অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪
ইয়াসমিন খন্দকার
নির্ঝর আরিশাকে দেখামাত্রই নিজের বাইক থেকে নামে। অতঃপর স্মিত হেসে আরিশার দিকে এগিয়ে যায়৷ নির্ঝরকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে যেন আরিশার হৃদস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে যায়৷ সে ভাবতে থাকে, তাহলে কি নির্ঝর তার প্রতি একই অনুভূতি রাখে যেমনটা সে রাখে? আরিশা এ নিয়েই ভাবছিল এমন সময় নির্ঝর তার সামনে এসে তার দিকে হেলমেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এটা পড়ে নাও। আমি তোমায় নিতে এসেছি।”
আরিশা খুশিমনে হেলমেটটা পড়ে নেয়। অতঃপর নির্ঝরের বাইকে বসে৷ নির্ঝর বাইক স্টার্ট দিয়ে আরিশাকে নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। অতঃপর তাকে নামিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি ভেতরে যাও।”
আরিশা বাইক থেকে নেমে বলে,”তুমি আসবে না ভাইয়া?”
“নাহ, আমার আসলে জরুরি কিছু আজ আছে।”
“ওহ।”
আরিশা আর কথা বাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। যাওয়ার আগে একবার ঘুরে তাকিয়ে দেখে নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর ততক্ষণে বাইকটা ঘুরিয়ে নিয়েছে৷ এখন তার উদ্দ্যেশ্য আফিফাকে নিয়ে আসা। আরিশা নির্ঝরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাকে কি তাহলে সত্যিই আমি নিজের করে পাব নির্ঝর ভাইয়া? ভাগ্য কি তাহলে আমায় সেই সংকেতই দিচ্ছে?”
নির্ঝর বাইক চালিয়ে আফিফার মেডিকেলের দিকে রওনা দেয়। ৩০ মিনিটের মধ্যেই সে সিলেট মেডিকেলের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। অতঃপর অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যেই আফিফা হাফাতে হাফাতে মেডিকেল থেকে বের হয়। নির্ঝরকে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বলে,”আপনি কি এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভাইয়া?!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“নাহ, আমি তো আরিশাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর এখানে এলাম।”
“ওহ।”
“উঠে পড়ো।”
আফিফার দিকে হেলমেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে নির্ঝর। আফিফাও বেশি কথা না বাড়িয়ে উঠে বসে। নির্ঝর আফিফার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”শক্ত করে ধরে বসো। আমি কিন্তু জোরে বাইক চালাবো।”
নির্ঝরের কথা শুনে আফিফা তাকে ধরে বসে। অতঃপর নির্ঝর বাইকটা স্টার্ট দেয়। আফিফা নির্ঝরকে ধরে তাকায় তার মনে বিশেষ অনুভূতি কাজ করছিল৷ কিছুদূর যাওয়ার পর নির্ঝর একটা রাস্তায় বাক নিতেই আফিফা বলে,”এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? এটা তো আমাদের বাড়ির অপোজিট সাইড।”
আফিফার কথা শুনে নির্ঝর বলল,”আমরা এখন বাড়িতে যাব না৷”
“তাহলে কোথায় যাব?”
“শুনলাম পাশেই একটা মেলা হচ্ছে। আমরা সেখানেই ঘুরতে যাব।”
আফিফার কথাটা শুনে ভীষণ ভালো লাগল। একটু পরেই নির্ঝর আফিফাকে নিয়ে সেই মেলার স্থলে উপস্থিত হলো৷ নির্ঝর বাইকটা গ্যারেজে রেখেই আফিফাকে নিয়ে মেলায় ঘুরতে লাগল। ফাঁক বুঝে একটা গোলাপ ফুল কিনে আফিফার কানে গুঁজে দিয়ে বলল,”সুন্দর লাগছে।”
আফিফার মুখে হাসি চওড়া হয়। এই মেলায় ঘুরতে পেরে তার অনেক ভালো লাগছে। নির্ঝর আফিফার খুশি লক্ষ্য করে বলল,”বলো, তুমি কি নাগরদোলায় উঠবে?”
