অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আমিনা হাসিমুখে তার ছেলের ছবির সামনে থাকা কেকের সামনে জ্বালানো মোমবাতিটা নেভালো। নিজের দুঃখ লুকিয়ে কষ্টমিশ্রিত স্বরে বলল,”শুভ জন্মদিন আমার বাবু..আজ তোমার ৬ বছর পূর্ণ হলো। তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থাকো। মা খুব শীঘ্রই তোমাকে খুঁজে বের করবে।”
বলেই সে নিজের সাথে আনা একটা গিফট ছবিটার সামনে রাখে। বলে,”এর ভিতর খুব সুন্দর একটা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার আছে। তোমার এটা খুব পছন্দ হবে। যখন তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে তখন এটা দিয়েই খেলবে, কেমন?”

বলেই আমিনা নিজেই কেকটা কাটে। দূর থেকে এসব পর্যবেক্ষণ করছিলেন সায়রা খান। নিজের মেয়ের কষ্টটা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তো আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। আমিনা তাকে দেখে এগিয়ে এসে কেকটা তার সামনে ধরে বলে,”এই নাও আম্মু। তোমার নাতির জন্মদিনের কেক।”
সায়রা বলে ওঠেন,”আর কতদিন এভাবে পাগলামো করবি তুই আমিনা? ৬ বছর…এটা কি কম সময়? এখনো তো আশা রাখিস যে তোর হারানো সন্তান তোর কাছে ফিরে আসবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমিনা শান্ত দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকায়। সময়ের স্রোত এগিয়ে এসেছে ৬ বছর। এই ৬ বছর যেন আমিনার কাছে ৬ টা যুগের সমান। এই ৬ বছরেও আমিনা তার ছেলেকে খুঁজে পায়নি, জাঈদও এই ৬ বছরে একবারো দেশে ফেরেনি আর নাতো তাদের কারো সাথে যোগাযোগ করেছে। তবুও আমিনা এখনো আশা ছাড়েনি। সে এখনো স্বপ্ন দেখে, তার ছেলে আবারো তার কাছে ফিরবে। আর তখন জাঈদও সব অভিমান ভুলে চলে আসবে দেশে। আমিনা তাই তো সায়রা খানকে কেকটা খাইয়ে দিয়ে বলে,”ফিরবেই..একজন মায়ের ভালোবাসার কাছে ভাগ্যকে হার স্বীকার করতেই হবে।”

সায়রা খান আর সইতে না পেরে নিজের রুমে চলে এলেন। বর্তমানে সায়রা, আমিনা ও আরুশি সবাই একটি ছোট্ট ফ্লাটে থাকেন। এখানেই তাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। সায়রা খান যেতেই আমিনা ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত ১২ টা বাজে। সে এবার নিজের মুখের মেকি হাসি সরিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। এই ৬ বছরে এই মেকি হাসিই তার পরিচয়। মন খুলে হাসতে ভুলে গেছে সে। অপরাধবোধ, ছেলে ও স্বামীকে হারানোর বেদনা তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিয়েছে। আমিনা নিজের দীর্ঘ শ্বাস আড়াল করে চোখের কোনে জমা হওয়া জল মুছে বলে,”আর কত কাঁদব তুই আমিনা? এই ৬ বছরেও কি তোর চোখের জল শুকায় নি?”

এরপর সে বিছানার পাশে থাকা ডেস্ক থেকে একটা ঘুমের ওষুধ নিয়ে নেয়। এই ৬ বছরে অগণিত রাত সে না জেগে কাটিয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন যে ঘুমের ওষুধ ছাড়া সে দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। এর পাশাপাশি আমিনার একটা নতুন পরিচয়ও হয়েছে। আরুশি তার মানসিক অবস্থা দেখে যাতে সে স্বস্তি পায় তাই একটি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে তাকে যোগদান করিয়েছে। এতে যদি বাচ্চাদের সান্নিধ্য পেয়ে তার মন ভালো হয়। কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে?

