আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৪
অরাত্রিকা রহমান
রাত-১টা~
রায়ান বাংলোর ভিতরে প্রবেশ করে বাইকের চাবি খুঁজতে শুরু করলো। রায়ানের কপালে একটু চিন্তার রেখা স্পষ্ট। চাবিটা না পেলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাড়িয়ে যাবে এমন কিছু মনে হচ্ছে তার।
-“ধুর, কই পড়লো চাবিটা! মিরার ঝুমকো ওইটাতে লাগানো। তা নাহলে এই চাবি আমি খুঁজতেও আসতাম না। পেলে হয় এখন।”
নিজের মনে কথাটা বিড়বিড় করে খুঁজতে থাকলো। কিছুক্ষণ খোঁজার পর বার কাউন্টারের পাশে তার চোখ পড়লো, ঠিক নিচের কোনটাতেই চাবিটা পড়ে ছিল। রায়ান একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে চাবিটা তুলতে তুলতে
“হাহ্! এইখানে ছিলো! এখানে কখন পড়লো আবার। যাক আমার বউয়ের ঝুমকো তো হাড়ায়নি। আলহামদুলিল্লাহ।”
তখনি তার মাথায় এলো যখন রায়া (মিরায়া) আর সে একজন আরেকজনের উপরে পড়েগেছিল তখন এই দিকে পড়ে গেছে হয়তো চাবিটা। কিন্তু রায়ানের হঠাৎ তখন রায়ার (মিরায়ার) কোমর আকরে ধরার দৃশ্য টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আসতাগফিরুল্লা। আমি পর নারী স্পর্শ কিভাবে করলাম? তওবা তওবা।” রায়ান নিজের গালে নিজের হালকা একটা থাপ্পর মারলো।
-“না না না , বাড়ি ফিরে মিরা কে সব বলে ক্ষমা চাইতে হবে। ধুর ধুর, সত্যি বলার পর কি করবে তাই জানি না। এই সব শুনলে আমাকে ত্যাজ্য স্বামী করে দেবে আমার বউ আমি সিয়র।”
রায়ান বিলাপ করতে করতে ওই জায়গা থেকে বের হয়ে মনে মনে বলতে থাকলো-“আশ্চর্য, রায়া মেয়েটাকে এতো অদ্ভুত লাগলো কেন কে জানে? চোখ গুলো চেনা চেনা, কন্ঠ টাও কেমন অদ্ভুত বানোয়াটে মনে হলো, আর কোমর… মনে হলো এর আগেও..!”
রায়ান আবার নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে নাসূচক ইশারা করলো-
“না না রায়ান কি ভাবছিস এসব। বউ ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে এই জীবনে ছুঁয়ে দেখিস নি তো চেনা চেনা কেন লাগবে। বউ বাদে সব মেয়ে তোর চাচি আম্মা লাগে।”
-“এর বেশি ভাবলে পাগল হয়ে যাবো। সামনে অনেক বড় একটা কাজ শেষ করতে হবে। বাইকে উঠে বাড়ি যা তাড়াতাড়ি বউয়ের কাছে। কত রাত হয়ে গেছে। আচ্ছা মিরা কি এখনো জেগে আছে? বউ প্লিজ একটু কষ্ট করে জেগে থাক, আজকে তোর বর তোকে সব সত্যি বলবে।” (বাইকের দিকে গিয়ে বাইকে উঠতে উঠতে বলল)
রায়ান বাইকে উঠতে যাবো তখনি তার চোখে একটা ঝিলিক পড়লো। রায়ান চোখ ঢেকে নিলো সেই ঝলকানিতে। তার পর মিটিমিটি চেয়ে দেখার চেষ্টা করলো যেখান থেকে আলো আসছে সেখানে। সে দেখলো খুব ছোট্ট একটা জিনিস থেকে এমন আলো আসছে লাইটের রিফ্লেকশন তার উপর পড়ার ফলে। রায়ান একটু হেঁটে ওই জিনিসটার কাছে গেল। তার ছায়ার জন্য এখন আর আলোর প্রতিফলন হচ্ছে না। রায়ান দাঁড়িয়ে থেকে ঠিক বুঝতে পারলো না জিনিস টা কি তাই নিচু হয়ে সেটা হাতে তুলে নিলো।
মিরায়াকে পড়িয়ে দিয়ে আসা ব্রেসলেট টা এখন রায়ানের হাতে। রায়ান কিছু সময়ের জন্য ফ্রিজ হয়ে রইল। কিছুই বুঝতে পারছে না, জিনিসটা সেখানে কিভাবে যাবে। হঠাৎই সে ব্রেসলেট টা থেকে ধুলো সড়িয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। যদিও এটা যে তার দেওয়া ব্রেসলেট এটাতে কোনো সন্দেহ নেই কারণ এটা আমেরিকান এ্যাক্সক্লুসিভ কালেকশন এর একটা, যার দ্বিতীয় কোনো কপি নেই। তাও রায়ান বারবার দেখলো ব্রেসলেট টা, সে নিশ্চিত এটা তার দেওয়া ব্রেসলেটই। সে একবার চারপাশে ঘুরে দেখলো আর সন্দেহে মিরায়াকে ডাকলো-
“মিরা.. মিরা… হৃদপাখি আই নো, তুমি এখানে আছো। বের হয়ে এসো।”
কিন্তু কেউ সারা দিল না। রায়ান এবার আরো চিন্তায় পড়ে গেল-“এতো রাতে মিরা এখানে কোথা থেকে আসবে আর জানবেই বা কিভাবে যে আমি এখানে আছি। এখানে তো একটু আগেও কেউ ছিল না।”
রায়ান তাও চারপাশে দৌড়ে আরেকবার খুঁজলো মিরায়াকে। বাংলোর পিছন দিকেও দৌড়ে একবার দেখে এলো, রীতিমতো হাপাচ্ছে রায়ান দৌড়ে দৌড়ে মিরায়ার নাম চিৎকার করতে করতে। অবশেষে আবার বাংলোর সামনে চলে এলো গ্যারেজের তার বাইক টার সামনে আর ধমকের সুরে শাসিয়ে বলল-
“মিরা.. দেখো যদি এখানে থাকো তাহলে বাইরে বেরিয়ে এসো এখনি। আমি খুঁজে পেলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
তবুও শুনশান জায়গায় কোনো আওয়াজ নেই, কারোর উপস্থিতি ও টের পাচ্ছে না সে। রায়ান এবার অধৈর্য হয়ে নিজের চুল একহাতে খামচে ধরলো-“মিরা, আমার হৃদপাখি দেখ, এভাবে জ্বালাতে হয় না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো চলে আয় না। বোকবো না প্রমিস। কেন এসেছিস এখানে এত রাতে? আমার টেনশন হচ্ছে তো।”
আশেপাশে কোনো সাড়া শব্দ নেই। রায়ান একটু শ্বাস নিয়ে মন শান্ত করলো আর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরু করলো- “এখানে মিরায়া ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি আর রায়া যখন এখানে এলাম তখনও তো কোনো মেয়ে এখানে ছিল না। এমন কি এই ব্রেসলেট টাও ছিল না। তারপর আমি ভিতরে গেলাম আর রায়া….রায়া!”
