আত্মার আগলে পর্ব ১১

আত্মার আগলে পর্ব ১১
সানজিদা আক্তার মুন্নী

এহসান মেহনূরকে আলতো করে কোলে তুলে নেয়।
মেহনূরের ভেজা শরীরে এহসানের স্পর্শ লাগতেই শরীর কেঁপে ওঠে তার। লজ্জা! ঘৃণা! বিদ্বেষ! সব মিলিয়ে যেন দমবন্ধ করা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে বুকের ভেতর।
এহসান ধীর পায়ে এগিয়ে চলে, শক্ত করে মেহনূরকে ধরে রেখেছে বুকে।
এহসান তাকায় মেহনূরের দিকে—তৃষ্ণার্থ ভালোবাসার চোখে। গভীর, দাবানলের মতো দহনজ্বালা ছড়ানো সে দৃষ্টি। মেহনূরও তাকিয়ে আছে এহসানের পানে তবে! মেহনূরের চোখে কেবল ঘৃণা! কেবল বিদ্বেষ! যেন এই পুরুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী, সবচেয়ে ঘৃণ্য অস্তিত্ব!

ভয়ংকর সুন্দর পুরুষ এই এহসান তালুকদার!আল্লাহ যেমন তাকে দাপট দিয়েছেন, যেমন তাকে সাম্রাজ্যের মসনদ দিয়েছেন, তেমনি অপরিসীম সৌন্দর্যেও রাঙিয়ে দিয়েছেন। মেহনূর স্পষ্ট দেখতে পায়—ঠান্ডায় এহসানের নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। খয়েরি ঠোঁট পানসে হয়ে এসেছে। দাঁড়ির গোড়ায় জমে থাকা পানির ছোট ছোট বিন্দুগুলো চকচক করছে ক্ষীণ আলোয়।
এতটা ভয়ংকর সুন্দর পুরুষ… সে খুন করতে পারে? নিকৃষ্টভাবে কাউকে ছিঁড়ে খেতে পারে?
একজন অচেনা মানুষকে বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু মেহনূর জানে! এটাই সত্য! এটাই বাস্তব!
এই এহসান তালুকদার একজন রাক্ষস!একজন নরখাদক!একটা পশু!তার প্রতি মেহনূরের ঘৃণা প্রতিমুহূর্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে…
এহসান মেহনূরের এমন ঘৃনা ভরা দূষ্টি দেখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে। চোখে একরাশ অসহায়তা। কণ্ঠে গভীর বেদনার সুর নিয়ে বলে

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “এতটা ঘৃণা নিয়ে তাকিও না আমার পানে, আমি এহসান সব সহ্য করতে পারব, কিন্তু তোমার এই ঘৃণার দৃষ্টি সহ্য করতে পারব না!”,
মেহনূর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কণ্ঠে বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই তাও দাঁত চেপে বলে
— “আপনি শুধুই ঘৃণার যোগ্য… শুধুই ঘৃণার!”
এহসান মৃদু হেসে, ব্যাকুল গলায় বলে—
— “অপবিত্র আমি হতে তো আর পারব না, তুমি পবিত্রের যোগ্য! তাহলে নাহয় হলামই তোমার ঘৃণারই যোগ্য!”
মেহনূর বিদ্রুপের হাসি দেয়। ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে—
— “এসব নাটকের সংলাপ আমার সামনে না করলেই ভালো হয়!”
এহসান বাড়ির সদর দরজায় পা রাখার আগে একবার ফিরে তাকায় মেহনূরের দিকে। চোখে প্রবল যন্ত্রণা, কণ্ঠে চিরন্তন আক্ষেপ—নিয়ে বলে

