আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৯

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৯
অরাত্রিকা রহমান

রায়ান ইন্ডাস্ট্রিস এর অষ্টম তলার কনফারেন্স রুমে সেই সকালটা যেন অদ্ভুত চাপা উত্তেজনায় ভরা। দেওয়ালে বড় ঘড়ি টিকটিক করে বাজছিল, আর সাদা বোর্ডে নীল মার্কারের আঁকিবুঁকি—কতগুলো সংখ্যা, প্রজেক্টের টাইমলাইন আর ডেডলাইনের হিসেব। টেবিল জুড়ে ল্যাপটপ, মোটা ফাইল আর চায়ের কাপে ফেনা জমে আছে।
রায়ান সামনে বসে আছেন, কিন্তু মন নেই। চোখ দুটো যেন দূরের কাঁচের জানালা ভেদ করে অনেক দূরে, কোথাও অন্য এক জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ম্যানেজার গলা খাঁকারি দিল—

—“স্যার, আমাদের অনুমান অনুযায়ী ট্যাবলিশমেন্ট শেষ হতে ছ’মাসের মতো সময় লাগবে। তবে যদি কাজের গতি দ্বিগুণ করতে চান, বাজেটও দ্বিগুণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব।”
আরেকজন সহকর্মী ক্যালেন্ডারের পাতায় আঙুল চালিয়ে বলল—
—“আমরা প্রতিটি ফ্লোরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তবে শ্রমিক আর সরঞ্জামের কিছু সমস্যা হচ্ছে। হয়তো একটু দেরি হবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

টেবিলের সবাই মাথা নাড়ল। কিন্তু রায়ান নিঃশব্দে বসে রইলেন। তার ঠোঁটে কোনো কথা নেই, শুধু একবার কলম নিয়ে নোটবুকে টোকা দিলেন—টক… টক… টক…।
হঠাৎ সেই শব্দও থেমে গেল। তার ভেতরে তখন অন্য এক ঝড়।
মনে পড়ছে ভোরবেলার টেবিল। মিরায়ার রাগান্বিত মুখ, ঠোঁটে ফোলাভাব, সবার সামনে তাকে ইগনোর করা। আর শেষে হঠাৎই চেয়ার থেকে উঠে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে চলে যাওয়া।
“কেন এমন করলো সে? রক্ত আগুন জ্বলছে আমার। আমি কি এতটাই অচেনা? অথচ কাল রাতে তো কত আপন করে…”

রায়ানের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল যেন রাগ আর বাঁধ মানছে না তার। সে এতো নরম মনের মানুষ নয় কেবল বউটার ক্ষেত্রেই কঠোরতা কাজ করছে না। তবে আর না আর এভাবে হচ্ছে না। কনফারেন্স রুমের শীতল এসির বাতাসও যেন আগুনের মতো জ্বলতে লাগল তার গায়ে।
সে নিজেকে সামলাতে চাইল। মাথা নিচু করে ফাইল খুলল, কিন্তু এক লাইনও পড়তে পারল না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মিরায়ার সেই অভিমানী মুখটা। ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটি। মনে মনে প্রশ্ন জাগলো-
“মিরা কোনভাবে কালকে রাতে আভাস পেয়েছে কি হয়েছিল! সেজন্যই কি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছে? ও কি রাতের চুমুর বিষয়টা বুঝতে পেরেছে? উফ্ ! মাথা পালক হয়ে যাচ্ছে আমার। কাল সারাদিন ঠিক মতো খায়নি, সকালেও কিছু খেলনা। আমাকে এমন জ্বালিয়ে কেন মারছে আমার বউটা।”

“না খেয়ে আমার ছোট্ট বউটি কিভাবে থাকবে? আমি কি করে মেনে নিলাম ওর এমন অবস্থা? হাজার ইগনোর করুক আমার সেটা নিয়ে মুখোমুখি হওয়া উচিত। কারণ টা কি তার এমন করার পিছোনে। সারারাত ঘুম হয়নি আমার, অথচ ভোরে নাস্তার টেবিলে… আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু তাকিয়ে রইলাম। আমি কি অযোগ্য স্বামী?”
হঠাৎ ধপ্ করে সে ফাইল বন্ধ করে টেবিলের ওপর ছুড়ে মারল। আওয়াজে সবাই চমকে উঠল। প্রজেক্টরের আলো একবার কেঁপে উঠল যেন ঘরের ভেতরেও অস্থিরতা ছড়িয়ে গেল।
ম্যানেজার দম নিয়ে বলল—