রায়ানের মাথায় এক মুহূর্তে সব ফ্লেসব্যাক প্লে হলো- রায়ার চোখ, অঙ্গ ভঙ্গি, কথা, শারীরিক গঠন, বাড়ির ঠিকানা চট্টগ্রাম সব..সব কিছুর সাথে সে মিরায়ার মিল পেল রায়ার। রায়ার অস্বাভাবিক ভাবে নিজের মুখ আড়াল করা চোখ ঢাকতে চশমা পড়া এই সবকিছুই সন্দেহের সৃষ্টি করছে তা
এখন রায়ানের মনে। রায়ান নিজের মনযোগ বাড়ালো রায়ার চোখ গুলো চিন্তা করলো চোখ বন্ধ করে তখনি হঠাৎ তার মাথায় এলো এই একই চোখ জোড়া সে প্রথমদিন বৃষ্টিতে দেখেছিল। রায়ান আচমকা চোখ খুলল বিস্মিত ভাব নিয়ে এবার চিন্তা যেন আরো সন্দেহের সৃষ্টি করছে কিন্তু দ্বন্দ্বের শেষ হচ্ছে না-
“না না, রায়া মিরায়া কিভাবে হয়! চোখ জোড়া এক কিন্তু আমার বউ বাইক চালাতে পারে না সেখানে রেস তো অনেক দূরের কথা। আর যেভাবে তখন সবার সামনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করল! এই সাহস কি মিরার হবে? উফ্! কিছুর সাথেই তো কিছু মিলছে না। কি ভাবছি আমি। রায়া মিরায়া হতে পারে না।”
-“কিন্তু রায়ান মেয়েটা এতো রহস্যময়ী কেন? রাইডার অথচ তার চেহারা কেউ কখনো দেখেনি তা কিভাবে হয়! এত ভালো রাইড করে চেহারা লুকাতেই বা কেন চায় মেয়েটা?”
রায়ানের মাথায় কিছুই ঢুকছে না তবে এখন রায়ার পরিচয় জানা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবেই সে সরাসরি মাহির কে কল করলো। মাহির এতক্ষণে খান বাড়িতে পৌঁছে গেছে প্রায়। বাইকে থাকা অবস্থাতে ফোন বাজতেই মাহির বাইক দাঁড়া করিয়ে ফোনটা পকেট থেকে বের করলো। রায়ানের কল দেখে সাথে সাথে রিসিভ করলো কল টা এই ভেবে যদি কোনো বিপদে পড়ে থাকে রায়ান।
মাহির চিন্তিত গলায়-“হ্যালো! রায়ান! কোথায় তুই? বাড়ি পৌঁছাস নি এখনো? ঠিক আছিস তো?”
রায়ান মাহিরের কথার কোনো উত্তর দিলো না বরং এক কথায় বলল-“মাহির, আমাকে রেস অর্গানাইজার এর কন্টেক্ট নাম্বার টা সেন্ড করে, ফাস্ট। নো মোর কুয়েশ্চেনস। ডু হুয়াট আই সেড।”
মাহির কিছুই বুঝলো না তার আগের কল টা কেটে গেলো। তবে কথা মতো অর্গানাইজার এর নাম্বার টা দিয়ে সে রায়ানকে একটা মেসেজ পাঠালো-
“এইটা নাম্বার। কিন্তু হঠাৎ এটা কেন চাইলি? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
রায়ান সাথে সাথে মাহিরের মেসেজ টা সিন করে শুধু লিখলো-“প্রয়োজন ছিল নাম্বারটা। পরে সব বলবো। বাই।”
মাহির রায়ানের মেসেজ দেখে অবাক হলো কিন্তু করার কিছু নেই অপেক্ষা ছাড়া তাই কিছু বলল না আর। সে আবার রাইড করতে লাগলো।
রায়ান এদিকে সেই নাম্বারে কল করেই যাচ্ছে লাগাতার। রাত গভীর এখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এটাই স্বাভাবিক। অতিরিক্ত বিরক্তি অনুভব হওয়ায় রেস এর অর্গানাইজার লোকটা কল ধরে বলল-“কে বলছেন? এতো রাতে কল দিয়ে বিরক্ত করার মানে কি?”
