আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৪
অরাত্রিকা রহমান
রিমির বাড়ি~
রিমি মাত্র নামাজ পড়ে উঠেছে। এর মধ্যেই তার ভাই বাড়িতে ঢুকে হট্টগোল শুরু করে। রিমি কিছু বলছে না- জানে কিছু বলে লাভ নেই। বাড়ির সব জিনিস পত্র মাটিতে ফেলে এক হুলুস্থুল কাণ্ড করছে। রিমি বিছানার উপরে এক কোনে বসে হাঁটু মুড়ে কান্না করছে। তার ভাই তার পড়ার টেবিলের উপর থেকে সব বই খাতা ফেলে দিয়ে তার ব্যাগে কিছু খুঁজছে। তার পাশে ছড়ানো ছিটানো জামাকাপড়।
-“কিরে মা*গী, এই কয়দিন কি ভাতার জুটে নাই। ব্যাগে টাকা না কেন? কই উড়াই আইছোস সব টাকা।” রিমির ভাই জোরে রিমির ব্যাগটা ফ্লোরে আছার দিয়ে বলল।
রিমি আতকে উঠলো ভয়ে কিন্তু এখন তার এইসব অপমান আর বিচ্ছিরি কথা সহ্য হচ্ছে না তাই সাহস নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো-
“মুখ সামলে কথা বলো। টাকাও আছে আর সাহসও আছে। আমি আর তোমাকে টাকা দিবো না। নিজের প্রয়োজন নিজে মিটাও। টাকার দরকার পরলে কাজ করো না হয় ভিক্ষা করো। আমার কাছে তোমার উপরে নষ্ট করার মতো টাকা নাই।”
রিমির চেঁচিয়ে উঠা তার ভাইয়ের ইগোতে লাগলো। সে রিমিকে চুলের মুঠি ধরে বিছানা থেকে নামায়। রিমির ব্যাথা কঁকিয়ে উঠে তার হাত ধরে থাকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“কি কইলি ? তুই আমারে টাকা দিবি না? তুই টাকা দিবি না তো তোর দরকার কি আছে আমার। বাইরো এই বাড়িত্তে।”
এই বলে সজোরে এক থাপ্পর মারে। রিমি ফ্লোরে গিয়ে পরলো সোজা। এক নাগারে কেঁদে যাচ্ছে শুধু। আজ শুক্রবার তার টিউশনি নেই, একটা কফি শপে প্রতিদিন লাইভ গান পারফর্ম করে সেটারও অফ আজকে যদিও এই ব্যাপারে কেউ জানে না। কারণ মেয়েদের এমন কাজ মানুষ খারাপ চোখে দেখে। মাসের শেষ প্রায়, হাতে টাকা নেই একদম, যা আছে সেটা তার নিজের হাত খরচ সর্বনিম্ন ধরে হলেও কম পরবে।
-“কিরে মা*গী কথা কানে যায় না নাকি? হয় টাকা বের কর আর নাইলে বাইরো এই বাড়িত্তে।”
রিমি কাঁদতে কাঁদতে নিজের ওড়না সামলে শুধু নিজের ফোনটা নিয়ে বের হয়ে গেল। এইটা প্রথমবার নয় যে তাকে টাকা না দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এর আগেও অনেকবার এটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। টাকা সবসময় থাকতো না যাই থাকতো সব তার ভাই জোর করে নিয়ে নিতে বলে মাঝে মাঝে টাকা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতো সালোয়ারের পকেটে। আজও তাই করেছিল।
নিজের এলাকা থেকে বের হয়ে সোজা ক্যাম্পাসের রাস্তায় আসে রিমি। একটা টঙের দোকানে বসে আছে চুপচাপ, চোখ ছলছল করছে কিন্তু কাঁদছে না। নিজের এলাকায় থাকলে লোকে হাজারটা কথা শুনাবে, ছেলেরা অসভ্যতামি করবে তাই এই জায়গায় এসেছে আর এখানে রাস্তার মাঝে কাঁদার জোর টুকুও নেই। রিমি কিছু বুঝতে না পেরে একবার ভাবলো রুদ্র কে কল করবে পরে আবার ভাবলো- “কেন একটা মানুষ কে নিজের জন্য বিব্রত করবো। আমার কপাল খারাপ এতে কারো দোষ নেই।”
রিমি রুদ্রর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই মিরায়ার কথা মাথায় আসে তার। রিমি একটু শান্ত হওয়ার জন্যই কল করে মিরায়াকে, বস্তুত নিজের নেশা খোর ভাই আর প্রিয় বান্ধবী মিরায়াকে ছাড়া তার চেনা কেউই নেই।
মিরায়া নিজের ঘরে বসে ছিল নামাজের পর একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। বাড়িতে সবাই এলে একসাথে দুপুরে খাওয়া দাওয়া হবে। এমন সময় রিমির কল আসে। মিরায়া রিমির কল দেখেই খুশিতে ফোনটা রিসিভ করে-
মিরায়া-“হ্যালো, রিমি? জান কি করিস। জানিস তোকে আর ক্যাম্পাসটা কি মিস করছি আমি। আজ দেখা হলো না। কি করিস তুই?”