—“স্যার… ফাইলে কি কোনো সমস্যা হয়েছে ?”
রায়ান চোখ তুলল। তার দৃষ্টিতে যেন ঝড়ের ইঙ্গিত।
—“মিটিং আজ এখানেই শেষ বাকি ফাইল রেখে দিন আমি দেখে নিবো পরে। নাউ আউট।”
তার কণ্ঠে কোনো উঁচু সুর নেই, কিন্তু দৃঢ়তা এমন যে আর কারো সাহস হলো না কিছু বলতে।
সে এক ঝটকায় ল্যাপটপ বন্ধ করল। শব্দটা যেন ধাতব দরজা বন্ধ হবার মতো কঠিন। চোখে আগুন, কিন্তু সেটা ব্যবসা নয়—পুরোটাই ব্যক্তিগত।
মাথায় তখন একটাই কথা বাজছিল—

“মিরায়া না খেয়ে আছে। আমার হৃদপাখি কষ্ট পাচ্ছে। আর আমি এখানে বসে মিটিং করছি? না… এভাবে হবে না।”
রায়ান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। চেয়ারটা ঘষাটান শব্দ করে সরে গেল পেছনে। সবাই নির্বাক। সে আর কাউকে পাত্তা দিল না। সোজা ডেস্ক থেকে গাড়ির চাবি তুলে নিল। যেন এমন কঠোর ব্যক্তিত্ব সে বহু দিন পর নিজের মাঝে অনুভব করলো। যেটা তার বউয়ের কাছে কোনোভাবেই টেকে না।
পেছন থেকে ম্যানেজার ভীতু কণ্ঠে বলল—

—“স্যার, দুপুরের মিটিং… পার্টনাররা আসবে—”
রায়ান একবারও ফিরে তাকাল না। শুধু একহাত তুলে থামতে ইশারা করল।
—“Cancel everything. I have something important to do. And don’t call me if there is something wrong handle it yourself.”
লিফটের দিকে হেঁটে গেল সে। তার পায়ের শব্দ করিডোরজুড়ে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল—টক… টক… টক। যেন একেকটা পদক্ষেপ ভেতরের জ্বালাটা আরও বড় করে তুলছে।
লিফটের দরজা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস এক ঝলক এল, কিন্তু তাতেও শরীরের আগুন কমলো না। বুকের ভেতর দমদম করছে ধুকপুকানি।

অফিসের সামনে কালো গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির দরজা খোলার শব্দ, তারপর ভেতরে ঢুকে দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করল। ভেতরের নীরবতা যেন আরও ভারী হয়ে উঠল।
সে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতেই বুঝল, আঙুল কাঁপছে। বুকের ভেতরটা ফেটে বের হতে চাইছে যেন।
“আজ আর বসে থাকব না। আমি আসছি হার্ট-বার্ড। যাই হোক, আমার বউটা না খেয়ে থাকবে, আমাকে ইগনোর করবে, আর আমি এখানে বসে টেবিলে বিজনেস এর কস্ট অ্যামাউন্ট গুনব ? কখনোই না।”
গাড়ি স্টার্ট হলো। ইঞ্জিনের গর্জন যেন তার অন্তরের অস্থিরতার প্রতিধ্বনি। রাস্তার দিকে গাড়ি নামাতেই শহরের ভিড় চোখে পড়ল—অফিসগামী মানুষের ছুটোছুটি, ট্রাফিক সিগন্যালের আলো, রাস্তায় বিক্রেতাদের চিৎকার। কিন্তু রায়ানের চোখে কিছুই ধরা পড়ল না।
তার মনে শুধু একটাই ছবি—

