অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯০

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯০
ইয়াসমিন খন্দকার

জাঈদ আমিনার দিকেই তাকিয়ে ছিল। এমন সময় আমিনা তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এগিয়ে এসে আরহামের পাশে বসে বলে,”তুমি চিন্তা করো না বড় আব্বু..তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে৷ আমরা সবাই আছি তোমার পাশে। দেখো, তোমার ছেলেও আজ ফিরে এসেছে। এবার তোমার আর কোন দুঃখ নেই।”
আরহাম ব্যথিত স্বরে বলেন,”কিন্তু তোমার দুঃখের কি হবে আমিনা? বিনা অপরাধে ৬ বছরে তুমি যে শাস্তি ভোগ করছ তার কি হবে?”
আমিনা একপলক জাঈদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,”যে বলেছে আমি বিনা দোষে শাস্তি পাচ্ছি? নিজের ছেলেকে আমি আগলে রাখতে পারিনি। মা হিসেবে আমি ব্যর্থ। এর শাস্তি তো আমাকে পেতেই হতো।”

বলেই আমিনা উঠে দাঁড়িয়ে জাঈদের উদ্দ্যেশ্যে,”এই ৬ বছর এমন কোন যায়গা আমি আমাদের ছেলেকে খোঁজা বাকি রাখিনি..কিন্তু ভাগ্য এতটাই বিড়ম্বনায় ফেলল যে..”
আমিনার গলার স্বর করুণ। সে নিজের চোখের কোণে জমা জল মুছে বলে,”ঐ নার্সও হঠাৎ করে কোথায় যেন নিখোঁজ হয়ে গেছে। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। উনি বাচ্চা পাচারকারী ছিল। আমার জন্য আমাদের বাবু আমাদের মাঝে নেই। তুমি আমাকে কখনো ক্ষমা করো না..কখনো না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বলেই আমিনা জাঈদের দিকে ভালো ভাবে তাকায়। জাঈদের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলে যাচ্ছে। সে নিজের অনুভূতিকে কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছে। ৬ বছরে এই প্রথম তার মনে অনুশোচনার অনুভূতি হচ্ছে যা আগে ছিল অনুপস্থিত। জাঈদকে চুপ দেখে আমিনা বলে,”আমি জানি, আমার পক্ষে সংসার করা তোমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তাই যদি চাও তাহলে শেষ করে দিতে পারো। তারপর নিজের জীবন নতুন করে শুরু করো।”

বলেই আমিনা বেরিয়ে যায়। জাঈদের ইচ্ছা হয় তাকে থামানোর। কিন্তু সে পারে না। ভেতর থেকে কিছু একটা তাকে থামিয়ে দেয়। আরুশিও বেরিয়ে যান রুম থেকে। আরহা জাঈদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”আমিনা আপুর উপর এখনো কি তোমার রাগ কমে নি ব্রো? আপু আজ থেকে ৬ বছর আগেই আমার আর মাম্মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। আচ্ছা, আমাদের এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য আমিনা আপুর থেকেও তো পাপার দায় বেশি ছিল। তাহলে তুমি পাপার প্রতি যদি কোন রাগ না রাখো তাহলে আপুর প্রতি কেন রাগ জমিয়ে রাখছ। আর যদি বলো, তোমাদের বাচ্চা হারিয়ে যাবার কথাটা তাহলে একবার নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে দেখো তো, আমিনা আপু যা করেছিল তা কি ভুল? সে তো নিজের মা ও সন্তান দুজনকেই বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু মাঝখান থেকে কিভাবে কি হয়ে গেল আর…”

আরহা থেমে শ্বাস নিয়ে বলে,”আমি বুঝতে পারছি। এই ৬ বছরে তুমি অনেক কষ্টে ছিলে ব্রো। কিন্তু আমিনা আপুও সুখে ছিল না, তোমার থেকে দ্বিগুণ কষ্টে ছিল সে। তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পরই আমিনা আপু এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মাম্মা আর চাচীর সাথে একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। জানো, এই ৬ বছরে এমন একটা রাতও নেই যখন আমিনা আপু শান্তিতে দুচোখের পাতা এক করেছে৷ প্রতিটা মুহুর্তে সে কতোটা কষ্টে কাটিয়েছে তার সাক্ষী আমিও হয়েছি। জানো, আমিনা আপু অপরাধবোধে একদম শেষ হয়ে গেছে। ঘুমের ওষুধ ছাড়া আপু দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষারোপ করে…”

জাঈদ আর শুনতে পারছিল না। অপরাধবোধে তার ভেতরটা একদম শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সে তো ভেবেছিল, এখানে আমিনা সবার সাথে সুখে আছে। অথচ এই ৬ বছর আমিনা এতো কষ্ট পেয়েছে শুধুমাত্র তার হঠকারিতার জন্য। জাঈদের নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা জন্মাতে লাগল। সে মনে মনে বলল,”এখন কিভাবে আমি সত্যটা সবাইকে বলবো? আমিনা বিনা দোষে এতদিন শুধু শুধু এভাবে শাস্তি পেল। আমাদের সন্তান তো হারায় নি। আমি তো এতদিন আমাদের ছেলেকে নিয়ে কানাডায় ছিলাম। বিনা দোষে ওকে এতোটা ভোগান্তি পোহাতে হলো শুধু আমার জন্য। ”
জাঈদ চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,”সবকিছুর জন্য আমি দায়ী..”