— “ইসস… যদি আমার অন্তরখানা তোকে বের করে দেখাতে পারতাম, তাহলে বুঝতিস এই এহসানের ভালোবাসা কাকে বলে!”
মেহনূরের চোখে কোনো নরমভাব আসে না। কণ্ঠে কঠিন সত্যের মতো ঝরে পড়ে—বলে
— “আপনার মতো মানুষের মুখে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারণ করাও মানায় না! এতে পৃথিবীর সব ভালোবাসার অপমান হবে!”
এহসান আর কিছু বলে না। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মেহনূরকে বুকের ভেতর আগলে রেখেই এগিয়ে যায় অতঃপর কক্ষে প্রবেশ করে।
মেহনূরের মনে ভয় ছিল— যদি কেউ তাদের এভাবে দেখে ফেলে? যদি ভুল বোঝে? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তেমন কিছুই হলো না।
কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করেই সে বিস্ময়ে হতবাক!
কিছুক্ষণ আগেই যেখানে রক্তের ছোপ লেগে ছিল, যেখানে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে ছিল, সেই কক্ষ এখন ঝকঝক করছে! মেঝেতে কোথাও একফোঁটা রক্ত নেই, বাতাসে কোনো আঁশটে গন্ধও নেই!
সোফার সামনে রাখা টি-টেবিলের ওপর খাবার সাজানো। যেন কিছুই হয়নি, যেন এখানকার দেয়ালগুলো কোনো ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী নয়!

মেহনূর ধীরে ধীরে এহসানের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলে
— “নামান আমায়! ঘরে এসে গেছি!”
এহসান কিছুই বলে না। নিঃশব্দে, এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরিয়ে না দিয়ে মেহনূরকে বাথরুমের দিকে নিয়ে যায়। এক হাতে তার কোমর ধরে, আর অন্য হাতে তাকে আলতো করে কোলে রেখে নিচে নামিয়ে দেয়।
মেহনূর নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, একের পর এক অনুভূতি মিশে যাচ্ছে তার ভেতর—ঘৃণা, ভয়, এবং এক অজানা স্নিগ্ধতার টান। এহসান তাকে কোনোরকম অস্বস্তি ছাড়াই আদেশ গলায় বলে,
— “আমি কাপড় এনে দিচ্ছি, বদলে নিবি। একটু অপেক্ষা করো।”
এহসান বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে এসে কাপড় রাখার কক্ষে চলে যায়। সেখান থেকে একটি কালো কুর্তি এবং সাদা সেলোয়ার নিয়ে আসে। মেহনূরের হাতে তা তুলে দেয়।
মেহনূর কাপড়গুলো হাতে নেয়, কিন্তু সে কিছু বলে না। এহসান কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন তার নিজস্ব এক জগতে হারিয়ে গেছে। তারপর, কোনো শব্দ ছাড়া, বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।
মেহনূর দরজা টেনে ঠাস করে বন্ধ করে দেয়।

এহসান কাপড় রাখার কক্ষে ফিরে এসে একখানা লুঙ্গি এবং সাদা সেন্ডু গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে নেয়।
মেহনূর কাপড় বদলাতে গিয়ে এক অদৃশ্য লজ্জার মধ্যে ডুবে যায়। এই কয়দিনে যে কাপড়গুলো এহসান তার হাতে দিয়েছে, প্রতিটি কাপড়ের ভাঁজেই একটা বক্ষবন্ধনী ছিলো। এই ভাবনায় সে অস্বস্তিতে যেন মরে যাচ্ছে এখন। “এহসান এগুলো নিজে রেখেছে, না এশাকে দিয়ে রেখেছে না অন্য কাউকে দিয়ে?”— এই প্রশ্নের দোলাচলে সে ভুগছে। এই চিন্তায় সে লজ্জায় পুড়ে যাচ্ছে, এই বিষয়টি তার নিজের জন্যই এক বিশাল অপমানের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেষ পর্যন্ত, সে নিজের লজ্জা গিলে, কাপড় পরিধান করে বাইরে আসে। কিন্তু বাইরে আসতেই মেহনূরের চোখ পড়ে এহসানের পানে “! যে লুঙ্গি আর সাদা সেন্ডু গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে “! যার জন্য ওর শক্তিশালী, ধবধবে ফর্সা শরীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কনুই পর্যন্ত নেমে আসা টাওয়াল দিয়ে সে তার চুল মুছে চলেছে, কিন্তু চোখ তার মেহনূরের দিকে এক টানা তাকিয়ে আছে। এই এহসান কেনো তার দিকে তাকিয়ে থাকে কেনো? কেনো? অশান্তি শুরু হয়ে যায় মেহনূরের ভিতরে ‘!