এইদিকে রায়ানের মনে যে ঝড় চলছে তা নিয়ে সে নিজেও বিরক্ত তবে শান্ত ও স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে চেষ্টা করলো-“আমি রায়ান চৌধুরী। আজকের রেসের চ্যাম্পিয়ন বলছিলাম। একটা প্রয়োজনে ছিল। সাহায্য চাইতে কল করেছি।”
অর্গানাইজার-“আরে ভাই রেস তো কখন শেষ এখন আবার কি সাহায্য। সকালে কল করেন।”
রায়ান এবার কিছুটা গম্ভীর গলায় হুমকি দিয়ে বলল-“রেস পরের বছরেও হক, এমন কিছু যদি চান তাহলে যা বলছি তা করুন চুপচাপ। তা নাহলে এই বছরের রেস লাস্ট রেস হবে আপনাদের অর্গানাইজেশন এর।”
রায়ানের হুমকিতে কিছু টা কাজ হলো হয়তো। লোকটা একটু আমতা আমতা করে বলল-“জ্বি..জ্বি স্যার বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
রায়ান এবার সোজা জিজ্ঞেস করলো-“আজকের রেস উইনার গার্লস টিম থেকে- রায়া রহমান। তার ডিটেইলহ দিন আমাকে এখনি। আই ওয়াট ইট রাইট নাউ।”
লোকটা সংকোচ করে বলল -“আসলে স্যার এভাবে কারো তথ্য আদান-প্রদান করা আমাদের প্রটোকলে নেই। এটা করা সম্ভব নয়।”
রায়ান আবার হুমকির স্বরে বলল-“যদি প্রটোকলই না থাকে ব্যাপারটা কেমন হবে একটু ভেবে দেখুন।”
লোকটার গলা শুকিয়ে এলো। তিনি হঠাৎ রাজি হয়ে গেলেন- “না না স্যার আপনার মতো বড় মানুষদের জন্য প্রটোকল ভাঙা কোনো ব্যাপার না। আমি এখনি দিচ্ছি ওই মেয়ের ডিটেইলস। কিন্তু স্যার কেন জানতে পারি ? মানে ওই মেয়ে কি আপনার কিছু হয়?”
রায়ান বিরক্ত কন্ঠে বলল-“আমার কিছু হয় কিনা সেটাই জানার চেষ্টাই চালাচ্ছি। আপাতত যদি তাড়াতাড়ি তার বায়োডাটা দিতেন সুবিধা হতো। বাড়তি কথা না বলে নিজের কাজ করুন।”
আর্গানাইজার একটু বিব্রত রায়ানের কথায় তবে সে প্রতিষ্ঠানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য প্রায় রায়ানের কাজ করতে-“জ্বি স্যার আমি পাঠাচ্ছি।”
রায়ান কথাটা শুনার পর সাথে সাথে কলটা রেখে দিলো। আর মনে মনে বিড়বিড় করলো-
“মিস রায়া আপনার আসল পরিচয় কি..? এতো রহস্যে কেন ঘিরে রেখেছেন নিজেকে? কি আছে আপনার ওই মাস্কের পিছনে? আমার বউ কোথায় ওর ব্রেসলেট এখানে কেন?”
তখনি রায়ানের ফোনে শব্দ হয় মেসেজ আসার। মূলত ওই লোকটা মিরায়ার রাইডিং ডিটেইলস এর পেপার আর বায়োডাটার ছবি দিয়েছেন- যেখানে মিরায়ার আইডি কার্ড, লাইসেন্স এর কার্ড সব কিছুর ফটো কপি ছিল। রায়ান ফোনটা খুলেই ছবি গুলো দেখতে শুরু করে। চোখ আটকে যায় প্রথম ছবিতেই, মিরায়ার আইডি কার্ড – যেখানে তার ছবিও ছিল। রায়ান ফোনে ছবিটা জুম করে নেয় স্পস্ট দেখার জন্য। যেহেতু মিরায়ার বয়স কম আর আইডি কার্ডও নতুন করা কিছু দিন আগের তাই ছবিতে চেহারা চিনতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথাই নেই। রায়ানের মুখে একটা বাঁকা হাসি আর অবাক কর ভাব যেন এতোক্ষণ ধরে খুব চেষ্টায় নিজের কাঙ্খিত অংকটা মিলাতে পেরেছে।
মিরায়ার বায়োডাটার থেকে বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না যে রায়াই মিরায়া। কিন্তু রায়ানের বিশ্বাস হচ্ছিল না তার নিজের চোখকে,-“মিরা, রায়া দুইজন এক!” রায়ানের মুখ থেকে অস্পষ্ট কথাটা বের হলো। এর পর বাকি কাগজ গুলোও দেখলো এক এক করে। রাইডিং ডিটেইলস অনুযায়ী দীর্ঘ তিন বছর ধরে রাইড করছে মিরায়া তবে এটা তার প্রথম অফিসিয়াল রাইড ছিল আজকের রেসে। আর রায়া তার ছদ্মনাম যা তার আসল মানের শেষে দুই অক্ষরের থেকে তৈরি।
রায়ান অবিশ্বাস থেকে হাসতে থাকলো জোরে। তার কোনো কিছুই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কিন্তু হাতে প্রমাণ রয়েছে সব অবিশ্বাস্য জিনিস এর। রায়ান ফোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলল-
“ওয়াও…লাইক সিরিয়াসলি ওয়াওওও… আমার বউ.. মানে সত্যি সত্যি রায়া…আজকের রাইডার কুইন, আমার হৃদপাখি। ওওয়াহহহ , হুয়াট! মাই ওয়াইফ ইজ সাচ আ ব্রিলিয়ান্ট রাইডার। ওহ মাই গড।”
রায়ান নিজের বউয়ের তারিফে নিজে একাই তালি দিতে লাগলো।
রায়ান তালি দেওয়া শেষ করে মাটিতে জোরে পা দিয়ে আঘাত করলো-“ড্যামেট, কেন কেন? কেন বলল না আমাকে ওর আসল পরিচয়। আমি কি ওকে আটকাতাম নাকি রাইড করা থেকে? কি বুঝে আমার থেকে লুকালো এটা। এতো বড় একটা কথা কেন জানি না আমি? বাড়ির কেউ জানলেও তো আমার জানার কথা , মনে তো হচ্ছে না বাকিদের কেউও জানে।”
-“আচ্ছা রেসের সময় ওভাবে যে পড়ে গেছিল, ঠিক মতো তো জিজ্ঞেস ও করি নি, যদি খুব বেশি লেগে থাকে ওর!আআআ.. কেন হৃদপাখি? একটাবার বলে দেখতি আমাকে নাচতে নাচতে তোকে নিয়ে গর্ব করে সবাইকে বলতাম ‘রায়া রহমান আমার বউ’ উফ্! কি একটা ফিলিং হতো আমার।”
রায়ান এখন যে মনে মনে কি অনুভব করছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। বউয়ের রাইডিং স্কিল্স দেখে যেমন গর্ব হচ্ছে তেমন তাকে লুকিয়ে রাইড করেছে বলে রাগ হচ্ছে তার।তবে রাগের চেয়ে খুশির পরিমাণ টাই যে বেশি তার সন্দেহ নেই। রায়ান এখনো খুশি তে হেঁসে যাচ্ছে-
