আত্মার আগলে পর্ব ৩৪
সানজিদা আক্তার মুন্নী
— “কি রে! তোর দেখি তোর বাপের চেয়েও বড় কলিজা!”
কণ্ঠস্বরটা ভারী, গভীর। তাচ্ছিল্য আর রাগ মিশে আছে তাতে।
চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা এরিক আতঙ্কে ছটফট করছে। হাতের বাঁধন খুলতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না।
এহসান আবারও হুংকার দিয়ে বলে
— “তোর বাপ-চাচা এক জীবন আমার ভয়ে আপন দেশে পা রাখেনি, আর তুই কিনা সিলেটেও ঢুকলি, গ্রামের মাটিতেও পা রাখলি!”
এহসান সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসে, ঠোঁটের কোণে একপাশে বিকৃত হাসি। নিয়ে আবারও বলে
— “তোর কলিজা কি তোর কাপুরুষ বাপ-চাচার থেকেও বড় নাকি?”
তারপর এহসান নিজেই মাথা নেড়ে বলে
— “হ্যাঁ, হয়তো বড় আছে! নয়তো তুই আমার সামনে দাঁড়াতে সাহস পেতি না।”
এরিক দ্রুত নিজের ভাবনা গুছিয়ে নিল। আতঙ্ক তার শরীরের প্রতিটি কোষে শিহরণ তুললেও মুখে শান্ত থাকার চেষ্টা করল।
— “তোমার সাথে আমার কোনো ঝামেলা নেই। আমায় ছেড়ে দাও। আমি শুধু আমার দেশের বাড়ি দেখতে এসেছি।”
কথাগুলো মুখে বললেও ভিতরে ভিতরে সে জানে, কিছুই ঠিক হচ্ছে না। তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এতদিন ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে ছিল, কিন্তু এহসানের চোখ এড়ানো সম্ভব হয়নি দেশে আসতেই।
সে ভেবেছিল, হয়তো এখানেই তার শেষ। কিন্তু এহসান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শুধু মাথা সামান্য কাত করে হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “ওরে ওর বাড়িতে ছেড়ে দে।”
এই কথা শুনে জয়নাল হতভম্ব হয়ে গেল।
এহসান উঠে গিয়ে গোডাউন এর বাইরে চলে গেলো জয়নাল ওর পিছনে যেতে বলল
— “ভাইজান, আপনি এরে মারবেন না?”
এহসান এবার একটু হাসে। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলে,
— “ও এসেছে আমার নির্বাচনে গন্ডগোল করতে। ওর বাপ-চাচাই পাঠিয়েছে, তা আমি জানি। কিন্তু বড় ইঁদুর ধরতে হলে ছোট ইঁদুরকে ফাঁদে ফেলতে হয়।”
জয়নাল এবার বুঝে গেল। এহসান ছোট মাছকে এখনই মারতে চায় না। সে অপেক্ষা করবে। বড় শিকার ধরার জন্য অপেক্ষা করতে জানে সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গাড়ি এগিয়ে চলল বিশাল এক সমাবেশের উদ্দেশ্যে।
নির্বাচন আর মাত্র ক’দিন পর। প্রতিদ্বন্দ্বীরা নানান দিক থেকে আঘাত হানার চেষ্টা করছে, কিন্তু এহসান এসব নিয়ে ভাবে না। তার একটাই লক্ষ্য—এই নির্বাচনে জিততেই হবে!
তার জন্য যা করতে হয়, করবে।
যদি একশোটা খুন করতে হয়, তাহলেও।
কেউ তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে, তাদের সরিয়ে দিতে সে বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না। ক্ষমতা তার চাই—এবং তা সে নিয়েই ছাড়বে!
এহসান মেহনূরকে বাড়িতে রেখে গেছে, কিন্তু মেহনূরের মন কোথাও বসে না।
এই ঘর, এই দেয়াল, সবকিছু যেন তাকে শূন্যতায় ভরিয়ে তুলছে।
তার মন টানছে অন্য কোথাও—তার নিজের বাড়িতে। যেখানে তার বাবা, ভাই, ছোট্ট ভাই-বোনরা আছে। যেখানে আছে তার নূরি ফুল, তার সবচেয়ে আপন।
আরেক আপনজন, তার এশা!
