অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশির জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে রাজীবের কোলে আবিষ্কার করে। আরুশিকে চোখ খুলতে দেখে যেন রাজীব স্বস্তি খুঁজে পায়। আরুশির মাথায় হাত রেখে বলে,”তুমি ঠিক আছ তো?”
মারিয়া এই দৃশ্য একদম সহ্য করতে পারছিল না৷ তত্মধ্যে আরহামও সেখানে চলে আসে এবং এই দৃশ্য দেখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। রাজীব মারিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মারিয়া, একটু এসো তো..আরুশিকে তুলতে একটু সাহায্য করো। ওকে ধরে নিয়ে একটি মেডিকেল ক্যাম্পের ওখানে যাই।”

মারিয়া মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে আসে। অতঃপর রাজীব ও মারিয়া মিলে আরুশিকে টেনে তোলে। এবং একসাথে ধরে নিয়ে মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে যায়। রাজীব পুরোটা সময় আরুশির পাশেই বসেছিল৷ মারিয়া দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিল। আরুশি একটু স্বাভাবিক হতেই রাজীব বলে ওঠে,”আচ্ছা, তুমি আমায় বলো তো, হঠাৎ এভাবে অজ্ঞান কিভাবে হয়ে গেলে? আর ঐ রুমে তোমাকেই কে-ই বা এভাবে বন্দি করে রাখল?”
আরুশির দৃশ্যপটে কিছুক্ষণ আগের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মনে পড়ে যায় আরহামের নৃশংসতার কথা। রাজীব আরুশিকে চুপ থাকতে দেখে বলে,”কি হলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
“আসলে ভাইয়া আমার কিছু মনে নেই। আমি মারিয়াকে খুঁজতে ওদিকটায় গিয়েছিলাম তারপর কে বা কারা গেইট লক করেছিল…আর আমার অন্ধাকারে ফোবিয়া থাকায় আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”
রাজীব বলে,”তুমি চিন্তা করো না। এটা কে করেছে সেটা আমি খুঁজে বের করবোই৷ তারপর তাকে উচিৎ শিক্ষাও দেব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশি আর কিছু বলে না। এরমধ্যে রাজীব বাইরে বেরিয়ে যায় আরুশিকে একটু বিশ্রাম নিতে বলে। রাজীব বেরিয়ে যাবার কিছু সময় পর আরহাম এসে আরুশির পাশে বসে। আরহামকে দেখামাত্রই আরুশি বলে ওঠে,”আপনি কেন এসেছেন এখানে? আমাকে ঠিক কতোটা কষ্ট দিতে পেরেছেন তা চেক করতে?”
“শোনো, আমি…”
“চিন্তা করবেন না। এসবের পেছনে যে আপনি জড়িত সেটা আমি কাউকে বলবো না। এখন দয়া করে আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হন৷ আপনার চেহারা আমার দেখতে ইচ্ছা করছে না।”
আরহাম এখানে এসেছিল আরুশির কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু আরুশির মুখে এমন কড়া কথা শুনে আরহামের ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছা মরে যায়। আর তাই সে দ্রুতগতিতে কেবিন থেকে বের হতে হতে বলে,”আমারই ভুল হয়েছিল এই অনাথ মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইতে আসা। নিজেকে কি না কি মনে করে।”
আরহামের প্রস্থানের পরই আরুশি খেয়াল করে মারিয়া কিছুটা দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়াকে দেখেই আরুশি হালকা হেসে বলে,”মারিয়া, তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় আমার কাছে আয়।”
মারিয়া একটু রাগী স্বরেই বলে,”না, আমি এখানেই ঠিক আছি। তুই বিশ্রাম নে। রাজীব ভাই আবার যদি এসে দেখে আমি তোর সাথে গল্প করে তোকে বিশ্রাম নিতে বাধা দিচ্ছি তাহলে আবার রেগে যাবে।”

“তোর গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেন মারিয়া? তুই কি কোন কারণে আমার উপর রেগে আছিস?”
“না, আসলে তোকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আর তাই…”
“আমি জানি তো, তুই আমাকে নিয়ে কত চিন্তা করিস। তবে তোকে এত চিন্তা করতে হবে না। আমি শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাব।”
মারিয়া মনে মনে বলে,”তোর সুস্থতার থেকেও আমার বেশি চিন্তা আমার ভালোবাসার মানুষটির তোর প্রতি আগ্রহ নিয়ে। রাজীব ভাইয়ের প্র‍তি আমার অনুভূতি নিছক ভালো লাগা নয় এটা অনেক বেশি গাঢ়। সেই প্রথম যেদিন ওনাকে দেখেছি সেদিন থেকেই আমি ওনাকে ভালোবাসি। ওনাকে নিজের করতে পাবো না কথাটা ভাবতেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমাদের মধ্যে কখনো কোন তৃতীয় ব্যক্তি আসবে এটা আমার কল্পনারও বাইরে আর শেষে কিনা তুই আমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হলি..না, নিজের ভালোবাসা আত্মত্যাগ করার মেয়ে আমি নই৷ রাজীব ভাইকে আমি নিজের করবোই৷ তার জন্য আমায় যা করতে হয় আমি করবো। যদি তোর সাথে বন্ধুত্বকে জলাঞ্জলি দিতে হয় তাও দেবো কিন্তু রাজীব ভাইকে আমি নিজের করবোই।”

