অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮০
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা তার ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। যদিও তার নিজেরই ভয় লাগছিল তবুও সে নিজের ছেলের কাধে হাত রেখে বলে,”ভয় পেও না বাবু। মাম্মা আছে তো, মাম্মা তোমার কিছু হতে দেবে না। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাকে রক্ষা করবে।”
বলেই আমিনা দ্রুত গতিতে বাইরে আসে৷ বাইরে এসেই দেখতে পায় এক ভয়াবহ দৃশ্য। চারিদিকে আগুনে ছেয়ে গেছে। আমিনা তার ছেলেকে বুকের আরো কাছে নিয়ে আসে৷ চারিদিকে ধোয়ায় ছেয়ে গেছে। আমিনার এমনিতেই কিছুটা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। তাই এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে তার ভীষণ অসুবিধা হচ্ছিল৷ তার উপর সে বাইরে বেরিয়ে সায়রা খানের কোন খোঁজ পায় না। কয়েকবার সে আম্মু বলে ডেকে ওঠে তবুও কোন সাড়া পায় না। এরমধ্যে সে লক্ষ্য করল অনেক মানুষ এদিকেই দৌড়ে আসছে তাই সে নিজের ছেলেকে শক্ত করে আকড়ে ধরে একপাশে সরে যায়। চারিদিকে ধোঁয়া দেখে আমিনা বুঝতে পারছিল না এখন কোনদিকে যাবে। কিছু মানুষকে অনুসরণ করে সে সিঁড়ির দিকে গিয়ে দেখতে পায় সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কিন্তু নিচে নামার জন্য এছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমিনা তাই চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে বলে,”হায় আল্লাহ, তুমি দেখো, আমার যাই হয়ে যাক আমার সন্তান যেন বহাল তবিয়তে থাকে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই সে সামনের দিকে এগোয়। আগুনের তেজ অনুভব করতে পারে সে৷ চোখ বন্ধ করে বলে,”আল্লাহ, এটুকু সহ্য করার ক্ষমতা দাও।”
আমিনা ঐ আগুনের মধ্যে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। তার হাতের কিছু অংশ আগুনে পুড়ে যায়। তবুও সে নিজের ছেলেকে শক্ত করে আকড়ে রাখে। তার শরীরে আগুনের আঁচও লাগতে দেয় না। এদিকে পরিবেশ একদম স্বাভাবিক ছিল। আমিনার হাত পুড়ে গেলেও সে নিজের সন্তানকে সুস্থ রাখতে পেরেছে দেখে মৃদু হাসে। নিজের ছেলের কপালে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলে,”আমরা ভালো আছি বাবু। মাম্মা তোমার কিছু হতে দেয় নি।”
আমিনার হাত তখন ভীষণ যন্ত্রণা করছিল। তবুও এসব কিছু তার কাছে ভীষণ ফিকে মনে হচ্ছিল। তবে সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছেও সে নিজের মাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এরমধ্যে হঠাৎ আমিনার ফোন বেজে ওঠে। আমিনা ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে সায়রা খান বলেন,”আমিনা…মা কোথায় তুই? তুই সুরক্ষিত আছিস তো?”
কথা বলার সময় তিনি ভীষণ কাশছিলেন। আমিনা বলে ওঠে,”আমি একদম ঠিক আছি, আম্মু। কিন্তু তুমি কোথায়?”
“আমি তোকে খুঁজতে ডাক্তারের কেবিনে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে তোকে পেলাম না। এখন এখানে চারিদিকে আগুন দাউদাউ করছে। আমি বের হবার কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না।”
অসহায় কন্ঠে বলেন সায়রা খান। আমিনা ঘাবড়ে যায়। বলে,”তুমি চিন্তা করো না আম্মু। আমি আসছি তোমাকে বাঁচাতে।”
সায়রা বলেন,”নাহ, তোকে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে হবে না। তুই তোর ছেলেকে সামলা। আমি কোন না কোন উপায় বের করে নেব।”
“না, আম্মু। আমি আব্বুকে হারিয়েছি, তোমাকে হারানোর কোন ঝুঁকি নিতে পারব না। তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি এক্ষুনি আসছি।”
বলেই আমিনা যেতে উদ্যত হয় এমন সময় তার খেয়াল হয় নিজের ছেলের দিকে। এই ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আবারো উপরে যাবার ঝুঁকি নিতে পারবে না সে। কি হবে তার মাকেও যে তাকে বাঁচাতে হবে। আমিনা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এমন সময় সে দেখতে পায় একজন নার্স তার দিকে ছুটে আসছে। তিনি এসেই বলেন,”ম্যাম, এদিকে আসুন। আপনার হাত তো পুড়ে গেছে। আসুন আমি ব্যান্ডেজ করে দেই আপনার হাতে।”
আমিনার নার্সটিকে দেখে মনে হয় ইনি ভালো মানুষ। তাই সে নার্সকে ভরসা করে বলে,”আমার হাতে আপাতত ব্যান্ডেজ করতে হবে না। আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন প্লিজ?”
“কি উপকার ম্যাম?”