সন্ধ্যার পর সবাই মিলে অনেকক্ষণ গল্প করছিল, হাসছিল, সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু যখন একা ঘরে ফিরল, তখন বুকের ভেতর শূন্যতা যেন আরেকটু গভীর হলো।
চারপাশে তাকিয়ে থাকে মেহনূর, অজানা এক কষ্টে মন ভরে যায়।
এহসানকে আজ সারাদিন একবারও দেখেনি। কোথায় আছে, কী করছে—কিছুই জানে না। কিন্তু বুকের ভেতর একটা অস্থিরতা লেগেই আছে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় মেহনূর। কাপড় রাখার কক্ষে প্রবেশ করে, হাত বাড়িয়ে এহসানের আলমারিটা খুলে। ভেতরে থাকা এহসানের গায়ে মাখা একখানা চাদর বের করে নিয়ে আসে।
চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেয় নিজের গায়ে চাদর জড়িয়ে নিতেই একটা প্রশান্তি নেমে আসে ওর ভেতর।
এহসানের গায়ের ঘ্রাণ লেগে আছে এতে।
এশার নামাজ অনেক আগেই পড়ে নিয়েছে, কিছুক্ষণ তেলাওয়াতও করেছে। মন কিছুটা শান্ত হলেও একটা উদাসীনতা রয়ে গেছে।
বেলকনির সোফায় এসে বসল মেহনূর। চোখ আটকে আছে অন্ধকার আকাশের দিকে।
সামনে পথঘাট একেবারে ফাঁকা, রাত গভীর হচ্ছে। কিন্তু তার অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না।
সে অপেক্ষা করছে—এহসানের জন্য।
সভা ভালোভাবেই সফল হলো।
গাড়িতে ওঠার পর হাসিব একরকম উচ্ছ্বাসের সুরে বলল,
— “ভাইজান, আমার মনে হয় জনতা তোমারেই বাইচা নিব।”
এহসান জয়নালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
— “এত ভাবা ভালো নয়। জনতার মন কোনদিকে যায়, তা বলা কঠিন।”
হাসিব গাড়ি চালাতে চালাতে বলে,
— “না ভাইজান, মানুষ কিন্তু তোমারেই নিব। দেখিও!”
এহসান আবারও হাসল, তবে এবার সেই হাসির মাঝে ছিল রাজনীতির কঠিন বাস্তবতা।
— “এটা রাজনীতির খেলা। এখানে ‘নিব’–‘নেবে’ এসব মানায় না। এখানে মানায়—নিতেই হবে!”
জয়নাল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলে
— “ভাইজান, তোমার কি মনে হয় জসিম দেশে আসবে?”
এহসান একপাশে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— “দেখে নিস, আগামী দশ দিনের ভেতর সে দেশে ফিরবে। কারণ, ওর ছেলে ওকে আশ্বাস দেবে—আমি কিছু করব না। আর সেই আশ্বাসেই সে পা রাখবে নিজের দেশে।”
তারপর খানিক থেমে গলায় এক ভয়ংকর দৃঢ়তা এনে বলল,
— “আর যেদিন পা রাখবে… আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে সেদিন আমি মন ভরে তৃপ্তি নিয়ে ওদের রক্ত দিয়ে গোসল করব!”
এরিককে তার আপন জমিদার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু সে জানে না, এখানে সে থাকতে পারবে কি না।
বাড়ির গেট অবধি বন্ধ হয়ে আছে—বিধ্বস্ত গাছপালায় ঢেকে গেছে পথ।
এক সময় যে বাড়ি ছিল প্রাণবন্ত, এখন সেখানে যেন এক মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা।
আপন ঘরের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে সে, কিন্তু প্রবেশ করা হয় না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর ফিরে রওনা হয় টাউনের দিকে।
গাড়ি নেই।
তাই হেঁটেই গ্রাম পেরোতে হবে।
সে জানে, এহসান তাকে দয়া করে মুক্তি দেয়নি। বরং তার বাপ-চাচাকে বের করে আনার জন্যই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
কিন্তু সে কি আর কম পানির মাছ?
সে জানে, শুধু এহসান নয়, তার বাপ-চাচারাও তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের প্রতিশোধের আগুন যেমন জ্বলছে, তেমনি তার বুকেও জ্বলছে জেদের আগুন!
সে এসেছে পাকাপোক্ত পরিকল্পনা করে।
একটা না একটা সফল হবেই।একটা না একটা!
তবে হুট করে কিছু করা যাবে না।
তার নিজেকে দুর্বল দেখাতে হবে সবার সামনে—শিকারীর সামনে যেন সে দুর্বল এক শিকার।
তাহলে এহসানের সন্দেহের চোখ তাকে ছাড়বে, আর সে আরও সময় পাবে।
আর এই সময়ের মধ্যেই সে চাল দেবে এমন এক দান, যাতে পুরো খেলার চালচিত্র বদলে যাবে!
সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে।তার প্রতিটি পা পড়ছে এক নতুন যুদ্ধের দিকে!
এদিক ছোট তালুকদার বাড়িতে—
রাতের খাবার খাচ্ছেন সবাই। সব পুরুষের পাশেই আপন বেগম দাঁড়িয়ে আছেন, শুধু মেহরুবের পাশেই নেই!
এশা দাঁড়িয়ে আছে মেহরাজের পাশে। এতদিন না হয় মেহরাজ আর মেহরুব দুজনেই বেগম ছাড়া ছিলেন, কিন্তু এখন মেহরুব একা। আর মেহনূর থাকলে তার বাবা আর ভাই দুজনকে তিনিই দেখে নিতেন।
এখন মাজহারুল সাহেব নিজের মায়ের হাতে রান্না করা খাবার খান। আগে খেতেন মেয়ের হাতে, কিন্তু মেয়ে তো আর এখন নেই!
আর মেহরুব?
তার একাই নিজে নিজে খেতে হয়।
তৌফিক তালুকদার বিষয়টি লক্ষ্য করেন। তিনি বড় গলায় ডাক দেন নিজের মেয়েকে—
— “নূরি আম্মা, এদিকে আসো তো!”
হঠাৎ তার ডাকে সবাই বেশ চমকে তাকান তার দিকে।
বাবার ডাক শুনে নূরি মুহূর্তের মধ্যে হাজির হয়।
নূরি টেবিল থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বলে—
— “জি, বলুন আব্বা?”
তৌফিক তালুকদার এক পলক মেহরুবের দিকে তাকিয়ে বলেন—
— “নূরি, মেহরুবের কিছু লাগবে কি না দেখো।”
উনার কথায় সবাই চমকে তাকান, মেহরুবও!
তবে কেউ কিছু বলেন না।
তৌফিক তালুকদার আবার আদেশের গলায় বলেন—
— “এখন থেকে প্রতি ওয়াক্ত খাবারের সময় তোমায় যেন আমি মেহরুবের পাশে দেখি!”
নূরি কিছু মুহূর্ত হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে—
— “আচ্ছা আব্বা, আমি আপনার কথা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
মেহরুব মনে মনে বেশ খুশিই হয়!
এখন থেকে সে তার নূরি ফুলের হাতের রান্না খাবে!নূরি কাঁপা পায়ে এসে দাঁড়ায় মেহরুবের চেয়ারের পাশে।
কেন জানি বেশ অস্বস্তি লাগছে তার!
নূরি স্পষ্ট দেখতে পায়, মেহরুব খাবার খাচ্ছে অনেক কষ্ট করে। বারবার হাতে ভাত মেখে রেখেই দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, সাহেব কোনো অকাজ করতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে!
হয়তো বেশি কেটেছে, তাই এত কষ্ট হচ্ছে!
ইস! যদি তাকে মুখে তুলে দিতে পারতাম, তবে হয়তো ভালো হতো…
নূরি মেহরুবের হাতের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে, তখনই ওর চাচা সাইফুল সাহেব বলেন—
— “নূরি, একটা কাজ কর। তুই যদি পারিস, তাহলে মেহরুবের মুখে খাবার তুলে দে। যেহেতু ওর খাবারের সময় পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব নিলি… আসলে, আজ সকালে ফ্যাক্টরিতে একটা কাজ করতে গিয়ে বেশ খানিকটা কেটে গেছে ওর হাত।”
মেহরুব থতমত খেয়ে যায় চাচার এমন কথায়!
নূরিও বেশ ঘাবড়ে যায়!মনে মনে তো এটা চেয়েছিল… তাই বলে এত তাড়াতাড়ি বাস্তব হয়ে যাবে!
নূরি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়—
— “আচ্ছা!”
এ বলে রান্নাঘরের দিকে যায়।
নিজে হাত ধুয়ে একটা বাটিতে মেহরুবের হাত ধোয়ার জন্য পানি নিয়ে আসে!
এদিকে এশা মেহরাজকে ভালোভাবেই খাবার তুলে দিচ্ছে।
মেহরাজ তো ভেবেছিল, এখানেও গালাগালি করবে! কিন্তু আল্লাহর কী এক দয়া ঢুকেছে এশার ভেতর— সে আজ মেহরাজকে বেশ সম্মানই দিচ্ছে!
