অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৮

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৮
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি নিজের কেবিনে বসে তাকিয়ে আছে তার সামনে বসা মহিলাটির দিকে। মহিলাটি ভীষণ অবসাদে ভুগছে তাই আরুশির কাছে পরামর্শ নেয়ার জন্য এখানে এসেছে। আরুশি এই ৫ বছরে খুলনায় একজন নামকরা সাইকোলজিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই প্রতিদিনই অগণিত মানুষের অবসাদ নিয়ে তার সাথে কথা বলতে আসে। আরুশি মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলে,”জ্বি, আপনার সমস্যা খুলে বলুন।”

মহিলাটি ভীষণ দুঃখ মিশ্রিত স্বরে বলে,”আমার দুঃখের কথা আর কি বলবো ম্যাম! বিগত ১ বছরে আমার জীবনটা একদম নরক হয়ে গেছে। জানেন, আমি ভালোবেসে একজনকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পর দুই বছর অনেক সুখের সংসার করেছি,আমাদের একটা ফুটফুটে বাচ্চাও হয় এর মধ্যে। কিন্তু তারপর হঠাৎ একদিন প্রকাশিত হলো যে আমার বাবার সাথে আমার হাসবেন্ডের বাবার পুরানো শত্রুতা ছিল৷ যার জের ধরে আমার শ্বশুর আমার স্বামীকে আদেশ দেন, আমাকে ছেড়ে দিতে। আমার স্বামী নিজের বাবার আদেশ মেনে আমায় ছেড়ে দেয়; আমি তাকে অনেক অনুরোধ করি পায়ে পর্যন্ত পড়ি কিন্তু সে আমার কোন কথাই শোনে না। এমনকি আমাদের সন্তানের কথাও একটিবারের জন্য ভাবে না। এখন সে আবার অন্য একটা মেয়েকে বিয়েও করে নিয়েছে। নিজের নতুন সংসারে ভীষণ সুখে আছে। আর এদিকে আমি আমার সন্তানকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়েছি৷ বুঝতে পারছি না কি করব। মাঝে মাঝে মন চায় নিজেকে শেষ করে দেই; অনেক বার সুইসাইড এটেম্পও করেছি কিন্তু নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সেটা করতে পারি নি। কিন্তু আমার স্বামী তার নতুন জীবনে এতো সুখী যে আমার কথা ভাবেও না..আমি আর এই জীবন মেনে নিতে পারছি না। আমি আমার স্বামীর কাছে ফিরতে চাই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশির হঠাৎ করে নিজের অতীতের কথা গুলো মনে পড়ে যায়৷ কাকতালীয় ভাবে এই মহিলার সাথে কতো মিল তার জীবনে। আচমকা আরুশির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে বলে ওঠে,”এসব কি কথা বলছেন আপনি? আপনার যেই স্বামী আপনার এবং আপনার সন্তানের সুখের কথা ভাবে নি তার কাছে ফিরে যেতে চান? আপনার কি কোন আত্মসম্মান নেই নাকি? আপনার তো উচিৎ নিজের সন্তানের সাথে নতুন ভাবে জীবন শুরু করা। তার যোগ্য মা হয়ে দেখানো। আপনার জন্য শুধু আপনার সন্তানই যথেষ্ট তাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে আপনার ভাবনা চিন্তা করার তো কোন কারণ দেখি না। আর ঐ স্বামীর কাছে ফেরার থেকে তো মরে যাওয়াও ভালো..”
বলতে বলতেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে আরুশি। তার প্যানিক এট্যাক হতে নেয়। যার ফলে মহিলাটি ভয় পেয়ে যায় এবং উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যায়। আরুশি এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। এমন সময় আরুশির চেম্বারের সহযোগী এসে বলে,”ম্যাম আপনি ঠিক আছেন তো? ঐ মহিলাটা কেন জানি বললো আপনি অদ্ভুত ব্যবহার করছেন?”
আরুশি হালকা শ্বাস নিয়ে বলে,”আমি ঠিক আছি..”

এমন সময় হঠাৎ করে আরুশির ফোন বেজে ওঠে। আরুশি ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাজীব ফোন করেছে। সে ফোনটা রিসিভ করে বলে,”হ্যাঁ, রাজীব ভাই বলো।”
“আরু কোথায় তুমি?”
“আমি তো নিজের চেম্বারে কেন?”
“এদিকে যে অনেক বড় ঝামেলা হয়ে গেছে।”
“কি হয়েছে?”
“আমাদের লিটিল চ্যাম্প তো মাফিয়া হয়ে গেছে! স্কুলে ওর এক সহপাঠীর নাক মে*রে ফাটিয়ে দিয়েছে। স্কুলে নালিশ বসেছে ওর নামে। স্বয়ং প্রিন্সিপাল আমায় ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে। আমি তো পুলিশের ইউনিফর্ম পড়ে আছি তাই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কিছু বলতেও পারছি না। তুমি প্লিজ জলদি চলে এসো।”
আরুশি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”উফ..এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না। আবার নতুন একটা ঝামেলা তৈরি করেছে। এবার ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। তুমি অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
বলেই আরুশি তাড়াহুড়ো করে নিজের চেম্বার থেকে বের হয়।

