আত্মার অন্তরালে পর্ব ২৫
প্রীতি আক্তার পিহু
প্রায় রাত দশটায়, চৌধুরী ম্যানশনের নতুন অতিথির আগমন হয়েছে।বাড়ির সামনে একটি গাড়ি এসে থামল যার, ভেতর থেকে নামলেন এক লম্বা, সুশ্রী মহিলা। বয়স অনেকটা হলেও চেহারা, মসৃণ লাল চুল, ব্যক্তিত্ব, পোশাক-আশাক তার বয়সকেও হার
মানিয়েছে। তিনি হলেন ইরিনা চৌধুরী অর্থাৎ আহসান এবং ইকবাল চৌধুরীর মা।এই তো সারাহ বিয়ে উপলক্ষে তিনি রাশিয়া থেকে এসেছেন।তাকে দেখে আহসান এবং ইকবাল চৌধুরী হাত ধরে ভেতরে এনে বসালেন।আহসান চৌধুরী স্নিগ্ধ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
“আপনার আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো মা?”
ইরিনা চৌধুরী হালকা হেসে বললেন, “ডোন্ট ওয়ারি মাই সান। আই’ম ফাইন।”
ঠিক তখনই সায়মা সেখানে উপস্থিত হয় আর মৃদু হেসে জানতে চাইলেন,
“কেমন আছেন মা?”
ইরিনা তাঁর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললেন,
“এই তো ভালো আছি সায়মা। কিন্তু বাকি সবাই কোথায়?আই’ওয়ান্ট টু সি মাই গ্রান্ডচাইল্ড।
কথাটা শেষ হতেই পেছন থেকে আয়ান তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” ওহ মাই গোড রাশিয়ান! গ্রান্ডমা ইজ দ্যাট রিয়েলি ইউ?”
ইরিনা হেসে বললেন, “ইয়েস মাই ডিয়ার। ইটস মি!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইরিনা চৌধুরী আসলে রাশিয়ান তাই ইংলিশে কথা বলার অভ্যাস তার এখনো যায়নি।আয়ান বসে কিছুক্ষণ হাসি ঠাট্টা করে চলে যায়।তাছাড়া এত রাতে হয়ত সারাহ,রুহি আর আনায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক পথ জার্নি করে এসেছে ইরিনা চৌধুরী তাই সায়মা তাকে রুম অব্দি এগিয়ে নিয়ে আসে। সায়মা বললেন,
“মা আপনার কোন কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন।”
ইরিনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।সায়মা চলে যেতে উদ্যত হয় কিন্তু তার পা হঠাৎই থেমে যায়।সে পেছন ফিরে কণ্ঠে দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,
“মা একটা কথা বলতে পারি? যদি কিছু মনে না করতেন।”
ইরিনা বললেন, “হে বলো।”
সায়মা এবার আস্তে ধীরে ইরিনার পাশে এসে বসল।তারপর কৌতুহলী কণ্ঠে বলল,
“আপনার কী আপনার ছেলেদের সাথে কথা হয়?
” কোন ছেলেদের কথা বলছো তুমি?”
” মানে ক্যাসিনো আর আলভারেজের কথা বলছি ?”
এমন কথায় ইরিনা চৌধুরী বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।অতঃপর কাঠকাঠ গলায় বলেন,
“আমি ওই নামে কাউকে চিনি না। আমার আহসান এবং ইকবাল ব্যতীত অন্য কোন ছেলে নেই।”
সায়মা বেগম মাথা নিচু করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললে।আসলে আহসান এবং ইকবল চৌধুরী হলেন ইরিনার পালিত ছেলে।তাদের মা ছোটবেলায় মারা যাওয়ায়, তাদের বাবা তার বিজনেস পার্টনার ইরিনাকে বিয়ে করেছেন।ইরিনার আগের ঘরে দুইটা ছেলে ছিল আলভারেজ এবং ক্যাসিনো।কিন্তু আলভারেজ সয়ং ইকবল আর আহসান চৌধুরীর একমাত্র বোনকে পালিয়ে বিয়ে করেছে যার কারণে তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে।সে ক্ষেত্রে আলভারেজের ছেলে আভীর হলো এই পরিবারের সদস্য অর্থাৎ ইউভানের ফুফাতো ভাই।
আর ইরিনার দ্বিতীয় ছেলে ক্যাসিনো? সে তো কলেজের এক মেয়েকে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলে ধ*র্ষ*ণ করে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিছে। তারা দুইভাই মিলে চৌধুরী পরিবারের মান সম্মান ডুবিয়েছে। তখন ইরিনা বলে উঠলেন,
” তুমি কেন হঠাৎ তাদের কথা জানতে চাইছো?”
ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এসে সায়মা আমতা আমতা করে বললেন,
“না এমনি জানতে চাইছি! আচ্ছা মা তাহলে থাকুন। আমি আসি।”
বলে সায়মা সেখান থেকে প্রস্থান করে। সায়মা যেতেই ইরিনার চোখোর কোণে লুকানো অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
অতীত,
আলিসা বিছানায় শুয়ে আছে। ডাক্তার তার চেকআপ শেষ করে উঠে দাঁড়ালেই ক্যাসিনো উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“ডক্টর, এভরিথিং ইজ ওকে?”
ডাক্তার হালকা হাসি নিয়ে উত্তর দেয় , “ডোন্ট ওয়ারিং মিস্টার ক্যাসিনো! কনগ্রাচুলেশন ইওর ওয়াইফ ইজ প্রেগন্যান্ট।”
এই শব্দগুলো আলিসার কানে পৌঁছাতেই যেন, তার সমগ্র পৃথিবী থেমে গেল।বিয়ে মাত্র এক মাস গড়িছে তাদের!ডক্টর বিদায় নিয়ে চলে যায়।ক্যাসিনো স্তব্ধ নয়নে আলিসার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, ধীরে তার পাশে বসে জানতে চাইল,
“তুমি খুশি নাও, রোজ?”
আলিসা সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দেয়, “আমার এই বাচ্চা চায় নাহ।”
“কেন?”
“এই বাচ্চার পরিচয় কি দেবেন? যে তার বাবা একজন ধ*র্ষক?”
“তাহলে কেন বিয়ে করেছিলে আমাকে?”
“আমি ধ*র্ষ*কের স্ত্রী হতে রাজি ছিলাম কিন্তু তার সন্তান জন্ম দিতে রাজি নই।”
“ধ*র্ষ*কের স্ত্রী যখন হয়েছ তখন তার সন্তানের মা হতেও হবে তোমার।”
এমন কথায় আলিসা তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “অধিকার দেখাচ্ছেন?এসব আপনার মুখে মানায় না।”
ক্যাসিনো দৃঢ় গলায় শুধালো, “রোজ তুমি আমায় নিকৃষ্ট মানুষ বলতে পারো। কিন্তু আমি নিকৃষ্ট স্বামী অথবা বাবা নয়। তোমার সাথে বিয়ের সম্পর্কে জড়ানোর পর আমি দ্বিতীয় নারীর দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি।”
এমন কথায় আলিসা বুক ধরফর করে ওঠে।ক্যাসিনো কী সত্য বলছে?তার আগমন কী সত্যি ক্যাসিনোকে পবিত্র পুরুষ বানাতে সক্ষম?নাকি সবই নিছাক মিথ্য!আলিসা শুকনো কন্ঠে আওড়াল,
“নিজের কুলষিত অতীত বদলাতে পারবেন?”
“তোমার অতীত ও পবিত্র ছিল না রোজ।”
কথাটা সে আলিসার চোখে চোখ রেখে বলল।মুহূর্তেই আলিসা দমে যায় কারণ সে নিজেই তো অপবিত্র!সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুণরায় বলল,
“আপনি কী সত্যি বদলেছেন ক্যাসিনো?”
