আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৫

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৫
অরাত্রিকা রহমান

-“এইযে ভাই, আপনার সমস্যা টা কি বলবেন? কি চাই? আমার পথ কেন আটকেছেন?”
লোকটা এখনো কোনো কথা বলল না। মিরায়াকে দেখে যাচ্ছে হেলমেটের ভিতরে থেকেই। এই দিকে মিরায়ার মন ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা। একটা লোকের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা মিরায়ার আছে, আর এই ব্যাপারে সে নিজেও অবগোত তবে যেহেতু কাউকে না জানিয়ে এতো রিস্ক নিয়ে বাড়ি ফিরছে রাতের বেলা তাই বাড়তি ঝামেলা তে জাড়াতে চাইছিল না। কিন্তু ঝামেলার পরোয়া করলে দুনিয়াতে টিকে থাকা মুশকিল।

লোকটা শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে এসে মিরায়ার বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যখনি বাইকের উপর হাত রেখে ছিল মিরায়া তখনি সাথে সাথে নিজের হাত মুঠো পাকিয়ে নেয় মন দৃঢ় রেখে। লোকটা বাইকের উপর থেকে হাত সড়িয়ে যখনি মিরায়ার দিকে হাত বাড়ায় মিরায়া এই সময়েই লোকটার হাত ধরে মুচড়ে ধরে হেলমেটের উপরেই একটা ঘুষি মেরে ভিসর গ্লাস ফাটিয়ে দেয়। আকস্মিক ঘটনায় লোকটা নিজেকে সামলাতে না পেরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো হালকা ব্যাথিত শব্দ করে-“আহহহ্…ইসসস!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরায়া বাইক থেকে নেমে আবারো আঘাত করতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উপরে উঠায়, মারতে যাবে ঠিক তার আগেই হেলমেটের ভিতর থেকে অচেনা লোকটা বলে উঠলো-“এই না না না, আর মারিস না, তোকে তো পাল্টা প্রতিঘাতও করতে পারবো না আমি।”
মিরায়া অচেনা লোকটার কথা শুনে একটু অবাক হয়ে নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত নিচে নামিয়ে নিয়ে চোখ ছোট ছোট করে রাতের অন্ধকারের মাঝে বাইকের লাইটের ঝাপসা আলোতে দেখার চেষ্টা করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো-
“কে আপনি? আমাকে তুই করে সম্বোধন করছেন কেন জানতে পারি? এতো রাতে আমার বাইক কেন আটকেছেন হ্যাঁ? মতলবটা কি!”

একসাথে এতো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে লোকটা একটু হেঁয়ালি করে বলল-“এতো প্রশ্নের উত্তর একসাথে কিভাবে দেই বলতো? আগে উঠতে দে। নিজেকে সামলে নেই।”
মিরায়া সোজা হয়ে দাঁড়ালো, লোকটা রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়ালো মিরায়ার সামনে, মিরায়া অবাক চোখে লোকটার হাবভাব খেয়াল করছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না কোথা থেকে উদয় হলো লোকটা মাঝ রাস্তায়। লোকটা নিজের হাত, আর জামা কাপড় থেকে ধুলো ঝেরে নিয়ে মিরায়ার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে নিজের হেলমেটটা খুলল। আর লোকটা হেলমেট খুলার পর তার চেহারা অবলকন হতেই সাথে সাথে মিরায়া তার দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে অবাক সুরে বলল-“আসিফ ভাই.. আপনি?”
আসিফ হেলমেটটা খুলে নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে নিলো। মিরায়ার প্রশ্নে সামান্য হেঁসে বলল-“হ্যাঁ আমি। সারপ্রাইজ…!”

মিরায়া আসিফকে এমন সময় ঐ জায়গায় একদমই আশা করে নি হঠাৎ আসিফকে সামনে দেখায় অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো-“আপনি এখানে কেন? কিভাবে? কোথায় যাচ্ছেন?”
আসিফ মিরায়ার দিকে আপ্লুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনেক দিন পর আবার সে তার প্রিয়শীকে নিজের চোখের সামনে দেখলো। আসিফ আকুল ভাবে তার মনে মিরায়াকে এক নজর দেখার জন্য যে তৃষ্ণা ছিল তা নিবারণ করতে চাইছে কিন্তু মিরায়া হেলমেট পড়ে থাকায় তা পারছে না।