মেহরাজ মনে মনে ভাবে—
“সমস্যা কী? সবার সামনে সম্মান দিচ্ছে, ঘরে গিয়ে লাথিও যদি মেরে দেয়, তাতেই আলহামদুলিল্লাহ!”
নূরি একটা বাটিতে পানি নিয়ে এসে মেহরুবের পাশে চেয়ার আলগা করে বসে।
তারপর মেহরুবকে উদ্দেশ্য করে বলে—
— “হাতটা ধুয়ে নিন, আমি খাইয়ে দেব।”
নূরির বেশ লজ্জা লাগছে!
কারণ, পরে না তার দাদাজান আর দাদিজান তাকে নিয়ে মজা করে! আর এশা তো করবেই!
তার চাচীরাও বেশ মজার মানুষ— ঠিকই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন!
মেহরুব এক পলক তাকায় নূরির দিকে, তারপর বাটিতে হাত ডুবিয়ে দেয়।
মেহরুবের হাত ধোয়া শেষ হলে, নূরি টেবিলের উপর বাটি রেখে—
নিজের হাত দিয়ে মেহরুবের হাত আলতো করে ধরে।
তারপর ধীর কণ্ঠে বলে—
— “দাঁড়ান, পানি তুলে দিই হাতে। তাহলে আর বেশি কষ্ট হবে না।”
এ বলে, নিজের পড়নে থাকা নরম কাপড়ের তৈরি নামাজের হিজাব দিয়ে আলতো করে, অতি যত্নসহ মেহরুবের হাত মুছে দিতে থাকে!
বাপ-চাচার সামনে এসব করতে বেশ লজ্জা লাগছে তার!
কিন্তু… এটা তো তার বাপ-চাচারই আদেশ!
হাত মুছে দিয়ে নূরি মেহরুবের প্লেট নিজের হাতে তুলে নেয়।
মেহরুব কিছুটা ওর দিকে ঘুরে যায়!
নূরি নরম হাতে, যত্ন সহকারে, আপন পুরুষের মুখে খাবার তুলে দেয়!
মেহরুব চোখ বন্ধ করে নেয়।
আজ কয়েক মাস পর কারও হাতে খাবার খেলো!
আগে সবসময়ই মেহনূর ওকে খাইয়ে দিত। কারণ, ওর হাত-পা সবসময়ই এদিক-ওদিক কাটা-ছেঁড়া থাকত।
কিন্তু এখন তো বোন নেই…
তাই কেউ মুখে তুলে দেয় না খাবার।আজ এতদিন পর কেউ মুখে তুলে দিল!
তাও এত যত্নে!আর যে দিল, সে তো তারই আপন বেগম!
বেশ ভালো লাগছে মেহরুবের বিষয়টি!
এদিকে মেহরাজের খাওয়া শেষ!
সে উঠে এশার ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে—
— “বউ, তাড়াতাড়ি ঘরে এসো! এই মুহূর্তেই! নয়তো সবার সামনে ঘরে নিয়ে যাব!”
এশা সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলে—
— “নিজে তো খেয়ে-দেয়ে আরাম পেয়ে গেছিস! এখন কি আমি না খেয়ে থাকব?”
মেহরাজ চারপাশে তাকিয়ে বাঁকা চোখে বলে—
— “ওহ! সরি, তাহলে খেয়েই আসো! বেশ! এনার্জির প্রয়োজন হবে!”
এ বলে মেহরাজ এশার ওড়না ছেড়ে দিয়ে উপরের দিকে চলে যায়।
এশা রাগে দাঁত চেপে মেহরাজের যাওয়ার পানে এক পলক তাকিয়ে তার খাবারের প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে যায়!
নূরি মেহরুবকে খাওয়াতে খাওয়াতে এক পলক ওদের দিকে তাকায়।
তারপর মুচকি হেসে ওঠে!
মেহরুব এক দৃষ্টিতে তার নূরি ফুলের সেই মনমুগ্ধকর হাসি দেখতে পায়!
মেয়েটা যেমন সুন্দর, তেমন সুন্দর তার প্রতিটি আচরণ!
তেমন সুন্দর তার হাসি!
মানুষ সবদিক দিয়ে এত স্মুথ হয় কী করে? এটাই মেহরুব খুঁজে পায় না!
তার মতো শ্যামবর্ণের পুরুষের কপালে এত সুন্দর মেয়ে লেখা আছে— এটা ভাবতেই অদ্ভুত লাগে মেহরুবের!