রিমি কষ্টে হেঁসে পলক ফেলতেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল চোখ দিয়ে। গলা সামান্য ভেঙে গেছে। সেভাবেই কথা বলার চেষ্টা করল-
“হ.. হ্যাঁ রে, আমিও খুব মিস করছি তোকে। আমি বসে আছি একটু বাইরে এসেছি।”
মিরায়া বিছানায় উঠে বসলো- “কিহ্! তুই একা ঘুরছিস? আমাকে বলতি আমিও বের হতাম।”
রিমি চোখের পানি মুছে বলল-“আরে পাগল, ঘুরতে না বোর লাগছিল তাই বের হয়েছি।”
মিরায়া খুশি মনে বলল-“বোর লাগছে তো আমার কাছে চলে আয়। একসাথে থাকলে আর বোর লাগবে না। এমনিতেই আমার ভালো লাগছে না।”
রিমি একটু কাঁদো কাঁদো মুখ হেঁসে বলল-“তোর ভালো লাগছে না কেন? তোর তো ছোট বোন আছে। তোর আদরের বনুর সাথে থাক।”
মিরায়া একটু রাগি ভাব নিয়ে বলল-“আরে বনুও বাইরে গেছে আর বান্ধবীর সাথে। কি উপন্যাস পড়ার মধ্যে যে পড়েছে ও কি বলবো। কিছু টাকা পেলেই বা কিনতে চলে যায় আবার কিনার দুই দিনের মাথায় পড়ে শেষও করে ফেলে জানিস। আর এই দিকে আসল বই পড়ার সময় তার মাথায় কিছু ঢুকে না।”
রিমি এবার সত্যি হেঁসে ফেলল-“ওহ্ আচ্ছা এই ব্যাপার। থাক বাচ্চা মেয়ে ছেড়ে দে যদি উপন্যাস পড়ে মজা পায় সমস্যা কি খারাপ কিছু তো না।”
মিরায়া মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল-“কি ধরনের উপন্যাস পড়ে সেটা তো আর বলিনি বললে আর বাচ্চা মনে হবে না তোর ওকে।”
মিরায়া কথা পাল্টে রিমিকে একপ্রকার জোর দিয়ে বলল-
“রিমি জান আমার। চলে আয় না আমার বাড়ি প্লিজ।”
রিমি একটু ভাবলো এইভাবে আর কতক্ষনইবা বাইরে থাকবে। আবার এমন অবস্থায় মিরায়ার বাড়িতে গেলেও তো খারাপ দেখায়। রিমি মিরায়ার কথায় দ্বিধায় পড়ে গেলো। তারপর না বলার ভাব নিয়ে অযুহাত দিতে বলল-
“না রে জান। আমি বাড়ির জামাকাপড়েই বের হয়েছি। এইভাবে কিভাবে আসবো বল। অন্যদিন যাব ঠিক আছে। রাগ করিস না।”
মিরায়া এবার জোর দেখিয়ে বলল-” না ঠিক নেই। বলেছি আসতে মানে আসবি। নাহলে সত্যিই রাগ করবো। তোর সমস্যা হলে বাড়িতে এসে আমার কোনো জামা পড়ে নিস তুই আমি তো একই রকম, সমস্যা হবে না। আমি লোকেশন দিচ্ছি তুই আয় কেমন। বাই।”
এই বলে মিরায়া ফোন কেটে দিল। রিমি এখনো ভাবছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। আবার বাইরে থাকাও তার মন মানছে না। মিরায়া ফোনটা কেটেই চৌধুরী বাড়ির ঠিকানা পাঠিয়ে দিল। রিমিও আর কোনো রাস্তা না পেয়ে একটা রিক্সা করে রওনা দিল।
প্রায় ২০মিনিট পর~
মিরায়া দৌড়ে নেমে আসে নিচে রিমি চলে এসেছে। দরজা তাড়াতাড়ি খুলে দিয়ে রিমিকে জড়িয়ে ধোরল-
“এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে চলে এলি বাড়ি তো বেশ দূরে। আমি ভেবেছিলাম সময় লাগবে।”
রিমি একটু শান্ত ভাব নিয়ে মিরায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“আজ শুক্রবার তো। তাই রাস্তা ফাঁকা ছিল।”
মিরায়া রিমির হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসতেই রিমির চোখ প্রায় ছানা বড়া হয়ে গেল। চৌধুরী বাড়ি এতো বড় আর সুন্দরভাবে সুসজ্জিত হবে সে ভাবেই নি। রিমি একটু চোখ ঘুরিয়ে সবটা দেখে নিল। চোখে অন্য রকম মুগ্ধতা।
মিরায়া- “কিরে কোথায় হাড়িয়ে গেলি।”
রিমি মিরায়ার দিকে তাকিয়ে বলল- “তোর বাড়ি অনেক সুন্দর মিরা সেটাই দেখছি।”
মিরায়া হেঁসে মুখ চেপে বলল-“আমার বাড়ি না এটা। রায়ান আর রুদ্র ভাইয়ার বাড়ি। আমি তো শুধু থাকতে এসেছি।”
রিমি ভুলে মুখ ফোসকে বলে ফেলল-” রায়ান ভাইয়ার বাড়ি আর তোর বাড়ি কি আলাদা হলো নাকি একই তো।”
মিরায়া আড় চোখে তাকিয়ে বলল-“কি বললি তুই কাদের বাড়ি এক?”
রিমি জিভ কামড় দিয়ে মুখ বন্ধ করে ইশারা করল মিরায়ার দিকে যে ভুলে বলেছে। আর মনে মনে ভাবছে- “কি এক গোলোক ধাঁধা। নিজের শশুর বাড়িতে থেকে সেটাকে নিজের বাড়ি বলতে পারছে না মেয়েটা।”
মিরায়া তারপর স্বাভাবিক হয়ে রিমিকে তার রুমে নিয়ে যাবে এমন সময় রামিলা চৌধুরী নিজের ঘর থেকে বের হন। মিরায়া রামিলা চৌধুরীকে দেখতে পেয়ে রিমিকে টেনে উনার সামনে নিয়ে বলা শুরু করলো-
“দেখ মামণি, বাড়িতে মেহমান এনেছি। ও রিমি আমার একমাত্র বান্ধবী (রিমির দিকে আঙুল তুলে)।”
রামিলা চৌধুরী হাঁসি মুখে রিমির দিকে তাকাতেই রিমি হকচকিয়ে সালাম দেয়-
“আসসালামুয়ালাইকুম মামণি.. না মানে সরি আন্টি।”
রামিলা চৌধুরী মৃদু হেসে রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন-
“তুমি আর মিরার তো একই। মামণি ডাকো সমস্যা নেই মা। ভারি মিষ্টি নাম তোমার।”
রিমির চোখ একটু ছলছল করল। অনেক দিন পর তার সাথে এত মমতা নিয়ে কেউ কথা বলল আবার মাথায় আদর করল। রিভিও হেঁসে বলল-
“থ্যাংক ইউ মামণি। এমন অসময়ে এসে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত (একটু অদ্ভুত অস্বস্তিতে হেঁসে)।”
রামিলা চৌধুরী রিমির কাছে এসে কান ধরে শাসনের সুরে বললেন-
“এ আবার কেমন ধারা কথা হ্যাঁ। যখন ইচ্ছে তখন আসবে। নিজের বাড়ি মনে করো। ওকে?”
রিমি রামিলা চৌধুরীর আদুরে শাসনে অবাক হলেও তার মনে অন্যরকমের শান্তি অনুভব হলো। মিরায়া একটু মুখ বাঁকিয়ে বলল-
“ও বাবা এক মুহূর্তেই এতো আদর। শোন রিমি আমার আদরে ভাগ বসাবি না। এখন তো মনে হয় খালি কেটে কুমির ডাকলাম।”
রামিলা চৌধুরী আর রিমি হেঁসে উঠলো মিরায়ার কথায়। রিমি মিরায়া কে জ্বালাতে বলল-
“মামণি এক কাজ করুন। মিরায়া কে ত্যাজ্য করে আমাকে মেয়ে করে নিন।”
মিরায়া মুখ ফুলিয়ে নিল। রামিলা চৌধুরী আবারো হেঁসে রিমি আর মিরায়া দুজনকে বুকে টেনে নিলেন। রিমি মিরায়া দুজনেই দুষ্টু হেসে উঠলো । ভালোই বুঝতে পেরেছে যে দুজনই মজা করছিল একজন অন্যজনের সাথে।
তারপরই মিরায়া রিমিকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের একটা কুর্তি দেয় পড়ার জন্য। রিমি একটু হাত মুখ ধুয়ে সেটা পড়ে নেয়। আর তারপর
রিমি মিরায়ার ঘরেই বসে ছিল হঠাৎ মিরায়া বলল-
“রিমি চল তোকে বাড়িটা ঘুরে দেখাই। তোর ভালো লাগবে। ছাদটা অনেক সুন্দর ওইখানে চল।”
রিমিরও আর ঘরে থাকতে ভালো লাগছিল না তাই মিরায়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে। তারপরই মিরায়া রিমির হাত ধরে ঘরে থেকে বের হয় সেই সময়ই রামিলা চৌধুরী মিরায়াকে ডাকেন-
“মিরা… মিরা মা.. একটু এই দিকে আয় তো। দেখনা এই মিক্সি টার কি হলো চলছে না।”
মিরায়া রামিলা চৌধুরীর ডাকে শুনে রিমির দিকে তাকিয়ে বলল- ” রিমি তুই যা আমি মামণি কেন ডাকলো শুনে আসছি। এই দিকে থেকে সোজা যাবি একদম সোজা যেই ঘরটা আছে তার পাশেই ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। তুই যা কেমন আমি একটু পর আসছি।”
রিমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সাথে সাথে মিরায়া দৌড়ে নিচে গেল। রিমি একাই ছাদে যাওয়ার জন্য আগালো। ছাদের সিঁড়ির পাশের একদম সোজা রুমটাই রুদ্রর। রিমি ছাদে যাওয়ার পথে রুদ্র ওর রুমের ফাঁকা দরজার মধ্যে দিয়ে বিছানার উপরে একটা গিটার দেখতে পেল। রিমি নিজের একজন গিটারিস্ট। ছোট বেলায় নিজের তাগিদেই গিটার চালানো শিখেছিল পাড়ার বড়ো আপুর থেকে। আর গানের গলা ভালো থাকায় এখন সেটা কাজে লাগিয়েই একটা কফি শপে লাইভ গান পারফর্ম করে।
রিমি গিটার দেখে একটু কৌতূহলি হয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখতেই বুঝতে পারলো ভেতরে কেউ নেই। সে পা টিপে টিপে রুমটাতে ঢুকে আশেপাশে না দেখে সোজা গিটার টা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলো। রিমির নিজের ব্যক্তিগত কোনো গিটার নেই তাই গিটার তার শখের জিনিসের মতো যেটা শখ শখই রয়ে গেছে। কফি শপ থেকে গিটার প্রভাইড করা হয় গান গাওয়ার জন্য। একা ঘরে একটা গিটার হাতে পাওয়া থির জন্য লটারি পাওয়ার সমান। রিমি না চাইতেও রুদ্রর বিছানায় বসে রুদ্র গিটার টা একটু টুংটাং শব্দ তুলে বাজিয়ে দেখতে লাগলো।
নিচে~
মিরায়া রামিলা চৌধুরীর কাছে গিয়ে দেখলো মিক্সার মেশিন চলছে না। মিক্সিতে একটা চালের জানা আটকে গেছিল তাই বন্ধ হয়ে গেছিল। মিরায়া মিক্সিটা আবার ধুয়ে এনে দেওয়ার পর আবার চলতে শুরু করে।
