনস, আপনাদের ছেলে সন্তান হয়েছে। মা এবং সন্তান দুজনেই ভালো আছে। যদিও বাচ্চাটা নিদিষ্ট সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাই ওজন একটু কম বাকি আর কোন সমস্যা নেই তেমন। কিছুদিন একটু কেয়ার করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
জাঈদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
“আমার ছেলে।”
আরুশির সামনে এসে বলে,”মাম্মা..আমার ছেলে হয়েছে। আমি বাবা হয়েছি।”
আরুশি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। সায়রাও আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তার মেয়ে ও নাতিকে সুস্থ রাখায়৷ আকাশও মামা হবার আনন্দে এগিয়ে আসে। আরহাম এগিয়ে এসে বলেন,”আমি এখনই গোটা পাড়ায় মিষ্টি বিলি করছি। আমার নাতি হয়েছে এর থেকে খুশির খবর আর হয় না।”
জাঈদ ডাক্তারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমার সন্তানকে আমি কবে কাছে পাব?”
“একটু অপেক্ষা করুন।”
জাঈদ বলে,”নাহ, আর পারছি না। আমার সন্তানকে আমি ছাড়া আর কেউ আগলে রাখতে পারবে না। ওকে জলদি আমার কাছে এনে দিন।”
আরহা আজ বৌভাতে নিজের হাতে সবাইকে রান্না করে খাইয়েছে। মাশরাফি সব মুহুর্তে তার পাশে থেকেছে। কিন্তু নিজের মাকে না দেখে সে একটু চিন্তা করছিল। এমন সময় আরুশি ফোন করে আরহাকে খুশির খবরটা দিল৷ ফুফু হবার আনন্দে আরুশি খুশি হলেও তার খুশি মিলিয়ে গেল যখন সে ভাবলো সে নিজের ভাইপোকে দেখতে পারবে না। কারণ আমিনা নিশ্চয়ই তাকে নিজের সন্তানের পাশে দেখতে চাইবে না। আরহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মাশরাফি আরহার মনের কথা বুঝতে পেরে তার কাধে হাত রেখে বলল,”আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, তোমার ভাইপোকে তুমি দেখতে পারবে, তাকে কোলে নিতে পারবে আর তার সাথে আনন্দও করতে পারবে।”
মাশরাফির কথা শুনে আরহা কিছুটা ভরসা পায়।
আমিনাকে সাধারণ কেবিনে সিফট করা হয়েছে। তার জ্ঞান ফিরলেও সে এখনো শয্যাশায়ী। বাচ্চাকে জাঈদ নিজের কাছে রেখেছে। একে একে আকাশ, সায়রা, আরহাম সবাই তার সাথে দেখা করতে এলেও জাঈদ আমিনার সাথে এখনো দেখা করতে আসেনি৷ এই ব্যাপারটা আমিনাকে পীড়া দিচ্ছে।
জাঈদ নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছিল। আরুশি তার পাশে বসে বলে,”শুধু নিজের ছেলেকেই আদর করলে হবে? যাও গিয়ে আমিনারও খোঁজ নিয়ে এসো।”
জাঈদ কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে,”ডাক্তার তো বলল আমিনা ঠিক আছে। আমি নাহয় পরে গিয়ে দেখা করব। আপাতত আমার ছেলের সাথে সময় কাটানোটা বেশি জরুরি।”
আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেই যান আমিনার সাথে দেখা করতে। আমিনা দুচোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। আরুশি তার শিয়রের পাশে এসে বসে,”আমিনা।”
আমিনা চোখ খুলে বলে,”বড় আম্মু। তুমি এসেছ? কেমন আছ তুমি?”
“আমি ভালো আছি, তুমি?”
“আমিও ভালো। আচ্ছা, আমার বাবু কোথায়?”
“তোমাদের বাবু জাঈদের কাছে। ও নিজের ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
“বাবুকে খুব আদর করছে ও তাই না?”
“হুম।”
“বড় আম্মু, আপনি আবার বাড়িতে ফিরে আসুন না। আপনার প্রতি তো আমাদের কারো কোন রাগ নেই। আপনি নেই জন্য জাঈদ সবসময় মন খারাপ করে থাকে। আমাদের সংসারটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। আর আরহারও তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে তো আর আপনাকে সামলাতে হবে না। আপনি তো বুঝবেন, ওর প্রতি আমাদের রাগ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি কেন শুধু শুধু এভাবে দূরে থাকছেন?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৬
আরুশি বলেন,”তুমি নিজেও এখন মা হয়েছ আমিনা। তোমার সন্তান আরেকটু বড় হোক তারপর তুমি আমার অবস্থা বুঝতে পারবে। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের থেকে মূল্যবান আর কিছুই হয় না। সে তার সন্তান যতোই ভুল করুক না কেন। আরহাকে যেভাবে ঐ বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে তারপর যতদিন না ওকে আবার সসম্মানে বাড়িতে অভ্যত্থনা জানানো হবে ততদিন আমার পক্ষে ওখানে ফেরা সম্ভব না।”
বলেই আরুশি বেরিয়ে আসেন। আমিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”কিন্তু আমি যে এত সহজে আরহাকে ক্ষমা করতে পারবো না। ওর জন্য আমি নিজের বাবাকে হারিয়েছি। এই ক্ষত কি এত সহজে শুকাবে?”