ক্যাসিনো এবার আলিসার হাত মুঠোই নিয়ে, সেখানে কয়েকটি চুমু খেয়ে বলল,
“হ্যাঁ! আমি তোমায় কথা দিচ্ছি রোজ, তুমি শুধু আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আনো। আমি একজন ভালো স্বামী আর বাবা হয়ে দেখাব।”
মুহূর্তেই আলিসা ক্যাসিনো বুকে ঝাঁপিয়ে পরে নিজের সব কষ্ট উগরে দিল। তার এটাই তো প্রাপ্তি যে , সে তার ক্যাসিনোকে ভালো বানাতে সক্ষম হয়েছে।
আলিসার শরীর দুর্বল থাকায় ক্যসিনো তাকে গভীর ঘুমে ঢেলে বেরিয়ে আসে। তার অভিমুখ এখন ল্যাবরেটরির আ্যশারের নিকট। দৃঢ় অভিভ্যক্তি এবং অবিস্মরণীয় তেজ নিয়ে সে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করে। ক্যাসিনোকে দেখে আ্যশার আতঙ্কে নিজেকে সংকুচিত করে, কারণ আজ যে সে সীমাহীন দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে। সে জানে আজ তার রক্ষা নাই!
ক্যাসিনো সরাসরি এগিয়ে এসে আ্যশারের চুলের মুঠি অতিসংকোচিতভাবে ধরেই টেনে আনে সামনে। তারপর গর্জন করে,
“সাহস কীভাবে হলে তোর এখান থেকে পালানোর? উত্তর দে!”
আ্যশারের মুখ ভিজে গেছে অঝোর কাঁদায়। ভাঙা কণ্ঠে সে কেঁদে কেঁদে ফিসফিস করে,
“ভ ভুল হয়ে গেছে, আর করব না!”
ক্যাসিনোর কানে কোনো শব্দ ঢোকে না। সে চুলের মুঠি ধরে দু’পাশে আছড়ে কয়েকটি থাপ্পড় মারে আ্যশারকে। প্রতিটি আঘাত আ্যশারের গালে লাল দাগ ভেসে ওঠে আর কিছু স্থানে ছিঁড়ে রক্ত ঝরে। ক্যাসিনোর শরীর দাউ দাউ করে জ্বলছে কারণ যদি আজ আলিসা আ্যশারকে দেখে ফেলতো? তাহলে সর্বনাশ হয়ে যেতো! সে দাঁত চেপে ক্যাথরিনকে নির্দেশ দেয়,
“চাবুক আনো, ক্যাথরিন!”
চাবুকের শব্দে আ্যশার আতঙ্কে কাঁদতে থেকে বলে,
“না, না আমায় মেরো না!”
কিন্তু ক্যাসিনোর কিছু শুনে না। সে চাবুক নিয়ে প্রথম আঘাত করে আ্যশারের পিঠে। মুহূর্তের মধ্যে আ্যশার ছিঁটকে গিয়ে দূরে পড়ে এবং চামড়া ছিঁড়ে পাতলা মাংস উন্মুক্ত হয়। তার মুখ থেকে বের হয় বেদনাময় আর্তনাদ,
“আআআহহহহহহ!”
নির্দয় ক্যাসিনো পুনরায় চাবুক দিয়ে আঘাত করে বুক, পিঠ, কাঁধ ও মুখ বরাবর। ঠোঁটে আঘাত পড়তেই চামড়ার স্তর উঠে গিয়ে লালচে ধূসর মাংস বেড়িয়ে আসে। আ্যশারের হাত-পা কাঁপছে; রক্তে ভেজা ক্ষুদ্র দেহ আঠালো হয়ে গেছে। ক্যাসিনো আবারও আঘাত হানতে গিয়ে আ্যশারের পা ধরে আকুতি জানাই,
“আর মেরো না, আমি মরে যাব!”