তার হৃদপাখির অভিমানী ঠোঁট, ক্ষুধার্ত মুখ, আর তার নীরব এড়িয়ে চলা, বুকটা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
গাড়ি গতি বাড়াতে লাগল। তার বুকের ভেতর তখন কেবল একটাই প্রতিজ্ঞা—
“আজকে আমি আমার বউকে না খেয়ে থাকতে দেব না। ও যতই রাগ করুক, ইগনোর করুক… ওকে নিজের হাতে খাওয়াবো। রাগ করলে রাগ ভাঙাবো তাও কোনো কষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। বউটা আমার এমনিতেই পাতা কাঠির মতো। ওই দিন চেয়ার টেনেছি মনে হলো চেয়ারের উপর কিছুই ছিল না। এমন শরীরে কিভাবে কি করব আমি। আমাকে তো নিতেই পারবে না।”
স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে সে চোখ শক্ত করল।

“হৃদপাখি, তুই যদি বুঝতিস… তোর কষ্ট আমার সহ্য হয় না।”
গাড়ি ছুটে চলল ক্যাম্পাসের দিকে। রাস্তাটা লম্বা হলেও রায়ানের কাছে মনে হচ্ছিল প্রতিটা সেকেন্ড যেন একেকটা যুগ।
সে মনে মনে ভাবল,
“যদি ও আমার কল না ধরে… আমি নিজেই যাব ওর কাছে। সামনে দাঁড়িয়ে বলব—আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারি না।”
স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে রায়ানের ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল।
“চাইলে তুই রাগ কর, ইগনোর কর… আমি তোর কাছে আসবই।”
তার বুকের ভেতর কেমন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। ভালোবাসা, অভিমান, ভয় আর অস্থিরতা মিশে যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সকাল বেলা, সূর্যের হালকা কিরণ গাছপালার পাতার মধ্য দিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। লাল মাটির রাস্তা দিয়ে হালকা বাতাস বইছে, যা গাছের ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি তৈরি করছে। ভার্সিটির বড় মাঠে কিছু শিক্ষার্থী বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ নীরব, কেউ হেসে খেলে। ক্যাম্পাসের চারপাশে লাল ইটের প্রাচীরের পাশ দিয়ে পুরনো বটগাছের ছায়া পড়ে। দূরে ঝর্নার মতো ছোট্ট ফোয়ারা জলে ঝিলমিল করছে, বাতাসে পানির নরম আর্দ্রতা রয়েছে।
মিরায়া ও রিমি ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের মধ্যে হাটাহাটি করছে। তারা ধীরে ধীরে মাটির রাস্তায় হাঁটছে, পায়ের নিচে খাস্তা খাস্তা শব্দ হচ্ছে। মিরায়ার চোখে এখনও গতকালকের ঘটনার কিছু অস্থিরতা আছে, কিন্তু সে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকবার। রিমি তার পাশ দিয়ে হেসে চলেছে, কখনও মিরায়ার দিকে তাকাচ্ছে, কখনও চারপাশের পরিবেশ দেখছে।

মিরায়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “জান, তুই এতো চুপচাপ কেন? কালকে রুদ্র ভাইয়ার সঙ্গে ঠিকমতো পৌঁছেছিল তো নাকি? সব ঠিকঠাক হয়েছে তো? ভাইয়াও আমাকে বলছিল তোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে।”
রিমি কিছুটা চিন্তায়, কিছুটা লাজুকভাবে বলল, “ আমি একদম ঠিক আছি রে। উনি আমাকে সাবধানের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ছিল।”

রিমি মিরায়ার প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারে যে রুদ্র মিরায়াকে
কিছু বলেনি তার পারিবারিক অবস্থার ব্যাপার বা গতকালের আর ভাইয়ের খারাপ ব্যবহার করার সম্পর্কে। তুই ঠিক আছিস জান? কাল যে ওই লোকটা তোকে এমন টানতে টানতে নিয়ে গেল মনে হল খুব রেগে আছে। তুই কি আমাকে বাঁচাতে ওই ছেলেগুলোর প্রতিবাদ করার জন্য বকা খেয়েছিস?”
মিরায়া স্বাভাবিকভাবে হালকা হাসি দিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, সবকিছু ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি। যে অবস্থাতে ছিলাম আমরা অভিভাবকের মধ্যে যে কেউ দেখলে ওরকমই আচরণ করতো। আমি ওনাকে বুঝিয়ে নিয়েছি। উনি রুদ্র ভাইয়ার বড় ভাই- রায়ান ভাইয়া।”
রিমি হলকা ঠাট্টা করে বলল-