“”উফ্… আমার বউটা এতো গুণী কেন রে! যেন সব দিক দিয়েই পারফেক্ট— চেহারার সেই শান্ত মিষ্টি সৌন্দর্য, কথার ভদ্রতা, হাতের রান্নায় স্বর্গের ঘ্রাণ, রাস্তায় রাইড দিলে মনে হয় বাতাসও ওর সঙ্গ নিতে চায়। আর শরীরটা… আল্লাহ! যেন নিজ হাতে গড়া এক নিখুঁত সৃষ্টি পুরাই মাখন, উফ্ উফ্। মনে হয় আল্লাহ আমার প্রতি তখন ভীষণ খুশি ছিলেন, আমি সিয়র আল্লাহর খুব প্রিয় রুহু ছিলাম। তাই এত জোশ একটা মেয়েকে আমার কপালে লিখে দিয়েছিলেন, তাও মাত্র ১৭ বছর বয়সেই। নিজের দোষে কপাল পুড়েছি সেটা ভিন্ন হিসাব।”
রায়ান পারছে না সেই মুহূর্তে মাটিতে গড়াগড়ি করতে। তবে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখটা লজ্জায় ঢেকে দৌড়াতে থাকলো এদিক ওদিক খুশিতে-
“রায়ান রে তুই তো খুশি ঠেলায় পাগলই হয়ে যাবি। আল্লাহ আমার স্বপ্ন স্বার্থক করে দেওয়ার জন্য থ্যাংকস থ্যাংকস থ্যাংকস। আহ্, আমি গর্বে মনে হচ্ছে গর্ভবতী হয়ে যাবো। আহ্! বউটা এখন কাছে থাকলে যে কি করতাম নিজেও জানি না। এতো আদর আদর পাচ্ছে কেন আমার!”
রায়ান নিজেকে কোনো ভাবেই শান্ত রাখতে পারছে না, মনে হচ্ছে তার হাত গুলো এখনি ডানাতে রুপান্তরিত হবে আর সে উড়তে শুরু করবে। রায়ান বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তার হাতে থাকা ব্রেসলেট টা চোখের সামনে ঝুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলল-
“বেইব, গেট রেডি টু লুজ অন দ্যা বেড টুডে। আজ কোনো ভাবে ছাড় দিচ্ছি না আমি। আসার সময়ও কিছু করি নি শুধু সবটা জানানোর অপেক্ষায়। কিন্তু আর না, খুব বেশি সময় দিয়ে ফেলেছি তোমায়। যেখানে বউয়ের এতো সিক্রেট আছে সেখানে আমারো একটা সিক্রেট থাকতেই পারে। শোধ বোধ। রাইট বেইবি?” (ব্রেসলেট টাকে প্রশ্ন করলো)
“বাইকে তখন কি বললে? তোমার বর খুব হেন্ডসাম তাই না? আজ দেখাবো তোমার বর আসলেই কতোটা হেন্ডসাম।”
হঠাৎ রায়ান বাংলোটার দিকে তাকায় আর সাথে সাথে রায়ানের জ্যাকের কথা মাথায় আসে। আর একই সাথে কেন জানি তার রক্ত গরম হয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ। বাংলোর দিকে তাকিয়ে একটু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো-
“হাড়ামির বাচ্চা, আমার বউকে এক রাতের অফার দেয়, রায়ান চৌধুরীর বউকে, হাহ্! যদি সত্য সম্পর্কে একটু ধারণাও থাকতো আজ যেখানে লাত্থি পড়েছে, সেটা কেটে তোর ওই ফাকি**পুরুষত্ব রাস্তার কুত্তা গুলারে খাওয়াতো এই রায়ান চৌধুরী। আমার বউয়ের পায়ের জুতা ও তোর শরীর স্পর্শ করেছে এটা আমি মানতে পারছি না।”
রায়ান বাইক থেকে সড়ে গিয়ে অন্য সব বাইকের কাছে গেলো যারা তাড়াহুড়ো তে বাইক ফেলেই চলে গেছে। সে সব বাইকের ভিতরের তেল গুলো বের করে একসাথে করে বাংলোর চার পাশে ঢেলে দেয়। বাড়ির দারোয়ান হয়তো সিগারেট খেতেন। পালানোর সময় বেখেয়ালে ফেলে গেছেন দেশলাইয়ের বক্স। রায়ান বাঁকা হেঁসে সেই বক্স টা নিয়ে বাংলো তে আগুন জ্বালিয়ে দিল। এক মুহুর্তের মধ্যে সব আগুনে ছারখার হয়ে যেতে লাগলো।
রায়ান পুড়তে থাকা বাংলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আর ঠিক তারপরই বাইকে চড়ে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলো বাইক আর বিড়বিড় করলো-
“মাই লিটল হার্ট বার্ড, ওয়েট ফর ইউর হাসবেন্ড,ওকে! আই এম কামিং এ্যাজ সুন এ্যাজ পসিবেল।”
ঢাকা মেইন রোড~
রাত ১টার বেশি সময়। ঠিক যখন রায়ান বাংলোতে ছিলো সেই একই সময়ে মিরায়া ঢাকা মহা সড়কে রাইড করছে। কিছু সময় পরই ঢাকা থেকে বের হয়ে যাবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সর্বোপরি ৫-৭ ঘন্টা সময় লাগে রাস্তার পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। তবে গভীর রাতের রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকায় খুব একটা সময় লাগবে না পৌঁছাতে। কিন্তু বাইকের তেল শেষ হয়ে যাবে চট্টগ্রামে ঢুকার পর পরই। তাই মিরায়া রিস্ক না নিয়ে মহা সড়কে তেল পাম্পের সামনে বাইক দাঁড়া করিয়ে টেংঙ্ক তেলে ফুল করিয়ে নেয়। অনেকটা লম্বা জার্নি তাই একটু জিরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাই হালকা বিশ্রাম নিতে মিরায়া ওই তেলের পাম্পের জায়গায়ই কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেছিল।
হঠাৎ মিরায়ার ফোন টা বেজে উঠলো। তারই সাথে তার বুক জোরে ধকধক করতে লাগলো। মিরায়া নিজের ফোন টা নিয়ে উল্টে দেখার সাহস পর্যন্ত করছে না যে কে কল করেছে।
-“ওহ্ আল্লাহ , এখনো ঢাকা ছাড়াতে পারলাম না তার আগেই জেনে গেলো নাকি আমি চলে যাচ্ছি! এই লোকটা এতো ফাস্ট কেন সব কিছুতে? এখন কল দিলেই আমার কি ধরা উচিত হবে? কি করবো আমি?”