ক্যাসিনো এবার থেমে গার্ডকে আদেশ দেয়, “একে ধরে লোহার চেয়ারে বেঁধে রাখো।”
গার্ডরা আ্যশারকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা শক্ত করে বাঁধে। ক্যাসিনো আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। আ্যশারের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে! ক্যাসিনো ধারালো ছুঁড়ি তার চোখের সামনে তুলে ধরে বলে,
“আজ তোকে এমন যন্ত্রণার মধ্যে ফেলব যে আর কখনো পালানোর কথা ভাবতে পারবি না।”
বলেই ছুঁড়ির ধারালো অংশ তার দেহে ঢুকিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ আ্যশারের কণ্ঠ থেকে বের হয় আর্তনাদ। ক্যাসিনো ছুঁড়ি গেঁথে দিয়ে কাঁধ থেকে পেট পর্যন্ত নামিয়ে আনে। সঙ্গে সঙ্গে চামড়া আলগা হয়ে মাংস খুলে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। আ্যশারের গলার শিরাগুলো ফেটে বের হওয়ার উপক্রম।যন্ত্রণায় সে গলা ফাটিয়ে চেঁচায়,
“আহহহহহহ! বাঁচাও! বাঁচাও!”
তার প্রতিটি আর্তনাদে ক্যাসিনো পৈচাশিক আনন্দ পাচ্ছে। নিখুঁতভাবে ছুঁড়ি দিয়ে সে তার শরীরে আকিঁবুকিঁ করে ফলসরুপ, কাটা মাংসের দু’পাশ আলগা হয়ে নালা নিঃসৃত হয়। ছিঁড়ে যাওয়া মাংসের টুকরো রক্তে আ্যশারের দেহ গাঢ় লাল রঙ ধারণ করেছে। কতই না বীভৎস দৃশ্য! যন্ত্রণায় আ্যশার অজ্ঞান হয়ে পড়ে।এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ক্যাসিনো ক্রুদ্ধ হয়,কারণ সে আরও কষ্ট দিতে চায় আ্যশারকে। বাঁকা হাসি দিয়ে সে আ্যশারের কাটা স্থানে লবণ ও মরিচ ছিটিয়ে দিল। লবণ গরম মাংসে লাগতেই আ্যশারের কণ্ঠনালী ফেটে কেঁপে ওঠে,
“মাআআআআ!”
তার কণ্ঠ থেকে শুধু ‘মা’ শব্দ বের হচ্ছে। হাহাকার তার বুক ফাটিয়ে দিচ্ছে। সে ছটফট করছে, কিন্তু বাঁধা দড়ি তাকে নড়তে দিচ্ছে না। ক্যাসিনো ঠান্ডা হাসি দিয়ে বলে,
“আরও জোরে চিৎকার কর। আরও! আরও!”
উচ্চস্বরে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সে কাটা মাংসের উপর লবণ-মরিচ ছিটিয়ে দেয়।ব্যাথায় আ্যশারের চোখ লাল হয়ে ওঠে, শিরাগুলো ফেটে বেরোনোর উপক্রম। মাথা হেলে মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে তার। অবশেষে ক্যাসিনো উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাথরিনকে নির্দেশ দেয়,
“এ যেন না মরে! ওকে প্রতিদিন ইনজেকশন দিয়ে পাগল করে রাখো।”
ক্যাথরিন কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু কেন, স্যার? একে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ?”
ক্যাসিনো কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ক্যাথরিন আ্যশারের দিকে তাকিয়ে দেখল, ছেলেটির দেহে উন্মুক্ত মাংস ও রক্ত ছাড়া আর কিছু দৃশ্যমান নয়। গার্ডরা দ্রুত আ্যশারকে বাঁধন মুক্ত করে নিয়ে যায় ব্যান্ডেজের জন্য। তাকে যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ক্যাসিনোর নিষ্ঠুরতার কারণে।
দুনিয়াটি স্বার্থপর! প্রত্যেক মানুষ শুধুমাত্র নিজের সুখ এবং স্বার্থের পিছুটানেই ছুঁটে। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ ক্যাসিনো! সে নিজের স্ত্রী এবং সন্তানকে রক্ষায় নির্ভীক কিন্তু অপরের কাছে নিছক আতঙ্কের প্রতীক। অন্যের আপনজনকে আঘাত করতে তার কোনো অনুতাপ নেই।ক্যাসিনোর মতো স্বার্থপরদের শিক্ষা তখনই পাবে, যখন তার নিজের আপনজনকে অন্যের হাতে কষ্ট পেতে দেখবে।
অন্ধকারে আবৃত নীরব রুমে একটি মেয়েকে হাত-পা ও মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে। তার চোখ-মুখমণ্ডলে আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। সেই গুমোট রুমের দরজা উন্মুক্ত হতেই পনেরো-বিশ জনের মতো যুবক ভেতরে প্রবেশ করে।এবার রুমটিতে সামান্য আলো আসে কিন্তু সেই ম্লান আলোতে মেয়েটির মুখ স্পষ্ট নয়, তবে ছেলেগুলো চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরল। তাদের দেখে মেয়েটির হৃদপিণ্ড ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠে। তখন তাদের মধ্যে এক ছেলে বলে উঠে,
“কেউ দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আয়।আজ ভেতরে খেলা হবে।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়েটি প্রাণরক্ষার আকুতি জানিয়ে মাথা নাড়ায়। কিন্তু তারা সেই প্রার্থনা উপেক্ষা করে দরজা বন্ধ করে দিল, আর রুমটি আবারও নিমজ্জিত হলো অন্ধকারে। সেই ঘোর অন্ধকারে তার উপর আরম্ভ হয় অমানবিক ধ*র্ষ*ণ । একে একে তারা মেয়েটির দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে।মেয়েটির কণ্ঠ থেকে কেবল গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। কী ভয়াল বিভীষিকা! সকলে উন্মত্ত পশুর ন্যায় তার শরীর ছিঁড়ে ভক্ষণ করল। প্রায় এক ঘণ্টা পরে তারা বের হয়ে গার্ডদের নির্দেশ দেয়,
“এই রুমে যেন কেউ প্রবেশ না করে আমরা আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত।”
এ কথা বলেই তারা সেখান থেকে চলে যায়। আর ভেতরে বস্ত্রহীন মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে রইল নিথর অবস্থায়। তার শরীরের নানাস্থানে গভীর দাঁতের দাগ স্পষ্ট, আর যৌনাঙ্গ থেকে নিরন্তর রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটির চোখ আর শ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে এবং দেহটাও অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। ঠিক তখনই হঠাৎ রুমে প্রবেশ করল এক অচেনা ব্যক্তি। তার পরনে লাল ওভারকোট আর মাথায় কালো টুপি;টুপিটা এতটাই নামানো যে মুখ একেবারেই আড়ালে।ব্যক্তিটির হাতে ছিল এক বিশাল কালো লাগেজ। ধীরগতিতে এগিয়ে এসে সে দেখল মেয়েটি নিস্তেজ হয়ে আছে। ক্ষণিকের মধ্যেই সে তাকে লাগেজের ভেতর ঢুকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। চারপাশে গার্ডরা অচেতন আছে দেখে ঠাণ্ডা হাসি ফুটে ব্যক্তিটির ঠোঁটে। বাইরে এসে সে শান্তভাবে লাগেজ টেনে গাড়ির ট্রাঙ্কে রাখে। তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে ধীরে ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়।
কয়েক ঘণ্টা পর গাড়িটি গিয়ে থামে ঘন জঙ্গলের গভীরে। সে পেছন থেকে লাগেজ নামিয়ে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসল। তারপর লাগেজ খুলে মেয়েটিকে বের করতেই মুখটি সুস্পষ্ট হয়; সে আর কেউ নয় বরং তানহা।
অপরিচিত ব্যক্তি এক বিকট হাসি দিয়ে ধারালো কোদাল হাতে নিয়ে তানহার বুকে আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে পাঁজরের হাড় ভাঙার তীব্র শব্দ হয়। আঘাতের নিচে মাংস থেঁতলে রক্তে মিশে জটলা পাকায়। শেষবারের মতো তানহার দেহ একবার কেঁপে উঠে চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ব্যক্তিটি দুই হাতে তার বুক চিরে ভেতর থেকে কলিজা টেনে বের করে এবং হাতের মুঠোয় তা নৃশংসভাবে পিষে ফেলল।এরপরও সে তানহার নিথর দেহে একের পর এক কোদালের কোপ মারে। প্রতিটি আঘাতে মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে ধমনীগুলো ফেটে অনবরত রক্ত ঝরল। সবশেষে সে মাটি খুঁড়ে তানহার দেহটি চাপা দেয়। খুনের সব প্রমাণ মুছে দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে লাগেজ হাতে নিয়ে সে প্রস্থান করে।যেন কিছুই ঘটেনি!