আসিফ মিরায়ার অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল- “হেলমেট টা খুলে কথা বললে ভালো হয় মেডাম। ভিসর গ্লাস ভেদ করে আপনার চাঁদের মতো উজ্জ্বল মুখটা দেখতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে খুব।”
মিরায়া জানে আসিফ মজার মানুষ টিমের সবাই তাকে সেই জন্যই বেশি পছন্দ করে। মিরায়া মজা হিসেবেই কথাটা নিলো। সে আসিফের কথায় নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হেলমেটটা খুলে নিয়ে বলল-
“নিন খুলে ফেলেছি। এবার তো বলুন, এখানে কিভাবে আপনি? কেন এসেছেন?”
আসিফ মিরায়ার চেহারাটা বেশ আনন্দিত মনে দেখছিল, চোখের তৃপ্তি আর মনের তৃপ্তি এক জায়গায় হলে যেমন হয় ঠিক তেমন করে। মিরায়া চিন্তিত চোখে ক্লান্তি স্পষ্ট, তবে সেটা যেন মেয়েটাকে দুর্বল নয় বরং আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আসিফ মিরায়ার দিকে তাকিয়েই হালকা মজার ছলে বলল-

“না এসে কি আর উপায় ছিল? মাঝরাতে হঠাৎ যদি দেখি কথা নেই বার্তা নেই আমাদের রায়া মেডাম এই সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বাইকে করে পারি জমিয়েছেন তাহলে কি তার গুরুর ঘরে বসে থাকা মানায়?”
মিরায়া অবাক হলো আসিফের কথায়। সে তো সোরায়াকে ছাড়া কাউকে বলেনি সে চট্টগ্রামে আসছে আর সোরায়া আসিফ কে যদি জানিয়েও থাকে এতো তাড়াতাড়ি আসিফের সেখানে যাওয়া তো সম্ভব নয় তাহলে কিভাবে জানলো আসিফ! মিরায়া কৌতুহল থেকেই প্রশ্ন করলো-

“আমি চট্টগ্রামে ফিরছি সেটা আপনি কিভাবে জানলেন আসিফ ভাই?”
আসিফ একটু হেঁসে মিরায়াকে তার ফোন বের করে লোকেশন ট্র্যাকিং করা অ্যাক বের করে স্ক্রিনটা মিরায়ার দিকে ধরে বলল-“কিভাবে আবার! এইভাবে জানতে পেরেছি।”
মিরায়া স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ফোনের স্ক্রিনে তার বাইকের লোকেশন দেখাচ্ছে। মিরায়া এখন আরো অবাক হয়ে বলল-“আমার বাইকের লোকেশন আপনি পাচ্ছেন কিভাবে আসিফ ভাই?”
আসিফ ফোনটা মিরায়ার থেকে সড়িয়ে নিয়ে অফ করে দিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বলল-
“ঢাকা এসে রাইডিং কমিউনিটির নিয়ম ভুলে গেছিস নাকি? তোর বাইক অন্য কাউকে দিয়ে ঢাকা পাঠানো হয়েছে। এইভাবেই কি বাইক যে কারো হাতে কখনো দিয়ে দেওয়ার নিয়ম আছে নাকি?

রুলসে আছে, বাইক ট্রান্সফার করার সময় ট্রেকিং ডিভাইস ইনসার্ট করা হয় বাইকে, সেটা ঠিক মতো গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারলো কিনা বুঝতে। নাহলে, যদি চুরি করে পালায় ভর্তুকি কে দেবে বল?
আর এটার দৌলোতেই যখন দেখলাম রেসের টাইম ওভার হওয়ার পরও আমাদের রায়া মেডাম কোনো খবর দিচ্ছেন না, তখন আপনার অবস্থান চেক করতে গিয়ে চোখে পড়লো আপনি বাইক ছুটিয়েছেন চট্টগ্রামের হাইওয়ের দিকে, তাও এই রাতের বেলায়। আমার কি আর ঘরে বসে থাকার জো আছে? তাই নিজেই চলে এলাম উইনার কে ওয়েল কাম করতে।”
মিরায়া সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝলো কিন্তু আসিফের এতো দূরে রাতের বেলা কষ্ট করে আসাটা মিরায়া ঠিক নিতে পারছিল না তাই হালকা কঠিন গলায় বলল-

“তাই বলে এই সময়েই চলে আসতে হবে এতোটা দূরে? আমি তো যাচ্ছিলামই। আর ওয়েট ওয়েট, আপনাকে কে বলল আমি জিতেছি? হাড়তেও তো পারি।”
আসিফ ঠোঁট কামড়ে হেঁসে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল-
“আকাশে চাঁদ নাও উঠতে পারে কিন্তু আমার রায়া জিতবে না। উঁহু তা হবে না, তা হবে না।”
মিরায়াকে নিজের হাতে করে বাইক চালানো শিখিয়েছে বলে আসিফ মিরায়ার রায়া সত্তাকে বরাবরই নিজের দাবি করে, মিরায়াও তার গুরু হিসেবে আসিফকে ভাইয়ের মতো সম্মান করে। তাই কখনো কিছু মনে করে নি আসিফের কথায়। তার কোনো ধারণা নেই আসিফ ঠিক তাকে কি নজরে দেখে। মিরায়া আসিফের কথায় বেশ মজা পেল। তার খুব ভালো লাগে শুনে যে রাইডার হিসেবে এমন একটা জায়গা সে তৈরি করতে পেরেছে যেখানে রায়ার হার অন্য সবার কাছে অসম্ভব মনে হয়।

মিরায়া মিষ্টি হেসে বলল-“সবই আমার গুরুজির ক্রেডিট। তবে হ্যাঁ আমি একা জিতিনি, টায় হয়েছিল রেসে। তার পর আমরা দুজন উইনার নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছি, সে ট্রফি চেয়েছিল আর আমি প্রাইস মানি।”
আসিফের মুখের হাঁসি মিলিয়ে গেল। সে মিরায়াকে একটু গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-
“ট্রফি তাকে দিয়েছিস মানে? তোর স্বীকৃতি তোর ট্রফি, মিরা। তুই টাকা কেন চুজ করতে গেলি?”
আসিফ সবসময় মিরায়ার কৃতিত্বে খুশি হতো। কিন্তু এইবারে মিরায়ার হাতে ট্রফি ছিলো না বলে তার বিষয়টা পছন্দ হয়নি।

মিরায়া একবার ভাবলো রায়ানের কথা সম্পূর্ণ টা আসিফকে খুলে বলবে কিনা। পরবর্তীতে আবার ভাবলো সকালে রায়ান যখন চট্টগ্রামে তাকে নিতে আসবে তখনি না হয় বলবে সব। রেসের ব্যাপারেও সাথে বিয়ের ব্যাপারেও।
মিরায়া আসিফের বিরক্তি কারণ বুঝতে পেরে তাকে বুঝিয়ে বলল-
“টাকা টা কমিউনিটির সবার। আমি নিজের হকের জন্য অন্যের হক নষ্ট করতে পারি না। তাছাড়া যে ট্রফি চুজ করেছে তার টাকার প্রয়োজন নেই। সিদ্ধান্ত টা আমি নিজের বিবেক থেকে নিয়েছি। প্লিজ আসিফ ভাই আপনি এটা নিয়ে রাগ করবেন না।”

মিরায়া মনে মনে আনন্দ নিয়ে আওড়ালো-“টেনশন নট গুরুজি। আমার ট্রফি আমিই পাবো। আমার বর দেবে আমাকে। একবার শশুর বাড়িতে নিয়ে যাক বউ করে তারপর। আমাকে নিতে এলে আপনাকেও দেখাবো, আমার বরটা কত হেন্ডসাম।”
আসিফ মিরায়ার দিকে তাকাল। কি মায়াবী সেই চেহারা! সে আনমনে বলল-“এভাবে বললে গোলে যাবো এখনি, রাগ করা তো দূরের কথা।”
মিরায়া ঠিক বুঝলো না আসিফের কথা-“কি বললেন? শুনতে পেলাম না গুরুজি।”
আসিফ হালকা কেশে নিয়ে বলল-“বললাম ভালো করেছেন মানব দরদী। কমিউনিটির সবাই খুশি হবে শুনলে তুই জিতেছিস।”

মিরায়া আসিফের কথায় মিষ্টি হাসলো। আসিফ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিরায়াকে একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে বলল-
“হয়েছে হয়েছে। এবার বাইকে উঠ। তাড়াতাড়ি চল নাহলে রাত টা রাস্তায় কাটাতে হবে। কি এক শরীর পেয়েছিস কে জানে ক্লান্তি বলতে কিছু নেই।”
মিরায়া দাঁত বের করে হেঁসে বলল-“আল্লাহ দিয়েছে আমাকে এই শরীর।”
আসিফ ব্যঙ্গ করে বলল-“হ্যাঁ জানি, আমি শিখিয়েছি তো সব।তুই কি তা আমি জানি, আর বলতে হবে না। এবার দাঁত না দেখিয়ে বাইকে উঠ।”
আসিফ নিজের হেলমেটটা পড়ে নিলো। কিন্তু হেলমেটের ভিসর তো মিরায়ার ঘুষিতে ভেঙে গেছে। ভাঙা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আসিফ একবার মিরায়ার দিকে তাকালো। মিরায়া ও খেয়াল করে চেহারায় একটু অপরাধ বোধ এনে বলল-

“সরি, আসিফ ভাই। তবে দোষ আপনার আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলাম কে, আপনি তো কিছুই বললেন না তখন। আমি কি করবো ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
“ভয় পেয়ে মানুষকে পালাতে দেখেছি, মারামারি করতে দেখিনি কাউকে। এই প্রথম তোকেই দেখলাম যেই মেয়ে নাকি ভয় পেলে চিৎকার না কোরে, পালিয়ে না গিয়ে উল্টো যাকে ভয় পাচ্ছে তাকেই মারধর করছে উড়াধুরা।”
মিরায়া নিজের কথায় অযৌক্তিকতা বুঝতে পেরে বানোয়াট হাসলো-“হেহেহেহে..!”
আসিফ আদেশ মূলক সুরে বলল-“হেহেহে..না করে চল এবার। সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম এখন নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি। এখন এটার টাকা তোর প্রাইস মানি থেকে নিবো।”
মিরায়া আসিফের আদেশে বাইকে উঠে হেলমেট পড়তে পড়তে বলল-“আচ্ছা নিয়েন। তবে আবারো সরি।”
আসিফ নিজে নিজে একটু হেঁসে বিড়বিড় করলো-

