অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪০

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪০
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশাকে সাথে নিয়ে খন্দকার বাড়িতে প্রবেশ করতে থাকেন রাহেলা খন্দকার। আরিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে চারিদিকে। রাহেলা খন্দকার অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন,”এটাই তোমার আসল বাড়ি। এই বাড়িতেই তোমার বেড়ে ওঠার কথা ছিল কিন্তু ভাগ্যের ফেরে..”
আরিশা রাহেলা খন্দকারকে জড়িয়ে ধরে। রাহেলা খন্দকার বলেন,”আজ আর আমরা কাঁদবো না৷ আজ তো আমাদের সুখের দিন৷ আজ এতগুলো বছর পর আমি নিজের মেয়েটাকে আবার ফিরে পেলাম। এখন চলো, তোমার আপনজনদের সাথে পরিচিত হয়ে নেবেন।”
এমন সময় সিতারা বেগম চলে আসেন। তিনি এসেই রাহেলা খন্দকারকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,”তুমি ফিরে এসেছ বৌমা। আর তোমার সাথে এটা কে?”
রাহেলা খন্দকার কাতর কন্ঠে বলে ওঠেন,”এই দেখুন মা৷ এ হলো আপনার নাতনী।”
সিতারা বেগম হতবাক স্বরে বলেন,”আমার নাতনী মানে?”

রাহেলা খন্দকার এবার একে একে সিতারা বেগমকে সব ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে সিতারা বেগম হতবাক হয়ে যান। অতঃপর বলে ওঠেন,”হায় আল্লাহ! এ তোমার কেমন বিচার৷ আজ এতগুলো বছর আমাদের বাড়ির মেয়েকে আমাদের থেকে বিছিন্ন রাখলে। এ কোন পাপের শাস্তি দিলে তুমি আমাদের? দিদিভাই, এসো ভেতরে এসো। আমার কাছে আসো। তোমায় একটু বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখি।”
রাহেলা খন্দকার আরিশাকে ইশারা করে ছুটে যেতে বলেন। আরিশাও ছুটে যায়। সিতারা বেগম নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় আরিশাকে। আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমাকে স্পর্শ করেই আমার কেমন আপন আপন লাগছে৷ এতদিন কোথায় ছিলে তুমি?”
“আমিও নিজের আসল পরিবারকে এতদিন খুঁজে বেরিয়েছি দাদিমা। যেদিন থেকে জানতে পেরেছি, ছোটবেলা থেকে যেই পরিবারকে আপন জেনে এসেছি সেটা আমার আপন পরিবার নয় তবে থেকেই তোমাদের খোঁজ করেছি। আর ভাগ্যের ফেরে আজ এতদিন পর তোমাদের সন্ধান পেলাম।”
এমন সময় আলমগীর খন্দকার সেখানে চলে আসেন৷ তিনি এসেই আরিশাকে দেখে বলেন,”একি তুমি এখানে? আম্মা, রাহেলা তোমরা এভাবে কাঁদছ কেন?”
রাহেলা খন্দকার উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন,”আসল সত্য জানলে তোমার অবস্থাও আমাদের মতোনই হবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি সত্যের কথা বলছ?”
“আমাদের মেয়ে..আমাদের মেয়ে ফিরে এসেছে।”
“কি? আমাদের মেয়ে মানে?”
রাহেলা খন্দকার এবার তাকে সমস্ত কিছু খুলে বলে। সব শুনে আলমগীর খন্দকার বলেন,”ঐ যে আমার মেয়ে তার প্রমাণ কি?”
রাহেলা খন্দকার হতবাক স্বরে বলেন,”প্রমাণ? এটা তুমি কেমন কথা বলছ। জানো ওকে যখন প্রথমবার দেখেছি তখনই আমার আপন আপন লেগেছিল। আর তাছাড়া জরিনা তো সবকিছু বললোই।”
“দেখো রাহেলা, তোমরা হয়তো ব্যাপারটা আবেগ দিয়ে ভাবছ কিন্তু আমার এই বিষয়টা বিবেক দিয়ে চিন্তা করতে হবে। যেই বাচ্চাকে জন্মের পরই মৃত বলা হয়েছিল সে আজ এতদিন পর আমাদের সামনে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাছাড়া এটা আমাদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রের অংশ তো হতে পারে। আমার তো শত্রুর অভাব নেই। তাই আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, আরিশাই আমার মেয়ে।”
রাহেলা খন্দকার বলেন,”একজন মায়ের মন কখনো ভুল করতে পারে না। আমি নিশ্চিত আরিশাই আমার মেয়ে। কিন্তু তোমার যদি আমাকে বিশ্বাস না হয় তাহলে তুমি একটা কাজ করতে পারো, তুমি ডিএনএ টেস্ট করাতে পারো। তাহলেই সবকিছু পরিস্কার হবে।”
“হ্যাঁ, তাই করবো আমি।”
এদিকে আরিশা নিজের বাবার এমন অবিশ্বাস দেখে ভেঙে পড়ে। সিতারা বেগম তখন আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”এতটা চিন্তা করো না দিদিভাই, আসলে তোমার বাবা একটু এমনই। রাজনীতি করে তো তাই সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। একবার ডিএনএ টেস্টটা করতে দাও। তারপরই সব সত্য সামনে আসবে।”
“ঠিক আছে।”