মিরায়া নিজের মনে গড়া সব ভেবে কলটাকে রায়ানের কল ভেবে চোখ দুটো বন্ধ করে ধীরে ফোন টা সোজা করে নিলো উল্টো অবস্থা থেকে। চোখ মিটিমিটি খুলতেই দেখলো সোরায়ার নাম্বারটা ভাসছে। একটু আগেও যেখানে রায়ানের কলের ভয় করছিল এখন সেখানে রায়ানের কল আসে নি বলে হতাশা বিরাজ করছে তার মনে। তবে এতো রাতে সোরায়ার কল আসায় ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকলো মিরায়ার কাছে। সে দ্রুত কল টা রিসিভ করলো, আর সাথে সাথেই অপর পাশ থেকে উত্তেজিত সোরায়ার কন্ঠ ভেসে এলো-
“হ্যালো, আপু! রেস কখনো শেষ হয়েছে এখনো কল করো নি কেন? আমি রাত জেগে বসে আছি তোমার জেতার খবর শুনতে। কি হলো বলবে তো নাকি?”
সোরায়ার উত্তেজনা দেখে মিরায়া হালকা হেঁসে উঠলো –
“খবর দেওয়ার কি আছে বনু? তোর আপু কি কখনো না জিতে ফিরেছে?”
সোরায়া বুঝে গেল মিরায়া রেস জিতে গেছে। সে সাথে সাথে বিছানার উপর উঠে গেল এক লাফে আর খুশিতে চেঁচিয়ে বলল-
“সত্যি বলছো? ইয়েএএএএ…! এখন যদি ঢাকা থাকতাম তাহলে তোমাকে জোরে একটা জাদুকি ঝাপ্পি দিতাম। উউউমমাহ, ইউ আর দ্যা।”
মিরায়া দূর থেকেও সোরায়ার আনন্দ অনুভব করতে পারছিল। তার নিজেরও খুব ভালো লাগছিল সোরায়া কে খুশি দেখে-“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। চট্টগ্রামে আসি আগে তার পর তোর আদর নেব, ঠিক আছে?”
সোরায়া প্রথমে না বুঝেই বলল-“হ্যাঁ হ্যাঁ তাড়াতাড়ি এসো।”
কথাটা বলার পর যখন আসলে বুঝলো মিরায়ার কথা তখনি সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল-“ওয়েট ওয়েট, কিহ্? চট্টগ্রামে? তুমি চট্টগ্রামে আসছো আপু?”
মিরায়া মুখে হালকা হাঁসি নিয়ে বলল-“তোর আপু কি কখনো একা একা নিজের জিৎ উপভোগ করেছে বলতো? তাহলে এবার কেন করবে? আমি রাস্তায় আছি। কয়েক ঘন্টা লাগবে আমার চট্টগ্রাম পৌঁছাতে।”
সোরায়া চিন্তিত কন্ঠে-“আপু এতো রাতে আসার কি প্রয়োজন ছিল? সকালে রায়ান ভাইয়াকে যদি বলতে ভাইয়াই তো দিয়ে যেতো তাহলে।”
মিরায়া রায়ানের নামটা শুনতেই কেমন হালকা লাজুক ভাব নিয়ে মুচকি হাসলো-“তোর রায়ান ভাইয়া, তোর একমাত্র দুলাভাই রে বনু। উফ্! আই কান্ট ওয়েট, কখনো যে তোকে সব বলবো। (মনে মনে)
সোরায়া মিরায়ার উত্তর না পেয়ে আবার বলল-“হ্যালো আপু? শুনছো? এতো রাতে না এলে হতো না?”
মিরায়া এবার উত্তর দিলো সোরায়ার প্রশ্নের-“আরে কাউকে না জানিয়ে আসছি আমি চট্টগ্রামে। তোর ভাইয়া জানে না।”
সোরায়া হালকা জোরে চেঁচিয়ে বলল-“কিহহ্? একা আসছো এতো টা জার্নি করে তাও ভাইয়াকে বলনি। আপু ভাইয়া জানার পর খুব রাগ করবে। তুমি ভালো করেই জানো ভাইয়া তোমাকে নিয়ে কি পরিমান সিরিয়াস।”
মিরায়া সোরায়ার কথায় আরো লজ্জা পেল যেন-“ইসস্, সিরিয়াস না ছাই। বউ বলেই এতো কিছু। আগে আমি জানতাম না বলে বুঝি নি।” (মনে মনে)
মিরায়া সোরায়াকে আশ্বাস দিয়ে বলল-“তুই চিন্তা করিস না এতো। সে কতটা সিরিয়াস আমার জানা আছে। এই জন্যই তো চলে এসেছি। তোকে নিয়ে ঢাকা ফিরব বুঝেছিস?”
সোরায়া নিজের ঢাকা ফেরার কথাটা শুনেই এক চিৎকার দিয়ে উঠলো-“সত্যি আপু? আমিও ঢাকা যাবো?”
মিরায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-“ও মা আবার ঢাকা আসবি, এমন প্রশ্নের মানে কি? কলেজ এখানে, পড়তে হবে না বুঝি?”
সোরায়া উৎসাহ নিয়ে বলল-“হ্যাঁ হ্যাঁ পড়বো তো। তাড়াতাড়ি চলে আসো আপু।”
মিরায়া হালকা হেঁসে বলল-“আচ্ছা আসছি, তুই ফোনটা রাখ। আমাকে আবার রাইড করতে হবে। বাই বাই। দেখা হচ্ছে।”
সোরায়া-“ওকে বাই বাই। তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
দুই বোন কথা বলে ফোন রেখে দেয়। সোরায়া আবার ঢাকা ফিরতে পারার খুশিতে খাটের উপরই লাফাতে থাকলো-
“ইয়াহু উউউ… আমি আবার কলেজ যাবো। ইয়েএএ… আবার জুঁইয়ের সাথে দেখা হবে আর মাহি…রর..স্যার..!”
সোরায়া মাহিরের নামটা নিয়েই একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আজ দুইদিন হয়ে গেছে সে চট্টগ্রামে চলে এসেছে ঢাকার কোনো খবর তার কাছে নেই। জুঁইয়ের সাথেও কোনো যোগাযোগ হয়নি। তার কাছে তার ফোনটাও নেই। এখন শুধু মিরায়ার সাথে কথা বলার জন্য চাচি একটা বাটন ফোন দিয়েছেন। কিন্তু জুঁইয়ের নাম্বারটাও নেই যে কথা বলতে পারবে সেটা দিয়ে। মন মেজাজ কিছুই ভালো নেই তার সব সময় ঢাকার কথাই মনে পড়ে আর সাথে মাহিরের কথাও।
সোরায়া খাট থেকে নেমে আয়নার সামনে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো-
“আচ্ছা মাহির স্যারের কি একবারও আমার কথা মনে পড়ে না? উনি নবীন বরণের দিধ কেন এমন করলেন? কেন আমাকে বলেছিলেন যে আমি উনাকে জ্বালাতন করছি তাও আবার উনার কথা মতো উনাকে এড়িয়ে চলে? কি মানে ছিল ওইসব কথার?”
সোরায়া নিজের কোনো প্রশ্নের উত্তর পেলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে গেল রান্নাঘরে। মিরায়া আসছে এই খবরে সে এখন যথেষ্ট খুশি। বাড়ি ফিরে মিরায়ার ক্ষুদা লাগতে পারে এই ভেবে ফ্রিজ থেকে রাতের বেঁচে যাওয়া খাবার গুলো বের করে রাখলো, গরম করতে। যেন মিরায়া এতো লম্বা জার্নি করে বাড়ি ফিরে কিছু খেতে পারে। অন্যদিকে মিরায়াও নিজের জার্নি শুরু করে।
চৌধুরী বাড়ি~
রাত ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ১.৩০ বাজছে। বাড়ির সবাই যে যার যার ঘরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মিরায়া রেসে যাওয়ার আগে সবাইকে বলেছিল তার শরীর ঠিক লাগছে না তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। কেউ আর কিছু বলেও নি তাকে। নিজের ঘর থেকেই মিরায়া নিজের কয়েকটা ওড়না একসাথে বেঁধে লম্বা দাঁড়ির মতো বানিয়ে বারান্দা দিয়ে সেটা ঝুলিয়ে নিচে নেমে রেসে গেছিল লুকিয়ে। এই সম্পর্কে কারোর কোনো ধারণা নেই বরং সবাই ভেবেছে মিরায়া নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে আছে। তাই সবাই নিশ্চিত হয়ে নিজেদের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে।
সম্পূর্ণ চৌধুরী বাড়ি ধীবর অন্ধকার কেবল রুদ্রর রুমের লাইট জ্বলছে। রুদ্র একের পর এক শার্ট বের করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের উপর ধরছে যেন কোথাও যাওয়ার জন্য বেশ তোর জোর চলছে, কিন্তু কোনো পোশাকই তার ভালো লাগছে না। সে একটার পর একটা শার্ট বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলছে -“ধুর এসব কবে কিনেছি আমি? একটাও ভালো না। টোটাল মানি ওয়েস্ট।”
শেষ মেষ সব ঘাঁটাঘাঁটি করার পর একটা সাদা শার্ট ই তার মনে ধরলো যেটা সে সবার আগে অপছন্দের তালিকায় রেখে বিছানায় ছুড়ে ফেলে ছিলো। রুদ্র শার্টটা পড়ে এলো আয়নার সামনে-“এটা তাও ঠিক ঠাক লাগছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট না করে আগে আগে এটা পড়ে ফেললেই হতো।”
রুদ্র এর পর শার্ট টা ঠিক মতো ইন করে পড়ে চুল ঠিক করে নিয়ে নিজের ঘর থেকে বের হয় গাড়ির চাবি আর তার একটা ওভার কোর্ট নিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামার পরই হঠাৎ বাড়ির মূল দরজা খুলে রায়ান ভিতরে ঢুকলো। ড্রয়িং রুম অন্ধকার অবস্থায় থাকায় রুদ্র আর রায়ান অন্ধকারে একে অপরের সাথে ধাক্কা খায়ে। সাথে সাথে দুইজন ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো-
রায়ান-“আআআআআআআআ…!
রুদ্র -“আআআআআআআআ…!