অপরদিকে, ছেলেগুলো প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এসে দেখল মেয়েটি অর্থাৎ তানহা নিখোঁজ, আর গার্ডরাও অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। কিছুই অনুধাবন করতে না পেরে তাদের মধ্যে একজন বলল,
“মেয়েটা গেল কোথায়?ওই শরীর নিয়ে মেয়েটার একা একা চলাফেরা করা অসম্ভব।তোরা দ্রুত সিসিটিভি ফুটেজ চেক কর!”
তারা তৎক্ষণাৎ সিসিটিভি ফুটেজে দেখল,তানহাকে লাল ওভারকোট পরিধানকারী ব্যক্তি অপহরণ করেছে। দৃশ্যাবলী দেখে তাদের মধ্যে একজন সঙ্গে সঙ্গে ফোন কাউকে কল দেয়,
“স স্যার অনেক বড় সমস্যা হয়েছে। মেয়েটিকে কেউ একজন কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে।”
এই কথা শুনে অপাশের ব্যক্তিটি চোয়াল কঠোর হয়ে যায়।তীব্র ক্রোধে সে গর্জে উঠল,
“ফাকিং বি*চ! তোদের আমি টাকা দিয়েছি কীসের জন্য? দ্রুত ওই কিডন্যাপারসহ মেয়েটিকে খুঁজে বের কর, না হলে তোদের মৃত্যু ইউভান চৌধুরীর হাতেই হবে।”
ছেলেটি আতঙ্কিত কন্ঠে কেঁপে বলল, “জ জি স্যার!”
ইউভান ফোন কেটে দিয়ে পাশে থাকা ফুলদানিটি আছড়ে ভাঙে। তার চক্ষুজোড়া আগুনের শিখায় জ্বলছে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী তানহাকে অপহরণ করিয়েছে, যেন মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিতে পারে। তার সুইটির গায়ে হাত তোলেছে ওই মেয়ে,তাকে ইউভান কীভাবে ছেড়ে দেবে?তৎক্ষণাৎ সে পাশের ওয়াইনের বোতলটি তুলে মুখের দলনিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে হিংস্র কন্ঠে বলল,
“সিংহের খাঁচা থেকে তার শিকাড় ছিনিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস কার ছিল? কে সে?”
ইউভান নিজে ভাবতে লাগল, কে হতে পারে সেই অচেনা ব্যক্তি? চিন্তা করতে করতে সে ওয়াইনের বোতল সম্পূর্ণ খালি করে ফেলে, বাঁকা হাসি ছড়িয়ে উচ্চারণ করে,
“যেই হোক না কেন, ইউভানের হাত থেকে কেউই বাঁচতে পারবে না। ধরতে পারলে কুকুর দিয়ে ছিঁড়ে খাওয়াব।”
ইউভানের সাংঘাতিক রাগ হচ্ছে, কোনোভাবে তার রাগ কমছে না।নিরুপায় হয়ে সে এবার আনায়ার রুমের সামনে আসে কারণ এই মেয়ে যে তার সব অসুখের সুখ।ভেতরে প্রবেশ করে সে আনায়ার ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থকে, মোলায়েম কণ্ঠে ডাকলো,
“সুইটি….”
আনায়া উঠছে না দেখে ইউভান তার অধরে অধর ছুঁয়ে দিল।ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ টের পেয়ে আনায়া লাফিয়ে বসে এবং ইউভানকে তার রুমে দেখে ঘাবড়ে বলল,
“আ আপনি এত রাতে আমার রুমে কী করছেন?”
“ভালো লাগছে না তাই এসেছি।”
“আপনার ভালো না লাগলে আমি কি করব?”