নূরি কে মেহরুব আলগোছে বলে
— এভাবে হাসিস না, তোর এই হাসি আমার আত্মা অব্দি উত্তাল করে দেয়।
মেহরুব এর এমন কথায় নূরির মুখ সাথে সাথে শুকনো হয়ে আসে। অবাক হয়ে সে প্রশ্ন করে
— আমি হাসলাম, আমার মুখ দিয়ে সেটা আপনার আত্মায় যাবে কী করে?
মেহরুব মৃদু হেসে বলে
— বোকা নূরি, ফুল, তুই এসব বুঝবি না।
নূরি ফুল ঠিক কত বছর পর নূরির মেহরুব ভাই তাকে এই নামে ডাকলো, তা তার মনে নেই। সেই ছোটবেলায় মেহরুব তাকে নূরি ফুল বলে ডাকতো, কিন্তু বড় হওয়ার পর কখনোই ডাকেনি। আজ প্রথম!
নূরি মেহরুব এর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে
— মেহরুব ভাই, আবার ডাকবেন নূ…
আবেগের তাড়নায় নূরি নিজের মনের আবদার সামন-সামনি প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল, তবে যখন বুঝে কি বলছে তখন মাঝপথে বন্ধ করে দেয়।
মেহরুব মুচকি হেসে বলে
— ডাকবো, এখন থেকে সারাজীবন ডাকব, নূরি ফুল বলেই ডাকব।
নূরি লজ্জায় পড়ে যায়! কী থেকে কী হচ্ছে, বেশ অবাক হয়ে যাচ্ছে সে মেহরুব এর আচরণে। হয়তো তাহাজ্জুদের মোনাজাতে কান্না করা দোয়া কবুল হয়ে গেছে আল্লাহর দরবারে, তাই হয়তো তার মেহরুব ভাই তার প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে।
মেহরুব কে খাইয়ে নূরি মেহরুব এর এটু খাবার অতি আবেশে মুখে তুলে নেয়! আর খাবার খায় না, যতটুকু ছিল, ততটুকুই খেয়ে উঠে যায়! মেহরুব যাওয়ার পর বাড়ির সব মহিলারাও টেবিলে বসে পড়েন!
এশা ভেবেছিল হয়তো এ বাড়ির মহিলারা তাকে কুটু চোখে দেখবে, কিন্তু সে ভুল। তারা নিজের বোনের মতো আপন করে নিয়েছে তাকে!
নূরি উঠে গিয়ে দেখে মেহরুব ছোটদের সাথে বসার ঘরে সোফায় বসে টিভিতে ইসলামি কী একটা হাদিস শুনছে। তাদের বাড়ির পিচ্চিরা একটা কাজ নিয়েই পড়ে, সেটা হলো কে কার থেকে বেশি হাদিস পারে, তার ব্যাখা পারে, কে কোরআন এর কোন আয়াত পারে, বুঝিয়ে বলতে এসব প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যে লেগেই থাকে।
নূরি একটা মলম নিয়ে মেহরুব এর সামনে যায়! তারপর মেহরুব কে মলম টা দিয়ে বলে
— মেহরুব ভাই, এটা লাগিয়ে নিন, হাতে ব্যথা কমে যাবে।
মেহরুব নূরির কথা বিরক্তি নিয়ে বলে
— আরে, দূর! এসব টুকটাক কাটার জন্য ঔষধ লাগাতে হয় নাকি? এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
নূরি জানে, মেহরুব আস্ত একটা অলস লোক। নিজের বেলায় খুব অলস, এত এত ঝড়ঝাপটা নিজের উপর দিয়ে গেলেও কোনো অভিযোগ করে না! উল্টো এসব কিছু কিছুই না বলে উড়িয়ে দেয় সব।
নূরি মেহরুবের পাশে ঔষধটা রেখে যেতে যেতে বলে
— আশা করি, আমার কথা টি রাখবেন।
মেহরুব এক পলক নূরির যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঔষধটি নিজ হাতে নিয়ে লাগিয়ে দেয় হাতে!
এদিকে এশা ঘরে এসে দেখে মেহরাজ বিছানায় শোয়ে আছে। এটা দেখেই তো ওর ঠান্ডা মেজাজ গরম হয়ে যায়।
এশা ক্ষিপ্ত হয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে বলে
— আমি কোথায় ঘুমাবো?
মেহরাজ নিজের হাত এলিয়ে দিয়ে এশা কে দেখিয়ে বলে — এখানে।
এশা চোখ বন্ধ করে নিজের রাগকে সামলাতে চেষ্টা করে বলে
— আমি এখানে ঘুমাব না।
মেহরাজ মুচকি হেসে বলে
— সমস্যা নেই, তাহলে তুমি বিছানায় ঘুমিয়ে যাও, আর আমি তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাব, সেদিন রিসোর্ট যেভাবে ঘুমিয়েছিলাম, হবে তো, বউ?