আরহা বলে,”ব্রো..”
জাঈদ বলে,”তোমাদের সবাইকে আমার একটা চরম সত্য জানানোর আছে।”
“কি সত্য ব্রো?”
জাঈদ ভাবে সে আর কোন লুকোচুরি রাখবে না। সব শোনার পর যদি সবাই তাকে ভুল বোঝে, ঘৃণা করে তাও সে সহ্য করে নেবে। আমিনাকে এই ৬ বছর বিনা কারণে সে যতোটা কষ্ট দিয়েছে তার বিনিময়ে অন্তত এটুকু সে ডিজার্ভ করে। জাঈদ আরহাকে বলে,”তুমি মাম্মা, চাচি, আকাশ, আমিনা সবাইকে আজ দুপুরে বাড়িতে আসতে বলো। তোমাদের সবাইকে অনেক কিছু জানানো বাকি আছে আমার।”

আবরাজকে নিয়ে বাইরে একটি পার্কে ঘুরতে এসেছে রিয়াশা। মূলত আবরাজের জেদের কারণেই তাকে নিয়ে বাইরে আসা। আবরাজ পার্কে এসেও খুশি নয়৷ কারণ এখানকার পার্কগুলো কানাডার মতো সুন্দর ছিল না। আর নাতো এখানে ম্যাপল ট্রি ছিল। তাই আবরাজ বলে,”আমাকে ভালো পার্কে নিয়ে চলো রিয়ু।
আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না।”
রিয়াশা আবরাজকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে এই পার্কটি অনেক সুন্দর।
“এভাবে বলছ কেন রাজ? দেখো অন্য বাচ্চারা কি সুন্দর খেলছে।”

কিন্তু আবরাজ বিরক্ত হয়ে একদিকে দৌড় দেয়। রিয়াশা তার পিছু পিছু যেতে নেয়। এমন সময় পার্কের গেইট থেকে বের হবার সময় হঠাৎ করে আবরাজ ভারসাম্য হারিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয় এমন সময় আমিনা দৌড়ে এসে তাকে আগলে নেয়। আবরাজ নিজের দুচোখ বন্ধ করে নেয় ভয়ে। আমিনা হতবাক চোখে আবরাজের দিকে তাকায়। সে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক দিয়ে হেটে যাচ্ছিল মনের দুঃখে। আবরাজের ভীত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে তার মাতৃহৃদয় কেমন জানি ছটফট করে ওঠে। আমিনা আবরাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”চোখ খোলো বাবু..তোমার কিছু হয় নি।”

আবরাজ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়৷ রিয়াশা দূর থেকে আমিনা ও আবরাজকে একসাথে দেখে থেমে যায়। মৃদু হেসে বলে,”ভাগ্যের কি তাহলে এই ইচ্ছা ছিল? দুই মা-ছেলের দেখা তাহলে হয়েই গেল..”
পরক্ষণেই সে কিছু একটা ভেবে একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ে বলে,”জাঈদ ভাইয়া চান না যে আমিনা আপু সত্যটা জানুক। তাই উনি না বলা পর্যন্ত আমি আমিনা আপুকে কিছু জানাতে পারব না।”
এদিকে আবরাজ ভ্রুকুটি করে আমিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”কে তুমি? আমাকে বাবু কেন বলছ? আমার নাম তো আবরাজ।”

কানাডায় থাকায় আবরাজের গলার স্বর অনেকটা বাংলা-ইংরেজি মেশানো। ভীষণ আদুরে লাগে শুনতে। আমিনা আবরাজের কথা শুনে হেসে বলে,”আমি তো তোমার নাম জানতাম না তাই বাবু বলে ডাকলাম।”
আবরাজ বলে,”বাবু নামের কাউকে তুমি চেনো নাকি?”
আমিনার বুকে যেন উতালপাতাল ঝড় ওঠে৷ সে নিজের চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করে। যদিও ব্যর্থ হয়। আবরাজ বলে,”তুমি কি কাঁদছ আন্টি?”
আমিনা নিজের চোখের জল মুছে বলে,”কই নাতো..”
“বাবু কে?”
“আমার খুব কাছের একজন। যাকে আমি নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলেছি।”

নিজের কষ্ট থেকে বেরিয়ে আমিনা আবরাজকে বলে,”কিন্তু তুমি এখানে একা কি করছ? তোমার মা-বাবা কোথায়? এভাবে একা ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। নাহলে তুমিও বাবুর মতো..”
বলতে গিয়ে থেমে যায় আমিনা। আবরাজ বলে,”আমার পাপ্পা তো কিছু জরুরি কাজে বাইরে আছে আর মাম্মি…”
আবরাজের মুখে দুঃখ ফুটে ওঠে। আমিনা আবরাজের এমন চেহারা দেখে বলে,”কি হয়েছে তোমার মাম্মির?”
আবরাজ আর কিছু না বলে দৌড়ে আবার পার্কের ভেতরে যায়। আমিনা পেছন থেকে বলে,”এই বাচ্চা,,শোনো..”
কিন্তু আবরাজ দাঁড়ায় না। একটু দূরে যেতেই রিয়াশা তাকে আগলে নেয়। এদিকে আমিনা ফিরে যেতে যেতে বলে,”বাচ্চাটাকে কেন আমার এত আপন লাগছিলো? ওর দিকে তাকিয়ে কেন আমার হৃদয় এভাবে কেদে উঠল। ওকে তো আমি চিনিও না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৯

এসব ভাবতে ভাবতেই সে সামনের দিকে এগোতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। সেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সাফোয়ান চৌধুরী।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯১