অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশা সামান্য হেসে রাহেলা খন্দকারকে ধরে তার গাড়িতে তুলে দিতে সাহায্য করেন। অতঃপর চকলেটের ব্যাগটা রাহেলা খন্দকারের হাতে তুলে দিয়ে বলে,”এটাও আপনার সঙ্গে রাখুন আন্টি। এটা বোধহয় আপনার।”
রাহেলা খন্দকার আরিশার দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মা। কেন জানি তোমায় আমার ভীষণ আপন মনে হচ্ছে জানো? আজ যদি আমার সন্তান বেচে থাকত সেও বোধহয় তোমার বয়সীই হতো।”
বলেই তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মোছেন। আরিশার ভীষণ খারাপ লাগে রাহেলা খন্দকারের কথা শুনে। মহিলাটিকে দেখে তো ভীষণ ভালো মনে হচ্ছে অথচ তার কপালে কতই না দুঃখ লেখা। আরিশা বলে ওঠে,”চিন্তা করবেন না আন্টি৷ আল্লাহর কাছে আপনার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ কাউকে ফেরায় না।”
“যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটত। যদি অলৌকিক ভাবে হলেও আমি আমার সন্তানকে ফেরত পেতাম..কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব নয় মা।”

গাড়ির ড্রাইভার বলে ওঠেন,”এখন কি তাহলে আমি আপনাকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে যাব নাকি হাসপাতালে?”
আরিশা বলে ওঠে,”এই অবস্থায় উনি অনাথ আশ্রমে কিভাবে যাবেন? আপনি ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে যান।”
রাহেলা খন্দকার বলে ওঠেন,”কিন্তু অনাথ আশ্রমের বাচ্চারা যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওদেরকে যে এই চকলেট আর জামাগুলো দিতে হবে।”
আরিশা বলে,”আন্টি,আপনি আমায় বিশ্বাস করে চকলেট আর এই জামাগুলো দিতে পারেন। আর অনাথ আশ্রমের ঠিকানাটা বলুন। আমি গিয়ে ওদের এগুলো দিয়ে আসব।”
রাহেলা খন্দকার আবেগময় দৃষ্টিতে আরিশার দিকে তাকান। আরিশা বলে,”আমায় বিশ্বাস করতে পারেন আন্টি। আমি এগুলো সঠিক জায়গাতেই পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব।”
রাহেলা খন্দকার বলেন,”তোমায় আমি বিশ্বাস করি মা। এই নাও এগুলো রাখো আর এখানে অনাথ আশ্রমের ঠিকানাও দেয়া আছে৷ এগুলো পৌঁছে দিও কেমন? ঐ হতভাগা বাচ্চাগুলোর কেউ নেই। ওদের জন্য কিছু একটা করতে পারলে আমার মনে হয় যেন আমি আমার সন্তানের জন্যই কিছু করছি।”
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না আন্টি। এগুলো আমি ঠিক যায়গায় পৌঁছে দেব। আপনি এখন তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যান।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অতঃপর রাহেলা খন্দকার আরিশাকে বিদায় জানায়। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে যেতে থাকে। যাওয়ার সময় রাহেলা খন্দকারের মনে হয় যেন তিনি খুব আপন কিছু হারিয়ে ফেলছেন।
এদিকে আরিশারও কেন জানি ভীষণ খারাপ অনুভূতি হতে থাকে। এমন সময় আফিফাও সেখানে এসে বলে,”বোনু, চল এখন। আমি সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ফেলেছি।”
আরিশা বলে,”আপ্পি আমাদের আগে একটা অনাথ আশ্রমে যেতে হবে।”
“অনাথ আশ্রমে কেন? আর তোর হাতে এগুলো কি?”
আরিশা আফিফাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে আফিফা বলে,”বেশ, চল তাহলে।”
আরিশা যেতে যেতে বলে,”জানো, আপ্পি ঐ মহিলাটা না অনেক ভালো। ওনাকে দেখে কেমন জানি মা মা ফিলিংসটা আসে। ওনার সন্তানকে উনি হারিয়ে ফেলেছেন অথচ অনাথ বাচ্চাদের জন্য কিছু করেই উনি সন্তুষ্টি লাভ করেন৷ সন্তানকে কতোটাই না ভালোবাসেন উনি। আর এদিকে আমার মা-বাবা যারা জন্মের পরই আমার ত্যাগ করেছিল। সত্যিই,কত বিচিত্রই না আমাদের এই পৃথিবী।”
“আজো এমন ভালো মানুষ আছে বলেই তো পৃথিবীটা টিকে আছে।”

অনাথ আশ্রম থেকে বাড়ি ফিরেই আফিফা ও আরিশা অবাক হয়ে যায়৷ কেননা, ঈশিতাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে ছবি বেগম, নিঝুম ও নির্ঝর। তাদের দেখেই আফিফা বলে ওঠে,”তোমরা?”
আনিকা খান এবং আবির খানও সেখানে ছিলেন। আনিকা খান বলে ওঠেন,”আফিফা আসলে তোর দাদি, চাচি আর নির্ঝর ওরা সবাই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।”
আফিফার চোয়াল আচমকা শক্ত হয়। সে বলে ওঠে,”তুমি বলো নি যে, আমরা এখন ফিরবো না?”
ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”আর মন খারাপ করে থেকো না দিদিভাই। ছোটরা ভুল করলে তো আমরা বড়রা তাদের ভুল ক্ষমা করে তাদের আপন করে নেই,তাহলে তোমরা কি পারো না বড়দেরকে ক্ষমা করতে?”