এশা মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে
— বাবা, মেহরাজ, বেশি উড়িস না, আজ কিন্তু আমার পায়ে জুতো আছে, তাই একটা বারিও মাটিতে পরবে না।
বাবা কথা শুনেই মেহরাজ এর বেশ রাগ হয়। মেহরাজ এক লাফ দিয়ে উঠে এশার দিকে তাকিয়ে বলে
— এশার বাচ্চা, চুপচাপ এসে ঘুমিয়ে যা, নয়তো বিয়ের দিন রাতে যে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেছি, তা আজ ঠায় ঠায় পূর্ণ করব।
এশা কি এসবে ভয় পাওয়ার মেয়ে? এশা উল্টো বিছানায় দুই হাঁটু দিয়ে ভর করে বসে মেহরাজের কলার টেনে ধরে দাঁত চেপে বলে
— যে হাত দিয়ে ছুবি, সে হাতি কেটে রেখে দিব, ভুলে যাস না, আমি এশা তালুকদার।
মেহরাজ তো এবার মোক্ষম সুযোগ, আমায় দেরি না করে, এশার কোমর জড়িয়ে ধরে একদম নিজের মুখের সামনে ধরে বলে
—– তোমায় শুধু ছুব না, তোমার সাথে সংসার করে চার-পাঁচটে বাচ্চার বাপ হয়ে দেখাবো, এশা তালুকদার, মনে রেখো, আমিও মেহরাজ ছিদ্দিক।
এশা মেহরাজের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
— তুই তাহলে নিজেকে এই পরিবারে কেউ মনে করিস না?
মেহরাজ বলে
— হ্যাঁ, মনে করি। এ পরিবারি আমার সব, এটাই আমার অস্তিত্ব, এখানেই বড় হয়েছি আমি, তবে সত্য তো সত্যই। আমি মেহরাজ তালুকদার নয়, আমি মেহরাজ ছিদ্দিক, আমার বাবা ওয়াজিদ ছিদ্দিক, তাই সেই ক্ষেত্রেও আমিও মেহরাজ ছিদ্দিক।
এশা মেহরাজের হাতের বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক নড়াচড়া করে, কিন্তু মেহরাজ ওকে আরও শক্ত আঁকড়ে ধরে রাখে! এশা এতে চোখ রাঙ্গিয়ে বলে
— মেহরাজ, ছাড় বলছি, নয়তো উষ্ঠা খাবি, কিন্তু এখন!
মেহরাজ উল্টো এশার ওড়না ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, ওর চুল ছেড়ে দিয়ে, এশার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে
— রাতে যখন ধরেছি, তখন আর সকালে ছাড়ব না।
এ বলেই মেহরাজ এশা কে নিয়েই বিছানায় পড়ে! আর এশা পিছনে থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, এশার খোলা চুলে মুখ বুঁজে দেয়!
এশা চিল্লিয়ে বলে
— আমার কবরে যত বিচ্ছু তৈরি হবে, দেখছি সব, শুধু তৈরি তোকে গালি দিয়ে ছাড় বলছি, নমরুদ!
মেহরাজ এশাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ওর গাড়ে দাঁত বসিয়ে দেয় আর বলে
— আর একটা গালি মুখ থেকে বের করছো তো? এ দাঁত সারা শরীরে বসবে, অসভ্য মেয়ে!
এশার শরীর অবস হয়ে আসতে থাকে মেহরাজ এর স্পর্শে। এশা চুপ হয়ে যায়, আর মেহরাজ? সে এশার ঘাড়েই মুখ বুঁজে ঘুমিয়ে তলিয়ে যেতে থাকে।
—
রাত তখন প্রায় দ্বিপ্রহর ছুঁই ছুঁই। রাস্তার পাশে এক চায়ের ট্যাং দোকানের সামনে বসে আছে —এহসান, হাসিব আর জয়নাল। হালকা হলুদ আলোয় ঝলমলে দোকানটা আশেপাশের অন্ধকারের তুলনায় বেশ উজ্জ্বল। আশেপাশে কয়েকজন মাঝরাতের অতিথি, কেউ চা খাচ্ছে, কেউবা ধোঁয়া ছাড়ছে আকাশের দিকে।
এহসান হাতের গরম চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, চায়ের স্বাদ যতই স্পেশাল হোক না কেন, ট্যাং দোকানের এই চায়ের মতো উওমি আর কিছুই হতে পারে না। তার মনে হয়, আসল স্বাদটা চায়ের মধ্যে নয়, বরং এই আড্ডার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
আর হাসিব আর জয়নাল? এরা দুইজন তো চা খোর। ঘন্টার মধ্যে দুই কাপ না খেলে চলে না! বিশেষ করে জয়নাল তো এক কাঠি সরেস। এহসান আর হাসিব যখন মাত্র প্রথম কাপ শেষ করেছে, তখন জয়নাল ইতিমধ্যে দু’কাপ সাবাড় করে ফেলেছে!