রাহেলা খন্দকার সোফায় বসে অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আলমগীর খন্দকারের জন্য। তিনি হাসপাতাল থেকে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট আনতে গেছেন। কিন্তু এখনো ফেরেন নি। রাহেলা খন্দকারকে চিন্তিত দেখে সিতারা বেগম বলেন,”তুমি এতোটা চিন্তা করো না বৌমা, সব রিপোর্ট ঠিকঠাক আসবে।”
রাহেলা বলেন,”চিন্তা কি আর সাধে করছি আম্মা? এতগুলো দিন পর আমি নিজের মেয়েটাকে ফেরত পেয়েছি৷ এখন যদি আবার কোন কারণে তাকে হারাতে হয়, তাহলে যে আমি..”
আরিশা রাহেলা খন্দকারের হাত শক্ত করে ধরে বলেন,”আমি তোমায় কথা দিচ্ছি মা এবার আমি আর তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না। রিপোর্ট যাই আসুক না কেন, আমি তোমাকে নিজের মা বলে মেনে নিয়েছি আর তুমিই আমার মা হয়ে থাকবে।”
রাহেলা খন্দকার কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস নেন। এমন সময় আলমগীর খন্দকারের আগমন ঘটে। তার চোখেই তার ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছিল। রাহেলা খন্দকার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,”রিপোর্ট পেয়েছ তুমি? রিপোর্ট কি এসেছে?”
আলমগীর খন্দকার কোন কিছু না বলে আরিশার দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। আরিশা উঠে দাঁড়ায়। ভয়ে সে শুকনো ঢোক গিলতে থাকে। সিতারা বেগম বলেন,”তোকে এত রাগী লাগছে কেন আলমগীর? রিপোর্ট কি নেগেটিভ এসেছে? তাই কি তুই এত রেগে গেছিস?”
আলমগীর খন্দকার এবার একদম আরিশার মুখোমুখি এসে দাঁড়ান। আরিশা কিছু বলবে তার আগেই হঠাৎ করে আলমগীর খন্দকার আরিশাকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর একদম ছোট বাচ্চার মতো কাঁদতে শুরু করে দেন। আরিশা বলে ওঠে,”বাবা..”
আলমগীর খন্দকার আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন,”আমার মেয়ে..আমার রাজকন্যা। এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? কেন এতদিন আমায় বাবা বলে ডাকোনি? আমি যে সারাটা জীবন এই বাবা ডাক শোনার জন্য পাগলের মতো তড়পে গেছি।”

রাহেলা খন্দকারও এবার এগিয়ে এসে কাঁদতে থাকেন। আলমগীর খন্দকার তাকে ইশারা করে কাছে ডেকে বলেন,”দেখো রাহেলা, এই হলো আমাদের মেয়ে। ওর তো আমাদের কাছে থেকে কত আদরে মানুষ হবার কথা ছিল। তাহলে কেন ও আমাদের th দূরে মানুষ হলো? কেন আমরা সারাটা জীবন সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত হলাম। বাবা হিসেবে যে আমার নিজেকে আজ ভীষণ ব্যর্থ মনে হচ্ছে। আমি না পারলাম আমার মেয়েকে হাত ধরে হাঁটতে শেখাতে, না পারলাম তার শৈশব, কৈশোরের সঙ্গী হতে। আমার পুরো জীবন যে আজ ব্যর্থ হয়ে গেল রাহেলা।”
সিতারা বেগম বলেন,”এতোটা ভেঙে পড়িস না আলমগীর। আল্লাহ যখন এতদিন পর তোর মেয়েকে তোর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে তখন এবার জীবনের বাকি দিনগুলো মেয়েকে নিয়ে সুন্দর ভাবে কাটা।”
“তা তো আমি কাটাবোই৷ তবে তার আগে আমায় খুঁজে বের করতে হবে কার ষড়যন্ত্রে এতগুলো দিন আমি আমার মেয়ের থেকে দূরে ছিলাম। তারপর তাকে যোগ্য শাস্তি দিয়ে তবেই আমি শান্তি পাবো।”

৩ মাস পর,
দীর্ঘ ৩ মাস জেলে থাকার পর অবশেষে বেকসুর খালাস পেয়ে জেল থেকে বের হলো জাঈদ শেখ। তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাঈদ জেল থেকে বেরিয়েই দেখতে পায় তার হয়ে কাজ করা মান্না তার সামনে দাঁড়িয়ে। মান্নাকে দেখেই জাঈদ বলে ওঠে,”তুই একা এসেছিস আমাকে নিতে?”
মান্না বলে,”হ্যাঁ, বস। আমি এসেছি৷ এই দুনিয়ার আর কেউ আপনার পাশে না থাকলেও আমি সবসময় আপনার পাশে আছি।”
জাঈদ মান্নাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ধন্যবাদ রে, আমার পাশে থাকার জন্য। কিন্তু আমার পাশে থেকে তোকে আর তোর জীবন নষ্ট করতে হবে না। তুই এবার নিজের মতো নিজের জীবন গুছিয়ে নেবে।”
“এসব আপনি কি বলছেন বস? আপনাকে ছাড়া..”
“আমি নিজের জীবনটা একটু গুছিয়ে নেই।”
“আপনার বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বস।”
“কেন?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৯

“কারণ আপনার বাবা আরিশা ম্যাডামকে তার আসল বাবা-মার থেকে দূরে করে দিয়েছিল।”
“মানে?”
মান্না জাঈদকে সব খুলে বলে৷ সব শুনে জাঈদ বলে,”আরিশা তো আগে থেকেই আমাকে ঘৃণা করত। এখন নিশ্চয়ই আমার বাবার কৃতকর্মের জন্য আমায় আরো বেশি ঘৃণা করে, তাই না? এজন্য তো আমি নিরপরাধ প্রমাণিত হবার পরেও আমার সাথে দেখা করতে এলো না। আমি আসলে এই ঘৃণাই ডিজার্ভ করি।”
“বস..”
“তুই নিজের রাস্তায় যা মান্না। এখন থেকে আমি এক নতুন জীবন শুরু করব।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪১