আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২২
অরাত্রিকা রহমান
রেস্টুরেন্টের টেবিলটার নরম আলোয়, গোলাপের সুবাস, এক শান্ত, অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মিরায়া ও রায়ান পাশাপাশি বসে। টেবিলের ওপরে সাজানো খাবারের সারি দু’জনের নজরই আকৃষ্ট করছে। প্রতিটি প্লেটের পাশে ছোট ছোট চামচ এবং ফর্ক রাখা, যেন প্রতিটি উপাদান তাদের জন্য নিজেই প্রস্তুত করা হয়েছে।
রায়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মৃদু হাসি ফোটাল। মিরায়া সামান্য লজ্জা নিয়ে তার দিকে তাকাল। সে হাতে ধরতে চাইল না, কিন্তু চোখে ভীষণ আগ্রহ। রায়ান মিরায়ার উদ্দেশ্যে-
—“যেটা তোমার পছন্দ আমাকে বল, হৃদপাখি,” সে ফিসফিস করল, চোখে এক অদ্ভুত মৃদু উষ্ণতা।
মিরায়া হঠাৎ থমকে গেল। মিরায়া টেবিলের কাচ্চির রাখা প্লেটের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিল। রায়ান খেয়াল করল—মিরায়া যেটা পছন্দ করছে, সে মুখে বলা ছাড়াই নিজেই তুলে নিল অল্প পরিমানে কাচ্চি সেই প্লেট থেকে।
মিরায়া বুঝতে পারলো না ঠিক না বোলাতেও কিভাবে রায়ান তার সব চাওয়া গুলো বুঝতে পারছে। তবে সে পরে আর খাওয়া নিয়ে কোনো দ্বিধা রাখলো না। মিরায়া হাত দিয়ে একটি ছোট সালাদের পাত্রের দিকে ইঙ্গিত করল। রায়ান তৎক্ষণাৎ চামচে সালাদ তুলে নিল যে প্লেটে কাচ্চি নিয়ে ছিল তার পাশে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এরপর পরম যত্নে মিরায়ার মুখের দিকে এগিয়ে দিল চামচে করে। মিরায়াও চুপচাপ মুখে নিল, যেন কিছু বলার প্রয়োজন নেই। রায়ান আবার একই চামচে নিজেও সেই কাচ্চি ও সালাদ খেয়ে নিল।
এভাবে দুজনে একই প্লেটে একই চামচে খাওয়া শেষ করে। হঠাৎ রায়ান খেয়াল করল মিরায়া টেবিলের এক কোণে রাখা ডেসার্ট গুলো দেখে যাচ্ছে। রায়ান মুচকি হেঁসে হাতের ইশারায় একজন ওয়েটার কে ডেকে সামনের ভারী খাবার সরিয়ে নিয়ে ডেসার্ট আইটেম গুলো সামনে দিতে বলল।
মিরায়ার মুখে না চাইতেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। রায়ান মিরায়ার দিকে তাকিয়ে ডেসার্ট আইটেম গুলো দেখিয়ে প্রশ্ন করল-
“হুইচ ওয়ান ডু ইউ লাইক, বেইবি?”
মিরায়া রায়ানের প্রশ্ন শুনে মৃদু উৎসাহ নিয়ে চকলেট পেস্ট্রির দিকে আঙুল তাক করে বলে উঠলো-
“আই ওয়ান্ট দ্যিস ওয়ান।”
পরপরই আবার পাশে থাকে আরো আকর্ষণীয় ডেসার্ট আইটেম এর দিকে আঙুল দিখেয়ে বলল-
“আই ওয়ান্ট দ্যেট ওয়ান, দ্যেট ওয়ান, আ্যান্ড দ্যেট ওয়ান টু।”
রায়ান মিরায়ার বাচ্চাসুলভ কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসলো। এতে মিরায়া বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো। মিরায়া নিজের মনে বলতে লাগলো- “কিরে মিরা এমন হাবাতেদের মতো করছিস কেন? মিষ্টি খেতে ভালো লাগে তাই এতো লাগাম ছাড়া হাবাতে পানা কেউ করে।”
রায়ান মিরায়ার লজ্জা পাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে মিরায়ার কথায় সম্মতি দিয়ে বলল-
“ওকে ওকে, হোয়াট এভার ইউ উইস, মাই কুইন।”
রায়ান তারপর একের পর এক ডেসার্ট চামচে তুলে মিরায়াকে খাওয়াতে লাগলো আর নিজেও মিরায়ার এঁটো চামচ দিয়ে তার এঁটো খাবার খেতে লাগলো। প্রতিটি খাবারের আইটেমে একই ঘটনা—মিরায়া যা ইচ্ছা দেখাল, রায়ান তা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তুলে দিল। কোনো বাধা, কোনো দ্বিধা নেই।
মিরায়ার চোখে লজ্জা, হালকা উত্তেজনা আর অজানা আনন্দের মিশ্রণ। সে রায়ানকে এক চামচ ও এক খাবার খাওয়া নিয়ে কিছু বলল না , সে জানে—এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবাদই রায়ানকে থামাতে পারবে না।
তবে কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করল-
“আপনি আমার দেখানো খাবার কেন খাচ্ছেন? তাও বার আমার মুখে নেওয়া চামচে।”
রায়ান তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সোজা মুখে উত্তর করল-
“কারণ খাবার গুলো আরো ভালো লাগছে খেতে তুমি খাওয়ার পর তাই নিজেকে থামাতে পারছি না খাবার গুলো সম্পূর্ণ শেষ করা থেকে।”
মিরায়া তাচ্ছিল করে হেসে বলল-
“বাজে কথা কম বলে আসল কারণ টা বলুন।”
রায়ান মিরায়ার দিকে তাকিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল-
” আসল কারণ হচ্ছে – তুমি পুরোটা খাবার শেষ করছো না আর তোমার ঠোঁটের স্পর্শ পাওয়া এঁটো খাবার আমি থাকতে কোনো আঁস্তাকুড়ে জায়গা পাবে তা আমি মানবো না। তাই নিজের মহামূল্যবান পেটে জায়গা দিচ্ছি সেগুলো কে। বুঝেছ আমার বোকা হার্ট-বার্ড?”
মিরায়া রায়ানের বলা কথার মারপ্যাঁচে পড়ে আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইল। যেন কেবল মাত্র রায়ানের বলা কথা তার হজম হচ্ছে না। রায়ান পরপরই মিরায়ার দিকে চামচ এগিয়ে বলল- “আআআ…”
মিরায়া আবার লক্ষী বাচ্চা মতো শব্দ করে হা করল- “আআআ…!”
রায়ান মিরায়ার মুখে খাবার দিয়ে-
“that’s like a good girl !”
চামচ থেকে চামচে, মুখ থেকে মুখে, নিঃশব্দে সংযোগের ভোল্ট তৈরি হলো।
টেবিলের চারপাশে কেউ নেই, শুধু তারা দু’জন। আরেকটু দূরে রাখা ঝাড়বাতির আলো হালকা নাচছে। আর এই নীরব মুহূর্তে, রায়ান ও মিরায়া বুঝতে পারছে—খাবারের মধ্যেই, চামচের স্পর্শে, চোখের দৃষ্টিতে, তাদের মধ্যে কোনো বাধা নেই।
চৌধুরী বাড়ি ~
সোরায়া আজ বিশেষভাবে খুশি। কলেজে আজকের দিনটা তার চোখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস ছিল। কারণ, তার কলেজের নতুন টিচার তার মনে ধরা প্রথম পুরুষ- তার মাহির স্যার।
—যে মানুষ টাকে সোরায়া না চিনে কেবল চুপচাপ পছন্দ করত। এখন সেই মানুষ তার ক্লাস টিচার। পুরো দিনটা সোরায়ার মনে যেন এক রোমাঞ্চকর মায়াজালে ভরা ছিল।
কলেজ শেষে বাড়ি ফিরে সে হালকা ধৈর্য্য নিয়ে দরজার খটখটালো। সাথে সাথেই বাড়ির হেল্পিং হেন্ড দরজাটা খুলে দিলেন।
হোরায়রা বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই মুখে বড় একটা হাসি নিয়ে হেল্পিং হ্যান্ড চুমকিকে বলল-
“কি অবস্থা চুমকি কেমন আছো? তোমার পরিবারের সবাই ঠিক আছে তো? কত গুলো দিন ছুটিতে ছিলেন খুব মনে পরেছে আমার তোমার কথা।”
চুমকি-” আসসালামুয়ালাইকুম আফা মণি। আমি বালা আছি বাড়ির সবাই ও বালা আছে। আমারো যে আপনাগোর কতা কি মনে পরছে কি কইতাম। বড় আফা মণি কই গেছে দেখলাম না যে আওয়ার পর থেইকা।”
সোরায়া- “আরে আপু তো ভার্সিটিতে। চলে আসার কথা। আমি তো কলেজ থেকে এলাম। তুমি কাজে যাও তোমার।”
চুমকি- “আচ্ছা আফা মণি।”
চুমকি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর সোরায়া ড্রয়িং রুমের দিকে তাকাল, আর তার চোখ খুঁজে পেল জুলিয়েটকে। ছোট্ট মেয়ে একেবারে প্রস্তুতভাবে বসে আছে, যেন জানে এই সময়টা কেউ এসে তাকে আদর করবে।
জুলিয়েট আসলে মিরায়ার জন্য অপেক্ষা করছিল, কারণ সে জানতো মিরায়া সাধারণত এই সময়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু আজ, মিরায়ার বদলে সোরায়া এসেছে আগে।
“মিয়াও!” জুলিয়েট উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল।
সোরায়া হাঁসিমুখে এগিয়ে গেল। প্রথমেই ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল। জুলিয়েটের চোখে উজ্জ্বলতা। সোরায়া মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আমার সোনা বাচ্চা কুট্টুস।”
জুলিয়েট লাফ দিয়ে বলল, “মিয়াও!”
সোরায়া মেয়েটির ছোট্ট মাথায় হালকা হাত রাখল এবং জিজ্ঞেস করল, “তুই ঠিক আছিস, জুলি?”
“মিয়াও!” জুলিয়েট আনন্দে উত্তর দিল, হাত দিয়ে ছোট্ট পা মুড়ল।
সোরায়া হাসিমুখে বলল, “আচ্ছা, বল তো কী হয়েছে আজ?” সে বসে থাকা জুলিয়েটকে আরও আরামদায়কভাবে কোলে নিয়ে বসল।
“আজ কলেজে—” সোরায়া শুরুর আগে জুলিয়েটের চোখে উৎসাহ লক্ষ্য করল। জুলিয়েটের ছোট্ট হাত মুভ করছিল, যেন প্রত্যেক কথার সাথে সঙ্গে খেলা করছে।
“জানিস, আজ আমার কলেজে নতুন একজন টিচার এসেছে—মাহির! আমার ক্রাশ!” সোরায়ার চোখে উচ্ছ্বাস। “সে নতুন টিচার হিসেবে যোগ দিয়েছে, আর উনি আমারই ক্লাস টিচার।ভাবতে পারছিস তো কত সুন্দর মাজার ব্যাপার?”
জুলিয়েট ছোট্ট গলা দিয়ে চিৎকার করে বলল, “মিয়াও!” যেন বলতে চাইছে, “সত্যি?”
“হ্যাঁ রে, সত্যি!” সোরায়া জুলিয়েটের মাথায় চুমু দিয়ে বলল। “উনি আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে আবার খাতায় আমার নাম লিখেওছে, আর আমার সাথে কথাও বলেছে। জানিস, কতো খুশি হচ্ছিল যে আমার মনে , উফ্!”
“মিয়াও! ” (“সে কী বলল?” )জুলিয়েট চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল।
জুলিয়েট ছোট্ট হাত নাড়লো যেন বলছে-” আমাকে বলো আরও!”
সোরায়া ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে ধরে কিছুক্ষণ আদর করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তুই থাক, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। বাকি সব পরে বলব।”
সোরায়া উঠে তার রুমের দিকে এগোল। রুমের দরজা খোলার সাথে সাথে বিকালের পর সন্ধ্যার হালকা হাওয়া ঘরে ভেসে এল। সোরায়া ড্রেস খুলে বাড়িতে পড়ার জামাকাপড় নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল। সে শাওয়ারের জন্য পানি চালু করল। পানির শীতল ছোঁয়া তার শরীর স্পর্শ করল, আর তার মনে ভেসে এল মাহিরের কথা—ক্লাসে তার চোখে চোখ পড়া, সবার সাথে তার আন্তরিকভাবে কথা বলা, নাম জানতে চাওয়া, এবং তার খাতায় নিজের নাম লিখতে দেখা।
প্রথম প্রেম প্রেম সেই অদ্ভুত উত্তেজনা, হৃদয়ের হালকা ঝঞ্ঝা, সবই একসাথে মিশে গিয়েছে। সোরায়ার মনে আনন্দের ঢেউ, এক অজানা উত্তেজনা। মাহিরের অবিবাহিত হওয়ার তথ্যটি, তার মনোযোগ, তার উষ্ণতা—সবই সোরায়াকে এক গভীর খুশিতে ভাসিয়ে তুলছে।
শাওয়ারের পানি তার শরীরের ক্লান্তি ঝরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু মনে মনে সে এখনও সেই ক্লাসের মুহূর্তগুলোই ভাবছিল—মাহিরের দৃষ্টিতে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, প্রথম প্রেমের মতো নরম আবেগ, যা হৃদয়কে অব্যক্ত আনন্দে ভরিয়ে তুলছিল।
খান বাড়ি~
মাহির ক্লাসের প্রথম দিন শেষ করে বাড়ি ফিরে আসলো। হালকা উত্তেজনা আর আনন্দ মিশে তার চোখে কিছুটা ঝলমল করছে। বাড়ির দরজা খুলতেই ঘরে ভেসে এলো পরিচিত গন্ধ—রান্নাঘরে তার মা (মিসেস সীমা খান) কাজ করছিলেন।
“বাড়ি ফেরার সময় হলো বুঝি?” সীমা খান হাসিমুখে বললেন।
“ইয়েস, আম্মু, আমি চলে এসেছি। আজকের দিনটা…উফ্!” মাহির কিছুটা হেসে বলল, “একদম অন্যরকম সুন্দর ছিল, জানো?”
সীমা খান রান্নার মাঝ থেকে চামচ থামিয়ে মাহিরের দিকে তাকালেন।
“অরে তাই নাকি, বল তো, কি কি হলো? নতুন চাকরি, প্রথম ক্লাস?”
মাহির চুলার পাশের ফাঁকা জায়গার পাশে হালকা হাত রাখল।
সে মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেয় –
“ওহ্ আম্মু, বলার মতো অনেক মজার মুহূর্ত আছে। কলেজে প্রবেশ থেকে শুরু করে আমাকে প্রিন্সিপাল স্যার এর রিসিভ করা , বাকি টিচার্সদের আমার প্রশংসা করা সব মিলিয়ে যেন নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হচ্ছিল।”
সীমা খান নিজের একমাত্র ছেলের এমন সফলতার বর্ননা শুনে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের মুখের পানে। যেন তার মনে ভেসে উঠছে সেই ছোট ছেলের কথা যাকে তিনি প্রথমবারের মতো স্কুলের গেটে দিয়ে এসেছিলেন হাত ধরে আজ সে কলেজের প্রভাষক। গর্ব তার চোখে মুখে দৃশ্য মান।
মাহির আবার বলতে শুরু করল –
“আর হ্যাঁ, একটা পিচ্চি বাচ্চা মেয়ে, আমার ছাত্রী—সোরায়া নাম বলল। কলেজের প্রথম দিনে সে পড়াশোনার কোনো প্রশ্ন করল না জানো, বরং সরাসরি জানতে চাইল আমি বিবাহিত নাকি। আমি একটু ইতস্তত বোধ করেছিলাম। ভাবি নি এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। একবার ভাবো আজ কালকার বাচ্চা গুলো কি বিচ্ছু।”
মাহির হেসে বলল সম্পূর্ণ ঘটনা তার মাকে মজার ছলে। তার জন্য সব কথাই স্বাভাবিক ছিল নিজের কর্মস্থলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা থেকে।
সীমা খান হেসে উঠলেন-
“হাহাহা! বাহ্ বাহ্! মেয়েটা তো বলতে হবে বেশ সাহসী আর স্পষ্টবাদী। মনে হয় একটু মজার প্রকৃতির ও কৌতুহলী। তাই না?”
মাহির হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আম্মু, মজার প্রকৃতিরও, একটু সাহসীও। আর এ ধরনের কথা ছাত্রীর কাছ থেকে আসলে অদ্ভুত লাগে।”
সীমা খানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাহিরের মুখে কোনো মেয়ের প্রশংসা শুনেই। তিনি উৎসাহিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন তার ছেলেকে-
“তা হে রে মেয়েটা দেখতে কেমন ?”
মাহির বিরক্তি নিয়ে বলল-
“আম্মু! মেয়েটা আমার স্টুডেন্ট। আমার হাঁটুর বয়সী। কি সব বলছো।”
সীমা খান রাগি গলায়-
“এখন তো মায়ের কোনো কথাই ভালো লাগে না কিছু বললেই “আম্মু কি সব বলছো!”। ভুল টা কি বলেছি ? বয়স তো তোর কম হলো না ২৭-২৮ বছর বয়সে বিসিএস ক্যাডার হয়ে কোন ছেলে অবিবাহিত থাকে আমাকে একটু বলবি। তুই আমার একমাত্র ছেলে। আমার ও তো কিছু সাধ আছে নাকি। বয়স কোনো ব্যাপার হলো নাকি মেয়ে কলেজে পড়ে। আর কতো বড় মেয়ে চাই তোর। আমার ছেলে বিয়ে করবে আমি নাতি নাত…
সীমা খান একটানে কথা গুলো বলছিলেন তবে তাকে শেষ করতে না দিয়েই মাহির তাকে থামিয়ে বলতে লাগল-
“উফ্! আম্মু আর ভালো লাগে না এই বিয়ে বিয়ে টপিক। চুপ করো এবার।”
সীমা খান হালকা কণ্ঠে বললেন,
“হুম, সেই তো, আমার আর কাজ কি সারাটা জীবন শুধু খেটেই যাব তোদের জন্য। একটু শান্তির জন্য মেয়েদের নিয়ে কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তোর বিয়ের ব্যাপারটা একটু এগোতে পারে তাই তো বলি। তোর তো হেল দোল নেই।ল”
মাহির সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
“আম্মু, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক সবই পড়াশোনার বিষয়। মেয়ের বিষয় হলে সেটা শুধু বিয়ের দিকেই কেন নিতে হবে। আমার বিয়ের সময় হলে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে।”
সীমা মাথা হেলালেন,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি কিছুই বলছি নি। তবে দেখিস, মেয়েটা অনেক স্পষ্ট আর সাহসী। একটু খেয়াল করিস। আর সুন্দর হলে তো..”
মাহির আবার কথা কেটে হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আচ্ছা, আম্মু। এবার খাবার দেও, খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
সে রান্নাঘর থেকে খাবারের ঘ্রাণ নিতে নিতে হাসিমুখে তার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। নিজের রুমে ঢুকে গোসলের জন্য পানি চালু করল। শাওয়ারের পানি মুখমণ্ডল এবং শরীরের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল।
গোসলের সঙ্গে সঙ্গে তার মনে সারাদিনের ক্লাসরুমের মজার মুহূর্তগুলো ভেসে উঠল—ছাত্রদের উত্তেজনা, মজার প্রশ্ন, সোরায়ার সাহসী উদ্ভাবনী প্রশ্ন। মনে মনে সে হেসে ফেলল, ভাবল কতটা অন্যরকম আনন্দ আজকের দিন নিয়ে এসেছে।
রেস্টুরেন্ট ~
হলঘরের পরিবেশ তখন নিস্তব্ধ। গোলাপের সুবাস আর ঝাড়বাতির আলোয় যেন এক স্বপ্নময়তা ভাসছে, গ্লাসের আভায় প্রতিফলিত হচ্ছে। মিরায়া আর রায়ান দু’জনই চুপচাপ খাবার শেষ করছে, তবে তাদের চোখে চোখে চলেছে নীরব কথোপকথন, অদৃশ্য টান।
মিরায়া খাওয়ার এক পর্যায়ে রায়ানের হাতে বাধা দিয়ে বলে উঠলো-
“আর পারছি না তো।”
রায়ান জোর করলো মিরায়াকে-
“আর অল্প একটু তো ।”
মিরায়া আবার হাত ঠেলা বলল-
“সত্যিই আর পারবো না। অনেক হয়েছে জোর করবেন না প্লিজ। সত্যিই পারছি না।”
রায়ান বুঝলো সত্যি হয়তো অনেক হয়ে যাবে জোর করলে। তাই সে আর জোর না করে আঙুলের ইশারায় রেস্টুরেন্ট এর ম্যানেজার কে ডাকলো।
ঠিক তখনই দূর থেকে ভদ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন হোটেল ম্যানেজার। কালো স্যুটে, মাথা সামান্য নত করে তিনি দাঁড়ালেন টেবিলের পাশে। গলায় অবিশ্বাস্য ভদ্রতা—
—“স্যার, ম্যাডাম… আপনাদের জন্য সার্ভ করা আমাদের জন্য গৌরবের। আজকের সন্ধ্যা আমাদের রেস্টুরেন্টের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ধন্যবাদ, আমাদেরকে এই সম্মান দেওয়ার জন্য।”
তার প্রতিটি শব্দে ছিল শ্রদ্ধা, যেন তিনি কোনো সাধারণ অতিথির সাথে নয়, রাজার দরবারের অতিথির সাথে কথা বলছেন।
মিরায়া একটু অস্বস্তি বোধ করল—এই অতিরিক্ত সম্মান যেন তাকে আরও বেশি দমবন্ধ করে তুলছে। কিন্তু রায়ান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, গলা স্থির রেখে শুধু বলল—
—“The bill?”
ম্যানেজার দ্রুত সাড়া দিয়ে হালকা হাসি দিলেন, তারপর পাশে দাঁড়ানো স্টাফকে ইশারা করলেন বিল আনার জন্য।
মিরায়া ভেবেছিল রায়ানই নিজেই হয়তো বিলটা পে করবে, কিন্তু হঠাৎ দেখল—রায়ান নিজের ওয়ালেট বের করে (চকচকে কালো লেদারের) ভেতর থেকে সে একটা প্লাটিনাম আমেরিকান কার্ড বের করল। কার্ডটা একেবারে নিখুঁতভাবে আঙুলের ফাঁকে ঘুরিয়ে সে মিরায়ার দিকে বাড়িয়ে দিল।
—“Pay the bill, baby.”
মিরায়া হতবাক। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল তার দিকে।
—“আমি? আমি কেন? বিল তো আপনিই পে করতে পারেন…”
রায়ান ঠোঁটের কোণে সেই পরিচিত রহস্যময় হাসি টেনে নিয়ে ধীর গলায় বলল—
—“কারণ এই কার্ডে আমি ছাড়া একমাত্র অধিকার তোমারই আছে, হৃদপাখি। টাকার মালিক আমি, কিন্তু এর অধিকারী শুধু তুমি। আমার প্রতিটি আয়, প্রতিটি ক্ষমতা—সবটাই তোমার দিকে ঘুরে আসে। তাই আজ প্রথমবারের মতো, আমি চাই তুমি আমার হয়ে এই বিলটা দাও। যেন বুঝতে পারো… এই পুরো পৃথিবীটায় আমার যা কিছু আছে, তার ভাগীদার একমাত্র তুমি।”
তার চোখদুটোতে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন কথার বাইরেও অনেক কিছু বলা আছে।
মিরায়ার বুক কেঁপে উঠল। এত বড় দায়িত্ব! সে কার্ডটা নিতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, কার্ড নয়, যেন রায়ানের পুরো জীবনটার এক অদৃশ্য দড়ি তার হাতে তুলে দিচ্ছে।
ম্যানেজার স্টাফ বিল এনে রাখল টেবিলে। মিরায়া দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে অবশেষে কার্ডটা দিল। স্টাফ ভদ্রভাবে মাথা নত করে কার্ড নিয়ে গেল। মুহূর্তটা এতটাই নীরব ছিল যে, মিরায়ার হৃদস্পন্দন পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল।
রায়ান তখন একটু ঝুঁকে, তার কানে ফিসফিস করে বলল—
—“বেইবি, কেন ইউ সি? এখনে তুমি শুধু অতিথি নও… তুমি আমার সাম্রাজ্যের রানী।”
মিরায়ার শ্বাস আটকে এলো। সে কার্ড ফিরিয়ে নিল স্টাফের হাত থেকে, কিন্তু হাতটা এত কাঁপছিল যে রায়ান তার আঙুল আলতো করে চেপে ধরল। চোখে এক অব্যক্ত হাসি—নির্লজ্জ, অথচ অদ্ভুতরকম উষ্ণ।
বিল পে করার পরপরই রায়ান মিরায়ার কোমরে হাত রেখে জরিয়ে ধরল। রায়ানের হঠাৎ স্পর্শে মিরায়ার শরীর কেঁপে উঠল । মিরায়া রায়ানের কোর্ট টা শক্ত করে ধরে রইল। রায়ান মিরায়াকে এমন লজ্জা পেতে দেখে বেশ মজা পেল যেটা তাকে আরো একটু বাড়াবাড়ি করার জন্য উস্কানি দিল।
রায়ান মিরায়াকে-
“বাড়ির দিকে যাওয়া যাক তাহলে? রাত হয়ে যাবে একটু পর।”
মিরায়া ভয়ে হালকা উপর নিচ মাথা নাড়ালো-“হুঁ।”
রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বের হয়ে রায়ান মিরায়ার পাশে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা ঢেউ, চারপাশে শহরের আলো আর দূরের গাড়ির হালকা হেডলাইট—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
রায়ান হঠাৎ মিরায়ার কোমর ধরে টেনে আরো কাছে নিয়ে এলো। মিরায়া হকচকিয়ে তাকাল। সে কথা বলতে চাইল
—“রায়ান ভাইয়া… অনেক খাওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবে হাঁটলে হয় না? আমি এমনিতেই হাটতে পারছি ন… ।”
কিন্তু তার কথার শেষ হওয়ার আগেই রায়ান আরেকটু কাছে টেনে নিল, কোমরে হাত শক্ত করে ধরে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো। তার চোখে সেই অনড়, স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস—যা মিরায়ার হৃদয়টা আরও দ্রুত ধকধক করতে বাধ্য করল।
মিরায়া রায়ানের এমন হঠা্ৎ কোলে তুলে নেওয়াতে মৃদু আওয়াজ করল-“ওহ্!”
রায়ান মিরায়ার কানের কাছে মুখ এনে বলল-
“এমন আওয়াজ বের করার মতো কিছু করেনি হৃদপাখি। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে না একদম। এখন কিন্তু আমরা রেস্টুরেন্ট এ নেই গাড়িতে যাচ্ছি।”
মিরায়ার গলা শুকিয়ে গেল রায়ানের কথা শুনে।মিরায়া হালকা গলায় বলল-
“আমাকে নামিয়ে দিন পড়ে যাবো। আমি হেটে যাচ্ছি তো নিজের ইচ্ছেতে। জোর করতে হবে না। ”
রায়ান মিরায়াকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল-
“জোর করা হচ্ছে না তোমাকে, কেয়ার করা হচ্ছে মাই হার্ট-বার্ড। চুপ চাপ আমার কোলে থাকো।”
রায়ান নরম স্বরে বলল—
—“হৃদপাখি, তুমি বুঝো না… তোমাকে এই মুহূর্তে হাতছাড়া করতে পারব না। আমি চাই তুমি আমার কাছে থাকো, শুধু এই মুহূর্তটা আমাদের। আর হ্যাঁ, হাটার কথা ভুলে যাও…।”
মিরায়ার গাল লাল হয়ে উঠল। সে একটু পশ্চাদপদ নিল, কিন্তু রায়ানের শক্ত হাত এবং গভীর দৃষ্টি তারকে আর কোনো দিকে সরতে দিল না।
সে হালকা লজ্জায় মাথা নামাল, কিন্তু রায়ানের কোলে থাকাটা এক অদ্ভুত নিরাপত্তা আর উত্তেজনার মিশ্রণ দিচ্ছিল।
রায়ান পূর্বের ন্যায় একই ভাবে মিরায়াকে গাড়িতে বসিয়ে দিল। রায়ান মৃদু চুমু দিয়ে তার কপালে আদর করল। মিরায়ার হাত সামান্য ঘুরলো, কিন্তু সে আর কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না। পুরো মুহূর্তটা যেন থমকে গেছে—শুধু নিঃশ্বাস, নরম বাতাস, আর দু’জনের হৃদস্পন্দনের ছন্দ।
রায়ান তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। রায়ান গাড়িতে উঠে বসে মিরায়ার দিকে ঝুঁকে গেল তার সিটে বেল্ট বাঁধতে। হঠাৎ মিরায়া হালকা রায়ানকে দেখে চমকে গেয়ে সিট মুভ করার বাটনে চেপে ফেলে। সাথে সাথে তার সিটে টা একদম নিচু হয়ে যায় আর রায়ান তার উপরে পড়ে যায় নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে।
হঠাৎ নিচে ঝুকে গিয়ে মিরায়া ভয় নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়। অপরদিকে রায়ান মুগ্ধ দৃষ্টিতে মিরায়ার ভয় মাখা চেহারাটার সৌন্দর্য লুফে নিতে থাকে নিজের দৃষ্টি দিয়ে।
মিরায়া নিজের অবস্থা সামলে নিয়ে মিটিমিটি নিজের চোখ দুটো খুলেই রায়ানকে তার মুখ বরাবর একদম সামনে দেখতে পেল। মিরায়ার ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। রায়ানের ও নিজেকে ধরে রাখতে খুব কষ্ট হতে শুরু করলো। রায়ান নিজেকে সামলে নিয়ে মিরায়ার উদ্দেশ্যে বলল-
“ডোন্ট ওয়ারি। আমি ঠিক করছি সিটটা। ডোন্ট প্যানিক বেইবি।”
হঠাৎই মিরায়ার চোখে অশ্রু জল জল করে উঠলো। রায়ান মিরায়ার এমন অস্বস্তি আর নিতে পারছিল না তাই সে আবার সিট টা উপরে তুলতে বাটনটাতে চাপে। হঠাৎই গাড়ির সিটে টা উপরে উঠতেই মিরায়ার নরম ঠোঁট রায়ানের বাম গালে লাগলো।
ঘটনাটা এতই দ্রুতগতিতে হলো যে দুজনের কেউই বুঝতে পারলো না। মিরায়া বুঝতে পারার সাথে সাথেই নিজের ঠোঁট আড়াল করে ফেলো নিজের হাত দিয়ে। অপরদিকে রায়ান এখনো আশ্চর্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
গাড়ির ভিতরে বসে ছিল রায়ান আর মিরায়া। জানালা কিছুটা খোলা থাকায় বাইরের গরম বাতাস ঢুকছে, গরম এবং আদ্রতার মিশ্রণ যেন সরাসরি ত্বকে স্পর্শ করছে। গরমের কারণে মৃদু ঘাম ছুঁয়ে যাচ্ছে মিরায়ার কপাল এবং রায়ানের গলার দিকে।
রায়ানের চোখ মিরায়ার দিকে হঠাৎ ধরা দিয়ে ঝলসানো সৌর্যর মতো ঝাপসা উষ্ণতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। গাড়ির ভিতরটা এক ধরনের ঘন কামনার আবহে ভরা, যেখানে দমবন্ধ করা গরমের সঙ্গে মিলেমিশে তাদের শরীরের কাছে কাছাকাছি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও প্রবল হচ্ছে।
মিরায়া একটু লেজেপাতলা হয়ে বসে আছে, কিন্তু রায়ানের চোখে যে আগুন, তা তাকে কিছু বলার আগেই অনুভব করিয়ে দিচ্ছে—কীভাবে এই মুহূর্তটি শুধু তাদের দুজনের জন্য, আর বাইরে থাকা গরম বাতাস যেন সেই মুহূর্তের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গাড়ির ছোট্ট স্পেসে তাদের নিঃশ্বাস মিলেমিশে যাচ্ছে, হাতের হালকা ছোঁয়ায় একটা নরম কম্পন গাড়ির ভিতরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। রায়ানের হাতে মিরায়ার হাতের স্পর্শ, চোখের খোঁচা—সব মিলেমিশে গরম আবহাওয়াকে আরও কামনাময় করে তুলছে।
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২১
রায়ান যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না খুব চেষ্টা করার পরও। রায়ান হালকা ঝুঁকে আরও কাছে এলো, তার হাত হালকা স্পর্শে মিরায়ার হাত ছুঁয়ে গেল, আর মিরায়া অজান্তেই তার হাতটিকে আরও কাছে টেনে নিল।
—“হৃদপাখি,” রায়ান নরম গলায় বলল, “এই মুহূর্তটা শুধু আমাদের। সময় থেমে থাকলে কেমন হত, তাই না?”