“আসলে আমার মা দ্বিতীয় তলায় আগুনে আটকে গেছে। আমার তাকে বাঁচাতে যেতে হবে। কিন্তু আমার বাবুকে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় যাবার ঝুঁকি আমি নিতে পারব না। তাই আপনি যদি ওকে সামলান তাহলে অনেক ভালো হয়। তাহলে আমি ওখানে গিয়ে মাকে বাঁচাতে পারব।”
“কিন্তু ম্যাম উপরে তো অনেক আগুন।”
“কিছু হবে না। আমি কলেজে থাকতে ট্রেনিং নিয়েছিলাম এরকম পরিস্থিতিতে কিভাবে উদ্ধার অভিযান চালাতে হয়৷ আপনি শুধু আমার বাবুকে সামলান। আর ওকে নিয়ে বাইরে চলে যান। মেইন গেটে তো আগুন লাগে নি।”
অগত্যা নার্সটি রাজি হয়। আমিনা নিজের ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে,”তুমি এখন একটু এই আন্টির কাছে থাকো বাব্বু। মাম্মা নানিকে নিয়ে আসছি।”
বলেই সে নিজের ছেলেকে নার্সের কোলে দিয়ে দ্বিতীয় তলায় যেতে উদ্যত হয়। নার্সটিও তার ছেলেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় তলায় যেতে গিয়ে ধোঁয়ায় আমিনার দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। এবার তার পায়ের কিছু অংশেও আগুন লাগে৷ তবুও সে কোন কিছুর পরোয়া না করে দ্বিতীয় তলায় যায়। সেখানে গিয়ে ডাক্তার কেবিনে যায়। সেখানে এককোণায় আগুনের লেলিহান শিখায় আটকে ছিলেন সায়রা খান। আমিনা তাকে দেখেই বলে ওঠে,”আম্মু..তুমি ঠিক আছ?”
কিন্তু সায়রা খান কোন সাড়া দেন না। কারণ ততক্ষণে তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমিনা সাবধানের সহিত এগিয়ে গিয়ে অনেক কষ্টে সায়রা খানকে উদ্ধার করে। অতঃপর নিজের কাধে করে তাকে নিয়ে আসতে থাকে।
হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের নিউজ শুনেই পুরো খান পরিবার হাসপাতালের বাইরে এসে উপস্থিত হয়েছে। আরহাম, আকাশ, জাঈদ সবাই এসেছে এখানে। একইসাথে আরুশিও এসেছেন খবর পেয়েই। আরহা ও মাশরাফি রিয়াশাকে নিয়ে IELTS পরীক্ষা দিতে গেছে। তারা এখনো খবর পায় নি তাই আসা হয়নি।
জাঈদ ভীষণ পাগলামো করছিল। বারবার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল কিন্তু বাইরে ততক্ষণে সেনাবাহিনি ও ফায়ার সার্ভিসের লোকরা এসে গেছে। তারা তাকে সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছিল।
কিছু সময় পর ফায়ার সার্ভিসের লোকরা আমিনা ও সায়রা খানকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তাদেরকে দেখেই খান পরিবারের সবাই যেন জান ফিরে পায়। আরুশি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। এমন সময় জাঈদ খেয়াল করে তারা সুস্থ হয়ে ফিরলেও তার ছেলে এখানে নেই। সায়রা খান অজ্ঞান থাকায় তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আমিনারও শরীরের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। জাঈদ এগিয়ে এসে আমিনাকে বলে,”আমার ছেলে কোথায়?”
আমিনা বলে,”বাবু..ওকে তো আমি একজন নার্সের কোলে..”
আমিনার পুরো কথা শেষ না হতেই জাঈদ বলে,”একজন নার্সের কোলে মানে? আমাদের ছেলেকে কোথায় রেখেছ তুমি এই অগ্নিকাণ্ডের মাঝে? এতটা কেয়ারলেস কিভাবে হলে তুমি?”
আরুশি এগিয়ে এসে বলেন,”শান্ত হও জাঈদ৷ ওর অবস্থাটা দেখো..পুড়ে গেছে বেচারি। ওকে একটু স্বাভাবিক হতে দাওম”
আমিনা সমস্ত ঘটনা বলে। সব শুনে জাঈদ বলে,”তুমি কিভাবে আমাদের ছেলেকে এভাবে একজনের কাছে দিয়ে দিলে? এখন যদি ওর কোন ক্ষতি হয়ে যায় তার দায় কে নেবে?”
আমিনা বলে,”আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না। আর ঐ নার্সকে দেখে ভালোই মনে হলো। একটু খোঁজ নিলেই..”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৯
আমিনার পুরো কথা শেষ হবার আগেই জাঈদ আমিনার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আমিনা হতবাক। আরুশি বলেন,”এটা কি করছ তুমি? মেয়েটার একেই এই অবস্থা তার উপর..”
জাঈদ বলে,”তুমি চুপ করো মাম্মা। এই মেয়েটা আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে৷ তোমাকে আর আরহাকে ওর জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয়েছে। আজ ওর জন্য আমার ছেলেকেও আমি হারিয়ে ফেললাম৷ এর জন্য আমি ওকে কখনো ক্ষমা করব না। আজ যদি আমি নিজের ছেলেকে খুঁজে না পাই তাহলে ওর সাথে আমার সম্পর্ক সারাজীবনের জন্য শেষ।”