আমিনা মন খারাপ করে বসে আছে নিজের রুমে। এমন সময় আফিফা খান তার পাশে এসে বসে। এই ৫ বছরে পুরো খান বাড়িতেও এসেছে অনেক বদল। আবরাজ খান ও আনিকা খান দুজনে ইন্তেকাল করেছেন। নিঝুম খান অবশ্য এখনো বেঁচে আছেন তবে তার শারীরিক অবস্থা বেশি ভালো না৷ আফিফা খানের সাথে নির্ঝর খানের বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আফিফা খান আজকাল ওনার সাথে ঠিকমতো কথাও বলেন না। আরুশিকে হারানোর পর থেকেই তিনি মর্মাহত। তবে এত কিছুর মাঝে নিজের নাতনীর সঙ্গ তাকে একটু আনন্দ দেয়। আফিফা খান আমিনার কাছে এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”কি হয়েছে আমার দিদিভাই এর? এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছে কেন?”
আমিনা কাদো কাদো স্বরে বলে,”গ্রানি..আমি আপচেট। আমি কারো চাতে কতা বলব না।”
“কি বলো? কি হয়েছে আমার আমিনা দিদিভাই এর? এত্ত আপসেট কেন সে?”
“কেউ আমায় বালোবাচে না..কেউ আমার দম্মদিন(জন্মদিন) মনে রাকেনি।”

আফিফা খান কানে হাত দিয়ে বলেন,”ওহ দিদিভাই ভীষণ সরি। কোন ব্যাপার না, আর কেউ ভালো না বাসলেও তোমার গ্রানি তোমায় অনেক ভালোবাসে। চলো আমরা দুজন মিলে চুপিচুপি তোমার বার্থডে সেলিব্রেশন করি। আর কাউকে বলবো না। আমরা দুইজনে শুধু পার্টি করব৷ তখন ওরা বুঝবে মজা।”
আচমকাই এই কথা শুনে আমিনার দুঃখী মুখে হাসি চলে আসে এবং সে বলে,”আই লাব ইউ গ্রানি..তলো আমরা দম্মদিন পালন করি আর একা একা পাটি করি।”
দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আমান। নিজের মা মেয়েকে এতোটা খুশি দেখে তার ভীষণ ভালো লাগে। বিশেষ করে নিজের মাকে। কেননা, আরুশি চলে যাবার পর কখনোই তার মাকে আর সে হাসতে দেখে নি৷ তবে যবে থেকে আমিনার জন্ম হয়েছে তবে থেকে আফিফা খান নিজের নাতনীকে পেয়ে এত কষ্টের মাঝেও একটু হাসতে পারেন;মজা করতে পারেন। এটা তার ভীষণ ভালো লাগে।

আরুশি প্রিন্সিপালের কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখতে পারে প্রিন্সিপাল রাজীবকে একের পর এক অভিযোগ করে চলেছে। আরুশি এগিয়ে আসে। রাজীবের পাশে বুক হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের ছেলের কানটা আলতো করে ধরে মুলে দিয়ে বলে,”তুমি আবার কি ট্রাবল ক্রিয়েট করেছ হুম? তোমাকে আমি বলেছিলাম না গুড বয় হয়ে থাকতে। তাহলে এসব দুষ্টামি কেন করেছ? কেন নিজের বন্ধুকে মেরেছ? তোমায় আমি শেখাই নি এটা ব্যাড ম্যানারস।”
“ওহ..মাম্মা। ছাড়ো লাগছে আমায়।”
“নাহ, আমি ছাড়বো না তোমায়। তুমি এত দুষ্টামি কেন করেছ? কেন মেরেছ নিজের ফ্রেন্ডকে?”
“বেশ করেছি মেরেছি। প্রয়োজনে আবার মারব। কেন ও বলে যে আমার পাপা নেই? আমার পাপা আছে। আছে আমার পাপা।”

আরুশি হঠাৎ থমকে যায় নিজের ছেলের কথা শুনে৷ রাজীবও অবাক হয়৷ তারা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। আরুশি এবার প্রিন্সিপ্যাল ম্যামের দিকে তাকিয়ে বলে,”জাঈদের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি ম্যাম। ও আসলে একটু ছেলেমানুষ তো..তবে এরপর আর এমন হবে না। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”
বলেই সে হঠাৎ করে কেবিন থেকে বের হয়। রাজীব আরুশির পেছনে এসে বলে,”আরু এতটা রাগ করো না। তুমি তো জানোই জাঈদ কতোটা সেন্সেটিভ চাইল্ড। তাই এসব কথা মেনে নিতে না পেরে রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৭

আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”জানেন,আমার ছেলে শুধু আমার পাপার নামই না আমার পাপার স্বভাবটাও পেয়েছে। আমার আম্মুর কাছে শুনেছি আমার পাপাও ঠিক এমন রাগী এবং জেদি ছিল। জাঈদও ঠিক তেমনি হয়েছে..ও যেদিন হয়েছিল সেদিনই আমার মনে হয়েছিল আমার পাপা তার প্রিন্সেসের কাছে ফিরে এসেছে আর..”
বলেই আরুশি কাঁদতে থাকে। এমন সময় জাঈদ বেরিয়ে এসে আরুশিকে কাঁদতে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আই এম সরি মাম্মা। আমি আর এমন করবো না। তুমি প্লিজ কেদো না।”
আরুশি জাঈদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৯