“এভাবে সরি বলে আমাকে মারতে চাইছিস নাকি?”
আসিফ নিজের বাইকে উঠলো।
মিরায়া আবার অপরাধ বোধ থেকে বলল-
“কতবার সরি বলবো? এবার তো মাফ করে দিন গুরুজি!”
আসিফ বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল-“ইটস ওকে। সাবধানে রাইড করবি। চল এবার।”
মিরায়া মুচকি হেঁসে বাইক স্টার্ট দিলো। এরপর আসিফ আর মিরায়া দুইজনেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এইদিকে আসিফ আবার মিরায়াকে ফিরে পেয়ে খুশি আর মিরায়া উৎসাহিত কখন সে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে আর তার বর তাকে সসম্মানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।

রায়ানের গাড়িতে~
রায়ান উৎফুল্ল মনে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ির স্পিড বেশি না আবার কম ও না। রায়ান গাড়ির সাউন্ড বক্সে কিছু সুন্দর গান একে একে বাজাতে শুরু করলো। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে গানের লাইন। গুলো নিজ মুখে আনমনে গেয়ে উঠছে। বউকে তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে, বিয়ে বিয়ে একটা আমেজ তার নিজের মনেই সে তৈরি করে নিয়েছে। কি যেন মনে করে হঠাৎ একটা বিয়ে বাড়ির গান লাগিয়ে সেটার লিরিক্স নিজেই জোরে জোরে গাইতে লাগলো আর হাওয়াতে হাত তো নড়ছেই-

“Ab toh na hota hai,
ek roz intezaar soni,
ak nehi to Kal hai,
tujhko to bas Meri honi reee….
Tenu leke main javanga….
Dil deke main javanga….
Tenu leke main javanga….
Dil deke main javanga….”

এভাবেই নিজের মনের আনন্দ নিজেই উপভোগ করতে করতে বলল-“ইসস্ যদি একটুও আন্দাজ করতে পারতাম তখন, আমার বউটা এতো মেচিয়োর তাহলে এতো গুলো দিন ওয়েস্টই হতো না।”
নিজেকে আবারো একবার গাড়ির সামনের আয়নাটা ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে একটু হতাশায় নিজেকে বকাঝকা করতে লাগলো-
“কি আহাম্মকের আহাম্মক রে, যেই মেয়ে বিবাহিত তাই বরকে না চেনা সত্ত্বেও, পর পুরুষ ভেবে তোকে কাছে যেতে দিতো না, সেই মেয়ে জড়িয়ে ধরতে বলেছিল, কাছে যাওয়াতে আটকাচ্ছিল না, এতোটা নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছিল, এই সব দেখেও কিছু বুঝলি না? তখন আবেগে না ভেসে গিয়ে একটু মাথাটা খাটালেই এখন বউ নিয়ে বিছানায় থাকতে পারতি গাধা।”

রায়ানের আবেগ এখনো তার কন্ট্রোলে নেই। মন চাইছে না ড্রাইভ করতে তবুও করছে। আনন্দে শরীর টা ছেড়ে দিচ্ছে বার বার। পেটের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভব হচ্ছিল তার, হাজারো প্রজাপতির ভীর সেখানে। জীবনে প্রথমবার রায়ান চৌধুরী এমন কিছু অনুভব করছে। হাত দুটো ডানা হলে উড়ে চলে যেত বউয়ের কাছে আমার ধারণা তৈরি হচ্ছে তার মনে।

রায়ান নিজের মধ্যে আর এই ভালো লাগা রাখতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল গোটা পৃথিবীকে আজ চিৎকার করে জানাবে তার বউয়ের পরিচিতি। রায়ান হঠাৎ গাড়ির মধ্যে থেকেই চিৎকার করলো-
“মাই লাভলি মিসেস। আই লাভ ইউ। আই জাস্ট ফাঁকি** লাভ ইউ সো মাচ, মাই লিটল হার্ট-বার্ড। ওয়েট ফর মি প্লিজ। আই এম কামিং পর ইউ, ওনলি পর ইউ মাই মিসেস‌।”
রায়ানের কি মনে হলো হঠাৎ কে জানে। ফোনটা হাতে নিয়েই কল লাগালো মাহিরের নাম্বারে। একা একা আনন্দ উপভোগ করতে আর ভালো লাগছিল না তার।