রামিলা চৌধুরী- “এখন তো বেশ চলছে। তখন কি হয়েছিল কে জানে।”
মিরায়া- “চাল গুঁড়ো করছিলে না, একটা দানা ভিতরে আটকে গিয়েছিল তাই চলছিল না। এখন ঠিক আছে সব।”
হঠাৎ বাড়িতে রায়ান, রুদ্র আর রায়হান চৌধুরী প্রবেশ করে। নামাজ শেষ তিনজনই বাড়ি ফিরে তাগাদা দিতে শুরু করলো খাওয়ার জন্য।
রায়হান চৌধুরী- “কি গো মহারানি! খাবার দেবে না নাকি।”
রুদ্র -“আম্মু জলদি খাবার দেও তো খুব খিদে পেয়েছে।”
রায়ান-“হ্যাঁ, আম্মু খুব খিদে পেয়েছে তাড়াতাড়ি।”
সবার সাথে মিরায়াও সুর মিলিয়ে বলল-
“মামণি আমারও। পেটে ইঁদুরের বাচ্চা গুলো লাফাচ্ছে।”
রায়ান মিরায়ার কথা শুনে চোখ বাঁকিয়ে তাকালো –
“বিড়াল ছানার মা হয়ে আশ মেটেনি নাকি? এখন আবার পেটে ইঁদুরের বাচ্চা!”
রুদ্র, রায়হান চৌধুরী আর রামিলা চৌধুরী হেঁসে উঠলো মিরায়া একটু লজ্জায় পড়ে গেল। মিরায়া রেগে গেল রায়ানের উপর জেদ করে খাবে না এই ভেবে বলল-
“মামণি আমি খাবো না। পেটের ইঁদুরের বাচ্চা গুলো মরে গেছে মাত্র। তোমার ছেলেকে বলো চিন্তা না করতে আর। আমি আমার ঘরে গেলাম।”
এই বলে মিরায়া রাগে নিজের ঘরে চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে। এই দিকে রিমিকে যে ছাদে যেতে বলেছে তার হুঁশ নেই। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল।
এইদিকে রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে রায়হান আর রামিলা চৌধুরী। রায়ান তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো-
“কি হয়েছে ? এইভাবে কি দেখছো তোমরা?”
রায়হান চৌধুরী চেঁচিয়ে বললেন রামিলা চৌধুরীকে-
“রামিলা এইটা আমার ছেলে না। হসপিটালে চেঞ্জ হয়ে গেছে আমি নিশ্চিত।”
রামিলা চৌধুরী পাত্তা দিলেন না তবে রায়ান বলল-
“মানে কি! আমি তোমার ছেলে না মানে?”
রায়হান চৌধুরী আবার চেঁচিয়ে বললেন-
“হাদারাম, বউ রাগ করে খাবে না বলল তোর কানে যায় নি। আমার বউমা খেতে না নামলে তুইও খেতে পাবি না। ”
রায়ান হা হয়ে রইল সে আসলে বুঝতে পারেনি মিরায়া সত্যি সত্যি খাবে না বলে রাগ করেছে। বাবার কথায় আর কিছু না বলে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে শুধু বলল-
“আম্মু, আমার বউ না খেয়ে থাকলে আমি খাবো এটা কেন মনে হলো তোমার বরের। আমি আমার বউকে নিয়ে নামছি খাবার টেবিলে দেও।”
রায়হান চৌধুরী আবার চেঁচিয়ে বললেন-
“রামিলা তোমার ছেলের ব্যবহার দেখেছো! নিজের মা কে নিজের বাবার ব্যাপারে বলতে ‘আম্মুর বর’ তকমা ব্যবহার করছে। ওকে তো আমি..! ”
-“চুপ করবেন আপনারা?” রামিলা চৌধুরীও চেঁচালেন।
এর মাঝেই রুদ্র বলে উঠলো-“ধুর, তোমরা চেঁচাও আমি আমার ঘরে গেলাম। খাওয়ার সময় ড়লে ডাক দিও।”
এই বলে রুদ্র নিজের ঘরে চলে গেল। ড্রয়িং রুমে রায়হান চৌধুরী ও আর দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে চলে গেলেন। এইদিকে রামিলা চৌধুরী সবার অবস্থা দেখে শ্বাস ছেড়ে বললেন-
“সব জেদ ওয়ালা আল্লাহ আমার কপালে দিছে। যেমন, বাপ তার তেমন ছেলে আবার ছেলে বউও পাইছে ওমনি একবারে ঠিক আছে।”
মিরায়ার রুম~
মিরায়া রাগ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান রুমের ভিতরে ঢুকেছে অনুমতি ছাড়াই মিরায়া সেটা ভালোই বুঝেছে। মিরায়া জানতো রায়ান ঠিক আসবে তাই ইচ্ছে করেই দরজা লাগায় নি। মিরায়া নিজের পিছনেই রায়ানের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল-
“আমি খাবো না। আমাকে খাওয়ার জন্য ডাকার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হবে না।”
রায়ান একটু হাসলো মিরায়ার বাচ্চাদের মতো রাগ করা দেখে। রায়ান মিরায়ার পিছনে তার বুকের সাথে মিরায়ার পিঠে স্পর্শ করে দাঁড়ায়। মিরায়া হঠাৎ পেতে উঠে রায়ানের স্পর্শে। মিরায়া সাথে সাথে পিছনে ঘুরতেই রায়ানের বুকে বাধা প্রাপ্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারায়। রায়ান মিরায়ার কমোর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। মিরায়া আকস্মিকতায় চোখ টিপে বন্ধ করে নেয়। রায়ান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার বউকে ভয় পেতে দেখতে লাগলো।
মিরায়া নিজেকে রায়ানের বুকে আবিষ্কার করে রায়ানের দিকে মুখ উঁচু করে তাকায়। রায়ান মিরায়ার দিকে চোখ মারে দুষ্টামি করে। মিরায়া হঠাৎই রায়ানের হাতের বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে নড়তে থাকে। রায়ান বিরক্ত হয়ে মিরায়াকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে রুমের ভিতরে গিয়ে বিছানায় ফেলে দিল মিরায়াকে। মিরায়া ভয়ে শিটিকে গেলো। হালকা পা কুঁচকে নিলো সে। রায়ান বিছানায় উঠে মিরায়ার কাছে গেল।
মিরায়া নিজের ওড়না ভালো করে জড়িয়ে বলল-
“কি… কি হচ্ছে টা কি!”
রায়ান গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল-
“কিছু হচ্ছে না এখনো পর্যন্ত সমস্যাই এইটা। যাই হোক, খেতে যাবে কি না বলো?”
মিরায়া নিজের জেদ ধরে রাখল-
“না আমি যাবো না। বললাম না পেটের ইঁদুরের বাচ্চা গুলো মরে গেছে। এখন খিদে নেই।”
রায়ান-“ঠিক আছে।” বলেই বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। মিরায়া রায়ানের দরজা লাগানো দেখে আরো ভয় পেয়ে বলল-” কি করছেন? দরজা লাগাচ্ছেন কেন?”
রায়ান মিরায়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বিছানার উপরে উঠলো আবার। মিরায়া আরো একটু পিছিয়ে গেল নিজের অবস্থান থেকে। রায়ান আরো মিরায়ার দিকে আগাতেই মিরায়া বলল-
“কি…কি করতে চাইছেন আপনি?
রায়ান হেঁসে মিরায়ার গালে এসে পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বলল-“তুমি তো বললে ইঁদুরের বাচ্চা গুলো মরে গেছে তাই খিদে নেই রাইট?
মিরায়া মাথা নেড়ে বলল-“হুঁম।”
রায়ান অন্য পাশের চুল সরিয়ে নিয়ে মিরায়ার মুখ নিজের দুহাতের মাঝে নিয়ে কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল-
“এখন তোমার লজিক অনুযায়ী, যদি পেটে ইঁদুরের বাচ্চার বদলে মানুষের বাচ্চা থাকে তাহলে তো আরো বেশি খিদে পাবে তাই না হার্ট-বার্ড?”
মিরায়া রায়ানের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে- “মা..মানে? কি বলতে চাইছেন?”
