অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৫
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা স্কুলে পৌঁছে যায়। শহরের একটি নামকরা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষিকা সে৷ নিজের দায়িত্বে কর্তব্যে কোন কার্পন্য নেই তার৷ তবে স্কুলে সে অনেক প্রফেশনাল। বাচ্চাদের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হয় না সে। কারণ আমিনার মনে হয়, সে কোন বাচ্চার ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লে হয়তো সেই বাচ্চাটা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আমিনা। রোজকার দিনের মতো আজকেও ক্লাস নিতে যায়। সে ইংলিশ পড়ায়। ইংরেজি নিয়ে স্নাতকোত্তর হওয়ায় আমিনা অনেক ভালো পড়াতে পারে বাচ্চাদের। তার পড়ানো নিয়ে কারো কোন আপত্তি নেই। আমিনা তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাচ্চাদের ক্লাস নিচ্ছিল৷ তখন একটা বাচ্চা মায়াভরা চোখে আমিনার দিকে তাকিয়ে ছিল। এই ছেলেটা প্রায়ই আমিনাকে এভাবে দেখে। ছেলেটার নাম রোহন। ক্লাস শেষ হতেই আমিনা হোমওয়ার্ক দিয়ে বেরিয়ে যেতে নেয় এমন সময় রোহন এসে তার সামনে দাঁড়ায়। আমিনা কিছুটা অবাক হয়ে বলে,”কিছু বলবে তুমি?”
রোহন হালকা হেসে বলে,”আপনাকে দেখলে না, আমার নিজের মায়ের কথা অনেক মনে পড়ে যায় ম্যাম।”
আমিনা থমকে যায়। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,”কেন? তোমার মায়ের সাথে কি আমার মিল পাও?”
রোহন মাথা নাড়ায়। অতঃপর দুঃখ মিশ্রিত কন্ঠে বলেন,”জানেন, আমি নিজের মাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার মা ঐ দূর আকাশের স্টার হয়ে গেছে। আমি তাকে খুব মিস করি।”
রোহনের কথাটা শুনে মোচড় দিয়ে ওঠে আমিনার বুক। সেও তো নিজের ছেলেকে হারিয়েছে তাই এই বাচ্চাদের কষ্ট সে অনুভব করে। সে রোহনের মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখে। আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় পরবর্তী ক্লাসের টিচার চলে আসেন। তাই আমিনা কিছু না বলেই চলে আসে ক্লাস থেকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
স্কুল ছুটির পর আমিনা বের হবার জন্য রওনা দেয়। এমন সময় দেখতে পায় রোহন নামের ছেলেটা মন খারাপ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমিনা অবাক হয়৷ স্কুলে একটা জরুরি মিটিং থাকায় সে ২০ মিনিট অফিস রুমে ছিল। এতক্ষণে তো সব বাচ্চাদের বাসা চলে যাবার কথা তাহলে রোহন এখানে কি করছে? এই ভাবনা থেকে আমিনা রোহনের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কাধে হাত রাখে৷ রোহন পিছন ফিরে আমিনাকে দেখে মৃদু হেসে বলে,”ম্যাম, আপনি?!”
“তুমি এখানে কি করছ রোহন? তোমার বাড়ির লোক কেউ নিতে আসে নি?”
রোহন দুদিকে মাথা নাড়ায়। আমিনা বলে,”আচ্ছা, তোমার বাড়ির কারো নাম্বার বলো আমি ফোন করছি।”
রোহন বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ সেখানে এসে দাঁড়ায় একজন বলিষ্ঠদেহী পুরুষ। বয়স তার ৩২/৩৩ হবে। তবে এখনো তার চেহারায় সৌন্দর্য বজায় আছে। সে এসেই রোহনের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”রোহন বেটা, এদিকে চলে আসো।”
রোহন লোকটাকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে যায় আর বলে,”আমার চাচ্চু এসে গেছে।”
সাফোয়ান চৌধুরী রোহনকে কোলে তুলে নেয়। তার ভাই-ভাবির এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর সে একা হাতে রোহনের দায়িত্ব সামলাচ্ছে। এখনো অব্দি বিয়েও করেনি রোহনের কথা ভেবে। রোহনের মধ্যেই তার প্রাণ ভোমড়া লুকায়িত। সাফোয়ান চৌধুরী রোহনের গালে চুমু খেয়ে বলে,”সরি বেটা, আজ একটু লেইট হয়ে গেল। তোমার কি আমার অপেক্ষায় থাকতে খুব কষ্ট হয়েছে?”
রোহন বলে,”প্রথমদিকে কষ্ট হচ্ছিল, তারপর আমার এই ম্যাম এসে আমায় সান্ত্বনা দিল এখন আমার ভালো ফিল হচ্ছে।”
সাফোয়ান এবার চোখ তুলে আমিনার দিকে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হয়। আমিনার চোখে তাকাতেই সাফোয়ানের অন্যরকম অনুভূতি হয়৷ সে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তাই মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েই অনেক কিছু বুঝতে পারে। সাফোয়ান আমিনার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে সুশ্রী এই রমণীর জীবনে হয়তো অনেক কষ্ট লুকায়িত আছে। সাফোয়ান ভালো করে আমিনার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এই রমনীর বয়স ৩০ এর কাছাকাছি, পরনে শাড়ি,মাথায় হিজাব, গায়ে কোন প্রসাধনী নেই। মুখটাও কেমন জানি বয়সের তুলনায় মলিন৷ চোখের নিচে কালো কালি জমে। তার দিকে তাকিয়েই সাফোয়ানের মনে কেমন অদ্ভুত ব্যথা অনুভব হয়৷ সাফোয়ান তবুও মৃদু হেসে আমিনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”আপনাকে ধন্যবাদ আমার রোহনকে সামলানোর জন্য। আমার ছেলেটা বড্ড অসহায়। আর একটু দুষ্টুও। আপনাকে বিরক্ত করে নি তো?”
