অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯১
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা সাফোয়ান চৌধুরীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। সাফোয়ান আমিনাকে বলে,”আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন?”
“আমার বাসায়।”
“আপনাকে তো অনেক ক্লান্ত লাগছে৷ চলুন আপনাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
আমিনা মানা করে দিয়ে বলে,”নাহ, তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি একাই চলে যেতে পারব।”
“প্রয়োজন আছে। আপনাকে দেখে ভীষণ অসুস্থ লাগছে। আপনি চলুন আমার সাথে।”
অগত্যা আমিনা আর মানা করতে পারে না। সাফোয়ানের গাড়িতে উঠে পড়ে। সাফোয়ান গাড়ি চালাতে শুরু করে। কিছু সময় গাড়ি চালানোর পর আচমকা গাড়ির ব্রেক কষে সে। কারণ তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা। সাফোয়ান ও আমিনা দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে আসে। সাফোয়ান বলে ওঠে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”
আমিনাও মহিলাটির জন্য দুশ্চিন্তা করছিল৷ এমন সময় আমিনার দিকে গম্ভীর চোখে তাকায় মহিলাটি। তিনি হলেন মর্জিনা বেগম। আমিনার দিকে হতবাক চোখে তাকায় সে৷ মুখটা আজও ভোলেন নি তিনি। মর্জিনা বেগম আমিনার পায়ের কাছে বসে বলে ওঠেন,”অবশেষে আপনার দেখা পেলাম আমি,,,,এখন আমার মন কিছুটা হালকা হচ্ছে। মনে হচ্ছে নিজের পাপের বোঝা হালকা হবে ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমিনা মহিলাটিকে টেনে তুলে বলে,”আপনি কে? আর এমন করছেন কেন?”
“আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি মর্জিনা..আমি সেই নার্স যার কাছে আজ থেকে ৬ বছর আগে আপনি নিজের ছেলেকে রেখে গিয়েছিলেন।”
আমিনা এবার ভালো ভাবে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকায়৷ অতঃপর ক্ষিপ্তস্বরে বলে,”আপনিই তাহলে সেই বাচ্চাচোর…আপনার উপর কত ভরসা করে আমি নিজের ছেলেকে রেখে গিয়েছিলেন আর আপনি কি করলেন? আমার সন্তানকে আমার থেকে দূরে করে দিলেন। কেড়ে নিলেন ওকে আমার থেকে,,,কেন করলেন এমনটা? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করি নি। আপনি জানেন, আপনার জন্য আমার জীবনটা কিভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে? আমি নিজের স্বামী, নিজের সন্তান সবকিছু হারিয়েছি। এখন ভালোয় ভালোয় বলুন, আমার বাবু কোথায়। কোথায় নিয়ে গেছিলেন আপনি ওকে?”
মর্জিনা বেগম হাতজোড় করে বলেন,”বিশ্বাস করুন, আমি বাচ্চা চোর নই,,,আমি তো আপনার সন্তানকে আপনার কাছেই ফিরিয়ে দিতে এসেছিলাম কিন্তু মাঝপথে,,,,”
“কি?”
“আপনার স্বামী আমাকে কল করে। এরপর ওনার সাথে দেখা করে আমি আপনার ছেলেকে আপনার স্বামীর কোলে তুলে দেই।”
আমিনা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়৷ দ্বিগুণ রেগে মর্জিনা বেগমের গলা চেপে ধরে বলে,”মিথ্যা বলছেন আপনি! কি ভেবেছেন এসব মিথ্যা বলে পার পাবেন? আমার স্বামীর কাছে যদি আমার সন্তানকে আপনি ফিরিয়ে দিতেন তাহলে ও নিশ্চয়ই আমাদের সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে ফিরত। আপনাকে আমি পুলিশে দেব। তাহলে সব সত্য বের হয়ে আসবে।”
“বিশ্বাস করুন ম্যাম আমি সত্যি বলছি। আপনার স্বামীর কোলে যখন আমি বাচ্চাটাকে তুলে দিয়েছিলাম সে আমায় একটা চেক দিয়ে বলেছিল এই শহর থেকে দূরে চলে যেতে আর বাচ্চাকে যে আমি ফিরিয়ে দিয়েছি তা গোপন রাখতে। ওনার কথা সেই সময় আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এর ফল পাচ্ছি। আমার দুই মেয়ে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মরতে বসেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আজ থেকে ৬ বছর আগে এক মায়ের থেকে তার সন্তানকে দূর করে দেয়ার ফল পাচ্ছি আমি। তাই আমি আবার এই শহরে ছুটে এসেছিলাম আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে। আর এভাবে আমাদের দেখা হয়ে গেল। পারলে আমায় ক্ষমা করবেন আর আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন।”
আমিনার পুরো দুনিয়া যেন বদলে যায়। সে ধরে আসা গলায় বলে,”আমি নিজে সন্তান হারানোর যে শোক সহ্য করেছি, আমি চাই না আপনাকেও তা সহ্য করতে হোক। আপনি যান, আপনার সন্তানদের চিকিৎসায় কোন সাহায্যের দরকার হলে আমায় বলবেন। আমি সবরকম সাহায্য করব।”
মর্জিনা বেগম আবারো আমিনার পায়ের কাছে বসে ক্ষমা চেয়ে চলে যান। সাফোয়ান চৌধুরী বলে ওঠেন,”আপনার জীবনে যে এমন কাহিনি ছিল জানতাম না। আর আপনি ঐ মহিলাটাকে এভাবে যেতে দিলেন কেন? ওনার জন্য আপনার সন্তানকে আপনি হারিয়েছেন।”
আমিনা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”ওনার প্রতি রাগ পুষে রেখে কি হবে? যেখানে আমার সবথেকে কাছের মানুষটাই আমাকে ঠকিয়েছে।”
আমিনা নিজের চোখের জল মোছে। বলে,”অনেক কেঁদেছি আমি..আর না। এবার মিস্টার জাঈদ খানকে নিজের করা সব অন্যায়ের জবাব দিতে হবে। আমার সন্তানের অধিকার আমি ঠিক বুঝে নেব।”
বলেই সে সাফোয়ানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”গাড়িটা একটু ঘুরাবেন প্লিজ..আমায় অন্য একটা স্থানে যেতে হবে।”
সাফোয়ান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়।
জাঈদ রিয়াশাকে ফোন করে বলেছে আবরাজকে নিয়ে উপস্থিত হতে। এছাড়া বাড়ির সবাইকেও সে থাকতে বলেছে। আরুশি এসে বলেন,”কি ব্যাপার? আমাদের সবাইকে এভাবে ডেকে পাঠিয়েছ কেন?”