দুই ভাইয়ের চিৎকারে রামিলা চৌধুরী ও রায়হান চৌধুরী ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে নিজেদের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমের লাইট জ্বালায়। লাইট জ্বালিয়ে তারা যা দেখলো তা কোনো কমেডি মুভির দৃশ্যের থেকে কম কিছু নয়- রায়ান আর রুদ্র দুইজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে “আআআ…!” করে চেঁচাচ্ছে তাও আবার একে অপরের উপস্থিতিতে ভয় পেয়েই।
রায়হান চৌধুরী জোরে চেঁচিয়ে বললেন -“চুপপ.. হচ্ছে টা কি এখানে? এতো চেঁচামেচি কিসের?”
রামিলা চৌধুরীর চোখে ঘুম উড়ে গেছে তবে চোখ এখনো নিভু নিভু তাই হাত দিয়ে চোখ কচলে যাচ্ছেন। বাবার চিৎকারে ভয় পেয়ে দুইভাই সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলো। দুইজন জড়িয়ে থাকা অবস্থায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের হাতের বাঁধন ছেঁড়ে দিয়ে আলাদা হয়ে দাঁড়ালো। রায়হান চৌধুরী ও রামিলা চৌধুরী তাদের দুই ছেলেকে অবাক চোখে দেখছেন। দুইজনের গেটাপ কেমন যেন অদ্ভুত। রায়ান বাইরে থেকে এলো সেটা তো বোঝা যাচ্ছে কিন্তু রুদ্র কোথা থেকে এলো? না কোথাও যাচ্ছে? আর এতো রাতে কোথায় যাচ্ছে? তার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রায়ান রুদ্র আড় চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে একনজর দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলল, দুইজনেরই লজ্জা লাগছে একটু আগের ঘটনার জন্য। কিন্তু বাবা মার সামনে নিজেদের বীরত্ব হাড়ালে চলবে না বলে রায়ান একটু অন্যভাবে ঘটনাটা ঘুরানোর চেষ্টা করলো-
-“সারপ্রাইজ আব্বু, আম্মু…!”, রায়ান হঠাৎ জোরে কথাটা বলল। আর সাথে রুদ্র কে চোখের ইশারা দিতেই রুদ্র ও রায়ানের মতোই করলো-“হ্যাঁ হ্যাঁ, সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ।”
রায়হান চৌধুরী চেঁচিয়ে উঠলেন -“মশকরা চলছে নাকি? এতো রাতে কিসের সারপ্রাইজ হ্যাঁ?”
রুদ্র নিজেও তো জানে না রায়ান কি বোঝাতে চেয়েছে। সে প্রশ্ন সূচক চাহুনিতে রায়ানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো-
“কিসের সারপ্রাইজ?”
রায়ান কি বলবে নিজেও বুঝলো না তবে কোনো ব
ভাবে তো ম্যানেজ করতে হবে, তাই আর কিছু না পেয়ে উত্তেজনা বজায় রেখে বলল-“সারপ্রাইজ হচ্ছে,,, আমি রেস জিতে গেছি।”
রুদ্র ও সাথে তাল দিয়ে খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল-“হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া রেস জিতে গেছে। সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ।”
রুদ্র এক মুহূর্ত রায়ানের দিকে তাকাতেই রায়ান ইশারা করে বলল-“ওভার এ্যাক্টিং এর দোকান।”
রুদ্র রায়ান এবার নিজেরা একটু স্বাভাবিক হয়ে গেল যেন বাবা মাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে তারা একটু আগে ইচ্ছে করে চেঁচামেচি করছিল সারপ্রাইজ দিতে।
কিন্তু রায়হান চৌধুরী তখন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো-“রেস জিতে সারপ্রাইজ দেওয়ার কি আছে তাও এভাবে? বয়স কত তোদের? ঠিক সময় বিয়ে করে সংসার করলে এখন তোদের বাচ্চাদের থেকে সারপ্রাইজ পেতাম।”
রায়ান রুদ্র হা হয়ে আছে যেন কিছুই বুঝতে পারলো না, হঠাৎ বিয়ে আর বাচ্চা কোথা থেকে উদয় হলো এসবের মাঝে।
রামিলা চৌধুরীও তাল দিয়ে বললেন-“সে আর বলতে, একজনের বয়স ২৭ গড়িয়ে ২৮ প্রায় আরেক জনের ২৬ প্রায় অথচ তারা এসব করে সারপ্রাইজ দিচ্ছে। এই জীবনে আর না কি কি দেখবো কে জানে।”
রুদ্র রায়ান আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে চেচিয়েছে দুইজন এটা বাবা মা বুঝতে পারলে যতটানা অসম্মান গায়ে লাগতো, বয়সের খোটা যেন তার চেয়ে বেশি অপমান জনক লাগছে। রুদ্র রায়ান দুইজন একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। কি ই বা বলবে আর। হঠাৎ রায়হান চৌধুরী রামিলা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললেন –
“তোমার ছেলেদের জন্য আমার ঘুমটা নষ্ট হলো। চলো ঘরে এখন, ঘুমোতে যাওয়া যাক। এই দুই নমুনা যা করছে করুক।”
রামিলা চৌধুরী রায়হান চৌধুরীর কথায় হালকা খেপে
বললেন- “ওমনি আমার ছেলে হয়ে গেল না? আকাশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম নাকি ওদের। আপনি এক নমুনা আপনার ছেলেরাও তাই। আমার বউমা গুলোর যে কি হবে কে জানে, ওদের ও না আমার মতো ভুগতে হয়। আমি গেলাম ঘুমোতে আপনার তিন নমুনা কি করবেন করুন।”
এখন রায়হান চৌধুরী, রায়ান ও রুদ্র তিন জনই আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রামিলা চৌধুরী সাথে সাথে কথা শেষ করে ঘরে চলে গেলেন রুমের দিকে। রায়হান চৌধুরী দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। রায়ান রুদ্র হালকা বানোয়াট বোকা বোকা চেহারা করে তাকালো।
দরজা টা লাগানোর আগে বললেন-
“এখনি ঘরে না এলে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে যাবো।”
রায়ান রুদ্র হঠাৎ শব্দ করে হেঁসে ফেললো। রায়হান চৌধুরী তাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন কিন্তু কিছু বলায় আগেই রামিলা চৌধুরীর ভারী গলা শুনা গেল-
“কি হলো? আমি কি ঘুমিয়ে যাব?”