এহসান কাপটা টেবিলে নামিয়ে জয়নালের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “বেশি চা খাইস না, নইলে আবার লিভার কিডনি ফাইট্টা যাইবে!”
হাসিব হো হো করে হেসে উঠল।
— “ভাইজান, তুমি ফাট্টার কথা বলতেছ? লিভার থাকলে তো ফাইট্টবে! এতদিন এত চা খেতে খেতে এসব লিভার-কিডনি সব নষ্ট হয়া গেছে!”
এহসান মুচকি হেসে হাসিবের দিকে তাকাল।
— “তাহলে ও বেঁচে আছে কিভাবে?”
জয়নাল তখন আরেক কাপ চা নিয়ে বসছে। কাপটা হাতে নিয়ে বিরক্ত মুখে বলল,
— “ভাইজান, ওর কথা তুমি শুনও না। ও একটা শালা ইবলিশ! সবসময় আমার পিছনে লেগে থাকে।”
এহসান চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিল। ধোঁয়া উঠছে কাপ থেকে, সেই সাথে কথা গুলোও যেন ধোঁয়ার মতো হালকা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।
— “নির্বাচন শেষ হলেই তোদের দুইটারে বিয়ে করিয়ে দিব! এরপর আর তোদের একজনের পিছে আরেকজন লাগার সময় পাবি না, নিজের বউ নিয়াই ব্যস্ত থাকবি!”
হাসিব মুচকি হেসে চোখ ছোট করল।
— “আর ভাইজান, এত তাড়াতাড়ি বিয়া কইরা কি করমু?”
এহসান হাসতে হাসতে বলল,
— “আর শালা, আমি তো ভাবছি, আল্লাহ যদি আমারে ছেলে দেয়, তোদের দুইজনে দুই মেয়ে নিজের ঘরে তুলমু! তোরা তো আমার বেটাগো শ্বশুর হবি তখন! তারপর কইরা নে নাতি-নাতনির খেলা!”
জয়নাল আর হাসিব মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়
এহসান এই কথাটা প্রায়ই বলে। যদি আল্লাহ তাকে দুইটা ছেলে দেন, তাহলে হাসিবের এক মেয়ে আর জয়নালের এক মেয়ে নিজের ছেলের জন্য বউ করে নেবে। কথাটা বলার সময় ওর চোখে একধরনের স্বপ্নিল আলো খেলে যায়—একটা বড় পরিবার, সবাই একসাথে, হাসিখুশি একটা জীবন।
রাতের নীরবতা ধীরে ধীরে আরও গভীর হতে থাকে। চায়ের ধোঁয়া মিলিয়ে যায় বাতাসে, কিন্তু আড্ডার উষ্ণতা থেকে যায় ঠিক আগের মতোই।
অনেকক্ষণ তিন ভাই মিলে আড্ডা দিয়ে এবার বাড়ির পথে পা বাড়ায় এহসান। রাস্তা নিস্তব্ধ, শহরের ব্যস্ততা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশে চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে, কিন্তু এহসানের মন অন্য কোথাও।
অন্যদিকে, মেহনূর বেলকনিতে বসে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রাত সাড়ে দশটা থেকে বসে আছে, এখন বাজে বারোটা! এহসানের আসার কোনো খবর নেই। তাই ওযু করে এসে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করেছে। পবিত্র আয়াতের প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু অপেক্ষার একধরনের উদ্বেগ যেন তাকে ছাড়তে চায় না।
হঠাৎ বাইরে গাড়ির শব্দ কানে এলো। কোরআনের খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায় মেহনূর। গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে—এহসান!