“ভাইয়া না অন্য কিছু তার আচরণে কিন্তু বোনের জন্য স্নেহ প্রকাশ পায়নি। বরং অধিকার বোধ প্রকাশ পেয়েছে।”
মিরায়া রিমির কথার কোন প্রতিবাদ করল না আর না কোন প্রতিক্রিয়া করল। সে সকাল থেকে ভেবে নিয়েছে রায়ান নামটা সে শুনেও না শোনার মত করে থাকবে মানুষটা সামনে থাকলেও তাকে কখনো দেখেনি এমন ভাব করবে। হঠাৎ করেই তার নিজের জীবনে এমন ভাবে কারো হস্তক্ষেপ মিরায়ার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করেছে।
মিরায়ার কোনরকম প্রতিক্রিয়া না থাকায় কথা আর এগলো না। দুজনই এরপর নিজেদের ব্যক্তিগত কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রিমি মিরায়াকে হালকা ঠাট্টা করে আবার বলল, “তুই তো গতকাল পুরো রহস্যজনক হয়ে গিয়েছিলি, মনে হয় তোর বড় ভাইও একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল। তোকে একটা ছেলে ছুঁয়ার জন্য হাত বাড়ানোতে এমন ভাবে মারলো।”

মিরায়ার চোখে হালকা লজ্জা আর অস্বস্তি, কারণ সে নিজেও জিনিসটা খেয়াল করেছে। কালকে ওই ছেলেগুলোর উপর রায়ানের হিংস্রতা যেন মিরায়ার প্রতি তার আসক্তি ও অধিকারের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছিল।
তবে মিরায়া তেমন কিছু প্রকাশ না করে মুখে স্বাভাবিক হাসি নিয়ে বলল- “হ্যাঁ, কিছুটা হয় তো… তবে সবই ঠিক আছে।”

ক্যাম্পাসের পরিবেশে তাদের কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। তারা আবার উঠে হাঁটতে লাগলো। দূরে গাছের পাতা লাফিয়ে উঠছে হালকা বাতাসে, পাখির ডাক এবং দূরে পড়ন্ত পাতার শব্দ মিলে এক শান্তিপূর্ণ ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করছে। মিরায়ার মনে হচ্ছে, এই সময়টা যেন শুধুই তার এবং রিমির, ক্যাপাসের কোলের মাঝে সময়টা থেমে গেছে। তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের বড় মাঠের দিকে চলে যাচ্ছে, গাছের ছায়া তাদের ওপর পড়ছে, দূরের ঝর্নার ফোঁটা বাতাসে লাফাচ্ছে, আর তারা নিজেদের ছোটখাট হাসি আর কথোপকথনে মগ্ন।
মিরায়ার মন ভরে যাচ্ছে—গতকালকের অস্থিরতা এখনও আছে, কিন্তু এই সময়টা যেন মুক্তি দিচ্ছে। মনে মনে সে ভাবছে, কিছুক্ষণ হলেও সবকিছু স্বাভাবিক, শান্ত, আর এই ছোট হাটাহাটিতেই যেন তার হৃদয় ফুরফুরে হয়ে উঠছে। তারা আবার একটা জায়গায় বসলো।

সকাল হালকা রোদ দিয়ে ঢাকাকে জাগাচ্ছে, কিন্তু রায়ানের গাড়ির ভেতরের পরিবেশ যেন অন্য এক দুনিয়া। গাড়ির স্টেয়ারিং এক হাতে শক্ত করে ধরেছে, অন্য হাতে ফোন। ফোনের স্ক্রিনে সেভ করা নাম—“হৃদপাখি”—তার চোখে ঝলমল করছে।
হৃদয়ে অস্থিরতার ঢেউ—মিরায়াকে না দেখে, না ছুয়ে যেন সে শান্ত থাকতে পারছে না। চোখ দিয়ে রাস্তা তাকিয়ে আছে, কিন্তু মনে মনে প্রতিটি কিমি মনে হচ্ছে মিরায়ার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। সে কল করতে চায়, বলতে চায়, কিন্তু শব্দ বের হয় না, গলার ভিতরে জমে থাকা উত্তাপ আর ক্রোধ যেন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফোনের স্ক্রিনে একটুখানি কাঁপন, এবং তার ঠোঁট অজান্তে হালকা কণ্ঠে ফিসফিস করে—“হৃদপাখি… তুই জানিস না, আমি কতটা অধিকারবোধে ভরা। এই সময়টা, এই মুহূর্তটা… শুধু আমার জন্য হওয়ার কথা, শুধু আমার।”
শহরের যানজট ভেদ করে রায়ানের গাড়ি ছুটছে ক্যাম্পাসের দিকে। রাস্তায় লাল-সবুজ বাতি বারবার তার পথ আটকে দিচ্ছে, কিন্তু গাড়ির ভেতর রায়ানের চোখে যেন শুধু একটাই ছবি—মিরায়ার অভিমানী মুখ।
সে একহাতে স্টিয়ারিং ধরে, অন্য হাতে ফোনটায় বের করল। স্ক্রিনে পরিচিত আবার নামটা ভেসে উঠল—

“হৃদপাখি”।
কল দিল।
ট্রিং… ট্রিং… ট্রিং…
কয়েক সেকেন্ড বাজল, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
ফোন কেটে গেল।
রায়ান বুকের ভেতর হাত চেপে ধরল। আবার কল দিল।
আবারও— ট্রিং… ট্রিং… ট্রিং…
কিন্তু ফোন ধরল না কেউ।
রায়ানের ঠোঁট থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল—

“হৃদপাখি… প্লিজ ধরো না রে…অস্থিরতায় শেষ হয়ে যাচ্ছি তো। তোর কন্ঠ না শুনা অব্দি শান্ত হতে পারবো না।”
গাড়ির ভেতর বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। বারবার কল দিলেও ফোন ধরছে না মিরায়া। মিরায়ার এমন আচরণ রায়ানের বুকে আগুনে ঘি ঢালছে। রায়ান জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল শহরের ভিড়—তবুও মনে হলো যেন পৃথিবীতে শুধু সে আর তার মিরায়া ছাড়া কেউ নেই।
সে ফোনটা ঠোঁটে চেপে ধরে ফিসফিস করল—

—“তুই কি জানিস না বউ, তোকে ছাড়া আমি এক সেকেন্ডও থাকতে পারি না? এখন যে আর পারা যাচ্ছে না। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে যে আমি সব বাঁধ ভেঙে ফেলব।”
গাড়ি তখন ক্যাম্পাসের ফটকের সামনে এসে থামল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল—ছেলেমেয়েরা বেরোচ্ছে, হাসছে, কেউ আবার আড্ডায় মেতে আছে। কিন্তু রায়ানের চোখ খুঁজছে কেবল একটিমাত্র মুখ।
অন্যদিকে…

ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর তখন বিকেলের শান্ত আলোয় ভরে আছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হাওয়া বইছে। চতুর্দিকে ছাত্রছাত্রীদের হাসি-আড্ডা, রঙিন জামা-শাড়ির ভিড়, ক্যান্টিন থেকে আসা চায়ের গন্ধে ভরপুর পরিবেশ।
ক্লাস শেষ করে মিরায়া আর রিমি ক্যাম্পাসের মাঠের কোণে একটা বেঞ্চে বসে আছে। মিরায়ার হাতে ব্যাগ, চোখ দুটো কেমন যেন দূরে কোথাও তাকানো।
হঠাৎ ফোনটা টেবিলের উপর কাঁপতে লাগল—
স্ক্রিনে নামটা জ্বলজ্বল করছে— “Rayan Calling…”
রিমি অবাক হয়ে বলল—
—“কিরে, তোর ফোন বাজছে! ধরিস না কেন?”
মিরায়া ঠোঁট কামড়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল, তারপর হালকা বিরক্তির সুরে বলল—
—“ধরব না।”
রিমি চোখ কুঁচকে তাকাল—

—“কেন? প্রয়োজনীয় হতে পারে, তুই ধরছিস না কেন? ঝগড়া হয়েছে এই মানুষটার সাথে নাকি?”
মিরায়া ঠোঁট শক্ত করে একদম নিশ্চুপ বসে রইল। ফোনটা বাজতেই থাকল, স্ক্রিনে নামটা ভেসে উঠেই বারবার কেটে গেল।
তার বুকের ভেতর ঢেউ খেলল—সে জানে, রায়ান অস্থির হয়ে ফোন করছে। কিন্তু মিরায়ার জীবনে রায়ানের হঠাৎ প্রবেশ মিরায়ার ব্যক্তিগত জীবনের স্বাধীনতা বঙ্গ করছে যেটা মিরায়ার পছন্দ না। আত্মপরিচয়ের দেওয়াল এতটাই পুরু যে হাত বাড়িয়ে ফোন ধরতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল, “না, আজকে আমি ওনাকে সহজে জিততে দেব না। আজকে আমি ওনাকে বুঝতে দেব আমার ব্যক্তিত্ব কতটা গভীর।”

আবার রায়ান
গাড়ির ভিতরে হাওয়া গরম হয়ে আছে, এয়ারকন্ডিশন চললেও তার শরীর ঘামছে। হৃদপিণ্ডে আগুনের মতো জ্বালা।
স্টিয়ারিংয়ে একহাত, আরেক হাত দিয়ে ফোনটা আবার তুলে নিল।
রক্তচাপা স্বরে ফিসফিস করল—
—“একবার… একবার ধর তুই, হৃদপাখি। তারপর দেখে নে, আমি তোকে কেমন শাসাই।”
তার কণ্ঠে ছিল না কোনো কোমলতা—ছিল দমবন্ধ করা অধিকার, কঠোর ভালোবাসা। সে আবার কল দিল।
বেঞ্চে
ফোন আবার কাঁপল।
রিমি হাসতে হাসতে বলল—

—“মিরা, প্লিজ ধর! লোকটা তোকে খেয়ে ফেলবে মনে হয়, এতক্ষণ ধরে একটানা কল দিচ্ছে।”
মিরায়া চোখ সরিয়ে নিল। গলায় শীতল সুর—
—“খেতে চাইলে খাক, আমি ফোন ধরব না।”
কিন্তু বুকের ভেতরে তার ধুকপুকানি বাড়তে লাগল।
অভিমান তাকে শক্ত করে রেখেছে, কিন্তু মনের গভীরে একটা অদ্ভুত টান কাজ করছে।
কল আবার কেটে গেল।
রায়ানের চোখে হিংস্র ঝিলিক ফুটল।
সে আড়ষ্ট গলায় ফিসফিস করে বলল—
—“বউ… তুই আমায় এভাবে অবহেলা করছিস? তুই জানিস না, আমি কেমন হতে পারি? আজকে তোকে চোখের সামনে না দেখে শান্তি পাব না।”
গাড়ির স্পিড আরও বাড়াল।
তার কণ্ঠে রাগ, কিন্তু সেই রাগের গভীরে লুকানো ভালোবাসা, যেটা শুধু মিরায়ার জন্যেই পাগল করে তুলছে তাকে।
Rayan Calling… Rayan Calling…
রিমি অবাক হয়ে বলল—

