আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪
অরাত্রিকা রহমান
পরের দিন সকাল বেলা,
চৌধুরী বাড়িতে এক প্রকার রাজকীয় আয়োজন চলছে বাড়িতে বড় বউ আসছে বলে কথা_তাও প্রথমবার এর মতো পা রাখবে শশুর বাড়িতে। এমনিতে তারাই চট্টগ্রামে যেতেন শফিক রহমানের বাড়িতে মিরায়াকে দেখতে যদিও মিরায়ার এ ব্যপারে কোনো ধারণা নেই। সে জানতো রামিলা চৌধুরী তার বোন রোকেয়া বেগমের সাথে দেখা করতেই যেতেন।
সকালে রুদ্র বিছানা ছাড়তে বাধ্য হয় এক বিকট শব্দে। শব্দ টা ছিল ভ্যাকিউম ক্লিনার এর। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা নিচে নামলো। রুদ্র নিচে নেমে সম্পুর্ন বাড়ি পরিষ্কার করা দেখে আশ্চর্য হলো।
-“আম্মু ? আম্মু?”
রুদ্র তার মাকে ডাকতে শুরু করলে রামিলা চৌধুরী উত্তর করেন- ” কি! কি হয়েছে টা কি চেঁচাচ্ছিস কেন?”
-“এসব কি চলছে? বাড়িতে কি কোনো মেহমান আসবে আজ?”
অতি আনন্দের সাথে রামিলা চৌধুরী বললেন- “হ্যাঁ।”
-“কে আসবে? যার জন্য এত আয়োজন?”
-“তোর ভাবি আসবে ঢাকায়। আর শোন তোকেই আনতে যেতে হবে। তাই আজ company তে যেতে হবে না। ফ্রেশ হয়ে রওনা দে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে মিরা আর সোরায়া কে নিয়ে আয়।”
রুদ্রর মাথায় হাত_
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“কিহ্! মিরা_মানে মিরা ভাবি আর সোরায়া! ঢাকায় আসবে কেন ওরা হঠাৎ?”
-“কেন আসবে মানে কি! বাড়ির বউ বাড়িতে আসবে না? আর মিরা মিরা করিস কেন ভাবি হয় তোর।”
-“উফ্ আম্মু! মিরা আর সোরা আমার অনেক ছোট তাই তো ছোট বোন ভেবে তুই করে বালি । আর আমার ভাইয়া মানে তোমার গুণধর বড় ছেলে যেই পেচ লাগিয়ে দেশ ছেড়েছে ভাবিকে কি ভাবি বলে সম্বোধন করা সাজে?”
-“মিরার সামনে বলা না গেলেও আমাদের সামনে তো বলবি নাকি। আর তোর ভাই আমার ছেলে না তোর বাপের ছেলে। ওই ঘাড়তেড়া আমার ছেলে না একদম আদর্শ বাপের আদর্শ ছেলে হইছে। আর এই দুজনের মাঝখানে আমি পরে গেছি।”
-“আচ্ছা আম্মু তুমি কি ভেবে দেখেছ মিরা এই বাড়িতে আসেছে ভাইয়া জানতে পারলে কি হবে। ও তো মিরার অস্তিত্বই সহ্য করতে পারে না।”
রুদ্রর কথা গুলো রায়হান চৌধুরী শুনে রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন-
“এটা ওর বাড়ি না, আমার বাড়ি। আমি ঠিক করবো কে থাকবে আর কে থাকবে না। ও বলার কে এই বাড়িতে কি হবে না হবে। মিরা আমার পুত্রবধূ আর এই সত্য যদি আমার আহাম্মক পুত্র না বুঝে ওকে এই বাড়িতে কখনো পা রাখতে হবে না তোর ভাইয়াকে বলে দিস।”
নিজের সব কথা বলে রায়হান চৌধুরী বাড়ি থেকে Chowdhury group of company- এর দিকে রওনা দেয়। রুদ্র আজ আর বাবার সাথে অফিসে যাচ্ছে না। তাকে এখন ভাইয়ের বউ, তার চেয়ে ৮-৯ বছরের ছোট ভাবি ও তার বোনকে আনতে যেতে হবে।
নাস্তা শেষে রুদ্র গাড়ি বের করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
আমেরিকায়~
এক নতুন সকাল। রায়ান যথারীতি তার শারীর চর্চা শেষে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে। আজ তার মুখে ছিল এক রহস্যময় হাসি। যেন মনে হচ্ছে খুব দ্রুত তার কোনো একটা চাওয়া পূরণ হবে।
রায়ান নিজের নাস্তা শেষ করে নিজের ল্যাপটপ এ বসে বাংলাদেশের বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইট দেখছিল নিজের কম্পানির জন্য । এমন সময় রায়ানের ম্যানেজার ম্যানেজার তাকে কল করেন। রায়ান ও কলটা রিসিভ করে স্বাভাবিক ভাবেই –
ম্যানেজার- “Good morning ,sir. ”
রায়ান- “Good morning.. What’s the matter?”
ম্যানেজার- “Actually sir, you were nominated for an award and the award show is happening this evening.”
রায়ান- “Yeah, I was informed about it. I will go, inform them . Is there any other problem?”
ম্যানেজার- ” But sir, one week ago you said not to have any official work today I had a plan. So, have you canceled that plan?”
রায়ানের কপালে হালকা চিন্তার রেখা পরে ম্যানেজারের কথা শুনে। নিজের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ তার একটা বাইক রেস এ যাওয়ার কথা।
বাইক রাইড করা রায়ানের একমাত্র শখ যেটা সে হাজারো কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও সর্বোপরি অগ্রাধিকার পায়। সে বরাবরই বাইক রাইড করতে পছন্দ করে। তার কাছে কাজের চাপ থেকে মুক্তি দিয়ে আনন্দ এনে দেওয়ার বিষয়টি কেবল বাইক রাইডিং । আর এখন যদি রেস এ সে না যায় তাহলে তার বাইকার হিসেবে গড়ে তোলা পরিচিতি নষ্ট হয়ে যাবে।
রায়ান খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বসে রইল । পরবর্তীতে ভেবে ম্যানেজার কে উত্তর করে-
“These two plans are totally different and the timing too. So it doesn’t matter. I can handle it. And listen don’t wait for me , go to the award ceremony yourself I will be there in perfect time.”
ম্যানেজার-“okay sir. See your there.”
নিজেদের কথা শেষ হলে রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মেরে নিজের চুল সামান্য খামচে ধরে আওড়ালো-
“ধ্যাত তেরিকি! এত বড় বিজনেসম্যান হয়ে এত বড় প্রতিষ্ঠান চালিয়ে এই ধরনের ভুল কিভাবে করলাম।”
রায়ান তাও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বলল-
“আরে এই সব কিছুই না। You are the Rayan chowdhury. You can do everything.”
এই বলে রায়ান বিকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আসলে বিকালে বাইক রেস আর তার পরপরই সন্ধ্যায় অফিসিয়াল প্রোগ্রাম। সে ভেবেছে একসাথে দুটোই সামলে নেবে যদিও চাইলেই সে প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল করতে পারতো । কিন্তু রায়ান কখনো কথার খেলাপ করে না। যেহেতু কথা দিয়েছে সে যাবে তার মানে তাকে যেতেই হবে।
বিকালটা যেন ছিল অন্যরকম উত্তেজনায় ভরা। আকাশটা ঝলমলে নীল, সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে নয়, একপাশে হেলে পড়েছে—আলোটা এমনভাবে রাস্তায় পড়ছে, যেন রেসের ট্র্যাক নিজেই উঁকি দিচ্ছে রায়ানের পায়ের ছায়ায়।
রায়ান আয়নায় চোখ রাখল। মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস—চোখে আগুন। ধীরে ধীরে সে নিজের রাইডিং গিয়ার পরে নিল। কালো-লাল কম্বিনেশনের লেদার স্যুট, পিঠে তার সিগনেচার “R” সিম্বলটা জ্বলজ্বল করছে, ঠিক যেন আগুনের মতো জ্বলছে তার ইচ্ছেশক্তি। গ্লাভসগুলো পরার সময় সে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল—আজও একটা ইতিহাস লিখবে সে।
রেস ট্র্যাকে তখন থমথমে উত্তেজনা। হেলমেটটা পরে, রায়ান বাইকের কাছে এসে দাঁড়াল। সেটা ছিল একখানা কাস্টম ডিজাইন করা সুপারবাইক—“Shadow Beast”। ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই এমন গর্জন তুলল, যেন বিজয়ের ঘোষণার আগে শেষ সুর বাজছে। সিগন্যাল লাইট একে একে লাল থেকে হলুদ, তারপর সবুজ হতেই, একযোগে আরো কয়েকটি সুপারবাইক গর্জে উঠল—গর্জন নয়, যেন যুদ্ধের দামামা।
রায়ানের শুরুটা ছিল হিসেব করে—গতি নয়, প্রথমে পর্যবেক্ষণ। ট্র্যাকে তার চারপাশে ছিল ৪ জন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ:
Carlos “The Hawk” – ডান পাশ থেকে স্টার্ট নিয়ে সে হঠাৎ স্ন্যাপ টার্ন করে লেন ব্লক করতে চায়।
Kenji “Blade Drift” – এক্সপার্ট ড্রিফটিং-এ, বাঁক নিতেই তার অস্ত্র।
Luca “Nitro Devil” – যেকোনো সময় গিয়ার শিফট করে হঠাৎ গতি বাড়াতে পটু।
Meera “Steel Nerve” – ঠাণ্ডা মাথার প্রতিযোগী, মেন্টাল গেম খেলতে ওস্তাদ।
প্রথম বড় বাঁক। Carlos তার বাইককে তীরের মতো ঠেলে দেয় রায়ানের সামনে—লক্ষ্য, তাকে চেপে ধরে গতির ভারসাম্য নষ্ট করা।
রায়ান ঠিক ওই সময়ে তার বিখ্যাত ট্রিক ব্যবহার করে – “Phantom Brake”।
🚨 সে হঠাৎই ব্রেক টিপে হালকা গতি কমায়, কিন্তু সামনের চাকার অ্যাঙ্গেল এমনভাবে ঘুরিয়ে নেয় যে বাইকটা একটা অদৃশ্য ছায়ার মতো পিছলে যায়—Carlos ভেবে বসে রায়ান তার পেছনে পড়ে গেছে। অথচ রায়ান পাশের লেন দিয়ে এমন নিখুঁতভাবে ঢুকে যায় যে Carlos টায়ার স্লিপ করে হারায় ব্যালান্স।
➡️ 1st প্রতিপক্ষ আউট!