আকাশও বিরক্ত হয়ে বলে,”এত বছর পর ফিরে এসে কি নতুন নাটক করতে চাও জাঈদ ভাইয়া? আমার আপুর পাশে তো এতদিন থাকতে পারো নি। তাহলে এসবের কি মানে?”
সায়রা খান আকাশের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই চুপ থাক। স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নিজের নাকটা গলাস না তো।”
এমন সময় আরহা তার মেয়ে নিঝুমকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হয়। জাঈদ আরহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”আমিনা কোথায়? ওকে ফোন করিস নি?”
“করেছি তো কিন্তু আপু ফোন রিসিভ করছে না।”
এমন সময় আমিনা ক্ষিপ্তবেগে বাড়িতে প্রবেশ করে। তার চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে৷ সবাই তার এই রূপ দেখে অবাক হয়। সাফোয়ানও তার পিছু পিছু আসে। আমিনা এগিয়ে এসে সরাসরি জাঈদের সামনে দাঁড়ায়। জাঈদের কলার চেপে ধরে জোরে। জাঈদ অবাক চোখে তাকায়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমিনা জাঈদের গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বলে,”এটা আমার দুধের শিশুকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
তারপর আবার একটা থাপ্পড় মেরে বলে,’এটা ৬ বছর ধরে আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে রাখার জন্য।’
তারপর আবার একটা দিয়ে বলে,”এটা ৬ বছর ধরে আমাকে অপরাধবোধে ডুবিয়ে রাখার জন্য।”
এভাবেই এলোপাতাড়ি অনেকগুলো থাপ্পড় মেরে আমিনা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। আশেপাশের সবাই অবাক চোখে এই দৃশ্য দেখছিল। জাঈদের মাথাও অপরাধবোধে নিচু হয়ে গেছে। সে আমিনার পাশে এসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চায় এমন সময় আমিনা আবার জাঈদের কলার চেপে ধরে বলে,”কেন? কেন এমন করলে তুমি জাঈদ? আমার জীবনটা কেন এভাবে এলোমেলো করে দিলে? একটা মায়ের কাছ থেকে তার সন্তানকে আলাদা করলে সেই মায়ের কি অনুভূতি হয় সেটা জানো না তুমি? তুমি কি আমায় কখনো ভালোবেসেছ আদৌ? যদি ভালোবাসতে তাহলে এমন করতে না। কোন জন্মের প্রতিশোধ নিলে তুমি আমার থেকে এভাবে? আমাকে ভেঙেচুরে একদম ছারখার করে দিলে। আমার জীবনটা তছনছ করে দিলে। তুমি জানো এই ৬ টা বছর আমি কিভাবে বেচেছিলাম? আমার দেহে হয়তো প্রাণ ছিল কিন্তু আমার আত্মা..আমার আত্মা অর্ধমৃত ছিল৷ একটা মুহুর্ত আমি শান্তিতে থাকতে পারিনি। তোমার জন্যেও ভেবেছি আমি। কিন্তু তুমি..তুমি আমার কথা একটুও ভাবো নি একটুও না।”
জাঈদ আফসোসের সুরে বলে,”আমি জানি আমি অনেক অন্যায় করেছি যার কোন ক্ষমা হয় না। তবে, আমি এখন চাই সবকিছু আমার আগের মতো ঠিক করতে। ৬ বছর আগে আমি যেই পাপ করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত অন্তত আমায় করতে দাও।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯০
“কিভাবে? কিভাবে করবে তুমি এর প্রায়শ্চিত্ত?”
এমন সময় রিয়াশা এসে উপস্থিত হয় বাড়ির মূল ফটকে। তার কাছেই ছিল আবরাজ। রিয়াশাকে দেখেই জাঈদ বলে,”তোমার ছেলেকে তোমার কাছে ফিরিয়ে। রাজ সোনা এসো..তোমার মাম্মির সাথে পরিচিত হও।”
আবরাজ অবাক স্বরে বলে,”আমার মাম্মি!”
রিয়াশা বলে,”হ্যাঁ, যাও রাজ।”
আমিনা আবরাজকে দেখে। এই ছেলেটার সাথেই তো একটু আগে সে দেখা করল। এজন্যই কি এত আপন লাগছিল। আমিনা দৌড়ে এসে আবরাজকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আমার বাবু!”