তখনি, এহসান তার হাতের টাওয়াল এক ঝটকায় মেহনূরের দিকে ছুঁড়ে মারে এবং গম্ভীরভাবে বলে,
— “নে, তাড়াতাড়ি তোর এই ঘাসগুলো মুছে নে, নইলে আবার সারা ঘর ভিজে যাবে!”
মেহনূর টাওয়াল হাতে নিয়ে কটমট করে তাকায় এহসানের পানে তারপর চুলে টাওয়াল বাঁধে বাঁধে বলে
—-ঘাস কি? এগুলোর নাম চুল? নাকী চোখও জ্বলে যাচ্ছে পাপের কারণ যে ঘাস আর চুলের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারছেন না!
এহসান নিজের বা হাত দিয়ে মাথার পানি ঝারতে ঝারতে ঠোঁট কেটে হেসে বলে
—- আমার চোখ সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে “!বেহায়া হয়ে গেছে! তাই এখন এই বেহায়া চোখ তোর ধবধবে ফর্সা কাঁধের ড্রেসের কাছে চলে গেছে”!
এহসানের এমন কথায় মেহনূর নিজের কাঁধের দিকে তাকায়”! তাকিয়ে তো ভরকে যায় “!কারণ কাঁধ থেকে ওড়না সরে গিয়ে ড্রেসের কিছু অংশ ও সরে গেছে”! যার কারনে ভিতরে কালো অবর্ননীয় নজরে আসছে, ছিঃ এতটা খারাপ নজরে এহসান ওর দিকে তাকিয়ে আছে ‘!
মেহনূর ক্ষোভ নিয়ে বলে

—- গজব পড়বে এই বেহায়া পাপিষ্ঠ চোখে “!ধ্বংস হয়ে যাবে এই চোখ যে চোখ মানুষের আপত্তিকর বিভ্রান্তিকর জায়গায় যায়”!
এহসান আবারও হেসে বলে।
—- তোর পানে চেয়ে যদি ধ্বংস হয় আমার আঁখি তবে আমি এহসান তাতেও রাজি”!
মেহনূর কিছু বলে না, চুপচাপ আলতো পায়ে বিছানার দিকে এগোয়। উদ্দেশ্য ঘুমিয়ে পড়া। এই লোকের সঙ্গে কথা বলাই বৃথা! কথা বলবে না এর সাথে “!
মেহনূর কোনো দিকে না তাকিয়ে বিছানায় উঠে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। তখন এহসান টেবিলে রাখা খাবারের প্লেট নিয়ে বিছানায় বসে। মেহনূর এসব না দেখে ওড়না টা রেখে বালিশ ঠিক করে যেই না বালিশে মাথা রাখবে।
অমনি এহসান ওর হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকে বসায়! আকস্মিক এমন হওয়ায় মেহনূর আশেপাশে বোকার মতো তাকায়! কিছু মুহূর্ত পর বুঝে যায়, কি হয়েছে তার সাথে!
তাই এহসানকে কিছু কড়া কথা বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে! তখনই এহসান মেহনূরের মুখে এক লোকমা ভাত পুড়ে দেয় আর শান্ত গলায় বলে,
+—–“একটাও টুঁশব্দ না করে খেয়ে নে, চুপচাপ।”
মেহনূর রাগে মুখের ভাতগুলো গিলে এহসানকে দাঁত চেপে বলে, ”
—-মেরে ফেলতে চান আমায়, এমনভাবে খাবার খাওয়াচ্ছেন! মরে যাই আমি যাতে?”
এহসান আরেক লোকমা ভাত মেহনূরের মুখের সামনে ধরে বলে,
—–“মেরে ফেলতে হলে খাওয়াতাম না। আর একটাও শব্দ করবি না, চুপচাপ গিলবি, আর যদি একটা কথা বলিস—”
এহসান কথা পুরো করতে পারে না, মেহনূর ঢোক গিলে মুখে তুলে নেয় খাবার। এ ভেবে এহসান খুব ভয়ংকর, কি থেকে কি করে ফেলবে, তাই ওর কথামতো আলিফ হয়ে চলাটাই সবচেয়ে ভালো।
এভাবে পাঁচ লোকমা খেয়ে, মেহনূর বিরক্ত হয়ে বলে, “—-খেতে চাই না।”
এর বলে পাশে থাকা ট্রে থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে, বিসমিল্লাহ বলে তিন বারে খেয়ে নেয়।
এহসান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, নিজের মুখে বাকি খাবার তুলে নেয়। মেহনূর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এটা ভেবে
—এই পুরুষটা আসলেই কী খাচ্ছে?”তাও তার এটু খাবার “!
এহসান খাওয়া শেষ করে, তারপর প্লেটে হাত ধুয়ে, মেহনূরের দিকে হাত বাড়ায়, উদ্দেশ্য তার মুখ মুছে দেওয়া। তবে মেহনূর মুখ সরিয়ে নেয়।
কিন্তু এহসান তাকে জোর করে ধরে, তার মুখ মুছিয়ে দেয় এবং বিরক্ত গলায় বলে
—–, “এত বেয়াদ্বব তুই”! কি বলব তোকে? এখন থেকে দিন-রাত রুটিন করে বেদম পেটাতে হবে, তাহলেই তুই সোজা হবি, বেয়াদ্বব নারী!”