তার হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে যায়। দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে, সদর দরজা খুলে দেয়।
দরজায় কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে যায়, আর এহসান বুঝে যায়—এটা তার আপন বেগমই।
একটু মুচকি হেসে তাকায় মেহনূরের দিকে। মেহনূরও শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন অভিমান লুকোনো সেই চোখের তারায়। তার পরনে কালো নামাজের লম্বা হিজাব, হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এহসানের চোখ আটকে যায়—এই নারীর কবুতরের বাচ্চার মতো নিষ্পাপ, অথচ কী রহস্যময় এক সৌন্দর্য!
মেহনূর চোখ নামিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে,
— “আসসালামু আলাইকুম।”
এহসান হাসিমুখে জবাব দেয়,
— “ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ।”
তারপর কিছু না বলে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে, বুকের দুই হাত বাজ করে। ক্লান্ত শরীর, চোখে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি—সারাদিন এই মুখটা দেখেনি, এখন মনে হচ্ছে চিরকাল শুধু এই মুখখানার দিকেই তাকিয়ে থাকতে ।
মেহনূর বিরক্ত চোখে তাকায়।
— “ভেতরে আসবেন নাকি বাকিরাতও বাইরে থাকবেন?”
এহসান হালকা হেসে গা এলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। মেহনূর দরজা বন্ধ করতেই, হঠাৎ এহসান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
মেহনূর কিছুটা বিস্মিত হয়, কিন্তু আজ প্রথমবার নিজ ইচ্ছায় আলতো করে হাত রাখে এহসানের পিঠে।
এহসান মেহনূরকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে, গভীর গলায় ফিসফিস করে,
— “তোমার এই নরম শরীরটা যতক্ষণ আমার বুকে লেপ্টে থাকে, ততক্ষণই আমার দেহে প্রাণ থাকে।”
তারপর আস্তে করে মেহনূরকে আলগা করে, তার মুখে হাত রাখে। মেহনূর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
— “আপনার এসব করতে ক্লান্ত লাগে না?”
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— “তোমার ন্যায় তাকালে আমার সব ক্লান্তি প্রশান্তিতে পরিণত হয়।”
এরপর আর কিছু না বলে মেহনূরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।
মেহনূরের ভেতরটা দুরুদুরু করছে—এটা তাদের ঘর নয়, যদি কেউ দেখে ফেলে! কিন্তু বাধা দেওয়ার কথা মনে আসলেও দেয় না, শুধু চোখ বন্ধ করে অনুভব করে এহসানের উষ্ণতা।
কিছুক্ষণ পর এহসান ধীরে ধীরে তাকে ছেড়ে দেয়। মেহনূরের লজ্জায় মুখ আরও লাল হয়ে যায়।
এহসান প্রশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
— “আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি খাবার দিচ্ছি।”
এহসান হাসিমুখে মাথা নাড়ে, মেহনূরের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঘরের দিকে চলে যায়।
মেহনূর রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়, মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে।
রাতের ছাদে দুটি নীরব প্রতিচ্ছবি
রাত গভীর, আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে।
এহসান আর মেহনূর ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। মেহনূর একদৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর এহসান তাকিয়ে আছে মেহনূরের দিকে।
তার কাছে ভয়ংকর সুন্দর বলতে একটাই জিনিস—তার নারী।
তার জন্য আকাশের সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই সে তার নারীর কেই এর চেয়ে বেশি সুন্দরে ঘেরা মনে করে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মেহনূর ধীর কণ্ঠে বলে,
— “কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবেন?”
এহসান গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
— “কেমন প্রশ্ন?”
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
— “আপনাকে আপন করার কথা ভাবলেই কিছু প্রশ্ন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।”
এহসান একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
— “কি সেগুলো?”
মেহনূর আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এহসানের পানে তাকায়।
— “আমার বাপ-চাচাকে আপনি এত ঘৃণা করেন কেন? আমি জানি তারা ভুল করেছে, কিন্তু আসল সত্যটা কী?”
এহসান চোখ নামিয়ে নেয়, গভীর শ্বাস নেয়।
— “থাক, প্রয়োজন নেই এসব জানার। শুনলে ঠিক থাকতে পারবে না।”
মেহনূর মলিন হাসে।
— “সত্য কখনও চাপা থাকে না। আমি যেভাবেই হোক জানবই। তাই আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই। বলুন না, দয়া করে।”
আত্মার আগলে পর্ব ৩৩
এহসান তিক্ত হেসে বলে,
— “সত্যি শুনতে চাও?”
মেহনূর মাথা নাড়ে,
— “হ্যাঁ, শুনব।”
এহসান আরেকবার তিক্তভাবে হাসে, তারপর গভীর কণ্ঠে বলা শুরু করে…