২ দিন পর,
আরুশি নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। গত দুইদিন সে ভার্সিটি যায়নি একটু অসুস্থ বোধ করায়। তবে আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভার্সিটি যাবে। তবে একটা ব্যাপার আরুশি লক্ষ্য করেছে এই দুদিনে রাজীব অনেকবার তার খোঁজ খবর নিলেও মারিয়া একটিবারও আরুশির সাথে যোগাযোগ করেনি। যেই বিষয়টাকে আরুশিকে অবাক করেছে। সে ভেবে নিয়েছে আজ মারিয়াকে গিয়ে জানতে চাইবে সে কি কোন কারণে রেগে আছে তার উপর। মারিয়ার ব্যবহারও কেন জানি কিছুটা অদ্ভুত ছিল।
আরুশি এসব ভেবে বের হতে নেবে এমন সময় হঠাৎ করে কলিং বেল বেজে ওঠে। আরুশি দরজা খুলতেই হতবাক হয়ে যায়। তার চোখ জলে ভড়ে ওঠে। দরজার সামনে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,”আম্মু, তুমি!”

আরিশা খন্দকার নিজের মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলেন,”আমার আরু..কতদিন পর দেখলাম তোকে। ইশ,কত শুকিয়ে গেছিস। নিশ্চয়ই ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস না, তাইনা?”
“খাইতো, আম্মু। কিন্তু তোমার হাতের খাবার না খেলে যে আমার পেটই ভড়ে না। তাই শুকিয়ে গেছি। কিন্তু তুমি হঠাৎ এভাবে এলে যে! তুমি যে আসবে সেটা তো জানাও নি।”
“তোকে চমকে দেওয়ার জন্যই এভাবে আসা।”
“তুমি একা এসেছ?”
এমন সময় জাঈদ শেখ এগিয়ে এসে বলেন,”মা-মেয়ের মিলনমেলায় আমার প্রিন্সেস তো আমায় খেয়ালই করে নি!”
আরুশি জাঈদকে দেখেই তার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”পাপা! তুমি এসেছ?”

“আমার প্রিন্সেসের কথা যে খুব মনে পড়ছিল। তাই চলে এলাম। এই সুযোগ কি আর কপালে জোটে খুব বেশি? সেই যে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমার প্রিন্সেস তার পাপার বুক খালি করে এই ঢাকা শহরে চলে এলো তারপর থেকে যে আমার অপেক্ষার পালা আর শেষই হচ্ছে না।”
“আমি খুব খুশি হয়েছি তোমাদের আসায়৷ কিন্তু তোমরা যে আসবে সেটা আগে বলবে না? তাহলে আমি তোমাদের জন্য কিছু রানা করে রাখতাম৷ কিন্তু ঘরে যে কিছুই নেই।”
আরিশা খন্দকার বলে ওঠেন,”তোকে কষ্ট করে আর কিছু করতে হবে না। এখন জলদি করে রেডি হয়ে নে।”
“রেডি হবো কেন?”
“আপ্পি আমাদের সবাইকে তাদের বাসায় আজ ইনভাইট করেছে। আজ নাকি আমানরা দেশে ফিরছে৷ সেজন্যই তো আসা।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরুশি একটি অস্বস্তি বোধ করে। কারণ ঐ বাড়িতে যেতে তার একদম ভালো লাগে না। কিন্তু কি আর করার।

এদিকে ঢাকায় খান পরিবারে খুশির আমেজ লেগেছে। আফিফা খান আজ ভীষণ খুশি। দীর্ঘ কয়েক বছর পর তার আদরের ছোট ছেলে দেশে ফিরতে চলেছে। আফিফা খানের যেন আর তড় সইছে না নিজের ছেলেকে দেখার জন্য। এদিকে সকাল থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করছে আরহাম। সে একটু হিংসাই বোধ করছে। কারণ তার মা ছোট থেকেই নিজের ছোট ছেলেকে তার থেকে বেশি ভালোবাসে। এই ব্যাপারটা আরহামের একদমই ভালো লাগে না।
একটু পরেই কলিং বেল বাজার শব্দ পেয়ে আফিফা খান দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। সাথে সাথেই দেখতে পেলেন সেই কাঙখিত চেহারা যার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিলেন। আমান মৃদু হেসে বললো,”মম…”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪

আফিফা আর অপেক্ষা না করে নিজের আদরের ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। আমানের সাথে সাথেই সায়ন চৌধুরী ও সায়রাও এসেছে। তারা দূর থেকে মা-ছেলের এই দৃশ্য দেখে খুশি হলেন। সায়রা নিজের বাবার কাধে মাথা রেখে বলে,”আজ আমারো মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে বাবা। আজ যদি মা আমাদের মাঝে থাকত..”
বলতে গিয়েই সে কেঁদে দেয়। সায়ন চৌধুরী নিজের মেয়েকে বুকের সাথে আগলে নেন।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৬