মেহনূর কোন উত্তর দেয় না, চুপচাপ বসে থাকে। এখন আবার ঐ ভয়ংকর খুনের দৃশ্যগুলো তার চোখে ভাসছে। অসাড় হয়ে যাচ্ছে তার নিজ দুনিয়া।কেন এমন হচ্ছে? কেনো?
এহসান ধীর পায়ে উঠে যায়, তারপর প্লেট, ট্রে এগুলো টেবিলে রেখে, বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, ওযু করে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে।
এসে দেখে মেহনূর বিছানায় শুয়ে আছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে ঘরের একটা লাইট রেখে, সবগুলো নিভিয়ে বিছানায় উঠে যায়।
এহসানকে বিছানায় আসতে দেখে মেহনূর এক লাফে উঠে যায়, তার মুখে একধরনের হতাশা এবং ক্ষোভ। চিৎকার করে বলে,
— “আপনি এখানে কেন?”
এহসান, কোনো উত্তর না দিয়ে, সোজা শুয়ে পড়ে। শান্ত গলায় বলে,
— “ঘুমাতে।”
মেহনূর উত্তেজিত হয়ে দাঁত চেপে বলে,
— “ঘুমান, আপনি আপনার বিছানায়। আমি চলে যাচ্ছি সোফায়।”
এবং সে নিজের দুই পা কম্বলের ভিতর থেকে বের করে নামিয়ে নেয়, উদ্দেশ্য সোফায় চলে যাওয়া। কিন্তু এহসান তাকে ধমক দিয়ে বলে,

— “চুপচাপ। দুই পা আবারও বিছানায় তুলে নে, নয়তো আমায় উঠতে হবে। আর আমি যদি এখন উঠি, তো তোর অবস্থা কতটা খারাপ হবে, সেটা একমাত্র আমার আল্লাহ আর আমি জানি।”
মেহনূর, এমন কঠোর হুমকি শুনে, চুপচাপ আবারও নিজের পা কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে নেয়। তার মধ্যে এক ধরনের নীরবতা চলে আসে, যেন কোনভাবেই নিজেকে বিপদে ফেলতে চাইছে না। কম ঝড় তো আর গেলো না এই এক রাতে নিজের উপর দিয়ে ‘!
যখন মেহনূর সোজা বালিশে মাথা রাখতে যাবে, ঠিক তখনই এহসান আবারও ধমকের গলায় বলে,
— “এখানে এসে মাথা রাখ, মেহনূর।”
মেহনূর বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে কাট গলায় বলে
+—- কোথায়
এহসান নিজের ডান হাতের শাহাদাত আঙুল নিজের বুকের বা পাশে ঠেকিয়ে দেখিয়ে বলে,
— “এখানে।”।”

এ কথার সঙ্গে মেহনূর আঁতকে উঠে, সোজা হয়ে বসে দাঁত চেপে বলে,
— ” কোখনই না’! আমি কোনো পাপিষ্ঠ বুকে নিজের মাথা রাখতে পারব না।”
এহসান ধীরে ধীরে নিজের হাত মেহনূরের হাতে রাখে তারপর , এক হেঁচকা টানে মেহনূরকে নিজের বুকে নিয়ে ফেলে “! এমন টায় মেহনূর মুখ থুবড়ে পড়ে এহসানের বুকে। মেহনূর চেষ্টা করে সরে যেতে, তবে এহসান মেহনূরে কোমর আলতো করে জড়িয়ে ধরে, যাতে তার শরীরের প্রতিটি অংশ অনুভব করে।আর মেহনূর নড়াচড়া না করে “!
ছুটাছুটিতে মেহনূরের পেটের অংশ থেকে কামিজ সরে যায়, আর এ জন্য এহসানের আঙুল মেহনূরের উন্মুক্ত পেটে স্পর্শ করে। মেহনূর, আঁতকে উঠে আঁকড়ে ধরে এহসানের বুক নিজের হাত দিয়ে খামচে, আর সাথে তার নড়াচড়াও থেমে যায়। পুরো শরীরে একটা শীতলতাও ছড়িয়ে পড়ে। শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়”!
এহসান, মেহনূরের পরিস্থিতি বুঝে মেহনূরের মাথাকে আরও শক্ত করে নিজ বক্ষস্থলে চেপে ধরে, আর শান্ত গলায় বলে,

— এই দুনিয়ায় রইবি যতদিন বেঁচে “!মাথা রাখতে হবে তোর ততদিনি এই পাপিষ্ঠ বুকে “! আমার এই পাপিষ্ঠ বুকের বা পাশি তোর জন্য সবচেয়ে উওম আশ্রয় “!
মেহনূর একটা টুঁশব্দও করে না চুপচাপ ঘাপটি মেরে শুয়ে তাকে অপ্রিয় পুরুষের বুকে”! তবে তার ঘুম নেই মাথা প্রচুর ব্যাথা”!
এহসান অনুভব করতে পারে মেহনূরের শরীরে তাপমাত্রা। তার শরীর খুব গরম, যেন আগুনের মতো। এহসানের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। মধ্য রাতে তো ওকে গোসলও করিয়েছিল, কিন্তু এখন যদি জ্বর ওঠে, তাহলে কি হবে? না, এমন কিছু হবে না নিশ্চয়ই, ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।
এসব ভাবতে ভাবতে, আরও শক্ত করে মেহনূরকে নিজের বুকের সাথে আগলে ধরে রাখে। মেহনূর একটুও নড়ে না, চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে।

এহসানের চোখেও একসময় ঘুম হাজির হয়।
রাত চারটার দিকে, এহসানের ঘুমন্ত কানে মেহনূরের গোঙানির শব্দ আসে। এহসান এক ঝটকায় চোখ খুলে নেয়। এমন অনুভব হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড ওর ওপর রেখে দিয়েছে। পরক্ষণেই এহসান উপলব্ধি করে, মেহনূরের ভীষণ জ্বর উঠেছে, আর মেয়েটি বেহুঁশ অবস্থায় মুখ দিয়ে শুধু বের করছে, “আব্বা, আম্মা… আব্বা।”
এহসান ধীরে ধীরে মেহনূরকে বালিশে শুইয়ে দেয়। তারপর একপলক তাকায়, আপন নারীর দিকে। ঘুমন্ত অবস্থায় শরীরের যন্ত্রণায় বারবার চোখ-মুখ কুঁচকাচ্ছে মেহনূর। গোলাপি অধর খানা কাঁপছে, মনে হচ্ছে সে কোনো দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে।
এহসান তার দিকে অসীম দৃষ্টিতে তাকিয়ে, নিজের হাত দিয়ে তার কপাল ছোঁয়ায়। এত শীতল, কিন্তু মেহনূরের শরীর জ্বলে উঠছে, অসহ্য তাপের মতো।
এহসান মেহনূরের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে বাথরুম থেকে নিজের রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে আসে। রুমাল ভিজিয়ে এনে মেহনূরের মাথায় আলতো হাতে রেখেই বলে, “এটা কিছুটা কমে যাবে, ইনশাআল্লাহ।”

জয়তুন তেল নিয়ে আসে, তারপর মেহনূরের পায়ের তালু থেকে শুরু করে হাতের তালুতেও তেল লাগিয়ে দেয়, যেন মেহনূর কিছুটা আরাম পায়।
ঘুম ভেঙে যায় মেহনূরের, কিন্তু চোখ খুলতে পারছে না। তার মাথার ব্যথা এত তীব্র, যেন ভিতরের সমস্ত কিছু ফেটে যাবে। অশান্তি চলে তার শরীরজুড়ে। এহসান মেহনূরের কাছে এসে বসে ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে, তারপর শান্ত গলায় বলে,
—– “কষ্ট হচ্ছে, জান? দেখো, একটু সময় লাগবে, কিন্তু এটা কিছুটা কমে যাবে। আল্লাহকে স্মরণ করো।”
মেহনূর অনেক কষ্টে চোখ খুলে এক পলক এহসানের দিকে তাকায়। তারপর ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে। মেহনূরকে এভাবে কাঁদতে দেখে, এহসানের মন অস্থির হয়ে উঠে। মনে হয় যেন কেউ তার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এহসান মেহনূরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অস্থির গলায় বলে, ”
—–কেঁদো না। বলো, কি হয়েছে? আমাকে বলো। কষ্ট হচ্ছে তাই না খুব হচ্ছে ? এভাবে কেঁদো না, মেহনূর।”
মেহনূর অস্পষ্ট গলায় বলে,

—– “মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, অন্তর বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে, কেউ সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে, মন হচ্ছে, ভিতরের সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।”
এহসান মেহনূরের কথা শুনে, তার ভিতরও একই অনুভূতি হয়, যেন কেউ তার মনটা খেয়ে ফেলছে। মেহনূরের যন্ত্রণার বোধ এহসানের নিজের ভিতরও খোঁচাচ্ছে।
এহসান মেহনূরের মাথা থেকে রুমাল সরিয়ে নিয়ে, আলতো হাতে তার মাথা টিপতে থাকে, যেন কিছুটা কমে যায় তার মাথার ব্যথা। অন্য হাতে মেহনূরের হাত নিজের হাতে মুঠো করে ধরে, তারপর ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেহনূরের শরীর এতটাই উষ্ণ, যেন ঠোঁট পুড়ে যাচ্ছে। তবুও এহসান বারবার মেহনূরের হাত নিজের ঠোঁটে ছুঁয়ে চলে।
মেহনূর চোখ বুঁজে, এই পাপী স্পর্শ নিতে চায়। তার আর কিছু করার নেই। এই স্পর্শকে গ্রহণ করতেই হবে তাকে।
খানিক পরে, মেহনূর ধীর গলায় বলে, ”
—-ফজরের সময় হয়ে যাচ্ছে, আজান দিবেন না?”
মেহনূরের কথায় এহসান এক পলক তাকায় কক্ষে থাকা ঘড়িতে। পাঁচটা সতেরো বাজে। মসজিদে যেতে হবে, মুয়াজ্জিন এখনও আসেননি বাড়ি থেকে। এহসান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহনূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে উঠে যায়।

