অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৫

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৫
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশা অনুষ্ঠানের ফাঁকে কিছুটা বিশ্রাম নিতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠায় আরিশা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে একটা আননোন নাম্বার থেকে প্রায় ৪০ টা মিস কলড! আরিশা ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,”আমায় আবার এই সময় কে মিস কল দিল?”
এই ভাবনা থেকে আরিশা কলব্যাক করতে যাবে এমন সময় ফোনটা আবার বেজে উঠতেই সে কলটা রিসিভ করে নেয়। রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে এক উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শুনতে পায়। জাঈদ বলে ওঠে,”আরিশা..এটা তুমি? আমি সেই কখন থেকে তোমায় ফোন করছি। ফোনটা রিসিভ করছিলে না কেন? আমি কত চিন্তা করছিলাম জানো?”
“কেন ফোন করেছেন আপনি আমাকে? আমি সেদিন বললাম না,আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।”
“এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না আরিশা। আমি কি এতটাই খারাপ যে একটা শেষ সুযোগ পাব না? তুমি কেন তোর আপুকে দিকে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছ?”

আরিশা এবার কিছুটা অবাক হয় কারণ সে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠায় নি। তাহলে কি আফিফা তাকে না জানিয়ে এমনটা করেছে? আরিশা বলল,
“আমি তো পাঠাই নি তবে আপ্পি আমার ভালোর জন্যই পাঠিয়েছে বোধহয়। আপনি এবার দয়া করে আমায় মুক্তি দিন।”
“আরিশা!”
জাঈদের কন্ঠে ছিল তীব্র আকুলতা। সে করুণ স্বরে বলে,”আমার কথা শোনো আরিশা, আমার সাথে অন্তত একবার দেখা করো। তোমাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। জাস্ট একবার আমায় সুযোগ দাও। তারপর তোমার যা সিদ্ধান্ত নেবার তুমি নিও।”
“আমি..”
“প্লিজ। এটাই আমার শেষ অনুরোধ। আমি কথা দিচ্ছি, এরপর আর কখনো তোমায় বিরক্ত করবো না।”
জাঈদের বারবার এমন অনুরোধ করায় আরিশা হার মেনে নিয়ে বলে,”বেশ, আমি আপনার সাথে দেখা করবো। বলুন, কোথায় দেখা করতে চান।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি একটু পাহাড়ি চা বাগানের দিকে এসো।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তবে এটাই শেষবার কিন্তু।”
বলেই আরিশা ফোনটা রেখে দেয়। আরিশা সম্মতি দিতেই জাঈদের মুখে খুশি খুশি ভাব ভেসে ওঠে। সে বলে,”তোমার জন্য অনেক সুন্দর সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করে রেখেছি আরিশা। আজ তোমার সব ভুল বোঝাবুঝি আমি মিটিয়ে দেব। আর একটা অনুরোধ, তোমার আপু বা পরিবারের অন্য কাউকে জানিওনা প্লিজ। নাহলে ওরা তোমায় আসতে দেবে না।”
দরজায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে এসমস্ত কথা শোনেন জামিলা শেখ। তিনি একটা শয়তানী হাসি দিয়ে বলেন,”আজ আরিশা এমন সারপ্রাইজ পাবে যেটা ওর জীবনের সবথেকে ভয়াবহ আর শেষ সারপ্রাইজ হবে।”

আরিশা বেশ তড়িঘড়ি করে সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তবে বেরোনোর সময় আদৃতা তাকে দেখে নেয়। আদৃতা বিড়বিড় করে বলে,”এই মেয়ে আবার এই সময় কোথায় যাচ্ছে।”
আরিশা বেরিয়ে যাবার কিছু সময় পর আদৃতা দেখে সায়ন চারিদিকে কাউকে যেন খুঁজছে। তাই সে এগিয়ে গিয়ে সায়নকে বলে,”কাউকে খুঁজছেন?”
কিন্তু সায়ন তাকে কোন পাত্তাই দেয় না। বিষয়টা আদৃতার অনেক খারাপ লাগে। সে বলে,”নিশ্চয়ই ঐ আরিশাকেই খুঁজছে সায়ন। ঐ মেয়েটার জন্যই আমার জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওর জন্যই সায়নের সাথে আমার বিয়েটা হয়নি। আর এখন তো আমার পরিবারও আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আমি তো ওকে একদমই ছাড়বো না। সাথে ঐ বৃষ্টিকেও না। এই দুজনে মিলে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। এদের দুজনকেই আমি শেষ করে দেব।”
বলেই আদৃতা ফুঁসতে ফুঁসতে বৃষ্টির দিকে তাকায়।
বৃষ্টি সবার সাথে আনন্দ করছিল। ছবি বেগম এসে বৃষ্টিকে বলে,”তুমি নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছ দিদিভাই। যাও, এখন নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

“আচ্ছা,দাদি।”
বলেই বৃষ্টি বিনয়ী কন্ঠে নিজের রুমের দিকে যায়। আদৃতা বৃষ্টির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার স্থান কেড়ে নিয়ে তুমি সুখী থাকবে সেটা তো হতে পারে না ডিয়ার বৃষ্টি। তোমাকে আমি কিছুতেই সুখী হতে দেব না। আমার সব সুখ তুমি কেড়ে নিয়েছ, আমার পরিবার, আমার পরিচয় সব তুমি কেড়ে নিয়েছ। এবার এসব কিছুর ফল তোমায় পেতেই হবে।”
কথাটা বলার সময় আদৃতার চোখে এক ধরণের বিধ্বংসী হিংসা লক্ষ্য করা যায়।