Kenji তখন ডান বাঁক আসতেই একের পর এক ড্রিফট শুরু করে—সে চায় ট্র্যাকে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিতে।
রায়ান জানে, শুধু গতি নয়, এ জায়গায় তাকে চাই ক্যালকুলেটেড অ্যাঙ্গেল + এয়ার প্রেসার কন্ট্রোল।
সে তার ট্রিক চালায় – “Scissor Lean”।
⚙️ বাইকটা দুইদিকে হেলে হেলে এমনভাবে কেটে যায় যে একে দেখে মনে হয় কেউ দু’টা কাঁচি চালাচ্ছে একসাথে! সে হ্যান্ডেলটা কাত করে এমন এক অ্যাঙ্গেলে ঘোরে, যেখানে বাইকটা কেবল ড্রিফট না, একইসাথে ট্র্যাকের গ্রিপ ধরে আগায়।
Kenji ভেবেছিল বাঁকে তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কিন্তু রায়ানের কৌশলে সে পাশ কাটাতে না পেরে বাইরে ছিটকে পড়ে।
➡️ 2nd প্রতিপক্ষ আউট!
Luca তখন Nitro Boost চালিয়ে দানবের মতো গতিতে ছুটছে। রায়ান তখনো তার গতি ধরে রেখেছে কিন্তু শীর্ষ গিয়ারে যায়নি। ঠিক শেষ ২০ সেকেন্ডে সে চালায় তার গোপন অস্ত্র – “Shadow Surge”।
🔧 এটা এমন এক সিস্টেম যা তার বাইকের ইঞ্জিন ও গিয়ারিং সিকুয়েন্সে আচমকা পরিবর্তন আনে, এবং বাইকটাকে সাময়িকভাবে অতিপ্রাকৃত গতিতে ঠেলে দেয়। তবে এটা চালাতে হয় নিখুঁত টাইমিং-এ, নাহলে ইঞ্জিন ওভারহিট করে।
রায়ান সেটা করে নিখুঁতভাবে। সে Luca-কে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়, আর Meera?
Meera রায়ানের উপর মানসিক চাপ দিতে চায়, ক্রমাগত হর্ন আর সাইড সুইপ চালিয়ে তার মনোযোগ ভাঙতে চায়।
কিন্তু রায়ান তখন চলে যায় এক অন্য জগতে—সে বেছে নিল তার বিখ্যাত ট্রিকটা: “Gravity Slide”।
রায়ান হ্যান্ডেলটা হঠাৎ ডানে ঘুরিয়ে হেলমেটটা একপাশে কাত করল, বাইকটা মাটি ছুঁইছুঁই করে এমনভাবে বাঁক নিল যে মনে হচ্ছিল সে একসাথে উড়ছে আর পিছলে যাচ্ছে! একদম নিখুঁত ব্যালান্স আর টাইমিং—চোখের পলকে সে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ওভারটেক করে সামনে চলে এল।
ট্র্যাকে তখন একটাই আওয়াজ—”RAYAN! RAYAN!”
শেষ ৫ সেকেন্ডে, সে তার “Nitro Pulse” চালু করল—একটা সিক্রেট বুস্ট সিস্টেম। বাইকটা গর্জে উঠল, এবং সে এমন গতিতে ছুটে গেল, যেন সময়কেও ফেলে পেছনে!হেলমেটের ভেতর সে এক বিশেষ সাউন্ড মুড চালু করে, যেটা বাইরের আওয়াজ ব্লক করে দেয়। শুধু বাইকের ইঞ্জিন আর ট্র্যাকের কম্পন—সে তখন রেসের সাথে একীভূত।
শেষ মুহূর্তে, বাঁক, গতিবেগ, এবং ধৈর্য—এই তিনের নিখুঁত মিশ্রণে রায়ান ফিনিশ লাইনে পৌঁছে যায় 0.3 সেকেন্ড আগে।
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩
সমস্ত প্রতিপক্ষ তখন থমকে যায়। চারদিক থেকে ক্যামেরা, চিৎকার, হাততালি। রায়ান ধীরে বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলল—চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, মুখে সেই আত্মবিশ্বাসী হাসি।
কিন্তু তার মুখে কোনো উল্লাস নেই—শুধু একটা মৃদু হাসি।
“এখনো অনেক বাকি। আমি রেস করি জেতার জন্য না… নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য।