অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩২
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি তীব্র প্রতিবাদ জানায় আদৃতার এমন জঘন্য অভিযোগের। সে বলে ওঠে,”কোন প্রমাণ ছাড়া আপনি আমার পাপার নামে একদম কোন বাজে কথা বলবেন না৷ আমার পাপা এমনটা করতে পারে না।”
আদৃতা বলেন,”কখন বললাম যে আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই? প্রমাণ ছাড়া কথা বলার মানুষ আমি নই।”
আফিফা খান এগিয়ে এসে আদৃতাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলেন,”তোমার স্বভাব সম্পর্কে আমরা ভালোই অবগত আদৃতা। আমরা সবাই খুব ভালো করেই জানি যে তুমি অতীতে কিভাবে আমাদের পরিবারটাকে ধ্বংসের চেষ্টা করেছিলে। বৃষ্টিক তো তুমিই মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিলে আর এখন..”
“ভুল করেছিলাম ভাবি। আর সেই ভুলের শাস্তিও তো পেয়েছে। ভেবে নাও, এখন সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই এসেছি।”
নির্ঝর খান এবার উত্তেজিত হয়ে বলেন,”তুমি যা বলছ তার সাপেক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ দেখাও। আর নাহলে কিন্তু আমাদের পরিবারে অযথা ঝামেলা সৃষ্টির জন্য আমি তোমার বিরুদ্ধে স্টেপ নিব।”
“জানতাম, তোমরা কেউই সহজে আমার কথা মানবে না। এজন্য প্রমাণ নিয়েই এসেছি।”
বলেই আদৃতা হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে বলেন,”কোথায়া আপনারা..আসুন ভেতরে।”
কিছু সময় পরই তিন জন্য ব্যক্তি রুমে চলে আসে। নির্ঝর খান বলে ওঠেন,”কারা এনারা?”
“এনারা তারা যারা সত্যটা সম্পর্কে জানেন। ইনি হলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার হারুন, তোমরা সবাই নিশ্চয়ই এনাকে চিনবে ইনি বৃষ্টির মৃত্যুর তদন্তে ছিলেন। আর ইনি হলেন রফিক রহমান একজন পথচারী যিনি নিজের চোখে সবটা দেখেছেন আর ইনি হলেন..”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরুশি বলে ওঠে,”আব্দুল চাচা..”
আদৃতা বলেন,”চিনতে পেরেছ তাহলে। ইনি হলেন তোমার পাপার পুরাতন ড্রাইভার। এবার এনাদের মুখ থেকেই সবাই সত্যটা শুনুন।”
মিস্টার হারুন বলে ওঠেন,”আজ থেকে ১৫ বছর আগে, এই এক্সিডেন্টের কেইসটা পাওয়ার পরেই আমরা তদন্ত শুরু করি। তদন্তের ক্ষেত্রে মিস্টার সায়ন চৌধুরী আমাদের সাহায্য করেছিল। আপনার মনে হচ্ছে, আপনি আমাদের সেই গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখে নাম্বারটা বলছিলেন যা আপনার ওয়াইফকে ধাক্কা দিয়েছিল।”
সায়ন চৌধুরী অতীতে ডুব দেন। তার স্ত্রীকে যখন একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছিল ঠিক তার চোখের সামনে তখনই তিনি গাড়িটার নম্বর প্লেইট দেখে নেন। আর সেটা তিনি পুলিশকেও বলেছিলেন৷ সায়ন চৌধুরী বলেন,”হ্যাঁ, আমার তো গাড়িটার নাম্বার প্লেইট আজো মনে আছে ***৬৬৭৫৬ ছিল…হ্যাঁ, এটাই তো।”
হারুন বলেন,”এই গাড়িটা ছিল মিস্টার জাঈদ শেখের। আমরা তদন্ত করে সেটা বেরও করেছিলাম কিন্তু..পরবর্তীতে জাঈদ শেখ নিজের প্রভাব খাটিয়ে কেসটা ধামাচাপা দেন। আপনারা তো জানেনই সেই সময় তিনি একজন নির্বাচিত এমপি ছিলেন৷ সেই প্রভাব খাটিয়েই তিনি সব করেছেন।”
এবার রফিক রহমান এগিয়ে এসে সায়ন চৌধুরীর সামনে এসে দাড়ান। বলেন,”আমাকে চিনতে পারছেন হুজুর?”