খান বাড়ি~
মাহির বারি ফিরেছে ঘন্টা খানেক আগে। বাড়ি ফেরার পর সে তার মা বাবাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই পায়। স্বাভাবিকভাবেই অনেক রাত হয়ে গেছিল তার আসতে আসতে। মাহিরের খাবার তার মা ঢেকে রাখা ছিলো টেবিলের উপরে। মাহির নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে চলে যায় ঘুমাতে। কিন্তু তার ঘুম আসছিল না তার কাঙ্খিত ষোড়শীর জন্য। মাহির তার ফোনটা বের করে সোরায়ার সাথে ছবি টা জুম করে বারবার দেখতে দেখতে মুচকি হাসছিল আর তার সোরায়ার আগে করা পাগলামো ও ছেলেমানুষী গুলো মনে করছিল-
“কি বলে ছিল ও! ওর ওজন মাত্র ৪৫ কেজি আমার কষ্ট হবে না ওকে তুলতে। হাহ্! আই উইস যদি ওই দিন ওর কথা মতো ওকে তুলে নিতাম নিজের বুকে। উফফফ্ ঊফফ্। মাহির, হুয়াই? হুয়াই ইউ আর বিং লাইক দিস? গেট ইউর সেল্ফ টুগেদার।”

মাহির মানসিক ভাবে খুব বিরক্ত তার নিজের উপর। একদিকে সোরায়ার চিন্তা মাথা থেকে যাওয়ার নাম নিচ্ছে না আবার অন্যদিকে মেয়েটার কোনো খোঁজ খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। সব দিক থেকে কোণ ঠাসা। মাহির দুঃখে বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে বলল-
“অন্তর টা জ্বালিয়ে দিয়ে হওয়া হয়ে কোথায় উবে গেলে?”
রায়ান ঠিক এই সময়টাতেই মাহিরকে কল করেছে। রায়ানের কল আসার শব্দ মাহিরের কানে যাওয়ার পর মাহির বালিশের থেকে মুখ তুলে রায়ানের কল দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি কলটা ধরলো। এতোক্ষণ খেয়ালি ছিল না আজকের রাতের ঘটনা টা। রায়ানের কলে আবার সব খেয়াল হলো তার।
মাহির কিছু বলার আগের রায়ান উত্তেজিত গলায় বলল-
“কি অবস্থা দোস্ত কি করিস?”

মাহির একটু অবাক কারণ এই সুরে রায়ান কখনো কথা বলে না। মাহির অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো রায়ান কে-
“অবস্থা তো ভালোই দোস্ত। তোর কি অবস্থা কি?”
রায়ান অস্বাভাবিক আনন্দ মিশ্রিত গলায় বলল-
“আমার অবস্থা তো ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখার মতো যে দোস্ত।”
মাহির বেশ বুঝতে পারলো যে রায়ান কিছু একটা নিয়ে খুব আনন্দিত কিন্তু সেটা আন্দাজ করতে পারছে না। তাই নিশ্চিত হতে পাল্টা প্রশ্ন করলো-

“আচ্ছা আমি লিখবো ইতিহাস তোর নামে। কিন্তু আগে বল আমাকে, ইতিহাসের কাহিনী টা কি?”
রায়ান হেঁসে বলল-“জিতে গেছিরে। আই ফাঁ*কিং ওয়ান।”
মাহির তুচ্ছ স্বরে বলল-“আমি জানি তুই জিতেছিস।”
রায়ান মাহির কে অন্যভাবে বুঝাতে বলল-“আরে এই জেতা ঐ জেতা না রে। I won the race and won in my life too buddy…”
মাহির রায়ানের কথা বুঝতে না পেরে বলল-“বুঝতে পারছি না কি বলছিস, ঝেড়ে কাশ তো।”
রায়ান আহ্লাদ করে বলল-“তোর ভাবি মা, মানে আমার হৃদপাখি সবটা জেনে গেছে। সম্পূর্ণ সত্যি জেনে গেছে আমাদের বিয়ের ব্যপারে।”
মাহির আকাশ থেকে পড়লো একেবারে-“কি? জেনে গেছে মানে? ওই তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নাকি শোকে? খুশি হচ্ছিস কেন তুই? ভাবি মা কি ঝামেলা করেছে নাকি? তুই কি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিস? ওই কথা বল! কি বলেছে ভাবি মা?”

রায়ান যে পরিমাণ দ্বিধায় ছিলো মিরায়াকে সত্যি জানানো নিয়ে মাহির রায়ানের কথায় ভেবে ছিল সত্যি টা জানার পর মিরায়া অন্য রকম ভাবে রিয়েক্ট করবে। হয়তো রাগ করবে রায়ান কে বিনা দোষে দোষী সাব্যস্ত করবে। তাই যখন মিরায়া সত্যি টা জেনে গেছে এটা জানার পর রায়ান এতোটা খুশি সেটা মাহিরের অস্বাভাবিক লাগছিল। সে ভাবছিল মিরায়ার সত্যিটা জানার ফল স্বরূপ কোনো ঝামেলা হয়েছে যার দরুন রায়ান তার মানসিক স্থিতি হাড়িয়ে ফেলেছে।
মাহিরের প্রশ্নের উত্তরে রায়ার বলল-

“তোর ভাবি মা আমার জন্য অপেক্ষা করবে বলেছে দোস্ত। আমাকে আবার ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে বলেছে। আমি এখন রাস্তায় ওকে আনতে যাচ্ছি। ঢাকা ফিরে ট্রিট দিবো তোকে, ওকে?”
রায়ান নিজেও ঠিক মতো বুঝিয়ে বলতে পারছে না সে ঠিক কি বলতে চাইছে মাহির কে।
মাহিরের মাথায় কিচ্ছু ঢুকলো না রায়ান ঠিক কি বলার চেষ্টা করছে। মাহির আবারো প্রশ্ন করলো-
“তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কাইন্ডলি একটু বুঝিয়ে বল তাড়াতাড়ি। আর তুই এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস?”

রায়ান একটু শান্ত করলো নিজেকে দুই তিনবার ব্রিথ ইন ব্রিথ আউট করে তারপর কিছু টা স্বাভাবিক হয়ে বলল-
“আমি বাড়ি যাওয়ার পর দেখি মিরা ঘরে নেই, পরে জুলিয়েট মানে আমাদের মেয়ে , ধুর তুই এইটা বুঝবি না, আমাদের মেয়ে মানে আমাদের পেট বিড়াল ও আমাকে একটা কাগজ দেখালো। কাগজটা ওই ডিভোর্স পেপার ছিল যেটা আমি এনেছিলাম, সেটাতে মিরা চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার আগে আমাকে লিখেছে ও আমার জন্য অপেক্ষা করবে আর আমি যেন আমার কথা রাখি। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম ও যেখানে যাবে আমি সেখানেই যাবো ওকে ফেরাতে। তুই বুঝতে পারছিস এর মানে? তার ভাবি মা ওর আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে রে। ও আমার সাথে সংসার করতে রাজি। আআহহহ্ শান্তি। ভাবতেই ভালো লাগছে। দাঁড়া তোকে কাগজটার ছবি পাঠাচ্ছি।”
মাহির যে এইবারও রায়ানের কথা খুব বুঝতে পেরেছে এমনটা নয়। তার মনে প্রশ্নের শেষ হচ্ছে না। কিন্তু আপাতত রায়ানের কথা বোঝার চেষ্টা করাটাই শ্রেয় পরে না হয় সব কিছুর উত্তর জানবে। মাহির রায়ানের কথার ধারাবাহিকতায় বলল-

“হ্যাঁ দেখা, দেখি। আগে গাড়িটা সাইড করে দাঁড়া করা তারপর দে।”
রায়ান মাহিরের কথা মেনে নিয়ে বলল-“আচ্ছা ওয়েট। গাড়িটা বরং থামিয়েই নেই।”
রাতের রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা। শুধু হেডলাইটের আলোয় সামনের রাস্তাটা যেন ছুরি কাটা নীরবতায় ছেদ ফেলছে। রায়ান এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে ফোনটা কান ঘেঁষে রেখেছে। এভাবে ফোন ধরতে সমস্যা হচ্ছিল তাই ফোনটা গাড়ির ডেস্কের উপর স্ট্যান্ডার টার উপর রাখলো ফোনটা স্পিকারে দিয়ে। তার পর আবার স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখলো।
হঠাৎ করেই সামনে হালকা মোড় আসতেই সে ব্রেকে পা দিল—চাকা সামান্য ঘর্ষণের শব্দ করল, কিন্তু গাড়ি থামলো না।

রায়ান ভ্রু কুঁচকে আবারও ব্রেকে পা রাখল,গাড়ি তবু চলছে একই গতিতে, একটুও কমছে না।
রায়ান বিরক্ত হয়ে উঠে গলা নিচু স্বরে গর্জে উঠল—
“Now what the fu*ck is wrong with this car?”
চোখ এক মুহূর্তের জন্য রোড থেকে সরে গেল, কিন্তু আবার সাথে সাথেই স্টিয়ারিংয়ে ফিরল।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মাহিরের রায়ানের আওয়াজ পেয়ে জিজ্ঞেস করলো—
“What’s wrong! গাড়ির কি হলো আবার?”
রায়ান দাঁতে দাঁত চেপে মাহিরের প্রশ্নের উত্তর দিল, গাড়ি ব্রেক করতে করতেই—”আরেহ হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না!”

এই কথাটা শুনেই মাহিরের মুখের ভাব পাল্টে গেল। সে হঠাৎ শুয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলো বিছানায় আর চিন্তিত গলায় বলল-
“ব্রেক কাজ করছে না মানে কি?! চেষ্টা কর! বারবার কর! ব্রেক কাজ করবে না কেন!”
রায়ান এবার জোরে পা দিয়ে ব্রেক চাপতে চাপতে শক্ত করে স্টিয়ারিং চেপে ধরে বলল—
“করেই যাচ্ছি, স্টিল কাজ হচ্ছে না!”
তার মুখে ঘাম জমেছে, হাতের পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেছে, চোখে একফোঁটা আতঙ্ক ঝলক দিয়ে গেল কিন্তু ভয় নেই চোখে।

এদিকে ব্রেক কাজ করছে না কোনো ভাবে এটা শুনে মাহির পুরো প্যানিক করে গেছে। সে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল, ঘরজুড়ে হাঁটছে এদিক-ওদিক।
“দেখ কিছু করে থামাতে পারিস কি না! ব্রেক হঠাৎ করে কাজ করবে না এমন তো সম্ভব না!”
রায়ান বুঝতে পারছে পরিবেশটা ভালো রিস্কি যার জন্য মাহির প্যানিক করছে। কিন্তু এখন মাহিরের সাথে সাথে যদি এখন সে তাল দেয় তাহলে পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হবে তাই রায়ান মাহির কে স্বাভাবিক রাখতে হালকা হাসি দিল, নিজের কণ্ঠে শান্ত একটা ভাব আনার চেষ্টা করল—
“আরে তুই প্যারা নিচ্ছিস কেন? গাড়ির হেলথ পারফেক্টলি ফাইন। হয়তো একটু সমস্যা হয়েছে, সময় দে, আমি দেখছি ঠিক হয়ে যাবে।”
গাড়ির ভিতর বাতাস ভারি। রায়ান জানে, ভয় পেলে বিপদ বাড়বে। সে নিজেকে শান্ত রাখল, গভীর নিঃশ্বাস নিল, চোখ সরাল না রাস্তায় থেকে। লাগাতার ব্রেক চাপতে থাকলো গাড়ি থামানোর চেষ্টায় তবু ব্রেক কাজ করছে না।
“ব্রেক কাজ করছে?” মাহিরের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

“না, করছে না…” রায়ান এবার নিচু গলায় বলল।
ফোনের অপর পাশে মাহির নিজের চুলে হাত দিয়ে খামচে ধরল, কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো—
“শোন দোস্ত, ব্রেক কাজ করাতে হবে না এখন। গাড়িটা চালা, কন্ট্রোল রাখ! ব্রেকের দিকে নজর দিলে গাড়ি আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাবে। বুঝলি? কন্ট্রোল হারাস না!”
রায়ানের শ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। স্টিয়ারিংয়ে তার আঙুলগুলো শক্ত হয়ে আছে, ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে।
রাস্তা এখন বাঁক নিচ্ছে, সামনের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে।
রায়ানের এখন স্থির মুখে মুখে দৃঢ় চেতনায় মাহিরকে বলল—
“চিন্তা করিস না, মাহির। আমি সামলে নেব…”

রাস্তাটা ধীরে ধীরে কেঁপে উঠল গাড়ির শব্দে। বাতাস ছিঁড়ে গাড়ি দৌড়াচ্ছে, ব্রেকহীন, অজানার দিকে। রাতটা আরও ঘন হয়ে আসছে — হেডলাইটের আলো দুই ফেনসুর রেখা আঁকে সামনে এগোচ্ছে, রাস্তাটা যেন শুধুই রাবার-গন্ধ আর ইঞ্জিনের হুমকিতে ভর করে আছে। গাড়ির স্পিড কাঁপছে, ড্যাশবোর্ডের সূচি অনবরত উপরে উঠে—হৃদস্পন্দনের মতোই তীব্র। রায়ানের কপালে ঘাম জড়ো, তার হাতগুলো স্টিয়ারিং-এ ,চোখ দুটো অস্থির, কিন্তু সিদ্ধান্ত অটল।
হঠাৎ তার মাথায় হালকা এক ভাব আসে — হ্যান্ডব্রেক। সে ঝট করে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডব্রেক টেনে দিলো। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এতবার হেন্ডব্রেক টেনেও কোনো কাজ হলো না, হ্যান্ডব্রেক যেন নিষ্ক্রিয়, অচল। দৌঁড়ানো স্পিডের সামনে হ্যান্ডব্রেক নীরব।

রায়ান চুপচাপ চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে সামনে— গাড়ির গতিটা বাড়েই চলেছি নিজে নিজে। রাস্তার পাশে লাইটের বেশ আলো, কেবল দুর্গম একটি বাঁক আছে সামনের দিকে; সামনের ট্রাকটার লুকোচুরি করা লোনার লাইট দুটো দূরের ধোঁয়ার মতো কেঁপে বেড়াচ্ছে। রায়ান জানে এটা আর কোনো খুটি-নাটক নেই। কোথাও দাঁড় করানো যাবে না গাড়ি আর, না আর কোথাও সরে যাওয়ার জায়গা আছে। একধরনের স্থির হতাশা ভিতরে ঘোলা জলে ঢেউ তুলছে।