আফিফা কিছু বলবে তার আগেই নিঝুম এগিয়ে এসে আফিফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”ফিরে চলো আফিফা। আমার ছেলেটা যে তোমাকে ছাড়া থাকতে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। হ্যাঁ, ও হয়তো ছেলেমানুষ তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না নিজের কষ্টটুকু প্রকাশ করতে পারছে না। কিন্তু আমি তো মা, তাই নিজের ছেলের কষ্টটা বুঝতে পারছি।”
ছবি বেগমও বলেন,”আর সবথেকে বড় কথা আমাদের পরিবার এতদিন পর একীভূত হয়েছে। আমার আসল নাতনিকে এতদিন পর ফেরত পেয়েছি সেখানে এই সময় তো আমাদের পরিবারের সবার একসাথে হয়ে আনন্দ করা উচিৎ। সেখানে এমন আলাদা আলাদা থাকা মোটেই কাম্য নয়।”

নির্ঝরও এগিয়ে এসে আফিফার হাত আলতো করে ধরে বলে,”আমি সবকিছুর জন্য মন থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি আফিফা। দয়া করে ফিরে চলো। আমি সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে চাই। আমাদের এই ভুল বোঝাবুঝি আর আমি বাড়াতে চাই না।”
আরিশাও আফিফাকে বলে,”সবাই যখন এত করতে বলছে তখন তুমি আর মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখো না আপ্পি। সবকিছু ঠিক করে নাও।”
আফিফা বলে,”বেশ,তোমরা যখন এত করে বলছ তখন আমি ফিরতে রাজি আছি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
ছবি বেগম জানতে চান,”কি শর্ত?”

“তোমাদের সবাইকে আরিশার সাথে করা সকল খারাপ ব্যবহারের জন্য ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আর ওকেও আমাদের সাথে খান ভিলায় মেয়ের মর্যাদা নিয়েই নিয়ে যেতে হবে।”
আরিশা বলে ওঠে,”এসব কি বলছ তুমি আপ্পি?”
ছবি বেগম আরিশার সামনে এসে বলে,”আমায় ক্ষমা করে দিস, আরিশা। তোর সাথে আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। তবে এখন আমি সব সত্য জানি, ঐ সায়ন ছেলেটা আজ সকালে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। ও এসেছে আমাদের সব বলেছে যে যা হয়েছে তাতে তোর কোন দোষ নেই। আর ঐ জাঈদ কিভাবে তোকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিল সেসবও আমরা জানতে পেরেছি ওর মাধ্যমেই। সব না জেনে তোর সাথে কত খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। সবকিছুর জন্য আমি হাতজোড় করে..”

আরিশা ছবি বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ছি ছি দাদি! তুমি কি করছ এসব? এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমায় লজ্জা দিও না। তোমরাই তো আমাদের আপনজন। তোমাদের সাথে আমার হয়তো কোন রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তোমরাই তো আমায় ছোট থেকে সমস্ত আদর-ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালন করেছ। তোমাদের সেই ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। তোমাদের প্রতি আমার কোন রাগ বা ক্ষোভ নেই।”
ছবি বেগম এবার আরিশাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেন। সবাই সাক্ষী হয় এই আবেগঘন দৃশ্য। সবার চোখেই জল এসে যায়। নিঝুম বলে ওঠে,”এতদিন পর আমার আসল মেয়েকে আমি ফেরত পেয়েছি। আগামীকাল ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে সকলের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেব। তোমরা সবাই আজ বাড়িতে ফিরে চলো। আমি চাই,পুরো পরিবার মিলে অতীতের সব তিক্ততা আর ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে আবার এক হই। আমরা সবাই তো একটা পরিবার নাকি?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩২

সকলেই একমত জানায়। নির্ঝর আফিফাকে বলে,”ফিরে চলো আফিফা। আমি কথা দিচ্ছি, এরপর আর তোমায় কোন অভিযোগ করার সুযোগ দেব না।”
আফিফা বলে,”বেশ,এটাই আমি তোমাকে প্রথম এবং শেষ সুযোগ দিলাম। এরপর যদি তুমি কখনো আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করো বা এমন কিছু করো যাতে আমাদের সম্পর্কের উপর আঘাত আসে তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে চিরজীবনের মতো ছেড়ে। এরপর আর হাজার অনুরোধ, কান্নাকাটি করলেও আমি ফিরবো না!”
“বেশ।”
অতঃপর সবাই মিলে রওনা দেয় খান ভিলার দিকে। পুরো পরিবার যেন মেতে উঠতে চলেছে পুনঃমিলনের আনন্দে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৪