রায়ান হালকা হেসে আবারও ফিসফিস করল-“বিশ্বাস করো বেইব ইঁদুরের বাচ্চার তুলনায় মানুষের বাচ্চার বেশি খিদে পায়। আর ইঁদুরের বাচ্চা গুলোর মতো এক মুহূর্তের জন্মে না অনেক হার্ডওয়ার্ক করতে হয়।”
মিরায়ার শরীর কেঁপে উঠলো। মিরায়া রায়ানের থেকে সরতে যাবে তখনি রায়ান মিরায়ার হাত টেনে ধরলো। মিরায়া হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। রায়ান আবার প্রশ্ন করলো-
“খেতে যাবে নাকি খিদে পাওয়ার অপেক্ষায় মানুষের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ইচ্ছা আছে? আই এম ইন্টারেস্টেড ইন বোথ, বেইব। চুজ ওয়াইজলি।”
মিরায়া তাও জেদ ধরে বলল হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে-“আমি যাবো না বলেছি তো, শুনতে পান নি?”
রায়ানও হার মানবার পাত্র না- “ওকে বেইবি ফাইন। হুয়াট এভার ইউ সে।” বলেই পাঞ্জাবি খুলার জন্য উদ্যত হয়। মিরায়া পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভয় পেয়ে রায়ানের হাত ধরে ফেলে পাঞ্জাবি খুলতে বাঁধা দিয়ে একনাগাড়ে বলতে থাকলো-
“যাবো, যাবো। আমি যাচ্ছি খেতে। থামুন, প্লিজ।”
রায়ান থেমে গিয়ে হতাশায় শ্বাস ছেড়ে বলল-“ধুরু বাল!আজকের দিনটা অন্তত জেদ ধরে থাকতি। বেশি না ১ঘন্টা জেদ ধরে থাক, সেটাই যথেষ্ট হবে। প্লিজ হার্ট-বার্ড।”
মিরায়া হতবাক হয়ে ভাবছে-“এই লোকের কি সত্যিই লজ্জা নেই নাকি। কি আবদার করছে এইসব! আল্লাহ আমাকে বাঁচাও!” এইভেবে মনে শক্তি জোগালো সে।
মিরায়া রায়ানের হাত ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল-“কিসের জেদ? আমার খুব খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে ইঁদুরের বাচ্চা গুলো আবার বেঁচে উঠেছে। আমি খেতে গেলাম।”
মিরায়া দরজার দিকে যাওয়ার আগেই রায়ান মিরায়ার হাত টেনে নিজের বুকের এনে ফেলে মিরায়া কে।
রুদ্রর রুম~
রুদ্র নিজের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো আনুমানিক ১০ মিনিট হয়েছে। পা এক জায়গায় টিকে আছে, শ্বাস গলায় আটকে আছে, চোখের পলক পড়ে নারাজ- কেননা এক অদ্ভুত দৃশ্য তার সর্বাঙ্গ স্থির করে দিয়েছে।
রিমি রুদ্রর গিটার টা কোলে নিয়ে আপন মনে বাজিয়ে গুনগুন করছে তাকে কেউ দেখছে তার সেই ব্যাপারে কোনো পাত্তা পাওয়া দ্বায়। অন্যদিকে রুদ্র এক পলকে দেখে যাচ্ছে রিমিকে তার মনে অন্য এক দ্বন্দ্ব – “আমি কি দিনে দুপুরে স্বপ্ন দিখছি? রিমি এখানে আসবেন কেন? আর আমার ঘরেই বা কেন এমন পরিস্থিতিতে তাকে দেখবো? আমার নিজেকে জাগানো উচিত। কিন্তু কিভাবে? আমার যে ইচ্ছে করছে না।”
রুদ্র রিমির কল্পনা করছে ভাবতে থাকে। কিন্তু রিমি একসময় নিজের থেকেই গিটার বাজানো বন্ধ করে দেয় হঠাৎ তার চোখ দরজার ওই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রর দিকে যায়। রিমি অপরাধ বোধে তাড়াতাড়ি গিটার টা বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পরল। রুদ্রও রিমির শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখে নিজের কল্পনা ভেদ করে বাস্তবে বুঝলো এটা রিমিই। রুদ্র কি বলে সামলাবে না বুঝেই বলল-
“ওয়েট, ওয়েট,ওয়েট। প্যানিক করবেন না প্লিজ। নাহলে আমি প্যানিক করে যাবো।”
রুদ্রর কথায় রিমি হেঁসে ফেলল- “জ্বি ঠিক আছে। আমি শান্ত আছি। আপনিও শান্ত থাকুন।”
রুদ্র নিজেকে শান্ত করে রিমিকে একবার দেখে জিজ্ঞেস করল-“আচ্ছা আপনি কি সত্যিই এখানে? না মানে সত্যিই এই বাড়িতে আমার ঘরে?”