জাঈদ সিলেটের পাহাড়ি চা বাগানের কাছাকাছি একটা হোস্টেলে এসেছে। এখন সে একটা রুম নিজে থেকে বেশ সুন্দর করে ডেকোরেট করছে। উদ্দ্যেশ্য,আজ এই রুমেই আরিশাকে নিয়ে এসে সে সুন্দর ভাবে প্রপোজ করে নিজের মনের কথা জানাবে। রুমটা সাজাতে সাজাতেই হঠাৎ করে জাঈদ বলে ওঠে,”আজকের পর আরিশা আর কিছুতেই আমার উপর রাগ করে থাকতে পারবে না। ওর সব রাগ আজকে আমি দূর করবো।”
বলেই জাঈদ মৃদু হাসে। এমন সময় হোস্টেলের এক কর্মকর্তা জাঈদের রুমে চলে আসেন খাবার নিয়ে। জাঈদ বলে,”খাবারগুলো ওখানে রাখুন, আসলে আমি এখানে একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। সে আসার পর একসাথে ডিনার করব।”
“আচ্ছা স্যার, তবে অনেকক্ষণ থেকে দেখছি আপনি একা একাই কাজ করে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অন্তত এই শরবতটুকু খান তাহলে আপনার ক্লান্তি দূর হবে।”
“আচ্ছা,দিন।”

বলেই জাঈদ শরবতটুকু নিয়ে খেয়ে নেয়। শরবতটা খাওয়ার কিছু সময় পর থেকেই জাঈদ কিছুটা দূর্বল বোধ করতে থাকে ও এক সময় ঘুমের ঘোরে ঢোলে পড়ে।
আরিশা জাঈদের কথামতো সিলেটের পাহাড়ি চা-বাগানের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু এখানে আশেপাশে কোথাও জাঈদকে দেখতে না পেয়ে আরিশা কিছুটা অবাক হয়। বিড়বিড় করে বলে,”আমাকে এখানে আসতে বলে উনি আবার কোথায় চলে গেলেন?”
কথাটা ভেবেই আরিশা ফোন বের করে জাঈদের ফোনে কল দেয়। কিন্তু জাঈদ ফোনটা রিসিভ করে না। আরিশা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,”ভীষণ অদ্ভুত তো লোকটা! এভাবে আমায় ডেকে পাঠিয়ে নিজেই এখন না-ই হয়ে গেছেন! অদ্ভুত ব্যাপার।”
আরিশা বিরক্ত হয়ে আশেপাশে হাটাহাটি করতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ করে সে দেখতে পায় জামিলা শেখ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। জামিলা শেখকে দেখে আরিশা অবাক হয়ে বলে,”আপনি এখানে? কিন্তু এখানে তো আপনার ছেলের আসার কথা ছিল।”

জামিলা শেখ আরিশার দিকে এগোতে থাকেন। আরিশা ভয়ে পিছোতে থাকে। জামিলা শেখ হঠাৎ করে আরিশার গলা চেপে ধরে বলে,”মায়াবীনী মেয়ে! তুই আমার ছেলের উপর কি যাদু করেছিস? তোর জন্য আমার ছেলে আমাকে অপমান করেছে,আমার কথার অমান্য হয়েছে। তোর মতো দুই টাকার মেয়েকে আমি কিছুতেই আমার ছেলের বউ হতে দেব না।”
“ছাড়ুন আমায়, লাগছে…”
“আর একটু অপেক্ষা কর। তারপর তোর সব কষ্ট চিরজীবনের মতো শেষ হবে।”
বলেই তিনি আরিশাকে ঠেলতে ঠেলতে একদম পাহাড়ের কিনারায় নিয়ে যান। আরিশা সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ তার ডাকে সারা দেয় না। আরিশা একসময় বলে ওঠে,”জাঈদ! কোথায় আপনি? প্লিজ আমায় বাঁচান।”
জামিলা শেখ ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে,”তোর কি মনে হয়, আমার ছেলে এখানে তোকে বাঁচাতে পারবে? ঐ তো আমাকে এখানে পাঠিয়েছে তোকে চিরতরে শেষ করে দিতে। কারণ ও এখন নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে যে তুই ওর জন্য কতটা ক্ষতিকর, ওকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারিস।”
আরিশার চোখে জল চলে আসে। সে ভাবল,, তাহলে জাঈদ আমাকে এভাবে ঠকালো! আমি তো ওনাকে বিশ্বাস করেছিলাম আর উনি..

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৪

আরিশার ভাবনার মাঝেই জামিলা শেখ নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আরিশাকে পাহাড়ের কিনারা থেকে জোরে একটা ধাক্কা মারে। আরিশা পড়ে যেতে ধরে পাহাড়ের কিনারার মাটি আকড়ে নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করে কিন্তু জামিলা শেখ নির্দয়ের মতো আরিশার হাতে লাথি মারতে থাকেন। আরিশা বলে,”প্লিজ..আমায় মারবেন না। আমি বাঁচতে চাই..”
কিন্তু জামিলা শেখের কানে আরিশার কোন অনুরোধ যায় না৷ একসময় আরিশার হাত ছুটে যায়। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,”আপ্পি!”
অতঃপর সে হারিয়ে যায় পাহাড়ের অতল গভীরে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৬