ফোনে মাহির। মাহিরের কণ্ঠে এখন কাঁপন, কিন্তু সে বলছে, জোর করে শান্ত দেখানোর চেষ্টা করে—
“রায়ান, তুই ঠিক আছিস? এবার কি করবি ভেবেছিল কোনো উপায়?”
রায়ান কড়া কণ্ঠে, মুহূর্তটা ঠিক দেখাতে বলল—
“উপায় নেই। কার ক্র্যাশ করাতে হবে, না হলে থামানো যাবে না।”
মাহির বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে ফট করে বলল—
“কি করতে হবে? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? নিজের কার ক্র্যাশ করানোর মানে কি?”
রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, শ্বাসটা বের হল যেন সামুদ্রিক মেঘ কেটে গেল তার তীর। তার শব্দটা অস্বাভাবিক শান্ত, কিন্তু চোখে অগ্নি-

“এছাড়া আর কিছু করার নেই। লাস্ট হোপ একটাই বাকি আছে। মরার হলে — মরে যেতাম তাতে কিছু আসতো যেতো না, কিন্তু আমাকে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে হবে। যেকোনো মূল্যে হক আমাকে পৌঁছাতেই হবে, আমার হৃদপাখি অপেক্ষা করবে আমার। আমি আমার কথার খেলাপ করতে পারব না।”
মাহির রায়ানের কথায় থতমত খেয়ে গেলো—এরকম কথা শুনে কেঁপে উঠল তার অন্তর আত্মা- “আজকে এই বউ পাগল সিয়র মরবে।”

মাহির রায়ানকে বোঝাতে বলল কলের ওপাশ থেকে তার কণ্ঠে বেদনার আভাস, আর একটু রাগ:
“তুই পাগল হয়ে গেছিস রায়ান! ভেবে দেখ- ভাবি কি তোকে আহত দেখতে চাইবে? এতো বছর পরও যখন ভুল বোঝে নি এখনো ভুল বুঝবে না? সব বাদ দে, তুই কোথায় আছিস বল, আমি আসছি—”
রায়ান হালকা করে কাঁধ ছাঁটা হেসে উত্তর দিল, অস্পষ্ট এক কঠিন হাসি, যেটা ভর করে ইচ্ছে আর হতাশার মধ্যে—
“ঢাকার হাইওয়েতে আছি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। I am gonna crash the car. বাই।”

কলটা ঝট করে কেটে গেছে। ফোনের স্ক্রিন অন্ধকারে নেমে যায় — আর মাহিরের কণ্ঠ নিশ্চুপ হয়ে পড়ে, কিন্তু তার হৃৎস্পন্দন সেটা কেটে ফেলতে পারে না। স্টিয়ারিং-এর কাছে তার আঙুল জোরে চাপে। রাস্তার ধুলোর গন্ধ নাকে লাগে। সামনে ছোট্ট একটা ব্রিজের কাটা দেখা যাচ্ছে—চোখের সামনে সব কাটা হয়ে এসে দাঁড়ালো। রায়ান চুপচাপ এক চিলতে হাসি দেয়, যেটা বিদ্রূপ আর ভালবাসার মিশেল; ওই হাসির পিছনে আছে অগণিত আত্মসমর্পণ।
রাস্তাটা হঠাৎ নেমে গেছে ঢালু পথে, একটা ভয়ংকর বাঁক সামনে, চারপাশের বাতাসে কেবল ধোঁয়ার গন্ধ আর টায়ারের ঘর্ষণের শব্দ। রায়ানের চোখে এখন এক অদ্ভুত শান্তি।
যেন সে জানে, এরপর কী হতে চলেছে, তবু পিছু হটার কোনো বিকল্প নেই। তার হাত স্টিয়ারিংয়ে শক্ত করে ধরা, গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন এখন তার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিশে গেছে।

স্পিডোমিটার একটার পর একটা লাইন ছাড়িয়ে যাচ্ছে—৮০…৯০…১০০…১২০…২০০
রায়ান নিজের নিঃশ্বাস টেনে বলে উঠল ফিসফিসিয়ে,
“এই গাড়ি না থামলেও আমি থামাবো, আমার মত করে…”
বাইরের বাতাস জানালার কাঁচে তীব্রভাবে আছড়ে পড়ছে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৪ (২)

রাস্তায় সামনে একটা পুরনো রেলিং, পাশে একটা গর্ত — ওদিকেই দৃষ্টি স্থির করে রায়ান স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল।
স্ক্র্র্র্র্র্রর্র্র——!!!চাকা স্লিপ করল, গাড়ি পাশ ফিরে ছিটকে গেল রাস্তার কিনারে। হেডলাইটের আলো এক মুহূর্তের জন্য পুরো অন্ধকারে গিলে গেল পৃথিবীটাকে। তারপর এক প্রচণ্ড শব্দ—
“ব্র্র্র্র্রুম্ম…!” ধাতব আওয়াজ, কাঁচের চূর্ণবিচূর্ণ ছিটা, আর আগুনের গন্ধ। সবকিছু থেমে গেল। নীরবতা। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here