রিমি রুদ্রর কথায় একটু লজ্জায় পড়ে গেল। কি বলবে তা ভাবতে থাকলো। আসল সত্যিই বলবে তার ভাইয়ের ব্যাপারে না শুধু মিরায়া ডেকেছে তাই বলবে। রুদ্র রিমির দিকে তাকিয়ে আছে। রিমি রুদ্র কে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুধু মিরায়ার ব্যাপারেই শুধু বলল-
“জ্বি সত্যিই। আসলে মিরা ফোন করে ডাকলো তাই আর কি। আর আপনার ঘরে আসার ব্যাপারটা আসলে..!
রুদ্র -” সেটা নিয়ে বলতে হবে না। ভালো করেছেন এসেছেন।”
রিমিকে বলা শেষ করতে না দিয়েই।
রিমি-“জ্বি?..” রুদ্রর তার ঘরে আসা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করে আরো ভালো করেছে বলায় অবাক হয়ে।
রুদ্র নিজের কথার পেতে পড়ে বলল-“ভালো করেছেন মিরার কথায় এই বাড়িতে ঘুরতে এসে। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি বেশ ভালো বাজাতে পারেন (গিটারের দিকে ইশারা করে)।”
রিমি একটু লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করল-“জ্বি ওই আর কি। আমি যাই মিরা হয়তো অপেক্ষা করছে আমার।”
রুদ্র-“থাকুন। না মানে, মিরা ভাবি তো..”
রিমি রুদ্রর কথা না শুনে এক দৌড়ে ছাদে যায় কিন্তু পুরো ছদ খুঁজেও মিরায়াকে কোথাও না পেয়ে একটু রেগে ছাদ থেকে আবার নামতে নামতে বলে-
“মিরার বাচ্চি.. আমাকে ছাদে যেতে বলে ঘরে বসে আছে। দাঁড়া পেয়ে নেই।”
এই বলে ছাদ থেকে সোজা মিরায়ার ঘরের দিকে যায়।
মিরায়ার রুম~
রায়ান মিরায়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মিরায়ার মুখ একটু উঁচু করে ধরে নিজের মুখের সামনে। মিরায়া চোখ বন্ধ করে আছে। অদ্ভুত এক লজ্জায় চোখ যেন চেয়েও খুলতে পারছে না সে। রায়ান মিরায়াকে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা বা কাছে আসতে বাঁধা দিতে না দেখে একটু হেঁসে মিরায়ার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মিরায়া কেঁপে উঠে রায়ানের বুকের উপরে হাত রেখে পাঞ্জাবি খামচে ধরে। রায়ান এবার মিরায়ার সারা মুখে আবেশে চুমু খায়- প্রথমে ডা গালে তারপর বাম গালে, পরে নাকে , থুতনিতে। মিরায়ার ভিতর বাহির সমস্ত অস্তিত্ব নড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে যেন এক সমুদ্রের মাঝে তলিয়ে যাচ্ছে অথচ সাঁতার কেটে পার হওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা টুকু নেই । রায়ান মিরায়ার স্থিরতার মাঝে অস্থিরতা বুঝতে পারলো তবে সে নিজেও নিরূপায়। বউয়ের থেকে বউ চায় নি বলে দূরে থাকা সম্ভব করতে পারলেও বউকে কাছে চাইতে দেখে দূরে থাকা অসম্ভব। রায়ানের মাথায় শত চিন্তার ভীর আসার পর তার একটাই উপায় মাথায় এলো-“যা হবে দেখা যাবে।”
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৩
রায়ান মিরায়ার অনবরত কাঁপতে থাকা গোলাপী ঠোট গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের বোধগম্যতা আর নিয়ন্ত্রণ হাড়ালো। রায়ান আগু পিছু চিন্তা না করে মিরায়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবে এমন সময় দরজায় জোরে শব্দ হয়- “ঠাস ঠাস!”