“তোর কিছু করতে হবে না সুইটি।চল আমরা লং ড্রাইভে যায়।”
“পাগল হয়েছেন?এত রাতে লং ড্রাইভ কে যায়?”
“আমরা যাব !”
বলেই ইউভান আনায়ার কথা না শুনেই, তাকে নিয়ে বাইরে আসে।তারপর একটি বাইক এনে চোখের ইশারায় আনায়াকে পেছনে বসতে বলে।আনায়া বিনাবাক্যে ইউভানে পেছনে বসে তাকে আঁকড়ে ধরল দু’হাত দিয়ে।তা দেখে ইউভান নিঃশব্দে হেসে বাইক স্টার্ট দেয়।রাত প্রায় আড়াইটা! নিস্তব্ধ রাতের আঁধারে তাদের বাইক নির্জন রাস্তার বুক চিঁড়ে গন্তব্যেহীন পথে এগোচ্ছে।আনায়ার মাথা ইউভানের কাঁধে হেলিয়ে রাখা এবং তার দীর্ঘ চুলগুলো বাতাসে উড়ে ইউভানের চোখ-মুখে কোমলভাবে আছড়ে পড়ছে।তাতে অবশ্য ইউভান বিরক্ত হচ্ছেনা বরং চুলের স্নিগ্ধ সুবাস সে উপভোগ করছে।বেশ কিছুক্ষণপর, তাদের বাইক একটি শুনশান মাঠের সামনে এসে থামে।তারা বাইক থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে এসে দেখে, পাশে একটি চায়ের স্টল খোলা।ইউভান পাশ ফিরে আনায়াকে জিজ্ঞাসা করল,
“চা খাবেন ম্যাডাম?”
আনায়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দেয়।ইউভান গিয়ে দুই’ কাপ চা নিয়ে আসে,তারপর তারা দুজ’ন খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর বসল।নীরব আকাশতলে দীপ্তিময় থালির মতো গোলকার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে।আনায়া সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“চাঁদটা কী সুন্দর তাই না মিস্টার ক্রিমিনাল?”
ইউভান এবার আনায়ার সামনে ঘুরে বসল।চাঁদের নরম আলোয় আলোকিত আনায়ার মায়াবী মুখখানি লক্ষ্য করে সে বলল,
“নোপ!তুই ব্যাতীত আমার চোখে আর কিছু সুন্দর লাগে না। কারণ যেদিন প্রথমবার তোকে দেখেছিলাম, সেই দিন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য আমার চোখে ফিকে মনে হয়েছিল।”
মুহূর্তেই লাজুক হেসে আনায়া মাথা নামিয়ে নেয়।ইউভান সেই লাজুক হাসিখানার দিকে চেয়ে পুনরায় আওড়ালো,
“লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই ম্যাডাম। নিঃসন্দেহে আমার চোখে আপনি চাঁদের থেকে অধিক সুন্দরী।”
আনায়া এবার মুখ উঁচিয়ে ইউভানের চোখে চোখে গেঁথে দিয়ে শুধালো,
“আপনার চোখজোড়ায় সাংঘাতিক তাই হয়তো আপনার নজরে আমি বেশি সুন্দর।”
খানিকক্ষণ নীরবতা।তাদের চায়ের কাপের চা ও প্রায় ফুড়িয়ে এসেছে।কিন্তু এদিকে আনায়ার হৃদয়ে অন্য কিছু চলছে। ইউভানের মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শোনার জন্য তার মন অস্থির হচ্ছে। কিন্তু ইউভান কী তা আদৌ বলবে?হৃদয়ের উত্তেজনার তাল সামলাতে না পেরে সে বলে উঠে,
“আপনি আমায় কিছু বলতে চান ইউভান ভাই?”
“তুই কী শুনতে চাস আমার কাছ থেকে?”
“আমি যা শুনতে চায় আপনি তা বলছেন না।”
“তো বলুন কী শুনতে চান আপনি ম্যাডাম?”
ক্রমাগত আনায়ার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে।তবুও চোখ দুটো বন্ধ করে সে শুকনো গলায় জবাব দিল,
“ওইযে ওই তিনটা শব্দ শুনতে চায়।”
ইউভান সামান্য তার দিকে ঝুঁকে জানতে চাইল, “কোন তিনটা শব্দ?”
আনায়া একটা দম নিয়ে বলে উঠল, “যেই তিনটা শব্দ শুনলে বুঝবো যে, আপনি আমার আর আমি আপনার।”
আনায়া ইউভানের কাছ হতে কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে আছে।কিন্তু, তার এই আকাঙ্ক্ষার মাঝে পানি ঢেলে ইউভান অনাকাঙ্ক্ষিত বুলি ছুঁড়লো,
“আই ফা*ক ইউ…”
এমন উক্তিতে মুহূর্তেই আনায়া লজ্জা আর ক্রোধে ছিঁটকে দূরে সরে যায়। একরাশ বিরক্তি চোখে সে ইউভানের পানের তাকিয়ে দেখে, নির্লজ্জ ব্যক্তিটি হাসছে।তীব্র ক্রোধে সে কিছু না বলে, উঠে দাঁড়ায়।সবুজ মাঠে বাতাসে ঢেউয়ের ন্যায় দোলা ঘাসের উপর দিয়ে আনায়া হাঁটা ধরল।ইউভানও উঠে তার পিঁছু নিয়ে খপ করে আনায়ার হাতটা ধরে ফেলে বলল,
“ওয়াট হ্যাপেন সুইটি?রাগ করেছিস?”
আনায়া তেজ দেখিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়।তৎক্ষণ এক নিমিষে ইউভান তার কোমর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। আনায়া ছুটে যেতে চাইলে, ইউভানের হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় হয়। মাথা ঝুঁকিয়ে তার কানের কাছে ঠান্ডা নিশ্বাস ছুঁইয়ে, ইউভান ফিসফিসিয়ে গাইতে শুরু করে,
❝Yeah
The sun is shinin’ everyday
The clouds never get in the way for you and me
I’ve known you just a week or two
But baby I’m so into you
Can hardly breathe
অভীমানি আনায়া তাও ইউভানকে দু’হাতে দূরে ঠেলে পিছন ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।ইউভান তাও আনায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং তার ফুঁলে ওঠা নাকের ডগায় চুমু খেয়ে পুণরায় গায়,
And I’m in so totally
Wrapped up emotionally
Attracted so physically
Actin’ so recklessly
I need you so desperately
Sure as the sky is blue
ইউভান থামল!এরপর আনায়ার কানের কাছে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বাকি অংশটুকু গেয়ে উঠল,
Baby I love you
I love you…..❞
মুহূর্তেই আনায়ার হৃদস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।ইউভান যে গানের মাধ্যমে ‘ভালোবাসি’ কথাটা প্রকাশ করেছে, সেটা সে ভালোমতো উপলব্ধি করতে পারছে। খুশিতে আনায়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ইউভানকে তাকে দু’বাহুর মাঝে আলিঙ্গন করে নিয়ে প্রশ্ন করে,
“কী হলো কাঁদছিস কেন?”
আনায়া তার বুকে লেপ্টে থেকে বলল, “খুশিতে! আমার জীবনের সবথেকে সুন্দর মুহূর্ত হলো আপনার সাথে কাটানো সময়গুলো মিস্টার ক্রিমিনাল।”
দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলে ইউভান বলল, “আর যদি কখনো তোর স্মৃতি থেকে এই সুন্দর মুহূর্ত গুলো মুছে যায় তখন? আমায় ছেড়ে চলে যাবি?”
আনায়া তখন চোখ তুলে ছলছল নয়নে তাকাল ইউভানের মুখপানে।অতঃপর বলল,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ২৪ (২)
❝আপনার ছেড়ে কোথায় যাব আমি?
সূর্য ছাড়া যেমন সকাল আলোহীন
সমুদ্র ছাড়া যেমন ঢেউ প্রাণহীন,
চাঁদ ছাড়া জোছনা যেমন রূপহীন,
তেমনি আপনি ছাড়া আমিও অর্থহীন।❞