—“কিরে, মিরা? ফোনটা এতক্ষণ ধরে বাজছে! ধরবি না?”
মিরায়া ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরল।
—“না, ধরব না।”
—“কেন? লোকটার নাম তো বারবার আসছে— রায়ান। ভাই এর ফোন ধরতে কি সমস্যা।”
মিরায়া হঠাৎ চোখ রাঙিয়ে তাকাল রিমির দিকে।
—“তোর যা জানার দরকার নেই। তা জিজ্ঞেস করবি না। আমি ধরব না মানে ধরব না।”
রিমি ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বলল—
—“ওরে বাবা! এত রাগ কেন? মনে হচ্ছে ফোনের ওপাশের লোকটা তোকে ছিঁড়ে ফেলবে যদি একবার কল ধরিস।”
মিরায়া মুখ ঘুরিয়ে নিল, কিন্তু বুকের ভেতরে ধড়ফড়ানি থামছে না। সে জানে রিমি মজা করছে, কিন্তু ফোনটা না ধরা মানে নিজেকেই হুমকির মুখে ফেলা। অথচ অভিমান তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
আবার রায়ান
গাড়ির ভেতরটা যেন আগুনে পরিণত হয়েছে।
সে আবার কল দিল। স্পিকারফোনে রিংটোন বাজছে। কিন্তু আবারও কাটল।
রায়ানের ঠোঁট বেঁকে গেল, চোখে ভয়ংকর ঝিলিক।

—“মিরা… তুই আমায় পরীক্ষা করছিস? তুই জানিস না, আমি একবার রেগে গেলে তোর সম্পূর্ণ পৃথিবী কাঁপবে তুই সহ। তোর এই নীরবতা ভেঙতে আমি নিজে যথেষ্ট। আসছি তোকে খুঁজে নিতে।”
সে একহাত দিয়ে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরল, আরেকহাতে ফোনটা কষে মুঠো করে বলল—
—“হৃদপাখি, মনে রাখিস— আমার কাছ থেকে পালানোর রাস্তা নেই। তোর সব পথ আমার কাছে গিয়েই শেষ হবে।”
ক্যাম্পাস বেঞ্চ
ফোন আবার কাঁপল।
রিমি হেসে বলল—
—“মিরা, প্লিজ, ধর। না হলে ওই ছেলেটা তোকে খুঁজতে খুঁজতে এখানেই চলে আসবে।”
মিরায়া ফিসফিস করে বলল—

—“আসুক না। আমিও দেখি কতদূর যেতে পারে।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, রায়ান এলে ঝড় বয়ে যাবে। তার চোখের আগুন, কণ্ঠের দমবন্ধ করা কঠোরতা—সেগুলো ভেবে শরীর কাঁপতে লাগল। অথচ অদ্ভুতভাবে সেই ভয়েও একরাশ অচেনা টান মিশে আছে।
আরেকবার কল দিল রায়ান। এবারও কোনো সাড়া নেই।
হাসল ঠাণ্ডা, ভয়ংকর এক হাসি।
—“তুই ফোন ধরিস না? ঠিক আছে, হৃদপাখি। আমি নিজেই চলে আসছি তোর সামনে। তখন তোর ওই অভিমান, ওই নীরবতা—সব ভেঙে ফেলব।”
গাড়ির অ্যাক্সিলারেটর জোরে চাপল।
চোখে রক্তিম আভা, ঠোঁটে ফিসফিস—

—“তুই শুধু আমার। আমার অধিকার এড়িয়ে বাঁচতে পারবি না, জানপাখি।”
ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকতেই চারপাশের ছাত্রছাত্রীদের চোখ বড় হয়ে গেল। কালো সেডানটা গর্জে উঠল, যেন হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে বজ্রপাত নেমে এসেছে। রায়ান দরজা খুলে বের হল—সাদা শার্টের হাতা ভাঁজ করা, চোখে দমবন্ধ করা কঠোরতা। চারপাশে যে কেউ তাকালেই বুঝে যায় লোকটা এখানে কারো খোঁজে এসেছে।
মিরায়ার বুক ধকধক করতে লাগল। সে রিমির সঙ্গে বেঞ্চে বসেছিল, কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই তার শরীরের ভেতর কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল। রিমি কৌতূহলী চোখে তাকাল—

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৮

—“ওই যে আসছে… তোর ফোনে যে নাম আসছিল, ওই লোকটা কি ও-ই?”
মিরায়া কিছু বলল না। ঠোঁট শক্ত করে বন্ধ করে রাখল।
রায়ান সরাসরি এগিয়ে এল, ভিড় ঠেলে, চোখ শুধু মিরার দিকে স্থির। চারপাশ যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ভারী পদক্ষেপের আওয়াজেই মনে হচ্ছিল মাটি কাঁপছে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here