কাপড় রাখার কক্ষ থেকে গিয়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা পড়ে নেয়, একখানা চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয়, তারপর কক্ষে এসে ওয়ারড্রব থেকে মিসওয়াক নিয়ে মেহনূরের সামনে আসে। তারপর একটু ঝুঁকে মেহনূরের কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
—-“আমি আসার আগে বিছানা থেকে নামবি না, বুঝলি?”
এহসান দ্রুত পা চালিয়ে মসজিদে পৌঁছায়। পুকুর ঘাটে গিয়ে ওযু শেষ করে অজান দিতে থাকে, যেন সময় নষ্ট না হয়।
অন্যদিকে, মেহনূর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিরবে আযান শুনছে, আর মনে মনে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। তার ভিতরের কষ্ট যেন বেড়ে চলছে, কিন্তু মুখে কিছু বলার শক্তি নেই।
নামাজ শেষে, এহসান তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরতে থাকে, তার একমাত্র উদ্দেশ্য—মেহনূরের কাছে ফিরে আসা।
মেহনূর মনেপ্রাণে চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াতে, ধীরে ধীরে নিজেকে জাগিয়ে তুলতে। সে ভাবতে থাকে, হয়তো এখন ওযু করে নামাজ পড়ে নিতে পারবে। কিন্তু শরীরের অবস্থা তাকে ছাড়ে না। কাঁপা কাঁপা পায়ে, একটুও দৃঢ়তা না রেখে বাথরুমের দিকে এগোতে থাকে। তবে দুর্ভাগ্য, তার শরীর আর সঙ্গ দেয় না। এক হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় মাটিতে। নিথর দেহে পরে থাকে মাটিতে “!উঠার যে শক্তি নেই

এদিকে এহসান তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে ঢুকে, কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজ কক্ষে চলে আসে।
এহসান যখন কক্ষে প্রবেশ করে, বিছানার দিকে পা রাখতেই তার কলিজা মুচড়ে ওঠে। নিজের প্রিয় নারীকে, নিজের প্রাণটিকে এমনভাবে পড়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতর এক প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভূত হয়। সে এক মুহূর্তে দৌড়ে মেহনূরের দিকে চলে যায়। মেহনূরের কাছে গিয়ে, এহসান দেখতে পায় তার মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে। সে যেন এক লহমায় ভেঙে পড়ে। মেহনূরের এই অবস্থা দেখে তার গলা কাঁপতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন কেউ তার হৃদপিণ্ডে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। কেউ টেনে ছিঁড়ে বের করে নিয়ে যাচ্ছে নিজের কলিজা এমন মনে হয় এহসানের ‘!

গতরাতে পরের ছেলে রায়ানেরও এমন করে মুখ থেকে ফেনা বের হয়েছিল, কিন্তু তখন এহসান কোনো কষ্ট অনুভব করেনি। বরং অদ্ভুত এক আনন্দ তাকে ঘিরে রেখেছিল। তবে আজ, যখন তার প্রানপ্রিয় নারীর মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে, তখন নিজ অন্তর ঝলসে যাচ্ছে । তার ভিতরটা একদম ফেঁটে পড়ছে”! এক সেকেন্ডের জন্যও স্থির থাকতে পারে না এহসান । কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে, শ্বাস আঁটকে আসছে “! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আপন নারী কে এমন যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে!

আত্মার আগলে পর্ব ১০

এহসান এক ঝটকায় মেহনূরের মাথা নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে, যেন তাকে কোনোভাবেই হারাতে না হয়। কিন্তু সে তখন অচেতন, কিছু বলতে পারে না। মেহনূরকে তার এই দুর্দশায় দেখতে দেখে এহসান এক অন্ধকারে ডুবে যায়।

আত্মার আগলে পর্ব ১২+১৩