আমিনা বলে,”নাহ তো, ওহ তো চুপচাপ বাইরে অপেক্ষা করছিল। আর আপনিই বা কেমন? নিজে লেইট করে এসে এই টুকুন ছেলের দোষ দিচ্ছেন। কেমন অভিভাবক আপনারা? ওর মা নেই এখন আপনার তো ওকে বেশি করে সামলানো উচিৎ। যদি ওর কিছু হয়ে যেত তখন কে দায় নিত? বাচ্চা হারানোর যন্ত্রণা বোঝেন আপনি? বেঁচে থেকেও মৃত হয়ে যেতে হয়, প্রতি মুহুর্তে মনে হয় জাহান্নামে বসবাস করছি…”
বলেই আমিনা কেমন হাসফাস করতে থাকে। সাফোয়ান চৌধুরী রোহনের ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে আমিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”ঠিক আছেন আপনি? এত হাইপার হচ্ছেন কেন? এত রাগ শরীর ও মনের জন্য ভালো নয়।”
আমিনা পানির বোতল সরিয়ে দিয়ে বলে,”হাইপার হবো না? আপনারা এত কেয়ারলেস হন কেন? বাচ্চা থাকতে তার যত্ন নিতে শিখুন৷ হারিয়ে গেলে, হাজার কেঁদেও কুল পাবেন না।”
বলেই আমিনা সামনে এগোয়। সাফোয়ান অবাক হয়ে ভাবতে থাকে,”এনার আবার কি হলো? এভাবে রেগে গেলেন কেন?”
আমিনা একটু দূরে এসে নিজেই নিজের উপর বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,”এটা তুই কি করলি আমিনা? সবাইকে কি তুই নিজের মতো ভাবিস নাকি? তুই নিজের বাচ্চাকে হারিয়ে ফেলেছিস জন্য কি দুনিয়ার সবাই হারিয়ে ফেলবে? তোর মতো অপয়া নাকি সবাই? নাহ, আমার ওনাকে সরি বলা উচিৎ।”
বলেই আমিনা আবার আগের স্থানে আসে। কিন্তু ততক্ষণে সাফোয়ান রোহনকে নিয়ে চলে গেছে। আমিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ তৈরি হয়। আমিনা নিজেকে তীরস্কার করে বলে,”তুই খুব খারাপ আমিনা৷ তুই নিজের বাবুকে সামলাতে পারিস নি, এখন সেই রাগ অন্যের উপর ঝাড়ছিস।”
আমিনার চোখে জল চলে আসে।
জাঈদ অস্থির হয়ে ঘামছে। আবরাজ ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার দেখে বলেছে ভীষণ জ্বর তার শরীরে। রিয়াশা আবরাজকে জলপট্টি করে দিচ্ছে। জাঈদ আবরাজের মাথার কাছে বসে পড়ে৷ রিয়াশা বলে,”আপনি চিন্তা করবেন না, ও ঠিক হয়ে যাবে।”
জাঈদ বলে,”চিন্তা না করে কি করবো? এখন ও ছাড়া আমার আর কে আছে? ওকে ঘিরেই তো আমার জীবন। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কিভাবে সামলাবো?”
এমন সময় আবরাজ বলে ওঠে,”মাম্মি..আমার মাম্মি লাগবে পাপ্পা। আমার মাম্মিকে এনে দাও। রিয়ু..মাম্মি..”
নিজের ছেলের মুখে এহেন কথা শুনে আবরাজ উঠে দাঁড়ায়। রিয়াশা উঠে এসে জাঈদের কাধে হাত রেখে বলে,”এই ছয় বছরেও কি আপনার রাগ, জেদ, অভিমান একটুও কমে নি। আপনি কি আর কখনো নিজের ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরবেন না? রাজকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবেন না?”
জাঈদের চোয়াল শক্ত হয়। সে বলে,”কোন মার কথা বলছ তুমি? যে নিজের বাচ্চাকে হারিয়ে ফেলে, নিজের বাচ্চাকে সামলাতে পারে না তার মা হবার কোন যোগ্যতা আছে নাকি?”
রিয়াশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আরহার সাথে আমার কথা হয় মাঝে মাঝে। ও বারবার আফসোস করে বলে, আপনার কথা। আমাকে বলে, কানাডাতেই যেহেতু আছি আপনাকে খুঁজে দেখতে। আমি ওকে মিথ্যা আশা দেই। শুধুমাত্র আপনাকে দেয়া কথা রাখার জন্য আমায় মিথ্যা বলতে হয়। ওরা কেউ আপনাকে ছাড়া ভালো নেই। আমি তো লজ্জায় আমিনা আপুর কথা জিজ্ঞেসই করতে পারি না। না জানি আমিনা আপু কেমন আছে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৪
জাঈদ উপহাস করে বলে,”কেমন আবার থাকবে? ভালোই আছে। আমার মা-বোনকে তো বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল নিজে নিজের ভাইয়ের সাথে মিলে সব সম্পত্তি ভোগ করার জন্য। তখন না বুঝলেও এখন আমি এটা বুঝি। এখন তো সবকিছুতেই ওদের রাজত্ব নিশ্চয়ই ভালো আছে। ছেলে-স্বামী হারানোর কোন ব্যথা আর ওর নেই। থাকলে এত বছরে ঠিক আমার বা আমার ছেলের খোঁজ করত। আমার তো মনে হয়, ও নিজের জন্য নতুন কাউকে খুঁজেও নিয়েছে।”