সায়ন চৌধুরী এবার অতীতে ডুব দেন।
ফ্ল্যাশব্যাক:-
সায়ন ও বৃষ্টি তাদের মেয়ে সায়রাকে নিয়ে বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিল লন্ডন থেকে। সায়রার তখন ৮ বছর বয়স ছিল। তার জেদের কারণে সায়ন ও বৃষ্টি তাকে নিয়ে সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে গিয়েছিল। সিলেট থেকে ফিরে আসার পথে মাঝরাস্তায় হঠাৎ করে তাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে যায়। যার ফলে তারা মস্ত বিপদে পড়ে। সায়ন ও বৃষ্টি গাড়ি থেকে নেমে আসে। সেসময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছিল তাই সায়ন বৃষ্টিকে বলে,”তুমি সায়রার সাথে গাড়ির মধ্যে থাকো, আমি দেখছি কি করা যায়।”
বৃষ্টি বলে,”তুমি এমনিতেই অসুস্থ। এই বৃষ্টিতে ভিজো না আর। যা করার আমি করছি।”
বলেই বৃষ্টি রাস্তার এক সাইডে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে যে কোন গাড়ি আসে নাকি। সায়ন বৃষ্টিকে মানা করছিল কিন্তু বৃষ্টি শোনে না তার কথা। এমন সময় একটা গাড়ি হঠাৎ রকেটের বেগে ছুটে আসতে থাকে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটা এসে বৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। সায়ন হতবাক হয়ে যায় ঘটনায়৷ সে সাথে সাথে গাড়িটার নাম্বার প্লেইট দেখে নেয় এবং গাড়িটকে আটকাতে যায় কিন্তু গাড়িটা বৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়েই ছুট লাগায়। এদিকে সায়নও তখন বৃষ্টিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময় রাস্তা একদম নির্জন ছিল৷ তবে পাশেই একটি ছোটখাটো চায়ের দোকান ছিল যেখানে বসে ছিলেন রফিক। তিনি ছুটে এসেছিলেন সায়নকে সাহায্য করতে।
অতীতের ঘটনা থেকে বেরিয়ে এসে সায়ন চৌধুরী বলে ওঠেন,”আপনিই তো সেই লোক যে আমাকে বৃষ্টিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু আপনি…”
“আমাকে ক্ষমা করবেন বাবু। আমি এত গুলো দিন ধরে একটা অনেক বড় সত্য লুকিয়ে রেখেছিলাম। আসলে সেদিন আমি ঠিকই দেখেছিলাম ঐ গাড়িতে কে ছিলেন..এলাকার এমপি হওয়ায় জাঈদ শেখকে আমরা সবাই চিনতাম। কিন্তু আমরা খেটে খাওয়া গরীব মানুষ..ওত বড় লোকের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই পুলিশের সামনে সত্যটা বলিনি আর না তো আপনাদের কাউকে জানাতে পেরেছি। কিন্তু আজ শেষ বয়সে এসে মনে হলো আজ যদি সত্যটা আমি লুকিয়ে রাখি তাহলে মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে মুখ দেখাতে পারব না।”
আরুশি বলে ওঠে,”নাহ, এসব সত্য হতে পারে না। আব্দুল চাচা, তুমি কিছু বলো। তুমি তো অনেক দিন ধরে আমার পাপাকে দেখেছ৷ তুমি তো জানো, আমার পাপা মানুষ হিসেবে কেমন। তুমি সবাইকে সমস্ত সত্যটা বলো যে আমার পাপা এমন কিছু করতে পারে না।”
আব্দুল চাচা বলে ওঠেন,”যদি সত্যি এমনটা হতো তাহলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হতো না ছোট ম্যাডাম৷ কিন্তু সত্যি এটাই যে, সাহেবই ছিলেন এসবের পেছনে…যদিও তাকে পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না। নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু জটিল কারণে তিনি ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। ফলে সেদিন তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি তার পাশেই বসে ছিলাম। তিনি আমাকে সরিয়ে জোরপূর্বক গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর দূর্ঘটনাবশত..”
“নাহ, এটা হতে পারে না।”
“পরবর্তীতে হুশে আসার পর উনি এই কেইসটা ধামাচাপা দেন। আরিশা ম্যাডামও এসব ব্যাপারে জানতেন।”
“কেন মিথ্যা বলছেন আব্দুল চাচা? আমার পাপা কখনো ড্রিংক করত না। এটা হতে পারে না।”
নির্ঝর খান এবার চরম ক্রোধ নিয়ে বলেন,”কতোটা চেন তুমি তোমার পাপাকে? তার জঘন্য অতীত সম্পর্কে কতোটা জানো? ও কতোটা খারাপ কাজ করেছিল জীবনে তা তোমার খালামনির কাছ থেকে শুনে নাও। আমার বোনকেও নিশ্চয়ই ঐ খুন করেছে। আর পরে সবটা ধামাচাপা দিয়েছে।”
“না..আবার পাপা খুনি নয়।”
আফিফা বলে,”শান্ত হও সবাই। আগে সবটা..”
“আর কি বোঝার আছে আফিফা? তোমার বোনু আর তার স্বামীর সব অপকর্ম তো সামনে এসে গেছেই। জাঈদ শেখ এর কথা নাহয় বাদ দিলাম কিন্তু আরিশা যে এতোটা নিচে নামবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নি। আমার বোনের খু*নি আমার সামনে সবসময় হেসে বেড়িয়েছে আর আমি..”
সায়রা সায়ন চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠে,”আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো পাপা। আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না..আমার মাকে খু*ন করা হয়েছিল..আর সেই খু-নির মেয়ে কিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে..”
আরুশির দিকে তাকিয়ে ঘৃণার সাথে কথাটা বলে সায়রা। আফিফা বলে,”সায়রা..এভাবে বলো না। আরুর এতে কি দোষ? আর এটা তো একটা এক্সিডেন্ট ছিল।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩১
নির্ঝর খান রেগে বলেন,”এসব বলে কোন লাভ নেই আফিফা। সব সত্যটা জানার পর আমি কিছুতেই এই খু*নির মেয়েটাকে আমার বাড়িতে রাখব না।”
আরুশি প্রবল আশা নিয়ে আরহামের দিকে তাকায় যে অন্তত সে আরুশির হয়ে কিছু বলবে। কিন্তু আরহাম চুপ থেকে আরুশিকে চরম হতাশ করে দেয়।