রায়হান চৌধুরী আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। এখন ড্রয়িং রুমে রায়ান আর রুদ্র একা। এতোক্ষণ একসাথে যুক্তি করলেও এখন দুইজনেই কেমন অস্বস্তি অনুভব করছে। তবে একটু আগের ঘটনাটা নিতান্তই ভয়ের জন্য হয়েছে। অন্ধকারে এমনটা আচমকা হতেই পারে আহামরি বড় কিছু নয়। রায়ান রুদ্র কে এতো রাতে এমন ফোর্মাল ড্রেসে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কি যে এতো গভীর রাতে কার সাথে মিটিং করতে যাচ্ছিস?”
রুদ্র একটু থতমত খেয়ে গেল। কি উত্তর দেবে ও-“তোমার দূর সম্পর্কের শালির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি!? ছিঃ ছিঃ এইটা বললে ত্যাজ্য ভাই করে দেবে নিশ্চিত।” রুদ্র মনে মনে ভাবলো।
রায়ান রুদ্র কে গভীর চিন্তায় দেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো-“ওই কিরে? উত্তর দিস না কেন? কি যাচ্ছিস এতো রাতে? ওয়েট ওয়েট কোনো মেয়ের চক্কর তাই না?”
মেয়ের চক্কর শুনেই রুদ্রর গলা শুকিয়ে এলো কিন্তু রায়ানকে এমন কিছু বুঝতে দিলে চলবে না তাই একটু বড়বড় ভাব নিয়ে বলল-“আরে এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে নাকি আমার বাইরে যাওয়ার আগে? যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাচ্ছি। মেয়ের চক্কর হতে যাবে কেন? আর হলেই সমস্যা কি?”
রুদ্র রায়ানের সাথে কখনো এভাবে কথা বলে না। ভাই অন্ত প্রাণ রায়ান তার আছে, রায়ানের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। হঠাৎ রুদ্রর ভড়কে যাওয়া দেখে রায়ান বেশ অবাক হলো।
রায়ান রুদ্রর বিরক্তি দেখে আর কিছু বলল না শুধু শান্ত কন্ঠে বলল-“আমি তো শুধু মজা করছিলাম এমন করে খেক খেক করে উঠার কি হলো! যাচ্ছিস যা। সাবধানে বাড়ি ফিরে আসিস তাড়াতাড়ি।”
রুদ্র নিজের জোরে কথা বলার জন্য একটু অপরাধ বোধ অনুভব করলো কিন্তু আর কিছুই না বলে বাড়ি থেকে বের হতে উদ্যত হয়। তখনি হঠাৎ রায়ান রুদ্র কে বলল-
“ওই চেম্প দ্বারা।”
রায়ান ছোট বেলায় রুদ্র কে চেম্প ডাকতো যেটা বড় হওয়ার পর খুব কমই রায়ানের মুখে শুনা গেছে। আজ হঠাৎ এ ডাক শুনে রুদ্রর পা থমকে গেল। রায়ান হেঁটে রুদ্রর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল-
“যেখানে যাচ্ছিস কাজ কমপ্লিট করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবি। রাত অনেক হয়েছে। ওকে?”
রুদ্র রায়ানের দিকে তাকালো খুব মায়া ভরা চোখে আর বলল-“ওকে ভাইয়া।”
রায়ান এবার একটু কুটিল হেঁসে বলল-“যাওয়ার আগে বলে যা তোর ভাবি কই?”
রুদ্র হালকা হেঁসে জবাব দিল-“মিরা ভাবি রুমেই আছে। সন্ধ্যার পর থেকে নিচে নামেনি। বললো ওর শরীর ঠিক লাগছে না।”
রায়ান ঠোঁট কামড়ে হেঁসে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল-
“শরীর ঠিক নেই বলে সন্ধ্যা থেকে ঘর থেকেই বের হয়নি। আর কেউ খবরও নেয় নি কি করছে এতোক্ষণ ঘরে। হাহ্! নো ওয়ান্ডার এতো বছরেও কেউ টের পায়নি তোমার রাইডিং এর ব্যাপারে হৃদপাখি।”
রায়ানের মনে হচ্ছিল এতোক্ষণে হয়তো মিরায়া আবার নিজের রুমে ঢুকে গেছে। সে আসলে দেখতে চাইছিল মিরায়া আর কিভাবে সত্য গোপন করতে পারে । রায়ান রুদ্র কে তাড়া দিয়ে বলল-
“আচ্ছা তুই তোর কাজে যা। আমি তোর ভাবির ঘরে যাচ্ছি।”
রুদ্র একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সন্দেহ ভরা নজরে-
“এই সময় তুমি মিরার.. মানে মিরা ভাবির ঘরে কেন যাবে?”
হাজার হোক বড় ভাইয়ের দায়িত্ব যেন রুদ্রর মাথা থেকে যায় না। রায়ান রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে মজার সুরে বললো-
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৩
“আমার একমাত্র ভাই প্লাস শালা সাহেব আপনি নিশ্চিন্তে নিজের কাজে যান। আপনার বোনকে প্লাস ভাবির সাথে আমি তার অনুমতি ছাড়া কিচ্ছু করবো না। আই প্রমিস।”
রুদ্র আর কথা না বাড়িয়ে বলল-“আই ট্রাস্ট ইউ, আমার বড় ভাইয়া প্লাস ভগ্নিপতি।”
তারপরই রুদ্র বের হয়ে গেল। রিমির সাথে দেখা করবে বলে।
রায়ান মুচকি হেঁসে রুদ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো-“ডোন্ট ট্রাস্ট মি হুয়েন ইট’স অ্যাবাউট ইউর সিস্টার। প্রমিসেস আর মেন্ট টু বি ব্রোকেন মাই লিটল ব্রাদার। মিরা আমার বউ , আমার হক আছে ওর উপর। হো আই ক্যান ডু এভরিথিং।”