আরুশি রুমের দরজা থেকে আমিনাকে দেখেন। মেয়েটা এই ৬ বছরে ভেতর থেকে একদম নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমিনাকে ঘুমের ওষুধ খেতে দেখে তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন,”মেয়েটার এত কষ্ট..ওর এই কষ্ট যদি এক বিন্দুও লাঘব করতে পারতাম। তুমি ওর প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হলে কেন আল্লাহ? ওর ছেলেকে ফিরিয়ে দাও না। আমিনার এই অবস্থার জন্য আমার ছেলেটাও দায়ী। ও যদি এখানে থাকত তাহলে সামলাতে পারত আমিনাকে। তাহলে হয়তো আমিনাকে এতটা খারাপ পরিস্থিতিতে পর‍তে হতো না।”

আমিনা ঘুমের ওষুধ খেয়েও সহজে ঘুমাতে পারছিল। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল। হঠাৎ করেই ডুকরে উঠে বলে,”আমার জন্যই আজ আমার বাবু হারিয়ে গেছে..আমি একটা খারাপ মা। আমার জন্য সব হয়েছে। জাঈদও আমার জন্য দূরে সরে গেছে। আমি দায়ী..সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। আমাকে আরো শাস্তি দাও আল্লাহ..আমাকে আরো শাস্তি দাও। না জানি জাঈদ এখন কোথায় আছে..ও নিশ্চয়ই দুঃখে কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওকে সামলানোর জন্যও কেউ নেই। সব আমার জন্য হয়েছে সব।”

ম্যাপল গাছে ভড়া একটি পার্কের ব্রেঞ্চে বসে আছে ছয় বছরের একটি শিশু। তার চোখে একটা চশমা। টরেন্টোর অন্যতম জনপ্রিয় শিশু পার্ক এটি৷ ছেলেটির দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। তার সামনেই কিছু বাচ্চাকে তার মা কোলে নিয়ে খেলা করছে৷ এই দৃশ্য দেখে তার চোখ কেমন ছলছল করে ওঠে। আচমকা একজন নারী চলে আসে। সে এসেই বলে,”কি হয়েছে আমার রাজ বাবুর? আমার রাজ বাবুর কি মন খারাপ?”
আবরাজ চোখ তুলে তাকায়। বলে ওঠে,”কিছু হয়নি রিয়ু। এমনি কিছু ভালো লাগছে না।”
রিয়াশা এসে আবরাজের পাশে বসে। আলতো হেসে বলে,”আমার সাথে বাসায় চলো৷ তোমার জন্য অনেক সুন্দর একটা সারপ্রাইজ আছে।”

“কি সারপ্রাইজ?”
কিছুটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায় তার গলার স্বরে। রিয়াশা বলে ওঠে,”গেলেই দেখতে পাবে।”
আবরাজ রিয়াশার সাথে ছুটে যায়। তার এতক্ষণের দুঃখী দুঃখী ভাব যেন লোপ পায়। তারা কিছুটা দূরে গিয়ে একটি ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে।
সেই ফ্ল্যাটে গিয়েই আবরাজ দেখতে পায় পুরো ফ্ল্যাট সাজানো অনেক সুন্দরভাবে। হঠাৎ করে জাঈদ তার সামনে এসে বলে,”হ্যাপি বার্থ ডে মাই সান। ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটান অফ দা ডে।”
আবরাজ ভীষণ খুশি হয় নিজের বাবার কথা শুনে। বলে ওঠে,”থ্যাংক ইউ পাপ্পা।”

এরপর তারা সবাই মিলে এক সাথে কেক কাটে। আবরাজ একবার কৃতজ্ঞতার সাথে রিয়াশার দিকে তাকায়। রিয়াশা আজ থেকে ৫ বছর আগে স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় পড়াশোনা করতে আসে। এখানে আসার কিছুদিন পর কাকতালীয় ভাবে তাদের দেখা হয়। সেই মুহুর্তে আবরাজকে তীব্র তিরস্কার করেছিল রিয়াশা। তাকে ফিরতে বলেছিল। কিন্তু আবরাজ রিয়াশাকে নিজের অসহায়ত্ব বুঝিয়েছে, আমিনার প্রতি তার ক্ষোভও তুলে ধরেছে। তখন রিয়াশা গলে গিয়েছিল। তাই সে আজ অব্দি সত্যটা লুকিয়ে রেখেছে সবার সাথে। জাঈদের এই লুকোচুরি খেয়াল তার সঙ্গ দিয়েছে। এমনকি আবরাজের জন্যেও মা হয়ে উঠেছে সে। আবরাজের কপালে চুমু খায় রিয়াশা। জাঈদ আবরাজকে বলে,”বলো আবরাজ, তোমার নিজের জন্মদিনে কি গিফট চাই?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮২

আবরাজ রিয়াশার দিকে তাকায়। বলে,”আমাকে তুমি সব দিয়েছ পাপ্পা। আমার এখন শুধু একটাই জিনিস লাগবে। আমার মাম্মি লাগবে। আমাকে তুমি মাম্মি এনে দাও।”
বলেই আবরাজ তাকায় রিয়াশার দিকে। রিয়াশাও অবাক চোখে জাঈদের দিকে তাকায়। আবরাজ কি চায় তারা দুজনেই বোঝে। কিন্তু তারা যে নিরুপায়!

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৪