আফিফা বলে,”নাহ, আসলে আমার…”
“ওহ বুঝেছি৷ ঠিক আছে, তাহলে চলো আমরা ওদিকটায় একটু ঘুরে আসি।”
বলেই আফিফার হাত ধরে নির্ঝর পুরো মেলার প্রাঙ্গনটা ঘুরতে থাকে। পুরো সময়টা আফিফার এত ভালো লাগছিল যে সে বলেই বোঝাতে পারবে না। কিছু সময় পর বিকেলের আধার ঘনিয়ে এলে আফিফা বললো,”এখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখন ফেরা উচিৎ।”
“ঠিক আছে৷ চলো।”
নির্ঝর আফিফাকে নিয়ে রওনা দেয়। কিছু সময় পর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন গাড়ি এসে তাদের বাইকটাতে ধাক্কা দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নির্ঝর কন্ট্রোল হারিয়ে বাইক নিয়ে রাস্তায় আছড়ে পড়ে। আফিফা ধাক্কা খেয়ে একটু আগেই বাইক থেকে পড়ে গেছিল তাই হাতে সামান্য আঘাত পেলেও সে খুব বেশি আহত হয় না। কিন্তু নির্ঝর মারাত্মক আহত হয় এবং তার হেলমেটটাও মাথা থেকে সরে যাওয়ায় মাথায় চরম আঘাত লাগে। আফিফা নির্ঝরের এই অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে,”নির্ঝর ভাইয়া…”
আশেপাশের কিছু লোক দ্রুত ছুটে আসে এই দূর্ঘটনা ঘটতে দেখে। এদিকে গাড়ির চালক দ্রুত সেই স্থান থেকে সরে যায় এবং একটু দূরে গিয়েই কাউকে একটা কল করে বলে,”মিশন ডান, বস।”
জাঈদ নিজের সোফায় বসে হুইস্কির বোতলে একটা চুমুক দিয়ে বলে,”এবার তুমি বুঝবে নির্ঝর, জাঈদ শেখের সাথে পাঙ্গা নেয়ার ফল কি হতে পারে।”
নির্ঝরের দূর্ঘটনার কথা শুনে বাড়িসুদ্ধ সবাই অস্থির হয়ে ওঠে। ছবি বেগম তো আহাজারি শুরু করে দেন। এত বছর পর ছেলেটা দেশে এসে এ কোন সমস্যার মুখোমুখি হলো। এখন তিনি আবরাজ আর নিঝুমকে কি জবাব দেবেন? আনিকা খান ছবি বেগমকে সামলে বলেন,”আপনি শান্ত হন, আম্মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আফিফা হাসপাতালেই আছে আমিও এখন যাচ্ছি। যতদূর শুনলাম মাথায় একটু আঘাত পেলেও ব্যাপারটা খুব একটা সিরিয়াস না। আপনি এত উদ্বিগ্ন হবেন না।”
ছবি বেগম তবুও শান্ত হতে পারেন না। আনিকা খান বাড়ি থেকে বের হতে নেবেন এমন সময় আরিশা দৌড়ে এসে বলল,”আম্মু দাঁড়াও, আমিও যাব তোমার সাথে।”
ছবি বেগম বিরক্ত স্বরে বললেন,”তুই আবার গিয়ে কি করবি?”
আরিশা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,”আমার নির্ঝর ভাইয়ের জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ আম্মু আমায় নিয়ে চলো।”
আনিকা খান বলে ওঠেন,”ঠিক আছে। এসো।”
আরিশা আনিকা খানের সাথে রওনা দেয়।
হাসপাতালে পৌঁছেই তারা জানতে পারে ইতিমধ্যে নির্ঝরের জ্ঞান ফিরেছে এবং আফিফা তার সাথে দেখা করতে গেছে। আনিকা খান ডাক্তারের সাথে কথা বলতে থাকেন নির্ঝরের শারীরিক অবস্থার ব্যাপারে। এদিকে আরিশা দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলে,”তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আল্লাহ৷ তুমি আমার নির্ঝর ভাইকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দাও। তার কিছু হলে যে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। বুকটা ছিড়ে যায়। নির্ঝর ভাইয়ের দূর্ঘটনার কথা শুনে যেন আমার হৃদস্পন্দন থেমে যাচ্ছিল৷ এখন একটু স্বস্তি পাচ্ছি। আমার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে পারব না আমি। খুব শীঘ্রই আমার মনের কথা জানিয়ে দেব নির্ঝর ভাইকে। এখন আপাতত গিয়ে তাকে দেখে আসি।”
এই বলেই আরিশা নির্ঝর এর কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে কেবিনের দরজায় গিয়ে সে থমকে যায় যখন দেখে আফিফা অশ্রুসজল চোখে নির্ঝরের সাথে কথা বলছিল। আফিফা বলছিল,
“আপনি ঠিক হয়ে যাবেন ভাইয়া, একদম ঠিক হয়ে যাবেন।”
নির্ঝর সামান্য হেসে আফিফার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”কাঁদছ কেন পাগলী মেয়ে? আমি তো ঠিক আছি তাইনা?”
“আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম নির্ঝর ভাইয়া এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিল আপনাকে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলব।”
নির্ঝর ভীষণ কষ্টে নিজের হাতটা দিয়ে আফিফার হাত জড়িয়ে ধরে বলে,”ভরসা রাখো, আমি কখনো তোমার থেকে দূরে যাব না। তোমাকে নিয়েই যে কয়েক সহস্র বসন্ত পার করার স্বপ্ন দেখেছি আমি।”
আফিফা অবাক হয়। নির্ঝর আর দেরি না করে বলে,”আমি তোমাকে ভালোবাসি আফিফা..জানি না কবে থেকে এবং কেন..তবে আমি শুধু এটুকু জানি যে আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। এত ভালোবাসি যে..পৃথিবীর সবার সাথে লড়াই করে হলেও তোমাকে নিজের করে পেতে চাই।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩
দরজায় দাঁড়িয়ে এসমস্ত কথা শুনে ফেলে আরিশা। তার দুইচোখ জলে টইটুম্বুর হয়ে যায়। তার ছোট্ট হৃদয় ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। সে আহাজারি করে বলতে থাকে,”তাহলে নির্ঝর ভাইয়া আমায় নয় আপ্পিকে ভালোবাসে!”